তালেবান বদলে গেছে, এটা ভাবার সুযোগ নেই

মো. শহীদুল হক সাবেক পররাষ্ট্রসচিব। বর্তমানে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাউথ এশিয়ান ইনস্টিটিউট অব পলিসি অ্যান্ড গভর্ন্যান্সের ফেলো অধ্যাপক হিসেবে কাজ করছেন। রোহিঙ্গা সংকট, ভূরাজনীতি ও সংযুক্তি—এ বিষয়গুলো নিয়ে দেশে-বিদেশে লেখালেখি এবং আলোচনায় যুক্ত আছেন। আফগানিস্তানে তালেবানের প্রত্যাবর্তনের পর পরিস্থিতি কোন দিকে এগোতে পারে, তা নিয়ে জনমনে রয়েছে নানা কৌতূহল। এ বিষয়গুলো নিয়ে প্রথম আলোর মুখোমুখি হয়েছেন মো. শহীদুল হক।

সাক্ষাৎকার নিয়েছেন রাহীদ এজাজ

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: আফগানিস্তান থেকে যুক্তরাষ্ট্র একরকম হুটহাট বিদায় নিল। ক্ষমতায় ফিরে এল তালেবান। বিষয়টিকে কীভাবে বিশ্লেষণ করবেন?

মো. শহীদুল হক: আফগানিস্তানের এই পরিবর্তনটা অনেক দিন ধরেই অনিবার্য মনে হচ্ছিল। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, আফগানিস্তানে কখনো বিদেশি শক্তি দীর্ঘদিন দেশটির ক্ষমতায় থাকতে পারেনি। পাশাপাশি আফগানিস্তানের ভেতরের শক্তির পাশাপাশি বাইরের শক্তির কারণে বাইরের কারও সেখানে দীর্ঘদিন থাকা সম্ভব নয়। আফগানিস্তানের মতো দেশে জাতিরাষ্ট্র গঠনের ভাবনা এবং যে রাষ্ট্রব্যবস্থা বর্তমানে দেখছি, সেটি অনেক বিচ্ছিন্ন। এখানে নেশন স্টেটস ডেভেলপ করা খুব জটিল। জাতি গঠনের যে ধারণায় যুক্তরাষ্ট্র অভ্যস্ত, এমন উদার একটি কাঠামো সেখানে গঠন করা সম্ভব ছিল না—এটা অনেকেই জানতেন। এটা জহির শাহ পারেননি, আমানুল্লাহ পারেননি, সোভিয়েত আমলে রুশরাও পারেনি। প্রতিবেশী পাকিস্তানের সব সময় একটি বড় ভূমিকা রয়েছে আফগানিস্তানে। ইরান পাশের দেশ হলেও শিয়া-সুন্নি একটি সংঘাত রয়েছে। পশতুন–অধ্যুষিত আফগানিস্তানের নৈকট্য পাকিস্তানের সঙ্গেই বেশি। পশতুনদের বাদ দিয়ে আফগানিস্তানের অন্যান্য ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীকে নিয়ে একটি জাতিরাষ্ট্র গঠন করে সেটিকে কার্যকরের স্বপ্নটা যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমাদের ক্ষেত্রে শুরু থেকেই ভুল ছিল। তবে সাত থেকে আট বছর আগে ভুলটা বুঝতে পেরে যুক্তরাষ্ট্র কিন্তু তালেবানের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করে দেয়। যদিও যোগাযোগটা গত দুই বছরে জোরালো হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র বুঝে গিয়েছিল, তালেবানের হাতে তাদের ক্ষমতা দিয়ে যেতে হবে। তবে তারা চাইছিল ‘ভালো তালেবানের’ হাতে ক্ষমতা দিয়ে যাবে। এখানেই ভুলটা। তালেবানের মধ্যে ভালো-মন্দ বিচারের সুযোগটা কোথায়? যুগ যুগ ধরেই তো তালেবান নিজেদের বৈশিষ্ট্য প্রমাণ করেছে। পশতুনরা পাহাড় থেকে নেমে জহির শাহকে বের করে দিল। আমি মনে করি, তাদের মধ্যে শতবর্ষের যে ধ্যানধারণা রয়েছে, তার বিন্দুমাত্র পরিবর্তন হয়নি। কাজেই তালেবান বদলে যাবে বা গেছে, এটা বিশ্বাস করা কষ্টকর।

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: নারীর অধিকার, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা—এই বিষয়গুলোতে তালেবান কি আগের জায়গা থেকে সরে আসবে? নারীবিক্ষোভের খবর সংগ্রহের অভিযোগে পৈশাচিকভাবে সাংবাদিক নির্যাতনের ঘটনা আমরা দেখেছি। এই প্রেক্ষাপটে তালেবান কি আদৌ নিজেদের বদলাবে?

মো. শহীদুল হক: তালেবান যে আদর্শকে আঁকড়ে চার দশক ধরে লড়াই করছে, ওই জায়গা থেকে সরে এসে তাদের লাভটা কোথায়? কেনই–বা সরবে? সরে এলে তো তারা দুর্বল হয়ে পড়বে। তারা ভাবছে ধর্ম তাদের পথ দেখাবে। তারা যে অন্যদের নেবে না, এরই মধ্যে সেটার প্রমাণ তারা দিয়েছে। কাজেই যে মতাদর্শের ভিত্তিতে তালেবান গড়ে উঠেছে, বদলালে তা ভেঙে পড়বে।

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: আফগানিস্তানে তালেবানের ফিরে আসার ফলে ভূরাজনীতিতে নতুন মাত্রা যুক্ত হলো। বিশেষ করে বেইজিংয়ে অনুষ্ঠিত তালেবানের সঙ্গে চীনের আলোচনা এখানে উল্লেখ করা যায়। সামগ্রিকভাবে এর প্রভাব কেমন হতে পারে?

মো. শহীদুল হক: প্রশান্ত ও ভারত মহাসাগরকে ঘিরে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের প্রতিযোগিতা এবং কোভিড-১৯ সংক্রমণের পর পুরো পৃথিবী একটা টালমাটাল অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। আফগানিস্তানের পটপরিবর্তন নিঃসন্দেহে এতে বাড়তি মাত্রা যোগ করেছে। ভৌগোলিক ও ভূরাজনৈতিক তিনটি কেন্দ্রের নিরিখে বিষয়টি দেখা যেতে পারে। এর মধে৵ একটি হতে পারে আফগানকেন্দ্রিক মধ্য ও দক্ষিণ এশিয়া। যেখানে আছে ভারত ও পাকিস্তান। অন্যটি মিয়ানমার, তার প্রতিবেশী চীন, ভারত ও বাংলাদেশ মিলে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া। শেষটি হচ্ছে বঙ্গোপসাগর ও প্রশান্ত মহাসাগরকে ঘিরে। এখন প্রথম কেন্দ্রে যদি ভারত ও পাকিস্তানের বৈরিতা বাড়ে এবং আফগানিস্তানে তালেবান স্থিতিশীলতা আনতে ব্যর্থ হয়, এ অঞ্চলে অস্থিতিশীলতা বাড়ার সমূহ আশঙ্কা রয়েছে। আবার ধরা যাক ইয়েমেন, আর্মেনিয়া ও আজারবাইজান। ওই দেশগুলোতে সংঘাত বাড়লে স্বভাবতই তার প্রভাব ওই অঞ্চলে পড়বে। সব মিলিয়ে সংঘাত তৈরি হলে তার রেশ বাইরে গিয়ে পড়বে। সবশেষে ভারত ও প্রশান্ত মহাসাগরকে যে যুক্তরাষ্ট্র গুরুত্ব দিচ্ছে, তার প্রমাণ কিন্তু যুক্তরাজ্য ও অস্ট্রেলিয়াকে নিয়ে তার ত্রিদেশীয় নিরাপত্তা জোট। আফগানিস্তান থেকে সরার পরপরই যুক্তরাষ্ট্র এই জোট করেছে। কোয়াড কিংবা ইন্দো–প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজিতে তারা যেভাবে চীনকে প্রতিরোধ করার কথা বলেনি, ত্রিদেশীয় জোটে তা সরাসরি বলেছে। এখন চীন কীভাবে প্রতিক্রিয়া দেখাবে সেটা দেখার বিষয়।

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: আফগানিস্তানে খাদ্যসংকটের মতো মৌলিক চাহিদার সমাধানে তালেবানের পরিকল্পনা কী?

মো. শহীদুল হক: তারা ভাবছে রাশিয়া, চীন ও পাকিস্তান তাদের খাদ্যসংকট দূর করে দেবে। তালেবান মনে করে অতীতে তাদের খাবারের ব্যবস্থা করেছে পাকিস্তান। তবে এখন কেন নয়! তাই তারা এখন পাকিস্তানের দিকে তাকিয়ে আছে।

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: আফগানিস্তানের পরিবর্তনে রাশিয়া, চীন ও তুরস্কের ভূমিকা কেমন হতে পারে? বিশেষ করে ইকোনমিক ইন্টেলিজেন্স ইউনিট তাদের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে এই তিন দেশের ভূমিকার প্রসঙ্গ টেনেছে।

মো. শহীদুল হক: রাশিয়া ও চীনকে বাদ দিয়ে এখানে তুরস্কের কথা প্রথমে বলতে চাই। ইসলামিক বিশ্বে সৌদি আরবের বিকল্প যে তুরস্ক হতে চায়, এটি এর মধ্যেই স্পষ্ট। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান নিপীড়িত মুসলমানের প্রসঙ্গে কাশ্মীর, উইঘুর ও রোহিঙ্গা—সবার প্রসঙ্গ টেনেছেন। তুরস্ক ন্যাটোর একটি পক্ষ। সৈন্য মোতায়েন করতে চাইলে সে পারে। তবে সম্পদ দিয়ে সহায়তার মতো অবস্থানে তুরস্ক পিছিয়ে। আবার তুরস্ক ও চীন যদি এক হয়ে যায়, সেখানে পরিস্থিতি অন্য রকম হতে পারে। চীন এখানে একটি মিত্র চাইবে। তালেবানের কাছে তুরস্ক অনেক বেশি গ্রহণযোগ্য। বিমানবন্দর পরিচালনাসহ নানা ক্ষেত্রে তুরস্ককে যুক্ত করেছে তালেবান। তুরস্কের সৈন্যরাও এখন আফগানিস্তানে বাগরাম ঘাঁটির ব্যবস্থাপনায় যুক্ত হয়েছে।

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: আফগানিস্তানে উগ্রবাদের উত্থান নিয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। ভারতের সঙ্গে তালেবানের সম্পর্কের সমীকরণ কী হতে পারে?

মো. শহীদুল হক: তালেবানের প্রত্যাবর্তন ভারতের জন্য ঝুঁকি তৈরি করেছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তাই তারা চেষ্টা করছে আফগানিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলতে। নিরাপত্তা পরিষদে আগস্ট মাসের সভাপতি ভারত ভারসাম্যমূলক অবস্থান নিয়েছে। তালেবানবিরোধী কোনো ভূমিকায় যায়নি।

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: আফগানিস্তানে সোভিয়েত হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে মুজাহিদদের লড়াইয়ে বাংলাদেশ থেকেও লোকজন শামিল হয়েছিল। পরে তারা দেশে ফিরে জঙ্গিবাদী তৎপরতা চালায়। এবারও এমন কোনো আশঙ্কা দেখেন কি না?

মো. শহীদুল হক: যেকোনো দেশে ধর্মভিত্তিক কোনো মতাদর্শের প্রত্যাবর্তন বা পুনর্জাগরণ সেটা ভারত, নেপাল, শ্রীলঙ্কা বা বাংলাদেশ যেখানেই হোক—প্রভাব ফেলতে পারে। দেখুন, বিশ্বজুড়ে আল–কায়েদার যে পরিধি, তা নানা নামে পরিচালিত হয়। ফলে তালেবানের প্রত্যাবর্তনে ওই শক্তিগুলো তো আরও শক্তিশালী হতেই পারে। তালেবান বিশ্বজুড়ে জিহাদিদের দেখাচ্ছে—ধৈর্য ধরো, কৌশলী হও, বাস্তববাদী হও। তবেই চূড়ান্ত জয়টা আসবে। মনে রাখতে হবে, তালেবান কিন্তু রাজনৈতিক কোনো আন্দোলন নয়। এটা তো আদর্শিক লড়াই। তালেবান কিন্তু রাজনৈতিক দল নয়, এটা একটি আদর্শ, যার হাত ধরে তালেবান ক্ষমতায় এসেছে, এর একধরনের বৈশ্বিক আবেদন আছে।

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: বাংলাদেশ সরকার এখনো আফগানিস্তানের তালেবান সরকারকে স্বীকৃতি দেয়নি। বাংলাদেশ পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করার কথা বলছে।

মো. শহীদুল হক: বাংলাদেশের অবস্থান এখন পর্যন্ত ঠিক আছে। চীন ও রাশিয়া তালেবানের সঙ্গে কাজ করার কথা বললেও এখন পর্যন্ত স্বীকৃতি দেয়নি। পাকিস্তানও দেয়নি। তার মানে হচ্ছে তালেবানকে স্বীকৃতি দেওয়াটা অনেক কিছুর ওপর নির্ভর করে।

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: আফগানিস্তানে যেসব বাংলাদেশি কর্মী কাজ করতেন, তাঁরা ফিরে এসেছেন। এমনকি ব্র্যাক তাদের কর্মীদের প্রত্যাহার করে এনেছে। সে ক্ষেত্রে দুই দেশের ভবিষ্যৎ সম্পর্ক কেমন হতে পারে?

মো. শহীদুল হক: আফগানিস্তানে ব্র্যাক ছাড়াও সেখানকার টেলিকমসহ নানা অবকাঠামো ও আর্থসামাজিক উন্নয়নে বাংলাদেশের নাগরিকেরা সুনামের সঙ্গে কাজ করছেন। আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থায় দায়িত্ব পালনের সময় আফগানিস্তানে কাজ করার অভিজ্ঞতায় বলতে পারি, বাংলাদেশের লোকজনের গ্রহণযোগ্যতার পাশাপাশি দেশটিতে কাজ করার দক্ষতা ও সামর্থ্য আছে। এই সুবিধাকে কাজে লাগানো আমাদের অব্যাহত রাখতে হবে।

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: আফগানিস্তান থেকে বিদেশিরা চলে গেল। এখন স্বাধীনভাবে স্বাধীন সত্তা নিয়ে তারা টিকে থাকতে পারবে কি না? সেই নেতৃত্ব কি তাদের রয়েছে?

মো. শহীদুল হক: তালেবান সবাইকে যুক্ত করে সরকার চালায় কি না, সেটা দেখার রয়েছে। শুরুতে নারীশিক্ষার কথা বলে এখন তারা নারীদের অন্দরমহলে পাঠিয়ে দিচ্ছে। বলছে, নারী-পুরুষ একসঙ্গে কাজ করতে পারবে না। কথা ও কাজের মধ্যে সমন্বয় না থাকলে বাইরের পৃথিবীতে তাদের গ্রহণযোগ্যতা হবে না। আন্তর্জাতিক সমর্থন ছাড়া তালেবানের জন্য ক্ষমতায় টিকে থাকাটাও সহজ হবে না। প্রশ্ন উঠতে পারে, তাহলে আফগানিস্তানের কী হবে? হতে পারে ওয়াখান করিডর দিয়ে যুক্ত হওয়ার মধ্য দিয়ে চীন ও মধ্য এশিয়ার সঙ্গে সংযুক্তির সুফলের বিষয়টি বেইজিং বিবেচনায় নেবে। আবার তালেবান যেভাবে বলছে, শরিয়াহর মধ্যে থেকে জাতিরাষ্ট্র গঠন হতে পারে। তাতে এমন হতে পারে, পুরোনো জায়গায় গিয়ে তারা ফ্যাসাদে জড়িয়ে পড়বে। তাই আফগানিস্তানে স্থিতিশীলতা আসবে কি না, তা নিয়ে যথেষ্ট সংশয় রয়েছে।

প্রথম আলো: আপনাকে ধন্যবাদ।

মো. শহীদুল হক: আপনাকেও ধন্যবাদ।