সড়ক ব্যবস্থাপনা

বাংলাদেশের সড়ক যথারীতি মৃত্যুফাঁদ থেকে যাচ্ছে। সড়ক ব্যবস্থাপনায় মৌলিক কোনো পরিবর্তন নেই। যে নিরাপদ সড়ক আন্দোলন হয়েছিল, পরিবর্তনের পক্ষে রাজনৈতিক অঙ্গীকার ঘোষণা করা হয়েছিল, সেসব এখন বিস্মৃতির গহ্বরে।

গণপরিবহন খাতের সমস্যা ও করণীয় কী, সবই চিহ্নিত। কিন্তু পরিস্থিতির উন্নতি নেই বরং তা আরও অবনতিশীল। কারণ, অদক্ষ চালক এবং দেখভালের বাইরে থাকা যানবাহন—দুটোই ক্রমাগত বাড়ছে। তবে জেনেশুনে সড়কে অদক্ষ চালক এবং ফিটনেসবিহীন গাড়ির ব্যাপক উপস্থিতিই সবচেয়ে ভয়ংকর অবস্থার সৃষ্টি করেছে। তিন দশক আগে বিআরটিএর প্রতিষ্ঠালগ্নে যানবাহনের চেয়ে চালকের সংখ্যা বেশি ছিল। এখন চিত্রটি উল্টো। যানবাহনের তুলনায় চালকের সংখ্যা কম—প্রায় সাড়ে ১৮ লাখ। এর সঙ্গে যদি চালকের উপযুক্ত কর্মঘণ্টার বিষয়টি বিবেচনায় নেওয়া হয়, তাহলে দক্ষ চালকের সংকটের গভীরতা বোঝা যায়। সুতরাং দেশে অবিলম্বে পর্যাপ্তসংখ্যক চালক প্রশিক্ষণ একাডেমি গড়ে তুলতে হবে।

ফিটনেস পরীক্ষার সঙ্গে দক্ষ পরিদর্শক প্রয়োজন; সেখানেও সংকট। ফিটনেসবিহীন যানবাহনের সংখ্যা প্রায় পাঁচ লাখ। এর প্রায় এক–পঞ্চমাংশ বাস-ট্রাক গোত্রীয়, যারা অর্ধেক সড়ক দুর্ঘটনার জন্য দায়ী। ২০১৮ সালের সড়ক পরিবহন আইন পাসের পরও আমরা দেখি, আইন কাগজেই আছে। উপরন্তু জনবান্ধব ধারাগুলো বেশি অকার্যকর। রাজনৈতিক অঙ্গীকারের গলদই এর মূলে।

বিআরটিএ মাত্র এক বছরে তিন হাজার কোটি টাকার বেশি সরকারকে আয় এনে দেয়। অথচ এই মানদণ্ডেও সড়ক ব্যবস্থাপনায় যতটা বিনিয়োগ দাবি করে, সেটা থেকেও সংস্থাটিকে বঞ্চিত রাখা হয়। ‌মাথাপিছু একজন পরিদর্শকের দায়িত্ব ৪১ হাজার গাড়ি ও ২৫ হাজার চালকের দেখভাল করা। এ রকম অত্যল্প বিনিয়োগের মধ্যেই রাষ্ট্রের দৃষ্টিভঙ্গি মূর্ত। এ দেশের সড়কে গত পাঁচ বছরে ৩৭ হাজার ব্যক্তির মৃত্যু ঘটবে এবং কাউকে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে না। হাইকোর্টের রায়মতে পৃথক ১০ দুর্ঘটনায় নিহত ব্যক্তিদের পরিবারগুলো তো ১০ কোটি টাকার ক্ষতিপূরণ পায়নি। কিন্তু মৃতের তালিকা দীর্ঘতর হচ্ছে। পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী ব্যক্তি অঙ্গহানির পরে বোঝা হবেন। রাষ্ট্র খোঁজ নেবে না। অথচ আইনে বলা থাকবে, ট্রাস্টি বোর্ড ক্ষতিপূরণ দেবে। বাস্তবে ট্রাস্টি বোর্ড গঠনই হবে না। তদুপরি রাষ্ট্রযন্ত্র ভান করবে, যেন সবকিছু ঠিকঠাক চলছে। আসলে তো চলছে না। বাংলাদেশের সড়কে অব্যাহত মৃত্যু অবশ্যই নিয়তি-নির্ধারিত নয় যে এর রাশ টানা অসম্ভব।

সুতরাং দক্ষ পরিবহনকর্মী তৈরিসহ সামগ্রিকভাবে সড়ক ব্যবস্থাপনার আধুনিকায়ন না করা হলে সড়কে মৃত্যু কমার কোনো যুক্তিসংগত কারণ নেই। নিরাপদ সড়ক দিবসে বুয়েটের সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের একজন মুখপাত্র যথার্থই বলেছেন, চালক ক্লান্ত ও অবসাদগ্রস্ত হলে অথবা যানবাহন ত্রুটিপূর্ণ হলে দুর্ঘটনা বাড়বে, এটা বলার জন্য গবেষণার দরকার নেই। এক বছর আগে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী বলেছিলেন, সড়ক দুর্ঘটনা রোধে গঠিত শাজাহান খান কমিটি ১১১টি সুপারিশ করেছে। অতীতে এ রকমের বহু কমিটি ও সুপারিশ নথিবন্দীই থেকে গেছে।

সড়কে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার বিষয়টি যেন একটি গোষ্ঠীর কাছে জিম্মি হয়ে আছে। এ অবস্থার পরিবর্তন ছাড়া নিরাপদ সড়ক আশা করা যাবে না। এ জন্য দরকার উচ্চপর্যায়ের রাজনৈতিক অঙ্গীকার এবং সে অনুযায়ী নীতি ও পরিকল্পনা গ্রহণ এবং বাস্তবায়ন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, প্রত্যেক যানচালকের ডোপ টেস্ট বা মাদক সেবনের বিষয়ে পরীক্ষা করা দরকার। তাঁর এ বক্তব্যের আশু বাস্তবায়ন জরুরি। কারণ, গবেষণা জরিপে দেখা যাচ্ছে, অধিকাংশ সড়ক দুর্ঘটনা ঘটছে বেপরোয়া চালকদের কারণে। তাঁদের মধ্যে একটা অংশ মাদকদ্রব্য সেবন করছেন কি না, তা অবশ্যই দেখা দরকার।