টিকাসংকটের কারণ অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস

অধ্যাপক ডা. মো. সায়েদুর রহমান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মাকোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান। প্রথম আলোর সঙ্গে তিনি কথা বলেছেন করোনা পরিস্থিতির ব্যবস্থাপনা, টিকা সংগ্রহ, টিকার কার্যকারিতা ও জনসচেতনতা বিষয়ে।

সাক্ষাৎকার নিয়েছেন এ কে এম জাকারিয়া

মো. সায়েদুর রহমান
প্রশ্ন:

প্রথম আলো: বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রধান সম্প্রতি বলেছেন, যেসব দেশে করোনা সংক্রমণ চলেছে ও মানুষ মরছে, সেখানে এখনই টিকা দরকার, আগামী বছর নয়। এখনই টিকা পাওয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের বাস্তব পরিস্থিতি কী?

মো. সায়েদুর রহমান: এটা উনি হয়তো বলেছেন, কিন্তু বাস্তবে এটা কোনো অর্থ বহন করে না। এখন যেভাবে টিকা দেওয়া হচ্ছে এটা করোনা মোকাবিলায় কতটা ভূমিকা রাখতে পারবে, সেটা এক বড় প্রশ্ন। বাংলাদেশে মাত্র ৩ ভাগ মানুষকে টিকা দেওয়া গেছে। সারা বিশ্বে পেয়েছে ৬ ভাগ মানুষ। বিশ্বের কোনো দেশে তা ৫০ ভাগের বেশি। বছরজুড়ে প্রতিদিন টিকা দেওয়ার বিষয়টি বৈজ্ঞানিকভাবেও খুব কার্যকর হওয়ার কথা নয়। সারা বিশ্বে যদি একই দিনে সবাইকে টিকা দেওয়া যেত, সেটা হতো সবচেয়ে কার্যকর পদ্ধতি। সেটা যেহেতু আমরা পারছি না, সে ক্ষেত্রে উচিত ছিল হয় কোনো একটি শহরে, কোনো একটি জেলায় বা কোনো একটি গ্রামে এক দিনে সবাইকে টিকা দিয়ে দেওয়া। এখন যেভাবে টিকা দেওয়া হচ্ছে তাতে ভাইরাস মিউটেটেড হওয়ার সুযোগ পাচ্ছে। যদিও বিশ্বে টিকা উৎপাদনের সামর্থ্য বেড়েছে, অবিশ্বাস্য দ্রুতগতিতে টিকা আবিষ্কার ও তৈরি হয়েছে। কিন্তু মূল সমস্যা হচ্ছে বৈষম্য, যার সঙ্গে তাল মেলানো বাংলাদেশের জন্য হয়ে উঠেছে কঠিন। এক বছরের মধ্যে বাংলাদেশের জন্য অন্তত ২৬ কোটি ডোজ টিকা প্রয়োজন। কিন্তু তা সংগ্রহের বাস্তব পরিস্থিতি নেই।

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: ভারত টিকা রপ্তানি বন্ধ করে দেবে, এটা জানা ছিল না। অনেকেই বলছেন টিকার জন্য একটি উৎসের ওপর নির্ভর করা ঠিক হয়নি।

মো. সায়েদুর রহমান: যখন ভারত থেকে টিকা কেনার সিদ্ধান্ত হয়েছে, তখনকার বাস্তবতায় সেটাই ছিল একমাত্র পথ। তখন টিকা ছিল তিনটি—ফাইজার, মডার্না ও অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা। ভারতে তৈরি অ্যাস্ট্রাজেনেকা ছাড়া তখন আমাদের সামনে আর কোনো পথ ছিল না। কিন্তু পরে বিশ্বে বিভিন্ন টিকা আবিষ্কৃত হতে থাকা অবস্থায়ও আমাদের এক উৎসের ওপর নির্ভর করে থাকা ঠিক হয়নি। আমরা নিজেদের চলমান গবেষণাগুলোর সঙ্গে যুক্ত করে অংশগ্রহণের মাধ্যমে অংশীদারত্ব নিশ্চিত করার পথেও অগ্রসর হতে পারিনি। এরপর বাজারে অনেক দেশের টিকা এসেছে। সেই টিকা কেনার ব্যাপারেও আমরা তেমন এগোতে পারিনি, এটা আমাদের ব্যর্থতা। সমস্যা হয়েছে, শুরুতে তিন কোটি ডোজ টিকার সংস্থান হয়েছে ভেবেই আমরা আত্মতুষ্টিতে ভোগা শুরু করেছি। যেখানে আমাদের দরকার ২৬ কোটি ডোজ টিকার, সেখানে তিন কোটি ডোজের আশ্বাস পেয়েই আমরা অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠেছিলাম।

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: হাতে যে টিকা ছিল, তাতে দুই ডোজ করে টিকা দিলে যে সংখ্যক মানুষকে দেওয়া যায়, তার চেয়ে বেশি মানুষকে প্রথম ডোজ দেওয়া হলো কোন বিবেচনা থেকে?

মো. সায়েদুর রহমান: আগেই বলেছি অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস থেকে এমন হয়েছে। শুধু একটু সচেতন ও সতর্ক থাকলেই যাঁকে প্রথম ডোজ টিকা দেওয়া হয়েছে, তাঁর জন্য দ্বিতীয় ডোজটির সংরক্ষণ নিশ্চিত করা সম্ভব ছিল। আমরা পরামর্শ দিয়েছিলাম দ্বিতীয় ডোজ শুরুর আগে প্রথম ডোজের টিকা দেওয়া এক–দুই সপ্তাহের জন্য বন্ধ করতে। সেটা করা হয়নি। এটা করা গেলে ব্যবস্থাপনাগত সুবিধা হতো। কিছুদিন পর সেটা বন্ধ করা হয়েছে। আর সরকারের লোকজন খুবই আত্মবিশ্বাসী ছিলেন যে ভারতীয় টিকা আসবেই। আমরা বিবেচনায় নিতে পারিনি যে এই পরিস্থিতি অনেকটা যুদ্ধাবস্থার মতো। বিষয়টি শুধু স্বাস্থ্যসংক্রান্ত নয়। স্বাস্থ্য একটি ফ্রন্ট মাত্র। যেমন লকডাউন বাস্তবায়নের সঙ্গে সরকারের অনেক মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্টতা আছে। মানুষকে সহায়তা বা প্রণোদনা দেওয়া সেটা ভিন্ন মন্ত্রণালয়ের কাজ। আমরা অনুধাবনে ব্যর্থ হয়েছিলাম যে টিকা কিনে আনা শুধু স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কাজ নয়, এখানে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বা কূটনীতিরও যুক্ততা রয়েছে। মহামারি ব্যবস্থাপনার বহুমাত্রিকতা বুঝতে না পারায় আমরা কার কী ভূমিকা, তা নির্ধারণ করতে পারিনি।

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: সবচেয়ে দ্রুততম সময়ে এখন কোনো দেশ থেকে টিকা পাওয়ার কোনো সম্ভাবনা রয়েছে কি?

মো. সায়েদুর রহমান: এখন আমরা বিভিন্ন দেশ থেকে টিকা কেনার চেষ্টা করছি। কিন্তু বাস্তবতা বিবেচনায় নিয়ে এবং আমি যতটুকু খোঁজখবর রাখি তাতে বলতে পারি যে এখন আমাদের যে টিকাগুলো পাওয়ার সম্ভাবনা বেশি, তার মধ্যে রাশিয়ার স্পুতনিক–ভি হচ্ছে সবচেয়ে সম্ভাবনাময়। চীন থেকে টিকা পাওয়ার সম্ভাবনাটিও এখনো আছে, কিন্তু একমাত্র রাশিয়ারই রাষ্ট্রীয়ভাবে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে টিকা দেওয়ার সামর্থ্য রয়েছে। আমি মনে করি, একটি সফল কূটনৈতিক তৎপরতাই পারে আমাদের জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যক টিকা অন্তত প্রথম বছরের জন্য জোগাড় করে আনতে।

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: ধরুন কেউ এক প্রতিষ্ঠানের তৈরি টিকার এক ডোজ নিয়েছেন, দ্বিতীয় ডোজটি অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানের হলে কোনো সমস্যা হওয়ার ঝুঁকি আছে কি?

মো. সায়েদুর রহমান: প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী প্রথম ডোজে যে টিকাটি দেওয়া হয়, দ্বিতীয় ডোজেও সেই কোম্পানির টিকাই দেওয়া হয়ে থাকে। এটি নিশ্চিত করার জন্য আদর্শ ব্যবস্থা হচ্ছে যাঁকে টিকা দেওয়া হচ্ছে, তাঁর জন্য দ্বিতীয় ডোজ সংরক্ষণ করা। এখন এক প্রতিষ্ঠানের প্রথম ডোজ টিকা ও দ্বিতীয় ডোজ অন্য প্রতিষ্ঠানের হলে ফলাফল কী হবে বা কত দিনের ব্যবধানে দ্বিতীয় ডোজটি দিলে তা কার্যকর হবে, এ–সংক্রান্ত একটি গবেষণার অন্তর্বর্তীকালীন ফলাফল ইতিমধ্যে প্রকাশিত হয়েছে। অন্য একটি চলমান গবেষণা যেটি যুক্তরাজ্যে পরিচালিত হচ্ছে, আশা করা যায় যে সেটির ফলাফলও ৩০ জুন নাগাদ প্রকাশিত হবে। তখন এ ব্যাপারে বিস্তারিত তথ্য জানা যাবে। বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে দুই ডোজ টিকার প্রথমটি হচ্ছে প্রাইম আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে বুস্টার। মনে করেন আপনি কোনো বিষয়ে একটি বই দুবার পড়লেন অথবা সেই বিষয়ে দুটি বই পড়লেন। এ দুই ক্ষেত্রে একটি বিষয়ে দুটি আলাদা বই পড়া বেশি ফলদায়ক হওয়ার সম্ভাবনাও আছে। বিজ্ঞানের সাধারণ সূত্র অনুসারে আমার ধারণা যে দুটি ভিন্ন ভিন্ন ধরনের বা কোম্পানির টিকা ক্ষেত্রবিশেষে বেশি কার্যকরীও হতে পারে।

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: যিনি দুই ডোজ টিকা নিয়েছেন, তিনি নিজেকে কতটা নিরাপদ মনে করতে পারেন?

মো. সায়েদুর রহমান: দুই ডোজ টিকা দেওয়ার পর এটা মনে করার কোনো কারণ নেই যে আপনি শতভাগ নিরাপদ। কেননা কোনো টিকাই শতভাগ কার্যকারিতা দাবি করেনি। তদুপরি এটা নির্ভর করবে আপনি কোন দেশে আছেন, সেখানকার মানুষের স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার ধরন কেমন, ভাইরাসের ধরন কী, কোন টিকা নিয়েছেন, নিজে মাস্ক পরেছেন কি না। তবে দুই ডোজ টিকা নেওয়ার পর করোনা ভাইরাসে মৃত্যুর আশঙ্কা নেই বললেই চলে। হাসপাতালে যাওয়ার আশঙ্কা ৯০ ভাগ কেটে যাবে, হাসপাতালে ভর্তি হলেও আইসিইউতে যাওয়ার আশঙ্কাও প্রায় শূন্যের কোঠায়।

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: টিকার কার্যকারিতার মেয়াদ সম্পর্কে কোনো ধারণা দেওয়া কি সম্ভব?

মো. সায়েদুর রহমান: সাধারণভাবে বলা যায় যে টিকা নেওয়ার ফলে যে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়, তা প্রতি ৩৬ দিন পর অর্ধেক হয় এবং সম্ভবত ছয় মাস পর্যন্ত তা নিরাপত্তা দিতে পারে। তবে মেমোরি সেলের মাধ্যমে অর্জিত প্রতিরোধক্ষমতা কয়েক বছর, এমনকি দশক ধরেও থেকে যেতে পারে। সে সময়ে কেউ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হলে শরীরের ইমিউন সিস্টেম ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য দ্রুত অ্যান্টিবডি তৈরি করতে পারবে। কিন্তু এই ক্ষমতার স্থায়িত্বকাল সম্পর্কে এখনো মন্তব্য করার সময় হয়নি, যেহেতু পর্যাপ্ত গবেষণালব্ধ তথ্য এখনো হাতে আসেনি।

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: বাংলাদেশে সরকারি বা বেসরকারি পর্যায়ে টিকা উৎপাদনের সম্ভাবনাকে কীভাবে দেখেন?

মো. সায়েদুর রহমান: আমরা একসময় টিকা উৎপাদন করতাম, অথচ এখন আমরা সেই ক্ষমতা হারিয়েছি। অথচ দেখেন যেসব দেশের ভ্যাকসিন বানানোর সক্ষমতা ছিল না, তারা এখন ভ্যাকসিন বানাচ্ছে। ভিয়েতনাম ও থাইল্যান্ডে করোনার টিকা তৈরি হচ্ছে। আর আমরা ৫০ বছর আগে যা পারতাম, এখন তা পারছি না। উচিত ছিল আমাদের টিকা তৈরির সক্ষমতাকে আধুনিকায়ন করা, সেটা না করে আমরা তা বন্ধ করে দিয়েছি। এখন বেসরকারি যেকোনো প্রতিষ্ঠান বাণিজ্যিকভাবে টিকা উৎপাদন করতেই পারে। কিন্তু এটা মনে রাখতে হবে যে টিকা যেহেতু প্রাণ রক্ষার উপাদান, সেটির ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণাধীন প্রতিষ্ঠানের সক্ষমতা থাকা প্রয়োজন। এটা পুরো দেশের জনগোষ্ঠীর নিরাপত্তার বিষয় এবং এবং বর্তমান বাস্তবতায় আমরা দেখছি যে টিকা সার্বভৌমত্বের একটি প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমরা দেখছি কিউবা বা ইরানের মতো দেশ বিশ্ব থেকে নানা কারণে বিচ্ছিন্ন থাকার পরও নিজেরা টিকা উৎপাদন করেছে এবং নাগরিকদের টিকার প্রাপ্যতা নিশ্চিত করেছে। রাষ্ট্রের দায়িত্ব চলমান মহামারি ও ভবিষ্যতের যেকোনো মহামারি মোকাবিলায় ভ্যাকসিন উৎপাদনের সক্ষমতা গড়ে তুলতে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার আওতায় বিনিয়োগ ও জনবল তৈরি করা।

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: সরকার করোনাকালীন ‘বিধিনিষেধ’ আরও এক মাস বাড়িয়েছে। আদৌ কি কোনো বিধিনিষেধ আমরা দেখতে পারছি?

মো. সায়েদুর রহমান: দেখুন লকডাউন বা বিধিনিষেধ হচ্ছে মহামারি নিয়ন্ত্রণের শেষ অস্ত্র। মাস্ক পরা, হাত ধোয়া, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা বা টিকা দেওয়া যখন সফল হবে না, হাসপাতালগুলো যখন রোগী দিয়ে ভরে যাবে, তখন লকডাউন দিতে হয়। আমরা টিকার পেছনে পয়সা খরচ করছি ঠিকই, কিন্তু আমরা মাস্কের পেছনে কত খরচ করেছি? সামাজিক দিকগুলোতেও আমরা গুরুত্ব দিতে ব্যর্থ হয়েছি। সামাজিক দায়বদ্ধতার অংশ হিসেবে দেশের বড় বড় প্রতিষ্ঠানগুলো কেন মাস্ক বিতরণ কার্যক্রম নিয়ে এগিয়ে আসছে না। মানুষকে সচেতন করতে ও করোনাবিরোধী লড়াইয়ে সম্পৃক্ত করতে যে মাত্রায় প্রচার–প্রচারণার প্রয়োজন ছিল তা হয়নি। বাংলাদেশের কোথায় কটি বিলবোর্ড আছে? কোথায় কটি নাটক লেখা হয়েছে মানুষের জীবনে করোনার প্রভাব নিয়ে? আমরা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ব্যর্থ হয়েছি, যার ধারাবাহিকতাতেই লকডাউনও কার্যকর ও কঠোরভাবে প্রয়োগ করতে পারিনি।

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: জনগণের উদ্দেশে কোনো পরামর্শ?

মো. সায়েদুর রহমান: আমি বলতে চাই মাস্কই ভ্যাকসিন। আর সব ধরনের টিকাই গ্রহণ করা যাবে। কেননা কার্যকারিতা যেমনই হোক না কেন, যেকোনো টিকা মৃত্যুঝুঁকি প্রায় শূন্যে নামায় এবং রোগের জটিলতা কমায়।

প্রথম আলো: আপনাকে ধন্যবাদ।

মো. সায়েদুর রহমান: আপনাকেও ধন্যবাদ।