প্রজনন স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনাসেবায় জেন্ডার বৈষম্য দূর করতে হবে  

বরাবরের মতো আজ বিশ্বব্যাপী প্রতিপালিত হচ্ছে ‘বিশ্ব জনসংখ্যা দিবস’। এবারের প্রতিপাদ্য বিষয় ‘জেন্ডার সমতাই শক্তি: নারী ও কন্যাশিশুর মুক্ত উচ্চারণে অবারিত হোক সম্ভাবনার দ্বার’।

স্বাধীনতা–পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ যেসব খাতে উল্লেখযোগ্য সফলতা অর্জন করেছে, তার মধ্যে পরিবার পরিকল্পনা সেবা অন্যতম। জাতীয় থেকে তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত এই সফলতার গল্প বাংলাদেশ সরকার ও উন্নয়ন সহযোগী সংস্থাগুলোর সম্মিলিত প্রয়াসের ফল। অথচ বিগত দশকে এই সফলতার ধারাবাহিকতা অনেকটাই স্থিমিত হয়ে পড়েছে। এর অন্যতম অন্তর্নিহিত কারণ জেন্ডার বৈষম্য— বিশেষ করে প্রজনন স্বাস্থ্যসেবায়। প্রজনন স্বাস্থ্যসেবায় জেন্ডার বৈষম্যের কারণে প্রতিনিয়ত ঘটছে নানান রকম সহিংসতা যেমন বাল্যবিয়ে, যৌতুক, অপরিণত বয়সে গর্ভধারণ, অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভধারণ, মাতৃমৃত্যু, শিশুমৃত্যু ইত্যাদি। যদিও জেন্ডারভিত্তিক সহিংসতা একটি বৈশ্বিক সমস্যা, তথাপিও এর কার্যকারণ অনেকটাই প্রেক্ষাপটনির্ভর।

নারীর প্রতি সহিংসতা সমীক্ষা ২০১৫-এর রিপোর্টে দেখা গেছে, বাংলাদেশে ৭২ দশমিক ৫ শতাংশ নারী তাদের জীবদ্দশায় কোনো না কোনো ধরনের সহিংসতার সম্মুখীন হয়েছেন এবং ৩৬ দশমিক ১ শতাংশ নারীর স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণের ক্ষেত্রে স্বামীর অনুমতি নিতে হয়। প্রয়োজনের সময় সহায়তা না পাওয়ার কারণে নারীদের সমস্যাগুলো আরও জটিল আকার ধারণ করে এবং বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের সৃষ্টি করে। যেমন পরিবার পরিকল্পনার অপূর্ণ চাহিদা (১০%), পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি ছেড়ে দেওয়া (৩৭%), এবং বাল্যবিবাহ (৫০%) (বিডিএইচএস, ২০২২)।

গবেষণায় দেখা গেছে ১৫ থেকে ১৯ বছর বয়সী নারীর প্রতি চারজনের মধ্যে একজন (২৪%) কখনো না কখনো গর্ভবতী হয়েছেন এবং প্রতি পাঁচজনের মধ্যে একজন (১৮%) জীবিত সন্তান জন্ম দিয়েছেন। বাংলাদেশে সক্ষম দম্পতিদের ৬৪% কোনো না কোনো পরিবার পরিকল্পনাপদ্ধতি ব্যবহার করছেন। ব্যবহারকারীদের মধ্যে আধুনিক পরিবার পরিকল্পনাপদ্ধতি ব্যবহারের হার মাত্র ৫৫%, যাদের প্রায় ৯০% নারী। উপরন্তু, পরিবার পরিকল্পনাপদ্ধতি ব্যবহার করার ক্ষেত্রে নারীরা এখনো সিদ্ধান্ত নিতে নির্ভর করছে পরিবারের অন্যান্য সদস্য, বিশেষ করে পুরুষদের ওপর। অপরদিকে আমাদের দেশে ১৬৮ জন মা সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে মৃত্যুবরণ করছেন, যা পৃথিবীর উচ্চ মাতৃমৃত্যুভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম। ( তথ্যসূত্র: এসআরভিএস ২০২১, বিডিএইচএস, ২০২২)।

পরিবার পরিকল্পনার ২০৩০ লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের অঙ্গীকার অনুযায়ী বাংলাদেশ ২০৩০ সালের মধ্যে এমন একটি দেশে পরিণত হতে চায়, যেখানে সবাই, বিশেষত নারী ও কিশোরীরা সুস্থ ও নিরাপদে জীবন যাপন করতে পারবে, ন্যায্য ও বৈষম্যহীনভাবে পরিবার পরিকল্পনা ও প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণ করতে পারবে। ২০১৯ সালে অনুষ্ঠিত নাইরোবি সম্মেলনে (আইসিপিডি+২৫) বাংলাদেশ সরকার তিনটি খাতের ফল শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনার অঙ্গীকার করেছে। এই তিনটি খাত হলো: প্রতিরোধযোগ্য মাতৃমৃত্যু, পরিবার পরিকল্পনার অপূর্ণ চাহিদা ও জেন্ডারভিত্তিক সহিংসতা।

প্রজনন স্বাস্থ্যসবায় জেন্ডারবৈষম্য দূর করতে একদিকে যেমন প্রয়োজন সামাজিক রীতিনীতির পরিবর্তন, তেমনি সেবা খাতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে প্রয়োজন প্রযুক্তিনির্ভর উন্নয়নের।

আমরা জানি, বর্তমান বাংলাদেশে মোট জনসংখ্যার একটি বড় অংশ হলো তরুণ প্রজন্ম এবং আগামীতে তারাই দেশের নেতৃত্ব দেবেন। তাঁদের সুস্থতা ও সার্বিক কল্যাণ নিশ্চিত করতে প্রয়োজন যুগোপযোগী প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা। তারই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ জনসংখ্যা নীতি ২০১২–এর হালনাগাদ করার ক্ষেত্রে কৈশোরকালীন প্রজনন স্বাস্থ্যের ওপর জোর দিচ্ছে। পাশাপাশি সবার বৈষম্যহীনভাবে ও সহজে সেবা প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে জেন্ডারভিত্তিক সমতা, স্বাস্থ্যসেবায় প্রযুক্তির ব্যবহার বৃদ্ধিসহ নানাবিধ উদ্যোগের প্রয়োজন।

এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকারকে জেন্ডার সমন্বিত পরিবার পরিকল্পনার সেবা, পরিবার পরিকল্পনাসেবায় জেন্ডারভিত্তিক সহিংসতা নিরসন এবং অনলাইনে কৈশোরবান্ধব প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা ও তথ্য প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে সহায়তা করছে ইউএসএআইডি সুখী জীবন প্রকল্প। পাথফাইন্ডার ইন্টারন্যাশনালসহ বাংলাদেশ সরকারের সব উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা এ ক্ষেত্রে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করবে, দেশের উন্নয়নে ও জনগণের প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে অব্যাহত রাখবে সার্বিক সহযোগিতা—এই আশাবাদ আমাদের।

  • মো. মাহবুব উল আলম প্রকল্প পরিচালক, ইউএসএআইডি সুখী জীবন প্রকল্প, কান্ট্রি ডিরেক্টর, পাথফাইন্ডার ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ।

  • হালিমা আক্তার প্রোগ্রাম কোঅর্ডিনেটর, ইউএসএআইডি সুখী জীবন প্রকল্প।