'হ্যালো ওসি' বুথ

‘জীবনস্মৃতি’তে রবীন্দ্রনাথ পুলিশ সম্পর্কে বলেছেন, ‘কুমির যেমন খাঁজকাটা দাঁতের মধ্যে শিকারকে বিদ্ধ করিয়া জলের তলে অদৃশ্য হইয়া যায়, তেমনি করিয়া হতভাগ্যকে চাপিয়া ধরিয়া অতলস্পর্শ থানার মধ্যে অন্তর্হিত হওয়াই পুলিশ কর্মচারীর স্বাভাবিক ধর্ম।’ রাজশেখর বসুর ভাষায়, ‘পুলিশের হাসি দুর্লভ’। উপনিবেশ আমলে পুলিশের মধ্যে জনমনে ভীতি বিস্তারের যে প্রবণতা ছিল, তার আলোকেই হয়তো রবীন্দ্রনাথ ও রাজশেখর বসু এমন মন্তব্য করেছিলেন। 

এ কথা সত্য, পুলিশের সেই আমলের ভীতিপ্রদ আচরণ একেবারে উবে যায়নি। তার রেশ এখনো বর্তমান। তাই হয়তো পুলিশকে এখনো জনগণ প্রকৃত বন্ধু মনে করার মতো অবস্থায় আসেনি। সে কারণেই পেটানো, হেনস্তা করা, গালাগালি করা—এগুলোকে অধিকাংশ মানুষ পুলিশি কাজের স্বাভাবিক ধারা মনে করে। 

অতি আশার কথা, দিন বদলাতে শুরু করেছে। পুলিশ জনগণের ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠছে। ৯৯৯ ফোন সার্ভিসের মাধ্যমে সাধারণ মানুষ এখন বিপদের সময় সরাসরি পুলিশের সহায়তা নিতে পারছে। 

পুলিশের জনবান্ধব পদক্ষেপের সর্বশেষ নজির রেখেছে চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশ। তৃণমূল পর্যায়ের অতি সাধারণ ও দরিদ্র শ্রেণির যেসব মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পরও অজানা আশঙ্কায় থানামুখী হতে চান না, তাঁদের কথা মাথায় রেখে চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশ ‘হ্যালো ওসি’ নামের একটি সেবা কার্যক্রম চালাচ্ছে। 

এই কার্যক্রমের আওতায় থানার বাইরে বিভিন্ন জায়গায় একটি ভ্রাম্যমাণ বুথ বসানো হচ্ছে। সেখানে একজন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) বসছেন। দিনমজুর, ভিক্ষুক থেকে শুরু করে সব শ্রেণির মানুষ লাইন ধরে সেখানে সুশৃঙ্খলভাবে আসছেন। ওসি তাঁদের কথা শুনছেন। মহানগরের ১৬টি থানার ১৬ জন ওসি মাসে দুবার করে হ্যালো ওসি বুথে বসছেন। ছোট্ট বুথে বসে তাঁরা বলছেন, জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাসবাদের কুফল। শুনছেন মাদক, উত্ত্যক্তকারীসহ নানা সমস্যার কথা। মাদক, উত্ত্যক্তকারী, চাঁদাবাজি, পারিবারিক সমস্যাসহ নানা বিষয়ে থানার ওসিকে কাছে পেয়ে মন খুলে বলছেন স্থানীয় ভুক্তভোগীরা। ওসিরা ছোটখাটো বিষয়গুলো তৎক্ষণাৎ সমাধান করছেন। বাকিগুলো সম্পর্কে আইনি পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। গত জুলাই থেকে এই সেবা চলছে। 

সন্দেহ নেই, এই সেবা পুলিশ সম্পর্কে সাধারণ মানুষের মধ্যেই ইতিবাচক ধারণা তৈরি করবে। 

এ ক্ষেত্রে চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশ কমিশনার মো. মাহাবুবর রহমানের বক্তব্য প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেছেন, পুলিশের কাছে জনগণ নয়, পুলিশই জনগণের কাছে যাবে। এতে মানুষের পুলিশিভীতি দূর হবে। পুলিশ ও জনগণের দূরত্ব কমলে অপরাধীদের সম্পর্কে তথ্য পাবে পুলিশ। এতে কমবে অপরাধ। পুলিশের পক্ষ থেকে এ ধরনের বক্তব্য আসা অত্যন্ত ইতিবাচক। 

চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশ যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে, তা সারা দেশে চালু করা গেলে একদিকে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি হবে, অন্যদিকে পুলিশের পক্ষে জনগণের সত্যিকারের স্বজন হওয়ার পথ প্রসারিত হবে।