স্বাস্থ্য খাতের গবেষণা

করোনাকাল স্বাস্থ্য খাতের ভঙ্গুর অবস্থা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়ার পরও কর্তাব্যক্তিদের যে চৈতন্যোদয় হয়নি, তার প্রমাণ চলতি অর্থবছরে স্বাস্থ্য গবেষণার জন্য গঠিত তহবিলের একটি টাকাও খরচ করতে না পারা। এর আগে করোনা পরীক্ষা, যন্ত্রপাতি কেনা ও লোকবল নিয়োগ নিয়েও স্বাস্থ্য বিভাগ নানা কেলেঙ্কারির জন্ম দিয়েছে।

সোমবার প্রথম আলোর খবরে বলা হয়, স্বাস্থ্য খাতের গবেষণা খাতে এত দিন নামমাত্র বরাদ্দ ছিল। করোনাকালে গবেষণার বিষয়টি সামনে আসে এবং বিভিন্ন মহল থেকে বরাদ্দ বাড়ানোর দাবি ওঠে। এ প্রেক্ষাপটে চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরে ‘সমন্বিত স্বাস্থ্য-বিজ্ঞান গবেষণা ও উন্নয়ন তহবিল’ নামে এক প্রকল্পে ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়। কিন্তু অর্থবছরের ১০ মাস চলে যাওয়ার পরও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা গবেষণার নীতিমালা চূড়ান্ত করতে পারেননি। ফলে বরাদ্দ অর্থ অলস পড়ে আছে। বাকি দুই মাসে নীতিমালা চূড়ান্ত কিংবা বরাদ্দ অর্থ ব্যয়ের সম্ভাবনা কম।

বরাদ্দ অর্থ পড়ে থাকা নিয়ে এখন অর্থ ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় একে অপরকে দুষছে। অর্থ বিভাগের অভিযোগ, প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদনের পরও তহবিলের নীতিমালা জারি করতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় চার মাসের বেশি সময় লাগিয়েছে। অন্যদিকে স্বাস্থ্য শিক্ষা বিভাগের বক্তব্য হলো, অর্থ মন্ত্রণালয় নীতিমালার খসড়া করেছে পাঁচ মাস পর। সমস্যাটি পদ্ধতিগত বা কারিগরি হোক, আলোচনা করে সমাধান করা যেত। কিন্তু দুই মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারাই বিষয়টির প্রতি গুরুত্ব দেননি।

প্রথম আলোর খবর থেকে আরও জানা যায়, সমন্বিত স্বাস্থ্য-বিজ্ঞান গবেষণা ও উন্নয়ন তহবিলের কার্যক্রম পরিচালনা সম্পর্কিত নীতিমালা অনুমোদনের জন্য প্রধানমন্ত্রীর কাছে অর্থ বিভাগ একটি সারসংক্ষেপ উপস্থাপন করে ২০২০ সালের নভেম্বরে। ৩ ডিসেম্বর এতে স্বাক্ষর করেন প্রধানমন্ত্রী। অর্থ বিভাগের বাজেট অনুবিভাগ এরপর ৯ ডিসেম্বর নীতিমালাটি জারির জন্য অনুরোধ করে স্বাস্থ্যশিক্ষা ও পরিবারকল্যাণ সচিবের কাছে চিঠি পাঠায়। কিছু যোজন-বিয়োজন করে গত সপ্তাহে স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবারকল্যাণ বিভাগ নীতিমালাটি জারি করে।

গবেষণা প্রস্তাব বাছাইয়ের জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) ইন্টারনাল মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক মো. মুজিবুর রহমানকে সভাপতি করে ৯ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। এ কমিটি বছরে দুবার পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দিয়ে আবেদন আহ্বান করবে এবং সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামতের ভিত্তিতে বাছাইয়ের পর তালিকা পাঠাবে ১১ সদস্যের জাতীয় কমিটির কাছে। জাতীয় কমিটির সভাপতি ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস ও হাসপাতালের পরিচালক কাজী দ্বীন মোহাম্মদ।

বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব গবেষণার অর্থ ব্যয় না হওয়ার জন্য আমলাতন্ত্রকে দায়ী করেছেন। কিন্তু আমলাতন্ত্র কি স্বাধীন কোনো সংস্থা? যে রাজনৈতিক নেতৃত্ব আমলাতন্ত্র পরিচালনা করেন, তাঁরাও দায় এড়াতে পারেন না। দুই মন্ত্রণালয়ে যেমন শীর্ষ সরকারি কর্মকর্তা আছেন, তেমনি আছেন মন্ত্রীও। তাই কেবল আমলাদের ওপর দায় চাপালে হবে না। চলতি অর্থবছরে গবেষণার কাজে ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দ করেও অর্থ ব্যয় করা যায়নি। অর্থ যদি খরচই না করা হয়, তাহলে বরাদ্দ করে কী লাভ? বাজেটপ্রণেতারা বড় বড় প্রকল্পের প্রতি যতটা আগ্রহ দেখান, গবেষণাকাজে ততটাই নিরুৎসাহিত থাকেন।

কিন্তু এবার দেখা গেল, গবেষণার জন্য যথেষ্ট অর্থ বরাদ্দ করার পরও গবেষণা হলো না। এর জন্য দায়ী কে? তাঁরা কি জবাবদিহির ঊর্ধ্বে? কোভিড মহামারি মোকাবিলা করার ক্ষেত্রে আমাদের নিজস্ব গবেষণা অনেকভাবে সহায়ক হতে পারে। বিশেষজ্ঞরা বারবার এ বিষয়ে তাগিদ দিচ্ছেন। বিশেষত করোনাভাইরাসের জিনোম সিকোয়েন্সিং বা জিন বিশ্লেষণের মাধ্যমে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণের কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব। অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ডসহ কয়েকটি দেশে এটা প্রমাণিত হয়েছে। আমাদেরও অবশ্যই গবেষণার উদ্যোগ নিতে হবে।