২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা

২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার বার্ষিকীতে যে কথাটি সবচেয়ে গুরুত্ব ও অগ্রাধিকারের সঙ্গে স্মরণ করা দরকার সেটা হলো, সেই সময়ের ক্ষমতাসীন দল বিএনপি তার দায় স্বীকার করেনি। এখনো দলটি এ ঘটনার ব্যাপারে একটি পলায়নপর অবস্থানে থাকাকেই নিজেদের জন্য স্বস্তিদায়ক ভাবছে। নেতৃত্বের সংকট ও লেজেগোবরে অবস্থায় থাকা দলটির মধ্যে আত্মশুদ্ধি বা আত্মজিজ্ঞাসার কোনো লক্ষণ নেই।

 বিশ্বের বহু দেশই সন্ত্রাসের শিকার। জঙ্গিবাদী সন্ত্রাসে আক্রান্ত হওয়াটা বর্তমান সময়ের একটি বাস্তবতা। কিন্তু ২১ আগস্টের ঘটনা সাম্প্রতিক সময়ের বিরল একটি ঘটনারই দৃষ্টান্ত, যেখানে নিয়মতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত ও সরকার পরিচালনাকারী রাজনৈতিক দল আরেকটি নিয়মতান্ত্রিক ও প্রধান বিরোধী রাজনৈতিক দলকে নিশ্চিহ্ন করতে চেয়েছে। এই কাজে তারা ইসলামি জঙ্গিদের ব্যবহার করেছে কিংবা তাদের দ্বারা নিজেদের ব্যবহৃত হতে দিয়েছে। উপরন্তু এই ভয়ংকর আঁতাতে রাষ্ট্রযন্ত্রের একাংশ যুক্ত হয়েছে।

বিএনপি ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার মামলাকে ভিন্ন খাতে নেওয়ার চেষ্টা হয়েছে। শেষ পর্যন্ত ঘটনার ১৪ বছর পর মামলার রায় হয়েছে। আমরা আশা করব, পেপার বুক তৈরির মতো প্রক্রিয়াগত বিষয় বাধা হবে না। হাইকোর্টের শুনানি প্রলম্বিত হবে না। প্রবাসী ও পলাতক আসামিদের দেশে ফিরিয়ে আনতে ও গ্রেপ্তার করতে সরকার দক্ষতার পরিচয় দেবে। কিন্তু ২১ আগস্টের পদ্ধতিগত হিংসাত্মক রাজনীতি আওয়ামী লীগের এক দশকের শাসনকে কীভাবে প্রভাবিত করেছে, তার একটা নির্মোহ মূল্যায়ন এখন সময়ের দাবি। ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার ঘটনার সঙ্গে বিএনপির যুক্ততার শাস্তি জনগণ পেতে পারে না। দেশের বর্তমান সংকুচিত গণতান্ত্রিক পরিসর, নির্বাচনী ব্যবস্থার অকার্যকর দশা, মানবাধিকার, সুশাসন ও আইনের শাসনের ধারণা দুর্বল হয়ে পড়া—এমন একটি পরিস্থিতি তৈরির পেছনে বর্তমান ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের কী মনমানসিকতা কাজ করেছে, তার বিশ্লেষণ জরুরি। বোঝা দরকার দেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির পেছনে ২১ আগস্টের ঘটনার দায় কতটুকু।

গত এক দশকে আওয়ামী লীগ এমন অনেক অস্বাভাবিক কিছু করে দেখিয়েছে, যা ২০০৪ সালের আগের আওয়ামী লীগের পক্ষে করে দেখানো অসম্ভব ছিল। পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের ষড়যন্ত্রে বাংলাদেশ বঙ্গবন্ধুকে সপরিবার হারিয়ে অপূরণীয় ক্ষতির শিকার হয়েছিল। নব্বইয়ে স্বৈরাচারের পতন ও গণতন্ত্রের পথে নতুন যাত্রার মধ্য দিয়ে সেই ক্ষত কিছুটা হলেও পূরণের দিকে দেশ এগোচ্ছিল। কিন্তু এরপর ২১ আগস্টের নৃশংসতার রাজনৈতিক অভিঘাত রাষ্ট্র ও সমাজজীবনে এমন গভীরভাবে পড়েছে, যার খেসারত দেশ এখনো দিয়ে যাচ্ছে।

গ্রেনেড হামলাকারী জঙ্গি সংগঠনটির বিনাশ ঘটলেও আমরা দেখেছি, নতুন নতুন সংগঠন গজিয়ে উঠেছে। হোলি আর্টিজানসহ নানা সন্ত্রাসী ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু ২১ আগস্ট থেকে শিক্ষা নিয়ে রাষ্ট্রযন্ত্রের রাজনৈতিক ব্যবহার কমেছে কি? এই প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকলে রাষ্ট্রযন্ত্র বা প্রশাসন দ্বারা জঙ্গি বা সন্ত্রাসবাদে মদদ দেওয়ার পুনরাবৃত্তি আর ঘটবে না—এ নিশ্চয়তা মিলবে কীভাবে? বিএনপিকে স্তব্ধ করে দেওয়া আর সমাজে ভিন্নমতের অবদমন করার মানদণ্ড কী করে এক হতে পারে? প্রধান বিরোধী দলকে অস্তিত্বহীন করে জাতীয় স্বার্থ সুরক্ষা ও জাতীয় নিরাপত্তার ধারণা আরও শক্তিশালী করা যায় কি? এর উত্তর না হলে বিকল্প পথ কী, তা খুঁজে বের করতে হবে।

বাতাসে ষড়যন্ত্রের গন্ধের কথা বলে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, বাংলাদেশ হিংসার রাজনীতির হুমকিমুক্ত নয়। ২১ আগস্টের ১৫তম বার্ষিকীতে তাই আমরা রাজনীতিবিদদের পুরো বিষয়টি মূল্যায়ন করার আহ্বান জানাই। হিংসাশ্রয়ী রাজনীতি থেকে উত্তরণের যথা উপায় রাজনীতিবিদেরই বের করতে হবে। দীর্ঘ রাজনৈতিক শূন্যতা ও গণতন্ত্রের ঘাটতিকে জাতীয় প্রতিরক্ষার জন্য হুমকি বিবেচনা করুন।