এ দেশে একদিন নারী-পুরুষের সমতা প্রতিষ্ঠিত হবে

স্যার ফজলে হাসান আবেদ।  ছবি: কবির হোসেন
স্যার ফজলে হাসান আবেদ। ছবি: কবির হোসেন
>

স্যার ফজলে হাসান আবেদ জীবনের শেষ সাক্ষাৎকারটি দিয়েছিলেন প্রথম আলোকে। ব্র্যাক থেকে তিনি তখন অবসর নিয়েছেন। নতুন নেতৃত্ব এসেছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় বেসরকারি সংস্থাটিতে। নেতৃত্ব পরিবর্তনের নানা দিক, ব্র্যাক নিয়ে তাঁর ভাবনা এবং বাংলাদেশ নিয়ে তাঁর স্বপ্ন-এসব নিয়ে গত ৩ অক্টোবরে তিনি প্রথম আলোর প্রশ্নের িলখিত বিস্তারিত জবাব দেন। সাক্ষাৎকারটি প্রথম আলোর সোমবারের ক্রোড়পত্র প্র বাণিজ্যে প্রকাশিত হয়। কোনো গণমাধ্যমের কাছে দেওয়া তাঁর জীবনের শেষ সেই সাক্ষাৎকারটি এখানে প্রকাশ করা হলো। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন শওকত হোসেন

প্রথম আলো: শুরু করেছিলেন একটি চিন্তা নিয়ে, সেটা কী ছিল। আর এখন ব্র্যাক যে পর্যায়ে গেছে, এটাই কি আপনার চিন্তা বা পরিকল্পনায় ছিল? কী কী করতে চেয়েছিলেন?

স্যার ফজলে হাসান আবেদ: ছোটবেলা থেকে আমি বেড়ে উঠেছি যথেষ্ট সচ্ছল পরিবেশে। তরুণ বয়সে এনজিও গড়ে তুলে বাংলাদেশের প্রত্যন্ত গ্রামে গিয়ে কাজ করব, এ রকম কোনো ভাবনা আমার একেবারেই ছিল না। ১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বর বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকায় যে ভয়ংকর ঘূর্ণিঝড় হয়েছিল, তার ক্ষয়ক্ষতি সরেজমিনে দেখতে আমি মনপুরা দ্বীপে গিয়েছিলাম। সেখানে দেখলাম পানিতে শত শত মানুষ আর গরু-ছাগলের মৃতদেহ একই সঙ্গে ভাসছে! এই দৃশ্য আমাকে ভীষণভাবে নাড়া দিয়েছিল। আমার মনে হয়েছিল, গরিব মানুষদেরই সবচেয়ে বেশি জীবন দিতে হয়। মনে হলো, দরিদ্র মানুষের জীবন এবং জগৎ থেকে আমি সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন। এর ঠিক পরপরই আমাদের মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলো। এবার লাখ লাখ মানুষকে যুদ্ধে মৃত্যুবরণ করতে দেখলাম। এসব ঘটনা আমাকে সম্পূর্ণই বদলে দিল। মুক্তিযুদ্ধের সময় লন্ডনে আমরা কয়েকজন বন্ধু মিলে ‘অ্যাকশন বাংলাদেশ’ নামে একটি সংগঠন গড়ে তুলেছিলাম। এর মাধ্যমে আমরা মুক্তিযুদ্ধের জন্য তহবিল সংগ্রহ করতাম। সেই সঙ্গে ব্রিটেন এবং ইউরোপের বিভিন্ন দেশের সরকারের কাছ থেকে বাংলাদেশের পক্ষে স্বীকৃতি এবং সমর্থন আদায়ের চেষ্টা চালাতাম।

১৯৭২ সালের শুরুর দিকে আমি লন্ডন থেকে বাংলাদেশে ফিরে আসি এবং যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের এক প্রত্যন্ত অঞ্চল সুনামগঞ্জের শাল্লায় প্রায় দুই লাখ মানুষের কাছে ত্রাণসামগ্রী পৌঁছে দেওয়া এবং পুনর্বাসনের কাজ শুরু করি। সে সময় বাংলাদেশে দারিদ্র্য এতটাই প্রকট ছিল যে আমি বুঝেছিলাম, ত্রাণকাজ শেষ হলেও এই মানুষদের এভাবে ফেলে যাওয়া সম্ভব নয়। বাংলাদেশ তখন বিশ্বের দ্বিতীয় দরিদ্রতম দেশ। আমাদের মাথাপিছু আয় ছিল ৭০ ডলারের নিচে। তার ওপর জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ছিল শতকরা ৩ ভাগ। একেকজন নারী গড়ে ছয়টির বেশি সন্তান জন্মদান করতেন। পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি গ্রহণের চল ছিল না বললেই চলে। সব মিলিয়ে দারিদ্র্য বিমোচন ছিল এক বিশাল চ্যালেঞ্জ।

সদ্য স্বাধীন যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে আমি যখন ব্র্যাক শুরু করেছিলাম, দেশের মানুষকে বাঁচাতে হবে—এটাই ছিল তখন একমাত্র ভাবনা। কখনো ভাবিনি যে ব্র্যাক একদিন পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ এনজিও হবে কিংবা দেশের সীমানা ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে কাজের বিস্তার ঘটাবে।

ব্র্যাককে আমরা বলি ‘লার্নিং অর্গানাইজেশন’। কাজ করতে গিয়ে আমরা প্রতিদিনের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়েছি। আমরা দেখেছি, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের চাহিদা এবং প্রত্যাশাগুলো বদলাতে থাকে। দেশে এখন জনসংখ্যার সবচেয়ে বড় অংশ হচ্ছে যুবসমাজ। তাদের জন্য পর্যাপ্ত সুযোগ সৃষ্টি করা, ভবিষ্যতের উপযোগী করে তাদের গড়ে তোলা—এসবই এখন আমাদের অন্যতম লক্ষ্য। তাই সময়ের প্রয়োজনের সঙ্গে তাল রেখে আমাদের কাজের কৌশল, সেবা দেওয়ার ধরন, অর্থায়ন এসব ক্ষেত্রে ব্র্যাকে প্রতিনিয়তই পরিবর্তন ঘটছে।

প্রথম আলো: আপনি বাংলাদেশের খারাপ অবস্থাগুলো দেখেছেন। দুর্যোগ, দুর্ভিক্ষ, শরণার্থী, অর্থনৈতিক অব্যবস্থা এসব। আবার আপনি বাংলাদেশের অনেক ভালো কিছুও দেখছেন। অর্থনীতিতে এগিয়ে যাচ্ছে, সামাজিক সূচকে বাংলাদেশ অনেক দেশের চেয়ে ভালো করছে। এই বাংলাদেশ নিয়ে আপনার মূল্যায়ন কী? আবার এই অগ্রযাত্রায় ব্র্যাকের অবদান কতটা ছিল বলে মনে করেন?

আবেদ: বেশ কিছু বিষয়ে আমরা দেশ হিসেবে দারুণ সাফল্য অর্জন করেছি। গত ৪৭ বছরে আমাদের শিশুমৃত্যু হার ২০০ থেকে কমে ৪০-এর নিচে দাঁড়িয়েছে, মাতৃমৃত্যু হার ৮০০ থেকে কমে ১৫৫-এর নিচে এবং জন্মের সময় প্রত্যাশিত গড় আয়ু ৪০ থেকে বেড়ে ৭০ বছর হয়েছে। অন্যদিকে জন্মহার, যা ১৯৭২ সালে ছিল ৬.৫ তা নেমে গেছে ২.২-এ।

বাংলাদেশের এই ঘুরে দাঁড়ানোর কৃতিত্ব একক কোনো প্রতিষ্ঠানের নয়। তবে আমাদের গর্ব এই, এসব সাফল্য অর্জনে ব্র্যাক সরকারের বিভিন্ন কর্মসূচি এবং উদ্যোগকে সার্বক্ষণিক সহায়তা জুগিয়ে গেছে। শিশুদের টিকাদান কর্মসূচি বাস্তবায়ন থেকে শুরু করে খাওয়ার স্যালাইনের প্রচার ও প্রসার, বিপুলসংখ্যক গ্রামীণ স্বাস্থ্যসেবাকর্মী গড়ে তোলা, মায়েদের জন্য নিরাপদ প্রসবের ব্যবস্থা করা, যক্ষ্মারোগ মোকাবিলা থেকে শুরু করে পয়োনিষ্কাশন ও পরিচ্ছন্নতা ইত্যাদি জনস্বাস্থ্য বিষয়ে ব্র্যাকের কর্মকাণ্ড দেশের স্বাস্থ্যসংক্রান্ত প্রতিটি অর্জনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।

গত ৪৪ বছরে বাংলাদেশের সাক্ষরতার হার ২৫ থেকে বেড়ে ৬৫ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। স্বাস্থ্যের মতো শিক্ষাক্ষেত্রেও বাংলাদেশের সার্বিক অগ্রগতিতে ব্র্যাকের তাৎপর্যপূর্ণ অবদান রয়েছে। এ পর্যন্ত প্রায় ১ কোটি ২০ লাখের বেশি শিশু ব্র্যাকের প্রাথমিক ও প্রাক্‌-প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে শিক্ষালাভ করেছে, যাদের ৬০ শতাংশের বেশি মেয়ে। অন্যদিকে আমাদের রয়েছে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়। দেশের উচ্চশিক্ষা ও গবেষণাক্ষেত্রে উৎকর্ষের অন্যতম কেন্দ্র হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়টি ইতিমধ্যে সুনাম অর্জন করেছে।

গত ৪৭ বছরে দেশের জনসংখ্যা দ্বিগুণ হলেও শ্রমশক্তি বেড়েছে সাড়ে তিন গুণ। মজুরিশ্রমের বাজারে বিপুলসংখ্যক নারীর প্রবেশ শ্রমশক্তি বৃদ্ধির একটি বড় কারণ। ক্ষুদ্রঋণ, প্রশিক্ষণ ও অন্যান্য সহায়তা দিয়ে এবং বাজারে প্রবেশের সুযোগ তৈরি করে দিয়ে আমরা লাখ লাখ দরিদ্র মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে সহায়তা করেছি। দরিদ্র মানুষের জন্য কর্মসংস্থান করতে গিয়ে আমরা হস্তশিল্প, হাঁস–মুরগি পালন, দুগ্ধজাত পণ্য, বীজ উৎপাদন ইত্যাদি বিভিন্ন ক্ষেত্রে শিল্প স্থাপনে অগ্রণী ভূমিকা রেখেছি।

আমি বলব, উন্নয়নের বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাংলাদেশ দারুণ সফল হয়েছে এবং সরকার ও অন্যান্য সংস্থার সঙ্গে ব্র্যাক সব সময় এই উন্নয়ন অভিযাত্রার অগ্রভাগে ছিল।

প্রথম আলো: ব্র্যাক ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেছে, বিশ্ববিদ্যালয় করেছে, আড়ং রয়েছে। এসব দিকে কেন গেলেন? এতে কি মূল কাজের কোনো সমস্যা হয়েছে?

আবেদ: আমরা কেন ব্যাংক গড়ে তুললাম, তার প্রেক্ষাপটটা বলি। ১৯৯৭ সালে আমরা একটা গবেষণা করেছিলাম। তাতে দেখা গেল, অতিদরিদ্র ১০ শতাংশ লোক ক্ষুদ্রঋণের সুবিধা পায় না। সেখানে আরেকটা চিত্র ছিল, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরাও ঋণ পায় না। তারা দরিদ্রও নয়, অতিদরিদ্রও নয়, আবার সচ্ছলও নয়। দরিদ্র মানুষ ঋণ পেতে পারে, আবার যারা সচ্ছল, তারাও ঋণ পেতে পারে। কিন্তু এদের কী হবে? সেই চিন্তা থেকেই ব্র্যাক ব্যাংক করতে যাওয়া, যাতে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের ঋণ দেওয়া যায়।

ইউনিভার্সিটি প্রতিষ্ঠার পেছনে আমাদের ভাবনা ছিল, আমরা যদি কিছু শিক্ষিত মানুষ তৈরি করতে পারি, যারা দরিদ্রদের নিয়ে কাজ করতে চায়। তাহলে তো আমাদের মতো মানুষ আরও পাওয়া সম্ভব, যারা সমাজের জন্য দায়িত্বশীল ভূমিকা রাখতে চায়। আর সেটা যদি আমাদের ইউনিভার্সিটির মাধ্যমে করতে পারি, আমাদের শিক্ষা ইনস্টিটিউটের মাধ্যমে যদি শিক্ষার মান উন্নয়ন করতে পারি, সিভিল সার্ভেন্টদের ডিগ্রি দিয়ে যদি সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হয়, তবে দেশের কিছু লাভ হবে।

শুরু থেকেই আমাদের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে আমরা দরিদ্র মানুষের স্বাবলম্বী হয়ে ওঠার জন্য সুযোগ তৈরি করতে চেয়েছি। আমরা দেখেছি, বিভিন্ন উপার্জনমূলক কাজের সঙ্গে যুক্ত হয়ে স্বাবলম্বী হওয়ার মাধ্যমে দরিদ্র মানুষ নিজেরাই নিজেদের ভাগ্য ফেরাতে পারে। এই লড়াইয়ে আমরা তাদের পাশে থেকে সহায়তা জুগিয়েছি। আর সেগুলো করতে গিয়ে আমাদের একাধিক সোশ্যাল এন্টারপ্রাইজ গড়ে উঠেছে।

যেমন ধরুন, গ্রামের দরিদ্র মহিলারা ব্র্যাকের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে হাঁস–মুরগি পালন করেছে। তারা যাতে লাভজনকভাবে এটি করতে পারে, তার জন্য বিদেশ থেকে উন্নত মানের মুরগির বাচ্চা নিয়ে এসেছি। চাহিদা বাড়তে থাকায় দেশেই গড়ে তুলেছি বিশাল আকারের হ্যাচারি ফার্ম। হাঁস–মুরগির রোগবালাই দমনের জন্য ভ্যাকসিনের ব্যবস্থা করেছি। অসংখ্য মহিলাকে ভ্যাকসিনেটরের প্রশিক্ষণ দিয়েছি। উন্নত মানের খাবারের জন্য ফিড মিল গড়ে তুলেছি। ফিড মিলের জন্য ভুট্টার জোগান দিতে গিয়ে চাষিদের ভুট্টা চাষে উদ্বুদ্ধ করেছি। এরপর যখন অসংখ্য মানুষ সফলভাবে হাঁস–মুরগির চাষ করেতে পেরেছে, তখন তার বাজার নিশ্চিত করতে গিয়ে জন্ম হয়েছে ব্র্যাক পোলট্রির। ক্ষুদ্র পরিসর থেকে শুরু করা উদ্যোগ একসময় জাতীয় পর্যায়ের কর্মকাণ্ডে রূপ পেয়েছে।

আবার আড়ংয়ের কথা ধরুন। ১৯৭৬ সালের শুরুর দিকে আমরা মানিকগঞ্জে কাজ শুরু করি। লক্ষ্য ছিল, সেখানকার দরিদ্র মানুষ, বিশেষ করে নারীদের উপার্জনমূলক কাজের সঙ্গে যুক্ত করা। আমরা সেখানে রেশমচাষের একটি সম্ভাবনা দেখতে পাই। মানিকগঞ্জে প্রাকৃতিকভাবেই ভেরেণ্ডাগাছ জন্মায়। ভেরেণ্ডা পাতা রেশম পোকার খাদ্য। এই পাতা খেয়ে পোকা যে রেশম তৈরি করে, তাকে বলে ‘এনডি সিল্ক’। আমরা তখন ওই এলাকায় ভেরেণ্ডাগাছ লাগাতে শুরু করি এবং দরিদ্র মহিলাদের রেশম পোকা পালনের প্রশিক্ষণ দিই। প্রায় দু-তিন শ মহিলা এনডি রেশমের গুটি তৈরি করা শুরু করেন। এগুলোর গুটি থেকে সুতা বানিয়ে রেশমের কাপড় তৈরির কাজ শুরু হয়। এই সিল্ক কাপড়গুলো সে সময় বিক্রি করা হতো ঢাকার কয়েকটি দোকানে। সাধারণত কাপড় সরবরাহ করার দু-তিন মাস পর দোকান থেকে টাকা পাওয়া যেত। গরিব মানুষের পক্ষে দু-তিন মাস অপেক্ষা করাটা ছিল অসম্ভব ব্যাপার। আমরা তখন নিজেই একটি দোকান খোলার কথা চিন্তা করলাম, যেখানে উৎপাদকেরা পণ্য দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে টাকা পেয়ে যাবেন। এই ভাবনা থেকেই ১৯৭৮ সালে প্রতিষ্ঠা হয় আড়ংয়ের।

আমাদের প্রতিটি কর্মকাণ্ডই গড়ে উঠেছে কোনো না কোনো সামাজিক প্রয়োজন মেটাতে গিয়ে।

প্রথম আলো: ব্র্যাককে আফগানিস্তানে নিয়ে গেলেন। সেখানকার অভিজ্ঞতাটা কী?

আবেদ: যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশে যেভাবে শুরু করেছিলাম, যুদ্ধবিধ্বস্ত আফগানিস্তানেও একইভাবে কাজ শুরু করেছিলাম আমরা। তবে আফগানিস্তানের অবস্থা ছিল আরও শোচনীয়। মাইনে ভরা সারা আফগানিস্তান। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি সব ক্ষেত্রেই তখন মারাত্মক অবস্থা বিরাজ করছিল। ২০০২ সালে মেয়েদের জন্য ৯০টি প্রাইমারি স্কুল দিয়ে আমরা সেখানে কাজ শুরু করি। এরপর একে একে ক্ষুদ্রঋণ, স্বাস্থ্যসহ নানা ক্ষেত্রে কর্মসূচির বিস্তার ঘটিয়েছি।

বর্তমানে আফগানিস্তানের ৩২টি প্রদেশের মধ্যে ১৪টি প্রদেশের প্রায় ৯৫টি জেলায় আমাদের কার্যক্রম রয়েছে। শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য কর্মসূচিসহ সেখানকার একাধিক প্রদেশে আমরা সরকারের সঙ্গে মিলে স্থানীয় সরকারব্যবস্থা জোরদার করার জন্য কাজ করছি। সামাজিক ক্ষমতায়নের জন্য আমরা সাধারণ মানুষকে জেন্ডারসমতা, নারী ও শিশুদের অধিকার এসব বিষেয়ে সচেতন করে তুলছি। তাদের সামর্থ্য এবং দক্ষতা বাড়ানোর জন্য বিভিন্ন ধরনের কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করছি।

সামাজিক কর্মকাণ্ডগুলোতে যাতে নারীদের অংশগ্রহণ বাড়িয়ে তোলা যায়, তার ওপর বিশেষ জোর দিয়েছি। আফগানিস্তানে মাঠপর্যায়ে যারা ব্র্যাকের সঙ্গে কাজ করছে, তাদের বেশির ভাগই নারী। তারা এখন একা একাই বোরকা পরে বাসে চড়ে গ্রামে যাচ্ছে। শুরুতে তারা এগুলো করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করত না। আসলে এটা অনেক সময় আত্মবিশ্বাসের ওপর নির্ভর করে। মেয়েরা যে সব কাজই সমানভাবে করতে পারে, এই প্রত্যয় আমরা বাংলাদেশে কাজ করতে গিয়েই অর্জন করেছি। সেই অভিজ্ঞতা থেকেই আমাদের এই আত্মবিশ্বাস এসেছে।

বাংলাদেশের উন্নয়ন ক্ষেত্রে আমাদের নিজস্ব উদ্ভাবনা এবং অর্জিত অভিজ্ঞতা অন্য একটি দেশের মানুষের জীবনমান উন্নয়নে কীভাবে কাজে লাগতে পারে, আফগানিস্তান থেকে আমরা সেই শিক্ষা এবং আত্মবিশ্বাস অর্জন করেছি। এই অভিজ্ঞতা আমাদের পৃথিবীর আরও অনেক দেশে কর্মসূচির বিস্তার ঘটাতে সাহস জুগিয়েছে।

প্রথম আলো: নেতৃত্বে পরিবর্তন এনেছেন। বাংলাদেশে অন্য যাঁরা এসব নিয়ে ভাববেন, কী কী বিষয় তাঁদের মনে রাখতে হবে? নেতৃত্ব পরিবর্তনের সবচেয়ে ভালো পথটি কী?

আবেদ: ২০০১ সালে যখন আমি ৬৫ বছর পূর্ণ করলাম, তখন ঠিক করলাম, ব্র্যাকের নেতৃত্ব অন্যদের কাছে হস্তান্তর করতে হবে। আমি নির্বাহী পরিচালকের পদ থেকে পদত্যাগ করে বোর্ডের সদস্য হলাম। সে সময় ব্র্যাকের চেয়ারম্যান ছিলেন সৈয়দ হুমায়ুন কবীর। তিনি প্রস্তাব করলেন, ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাতারই প্রতিষ্ঠানের চেয়ারপারসন হওয়া উচিত। তখন থেকেই আমি ব্র্যাকের চেয়ারপারসন হলাম।

বিগত কয়েক বছরে আমি ব্র্যাকে আমার পরবর্তী নেতৃত্ব নিয়ে অনেক ভেবেছি এবং সেভাবেই প্রস্তুতি নিয়েছি। ব্র্যাককে আমি ব্যক্তিনির্ভর না করে সব সময়ই সংগঠন হিসেবে দাঁড় করাতে চেয়েছি। সব সময় এমন একটি ব্যবস্থা গড়ে তুলতে চেয়েছি, যাতে আমার অবর্তমানেও ব্র্যাক তার শ্রেষ্ঠত্ব ধরে রাখতে পারে। এ জন্য আমি একটি পেশাদার এবং সুশৃঙ্খল পালাবদল নিশ্চিত করতে চেয়েছি।

এই পরিপ্রেক্ষিতে আমার মনে হয়েছে, চেয়ারপারসন হিসেবে ব্র্যাক এবং ব্র্যাক ইন্টারন্যাশনালের বোর্ডের সক্রিয় ভূমিকা থেকে সরে দাঁড়ানোর এটিই সঠিক সময়। তাই আমি ব্র্যাক বাংলাদেশের পরিচালনা পর্ষদ এবং ব্র্যাক ইন্টারন্যাশনাল সুপারভাইজরি বোর্ডের চেয়ারপারসন পদ থেকে অবসর নিয়েছি। ব্র্যাকের পরিচালনা পর্ষদ আমাকে ব্র্যাকের চেয়ার ইমেরিটাস নির্বাচিত করেছেন। এখন আমি ব্র্যাকের ভবিষ্যৎ কর্মকৌশল এবং পরিচালনা কাঠামো নির্ধারণের বিষয়ে মনোযোগ দেব।

প্রতিষ্ঠানের ভেতরে সঠিক নেতৃত্বের উত্তরাধিকার সৃষ্টি করতে পারাটা জরুরি। নেতৃত্ব সৃষ্টির পূর্বশর্ত হচ্ছে একটি শক্তিশালী প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কৃতি গড়ে তোলা। আমরা সব সময় ব্র্যাকের নিজস্ব সংস্কৃতি গড়ে তোলার ক্ষেত্রে বিশেষ মনোযোগ দিয়েছি। মূল্যবোধনির্ভর প্রতিষ্ঠান হিসেবে ব্র্যাককে গড়ে তুলতে চেয়েছি। সব কর্মীর মধ্যে উদ্যোক্তার দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তোলা, উদ্ভাবন সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টি করা, সবকিছুকে প্রশ্ন করতে পারা এবং অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নেওয়ার মাধ্যমে বিকশিত হওয়ার ধারা চালু করতে পেরেছি। আমার বিশ্বাস, নতুন নেতৃত্ব আমার অবর্তমানে এই সংস্কৃতির ধারা অব্যাহত রাখতে সচেষ্ট এবং সক্ষম হবেন। ব্র্যাকের মূল্যবোধগুলো সমুন্নত রাখতে কাজ করবেন।

প্রথম আলো: নতুন যাঁরা নেতৃত্বে এলেন, তঁাদের প্রতি আপনার প্রত্যাশা কী?

আবেদ: আগেই বলেছি, আমি ব্র্যাক বাংলাদেশের পরিচালনা পর্ষদ এবং ব্র্যাক ইন্টারন্যাশনাল সুপারভাইজরি বোর্ডের চেয়ারপারসন পদ থেকে অবসর নিয়েছি। এই পদ দুটিতে দায়িত্ব পালনের জন্য অত্যন্ত যোগ্য দুজন ব্যক্তিত্বকে আমি নির্বাচন করেছি। ড. হোসেন জিল্লুর রহমান ও আমিরা হক এখন থেকে ব্র্যাক এবং ব্র্যাক ইন্টারন্যাশনালের চেয়ারপারসন হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন। সেই সঙ্গে ব্র্যাক ইন্টারন্যাশনালের নির্বাহী পরিচালক হিসেবে ডা. মুহাম্মাদ মুসা এবং ব্র্যাক বাংলাদেশের নতুন নির্বাহী পরিচালক হিসেবে আসিফ সালেহ্ দায়িত্ব পেয়েছেন। এখন ব্র্যাক ও ব্র্যাক ইন্টারন্যাশনালের নির্বাহী পরিচালকেরা সার্বিক ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব পালন করবেন। নতুন চেয়ারপারসন ও বোর্ড তাঁদের পরামর্শ ও স্বচ্ছভাবে পরিচালনার জন্য দিকনির্দেশনা দেবেন।

ব্র্যাককে সামনে এগিয়ে নেওয়ার কাজে যথাযোগ্য নেতৃত্ব নির্বাচনের বিষয়টি ছিল আমার সিদ্ধান্তের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। গর্ব এবং আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে আমি এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছি। ডা. মুহাম্মাদ মুসা ও আসিফ সালেহর সক্ষমতা ও বিচক্ষণতার ওপর আমার পূর্ণ আস্থা রয়েছে। ব্র্যাকের এই নতুন নেতৃত্বকে নিয়ে আমি ভীষণ আশাবাদী। আমার বিশ্বাস, তাঁদের নেতৃত্বে ব্র্যাককে শোষণমুক্ত পৃথিবী গড়ার পথে আরও এগিয়ে নিয়ে যাবে এবং ব্র্যাকের ভেতর থেকেই নতুন নেতৃত্ব তৈরি হওয়ার এই সংস্কৃতি ভবিষ্যতেও অব্যাহত থাকবে।

প্রথম আলো: বাংলাদেশ নিয়ে আপনার স্বপ্নটা কী?

আবেদ: বাংলাদেশ অনেক ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করলেও একটি বিষয়ে আমাদের পশ্চাৎপদতা যাবতীয় অর্জনকে প্রশ্নবিদ্ধ করে চলেছে। আর সেটি হলো জেন্ডারসাম্য অর্জনে আমরা প্রত্যাশিত সাফল্য দেখাতে পারিনি। আমাদের অনেক প্রচেষ্টা সত্ত্বে¡ও পিতৃতান্ত্রিকতা এখনো আমাদের সামাজিক জীবনে শিকড় গেড়ে বসে আছে।

আমি এ দেশে অদূর ভবিষ্যতে নারী–পুরুষের সমতা প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখি। আমি আমার জীবনকালে হয়তো এটা দেখে যেতে পারব না। সম্ভবত এটি আমার জীবনের অসমাপ্ত অ্যাজেন্ডা হিসেবে থেকে যাবে। আমি অত্যন্ত দুঃখ বোধ করি, যখন দেখি আজও নারীর ওপর পীড়ন ও নির্যাতনের অবসান হয়নি। এখন পর্যন্ত নারীরা পুরুষের তুলনায় কম মজুরির বিনিময়ে বেশি কাজ করে এবং এখনো কিছু নির্দিষ্ট পেশা ও কার্যক্রম থেকে পদ্ধতিগতভাবে তাদের দূরে সরিয়ে রাখা হয়। এখনো দেশে বহু মেয়ের বাল্যবিবাহ হয় এবং তাদের এক-তৃতীয়াংশের বেশি পারিবারিক সহিংসতার শিকার হয়। অথচ সমাজের উন্নয়ন ও পারিবারিক সুখ–শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য নারী–পুরুষের সমতা অত্যন্ত প্রয়োজন। তবে আমি বিশ্বাস করি, আমাদের দেশ অবশ্যই নারী–পুরুষ সমতার দিকে দ্রুত অগ্রসর হবে এবং সমাজপ্রগতির পথে আমাদের অগ্রগতি ত্বরান্বিত হবে।

প্রথম আলো: ভবিষ্যতের ব্র্যাক নিয়ে আপনার স্বপ্নটা কী?

আবেদ: ব্র্যাকের সাফল্য অনেক, তবে সামনে আমাদের বহু চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করতে হবে। এই চ্যালেঞ্জগুলো দিনের পর দিন আরও জটিল হতে থাকবে। তবে এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ যে আমরা আমাদের অগ্রাধিকারগুলোকে চিহ্নিত করতে পেরেছি। জনসংখ্যার চাপ, নগরায়ণ ও জলবায়ু পরিবর্তন আমাদের সামনে নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ নিয়ে আসবে। বাংলাদেশ এবং বিশ্বের অন্য যে দেশগুলোতে আমরা কাজ করছি, সেখানে ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় নতুন ও উদ্ভাবনী সমাধান বের করতে হবে। আর এই কাজে তরুণ প্রজন্মের অমিত সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে হবে।

একটা প্রতিষ্ঠানকে যদি টিকে থাকতে হয়, তবে সমাজের সঙ্গে প্রতিনিয়ত তার সম্পৃক্ততা বাড়াতে হবে এবং বুঝতে হবে, কখন সমাজের জন্য কী প্রয়োজন। একেক সময় একেকটা ধারা আসবে, চাহিদা আসবে, প্রয়োজনীয়তা আসবে। নতুন কর্মসূচি গ্রহণ করে সেই প্রয়োজনীয়তা যদি পূরণ করতে পারি, তবে মানুষের কাছে ব্র্যাক গ্রহণযোগ্যতা হারাবে না। আমি এখন ব্র্যাকের কর্মীদের সেই পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছি, নতুন কী করা যায়, সমাজের চাহিদা কী, এটা কীভাবে মোকাবিলা করা যায়, কীভাবে তা পূরণ করা যায়, সেটাই সব সময় ভাবতে হবে।

আগামী ১০ বছরে আমরা আমাদের কাজের প্রভাব পৃথিবীর আরও বেশি মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে চাই। ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বের ২৫০ মিলিয়ন মানুষের কাছে ব্র্যাক যেন পৌঁছে যায়, সেটিই আমার প্রত্যাশা। আমি স্বপ্ন দেখি, ব্র্যাক আগামীতে আরও বড় হবে, নতুন উদ্ভাবন চালিয়ে যাবে এবং নতুন দিনের প্রয়োজনে নতুন সমাধান নিয়ে এগিয়ে আসবে।

প্রথমআলো: আপনি কাকে অনুসরণ করছেন, আপনার জীবনে কার প্রভাব বেশি?

আবেদ: আমার মা, সৈয়দা সুফিয়া খাতুন।

প্রথমআলো: আপনার প্রিয় কবিতা, প্রিয় গান?

আবেদ: প্রিয় কবিতা রবিঠাকুরের ‌‘শাহজাহান’ আর প্রিয় গান রবিঠাকুরের ‘তুমি রবে নীরবে’।