‘যার যত ক্ষতিই হোক, আমি আমার প্রাপ্য চাই’—এই মনোভাব গণতন্ত্র ও নৈতিকতাভিত্তিক সমাজব্যবস্থার সঙ্গে সংগতিহীন। সভ্য সমাজব্যবস্থায় যেকোনো সমস্যার যেনতেন প্রকারেণ সমাধান বিধেয় নয়। কিছু সমস্যা আছে, যা নিরসনে অনেক সময় এমন কোনো প্রক্রিয়ার অনুসরণ করা হয়, যা অন্যের জন্য নতুন সমস্যা তৈরি করে। গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার সাহেবগঞ্জ বাগদা ফার্ম এলাকায় তিন ফসলি জমিতে ইপিজেড নির্মাণের পরিকল্পনা এবং তা বাতিল করার দাবিতে সাঁওতালদের আন্দোলন করার ঘোষণা এই ধরনের সংকট সামনে এনেছে।
পত্রিকার তথ্যানুযায়ী, বাগদা ফার্ম এলাকায় রংপুর চিনিকলের মালিকানাধীন ১ হাজার ৮৩২ একর জমি আছে। এই জমিতে চিনিকলের তত্ত্বাবধানে একসময় আখ চাষ হতো এবং উৎপাদিত সেই আখ রংপুর চিনিকলে মাড়াই হতো। ২০১৬ সালে এসব জমিতে আখ কাটা নিয়ে চিনিকল কর্তৃপক্ষের লোকজন ও পুলিশের সঙ্গে সাঁওতালদের সংঘর্ষ হয়। এতে তিন সাঁওতাল নিহত এবং পুলিশসহ ২০ জন আহত হন। এরপর থেকে স্থানীয় সাঁওতালরা কয়েক দফায় এই জমির ওপর তাদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে। সেসব জমিতে এখনো তাঁরা ফসল ফলাচ্ছেন।
কাগজে–কলমে তাঁরা এই জমির মালিক না হলেও এই জমির ফসলের ওপর তাঁদের জীবন–জীবিকা অনেকখানি নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। এই বাস্তবতার মধ্যে শিল্প মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন বাংলাদেশ এক্সপোর্ট প্রসেসিং জোন অথরিটি (বেপজা) ওই জমিতে ইপিজেড স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছে। কিন্তু স্থানীয় সাঁওতালরা বলছেন, এতে তাঁরা তিন ফসলি জমি হারাবেন। এতে অনেককে না খেয়ে থাকতে হবে। সরকারের দিক থেকে বলা হচ্ছে, এখানে ইপিজেড নির্মিত হলে অসংখ্য শিল্পকারখানা গড়ে উঠবে। এখানে দুই লাখ মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। সেখানে সাঁওতালদেরও কর্মসংস্থান হবে এবং এ ক্ষেত্রে তাঁদের অগ্রাধিকার দেওয়া হবে।
এই জমিতে আন্দোলনরত সাঁওতালদের প্রচলিত আইনগত অধিকার প্রমাণ করার সুযোগ হয়তো নেই। কারণ, প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে যে জমিতে তারা বসবাস করে আসছে, তার দলিলপত্র বা কাগজ তৈরির কথা এই প্রান্তিক জাতিগোষ্ঠীর বিবেচনার মধ্যেই নেই। কিন্তু শুধু আইনগত থেকে সাঁওতালদের বিষয়টি দেখলে হবে না। যে ভূমির ওপর নির্ভর করে তাদের জীবন-জীবিকা চলে, সেখান থেকে তাদের কোনো বিচার-বিবেচনা ছাড়া উৎখাত করা যাবে না। আর জমিগুলো যেহেতু তিন ফসলি, সেহেতু এখানে ইপিজেড নির্মাণ দীর্ঘ মেয়াদে ভালো হচ্ছে কি না তা পর্যালোচনা করা দরকার। আসল কথা হচ্ছে সাঁওতালদের স্বার্থ নিশ্চিত ও তাঁদের সঙ্গে কোনো ধরনের আলোচনা বা সমঝোতা ছাড়া একতরফাভাবে কিছু করার সুযোগ নেই। আমরা আশা করছি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বাস্তব বিবেচনা বোধের পরিচয় দেবে। এ নিয়ে কোনো ধরনের সংঘাত-সহিংসতা কোনোভাবেই কাম্য নয়।