সড়ক ও রেলপথে মৃত্যু

সম্পাদকীয়

গত শনিবার জয়পুরহাটে একটি ট্রেনের সঙ্গে একটি যাত্রীবাহী বাসের সংঘর্ষে ১২ ব্যক্তির মর্মান্তিক মৃত্যুর খবর জাতীয় সংবাদমাধ্যমে যথাযথ গুরুত্বের সঙ্গে প্রকাশিত হয়েছে এবং তা জনমনে যথারীতি বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছে। কিন্তু সেদিনই দেশের ১৪টি জেলায় পৃথক সড়ক দুর্ঘটনায় মোট ১৮ জন মানুষের প্রাণ হারানোর খবরগুলো সংবাদমাধ্যমে ততটা গুরুত্ব পায়নি, একই সঙ্গে অনেক মানুষের মনে কোনো প্রতিক্রিয়াও সৃষ্টি করেনি। কারণ, সড়ক দুর্ঘটনায় মানুষের মৃত্যু এ দেশে নৈমিত্তিক বিষয়ে পরিণত হয়েছে। একটি দুর্ঘটনায় একসঙ্গে অনেক মানুষের প্রাণহানি না ঘটা পর্যন্ত আমরা নাড়া খাই না। আমরা সড়কে মৃত্যুর ক্রমবর্ধমান মিছিলের দিকে তাকিয়ে থাকি অনেকটাই নির্বিকারভাবে।

সড়কের তুলনায় রেলপথের দুর্ঘটনা ঘটে অনেক কম। তবু যত সংখ্যায় ঘটে, ততটাও স্বাভাবিক নয়। কারণ, যোগাযোগের পথগুলোর মধ্যে রেলপথ সারা বিশ্বেই সবচেয়ে নিরাপদ হিসেবে স্বীকৃত। আমাদের দেশে রেলপথে যেসব দুর্ঘটনা ঘটে, তার অধিকাংশই সংশ্লিষ্ট দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের অস্বাভাবিক মাত্রার দায়িত্ববোধহীনতার ফল। জয়পুরহাটের দুর্ঘটনাটিও শতভাগ তা-ই। দুর্ঘটনাটি ঘটেছে একটি রেলক্রসিংয়ে, সেখানে রেললাইনটি একটি সড়ককে আড়াআড়ি অতিক্রম করেছে। ট্রেন সড়ক অতিক্রম করার সময় দুর্ঘটনা এড়াতে সড়কে প্রতিবন্ধক নামিয়ে দেওয়া হয়। এ কাজে রেল বিভাগের তিনজন কর্মী নিয়োজিত থাকেন; তাঁরা প্রত্যেকে ৮ ঘণ্টা করে পালাক্রমে দায়িত্ব পালন করেন। নয়ন মিয়া নামে রেল বিভাগের যে কর্মী শনিবার সকালে দায়িত্বে ছিলেন, তিনি দুর্ঘটনার সময় ঘুমাচ্ছিলেন।

বাংলাদেশে রেলপথে দুর্ঘটনাগুলোর অধিকাংশই এ রকম রেলক্রসিং দুর্ঘটনা। রেলক্রসিং অতিক্রম করার সময় যাত্রীবাহী বা পণ্যবাহী যানবাহন ও মানুষ চলন্ত ট্রেনের নিচে পড়ে। বাংলাদেশ রেলওয়ের হিসাব অনুযায়ী, ২০০৮ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত সারা দেশে রেলক্রসিং দুর্ঘটনা ঘটেছে মোট ৩১০টি, প্রাণ হারিয়েছেন ২৮১ জন মানুষ। গত বছর ১৩টি রেলক্রসিং দুর্ঘটনায় মারা গেছেন ১৮ জন।

রেলক্রসিং দুর্ঘটনাগুলো ঘটে সাধারণত ক্রসিংগুলোর নিরাপত্তাকর্মীদের দায়িত্ব পালনে অবহেলার কারণে। জয়পুরহাটের দুর্ঘটনাটির মতো ফেনী ও গাজীপুরের কালিয়াকৈরেও যথাক্রমে ১১ অক্টোবর ও ৯ নভেম্বর পৃথক দুটি রেলক্রসিং দুর্ঘটনায় ৫ ব্যক্তির প্রাণহানি ঘটেছে, আহত হয়েছেন ১৫ জন। দুটি রেলক্রসিংয়েই নিরাপত্তাকর্মীরা দুর্ঘটনার সময় ঘুমিয়ে ছিলেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

নিরাপত্তাকর্মীদের অবহেলার কারণে রেলক্রসিং দুর্ঘটনায় মানুষ হতাহত হলে তাঁরা প্রথমে কিছুদিন পালিয়ে থাকেন। তাঁদের চাকরি স্থায়ী নয়, তবু রেল বিভাগ হয়তো তাঁদের সাময়িকভাবে বরখাস্ত করে। তারপর একটা সময়ে বিষয়টি সবাই ভুলে যায়। কখনো কখনো অপমৃত্যুর মামলা করা হয়। সাধারণত সেসব মামলার নিষ্পত্তি হয় না—কারও কোনো শাস্তি হয় না। ফলে রেলক্রসিংগুলোতে দুর্ঘটনায় মানুষের প্রাণহানি চলতে থাকে। সারা দেশের রেলক্রসিংগুলো নিরাপদ করার কোনো কার্যকর উদ্যোগ কখনোই নেওয়া হয়নি। রেল বিভাগ এ বিষয়ে যথেষ্ট গুরুত্ব দেয় বলে প্রতীয়মান হয় না।

রেলক্রসিংয়ের দুর্ঘটনাগুলো একই সঙ্গে সড়ক দুর্ঘটনাও বটে। কেননা সড়কপথে রেললাইন অতিক্রম করতে গিয়েই যানবাহন ও মানুষ চলন্ত ট্রেনের মুখে পড়ে দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছে। এসব দুর্ঘটনাকে সড়ক দুর্ঘটনার অন্তর্ভুক্ত হিসেবেও দেখা যেতে পারে এবং সড়কে চলাচলের ক্ষেত্রে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সব ধরনের সতর্কতা অবলম্বনের ওপর গুরুত্ব দেওয়া উচিত। রেল বিভাগ ও সংশ্লিষ্ট সড়ক নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর উচিত মিলিতভাবে রেলক্রসিংগুলোর নিরাপত্তা বাড়ানোর জোরালো উদ্যোগ নেওয়া। তা ছাড়া দায়িত্বে অবহেলার জন্য রেলক্রসিংয়ে দুর্ঘটনায় মানুষের মৃত্যু হলে আইনানুগভাবে তার শাস্তির বিধান করা একান্ত জরুরি।