তরুণ উদ্যোক্তারা যেভাবে পর্যটনশিল্পকে বদলে দিচ্ছেন

তুলনামূলক কম জনপ্রিয় স্থানগুলোকে প্রচারের মাধ্যমে জনপ্রিয় করে দেশের পর্যটনের বিকাশেও দারুণ ভূমিকা রেখে চলেছেন তরুণ উদ্যোক্তারা।

খাদ্য, শিক্ষা, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা—এসব হচ্ছে আমাদের মৌলিক চাহিদা। এর সঙ্গে কি ভ্রমণকেও যুক্ত করা যায় না? ভ্রমণকেও যে একটি মৌলিক চাহিদা করা যায় এবং করা উচিত, এমন একটি আলোচনা বিগত বছরগুলো থেকে হয়ে আসছে। কারণ, মানসিক স্বাস্থ্যের বিকাশ কিংবা ভিন্ন জনপদের সংস্কৃতি-জীবনাচরণ সম্পর্কে জানতে ভ্রমণ ব্যতীত বিকল্প কিছু নেই।

মানুষের দৈনন্দিন জীবনের নানা চাহিদা এবং চাহিদা পূরণের সামর্থ্যের সঙ্গে সঙ্গে তৈরি হয় নতুন সম্ভাবনা। পর্যটন আমাদের সেই সম্ভাবনার দারুণ ক্ষেত্র। বৈশ্বিক মহামারি করোনা–পরবর্তী অর্থনৈতিক দুরবস্থা কাটিয়ে উঠে নেপালের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়িয়েছে কেবল পর্যটনশিল্পের পিঠে চড়ে। ঋণের চাপে দেউলিয়া হয়ে যাওয়া শ্রীলঙ্কার কথাই ভাবুন? এমন ভঙ্গুর অর্থনীতির চাকায় প্যাডেল চালিয়ে সেটিকে সচল করেছে পর্যটন।

আশার কথা, অযত্ন-অবহেলায় পড়ে থাকা এ সম্ভাবনায় আশার মশাল জ্বালিয়েছে আমাদের দেশের তরুণসমাজ। বেশ কিছু বছর ধরেই নিজেদের ভ্রমণ নেশাকে পেশা হিসেবে বেছে নেওয়া তরুণের সংখ্যা চোখে পড়ার মতো। নানা সীমাবদ্ধতা আর ভ্রান্ত সব ধারণাকে জয় করে পার্বত্য চট্টগ্রামের গহিন পাহাড়ি এলাকাকেও তাঁরা বানিয়েছেন পর্যটনক্ষেত্র।

নিরাপত্তাব্যবস্থা উন্নত করায় দেশের পর্যটনে বর্তমানে নারীদের অংশগ্রহণও অনেক বেড়েছে। নারীরাও যে ঘুরে বেড়াতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছেন, এটি একটি আশাব্যঞ্জক পরিবর্তন। কক্সবাজারের পাশাপাশি নতুন পর্যটন সম্ভাবনাময় জায়গাগুলোতে আধুনিক সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করায় পরিবার নিয়ে ভ্রমণেও উৎসাহিত হচ্ছেন অনেকে। এমনকি পরিবার ছাড়াও নিশ্চিন্তে ঘুরে বেড়ানোর সুযোগ তৈরি হয়েছে। অনেক নারী সেই সুযোগ গ্রহণ করছেন।

আমাদের কক্সবাজারকেন্দ্রিক পর্যটনকে দেশের বিভিন্ন কোনায় পৌঁছে দেওয়া, আর সেসব জায়গাকে মানুষের কাছে তুলে ধরা এবং পর্যটকবান্ধব করে তোলার পেছনের গল্পটা পুরোটাই আমাদের তরুণদের হাতে লেখা।

তুলনামূলক কম জনপ্রিয় স্থানগুলোকে প্রচারের মাধ্যমে জনপ্রিয় করে দেশের পর্যটনের বিকাশেও দারুণ ভূমিকা রেখে চলেছেন তরুণ উদ্যোক্তারা। মেঘ দেখতে যাওয়া রাঙামাটির সাজেক ভ্যালি কিংবা বর্ষার অথই জল দেখতে যাওয়া সুনামগঞ্জের টাঙ্গুয়ার হাওর এর বড় উদাহরণ। ইতিমধ্যেই সুন্দরবনের কোল ঘেঁষে তরুণ উদ্যোক্তারা গড়ে তুলছেন দারুণ সব ইকো রিসোর্ট, যা বিশ্বের নানা দেশের পর্যটকদের সুন্দরবন ভ্রমণে আরও উৎসাহিত করবে।

দেশের পর্যটন নিয়ে কাজ করা তরুণেরা বিশ্বাস করেন, পর্যটনে বাংলাদেশের সম্ভাবনার কথা।

বর্তমানে ট্যুরিজম নিয়ে যাঁরা কাজ করছেন, তাঁরা অনেকেই শুরুতে শখ হিসেবে নিলেও পরবর্তীকালে ভ্রমণকে পেশা হিসেবে নিয়ে কাজ করেছেন। প্রথম দিকে তাঁদের বেশির ভাগই পরিচিত মানুষজন ও পরিবারের সদস্যদের সহযোগিতা পাননি। এখনো বাংলাদেশে প্রচলিত ক্যারিয়ার ভাবনায় পর্যটনশিল্পকে অনেকে ঠাঁই দিতে নারাজ।
তবে দিন দিন পর্যটনশিল্পের বিকাশ ঘটায় এখন সেই ধারণা কিছুটা হলেও বদলেছে।

সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এখন ‘ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট’ বিষয়ে উচ্চতর শিক্ষা নেওয়ার সুযোগ করে দিচ্ছে। প্রাচ্যের অক্সফোর্ডখ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দিয়ে পাবলিক কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম এ বিষয়ে একাডেমিক ডিগ্রি অর্জনের সুযোগ তৈরি হয়। এরপর পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, ইসলামিক বিশ্ববিদ্যালয়, পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং রাঙামাটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে এ বিষয়ে পড়ার সুযোগ রয়েছে।

বিভিন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ক্যাম্পাস ও ৯টি অধিভুক্ত কলেজে প্রাথমিক পর্যায়ে ‘ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট’ নামে (সম্মান ) শিক্ষা কোর্স প্রবর্তন করা হয়েছে। পর্যায়ক্রমে অন্যান্য কলেজেও এই শিক্ষা কার্যক্রম সম্প্রসারণ করা হবে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকে (সম্মান) ট্যুরিজম শিক্ষা কোর্স বাংলাদেশের পর্যটনশিল্পের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। এসব শিক্ষা কার্যক্রম ও উচ্চতর ডিগ্রি অর্জনের সুযোগের ফলে একদিকে যেমন লাভবান হচ্ছে দেশের পর্যটনশিল্প, তেমনি তরুণদের জন্য খুলে যাচ্ছে ক্যারিয়ার গড়ার আরেকটি জানালা।

দেশের পর্যটনশিল্পের বিকাশের জন্য দেশের নানা প্রান্তিক অঞ্চলের মানুষের আয়রোজকার বেড়েছে। টাঙ্গুয়ার হাওরে পর্যটন বিকশিত হওয়ার পর সবচেয়ে লাভবান হয়েছে সেই অঞ্চলের মানুষ। টাঙ্গুয়ার হাওরে বেশির ভাগ পর্যটনবাহী নৌকায় কাজ করছেন স্থানীয় জনবল। পাঁচ মাসের পর্যটন মৌসুমে তাঁরা আয় করছেন মাসে ৩০-৪০ হাজারের বেশি টাকা। বছরের বাকি সময় তাঁরা অন্যান্য কাজ করে এখন অতীতের চেয়ে অনেক ভালো অবস্থায় দিন পার করছেন। ছেলেমেয়েদের শিক্ষা প্রদানের খরচ জোগাতে পারছেন। এ ছাড়া পর্যটনশিল্প বিকাশের পর হাওর অঞ্চলে ডাকাতিসহ নানা অপরাধের হার এখন শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছে।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলো ব্যবহার করে পরিবেশবান্ধব ‘ইকোট্যুরিজম’ নিয়ে কাজ করা বহু তরুণ মিলে গড়ে তুলেছেন নতুন কমিউনিটি ই-ট্যুরিজম অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ই-টাব)।

দেশের পর্যটন নিয়ে কাজ করা তরুণেরা বিশ্বাস করেন, পর্যটনে বাংলাদেশের সম্ভাবনার কথা। শুধু তাঁদের প্রয়োজন সহযোগিতা, উদ্যোক্তাবান্ধব নীতিমালা ও পর্যটকদের জন্য নিরাপদ পরিবেশ। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের পর্যটকদের বাংলাদেশ ভ্রমণে আরও উৎসাহিত করার জন্য সরকারকে আরও বেশি উদ্যোগী হতে হবে।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ট্যুরিজম ফেয়ারে নামমাত্র অংশগ্রহণ বাদ দিয়ে দেশকে সুন্দরভাবে উপস্থাপন করার উদ্যোগ নিতে হবে। দেশের তরুণসমাজ যেভাবে নিজস্ব উপস্থাপনার মাধ্যমে দেশের মানুষদের পর্যটনকেন্দ্রগুলোতে আহ্বান করছে, ঠিক সেভাবেই বিদেশে অনুষ্ঠিত ট্যুরিজম ফেয়ারে তাদের অংশগ্রহণের সুযোগ করে দিলে এবং তরুণসমাজের সময়োপযোগী মার্কেটিং দক্ষতা কাজে লাগাতে পারলে দেশের পর্যটনশিল্পে বিদেশি পর্যটকদের আনাগোনা অবশ্যই বাড়বে।

এ ছাড়া দেশের পর্যটনবান্ধব জায়গা ও ঐতিহাসিক স্থাপনাগুলোর গোছানো কোনো ডকুমেন্টারি নেই। পর্যটন মন্ত্রণালয় চাইলে সরকারিভাবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোতে গোছালো ও পরিচ্ছন্ন ভিজ্যুয়াল প্রেজেন্টেশনের মাধ্যমে দেশের সৌন্দর্য সারা বিশ্বের কাছে তুলে ধরতে পারে। একটি পরিপূর্ণ ওয়েবসাইটের মাধ্যমে দেশের ৬৪ জেলার সম্ভাবনাময় পর্যটনবান্ধব জায়গাগুলোর বিস্তারিত বিবরণ তুলে ধরতে পারে বাংলা ও ইংরেজি—দুই ভাষাতেই। এতে পৃথিবীর যেকোনো প্রান্ত থেকেই উৎসাহী পর্যটক এক নিমেষে ধারণা পাবে বাংলাদেশ সম্পর্কে।

নিজেদের সামর্থ্য অনুযায়ী দেশের ক্ষুদ্র পরিসরে পরিবেশবান্ধব পর্যটনশিল্প বিকাশে কাজ করছেন একদল তরুণ। পরিবেশের ক্ষতি না করে পর্যটনশিল্পের বিকাশে তাঁরা নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। এটাই সঠিক সময় সরকারিভাবে এগিয়ে আসা, তাহলে সামগ্রিকভাবে দেশের পর্যটনশিল্প লাভবান হবে। পর্যটনশিল্পও এগিয়ে যাবে, পরিবেশেরও ক্ষতি হবে না—বিষয়টি নিশ্চিত করতে পর্যটনবান্ধবখ্যাত অন্য দেশগুলোর অভিজ্ঞতা ও নীতিমালা অনুসরণ করা যেতে যারে।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলো ব্যবহার করে পরিবেশবান্ধব ‘ইকোট্যুরিজম’ নিয়ে কাজ করা বহু তরুণ মিলে গড়ে তুলেছেন নতুন কমিউনিটি ই-ট্যুরিজম অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ই-টাব)। ১১২ তরুণ ট্যুর অপারেটর/এজেন্সি মিলে চেষ্টা করছেন বাংলাদেশের পর্যটনশিল্পের বিকাশে। নিরাপদ ও পর্যটকবান্ধব নানা স্থাপনা গড়েছেন সাজেক ভ্যালি, সেন্ট মার্টিন, টাঙ্গুয়ার হাওর, হবিগঞ্জ, সুন্দরবনের মতো দেশের বিভিন্ন জায়গায়।

ই-টাবের সভাপতি ইমরানুল আলমের মতে, একটা দেশের অর্থনীতির বড় ধরনের অংশীদার হতে পারে সেই দেশের পর্যটনশিল্প। থাইল্যান্ড, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপসহ বিশ্বের আরও অনেক দেশের অর্থনীতির বড় জোগান আসে পর্যটন থেকেই। বাংলাদেশের অধিক জনসংখ্যা ও অনেক পর্যটন সম্ভাবনাময় জায়গার দরুন দেশি ও বিদেশি পর্যটকদের জন্য বাংলাদেশের পর্যটন দারুণ সম্ভাবনার একটা জায়গা। ক্যারিয়ার হিসেবেও অন্য সব পেশার সঙ্গে এখন সম্মানের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ট্যুরিজম। নানা সীমাবদ্ধতা নিয়েও যেভাবে তরুণেরা কাজ করছেন, রাষ্ট্রীয় ও সামাজিকভাবে সহায়তা পেলে পর্যটনেও বাংলাদেশ বিশ্বের কাছে অন্য উচ্চতায় যাবে বলে বিশ্বাস করেন তিনি।

  • সৌরভ ইশতিয়াক পর্যটনশিল্পের একজন তরুণ উদ্যোক্তা