ভবিষ্যতের জন্য দক্ষ কর্মী তৈরি করতে হবে

অধ্যাপক সি আর আবরার।
অধ্যাপক সি আর আবরার।
>

অধ্যাপক সি আর আবরার অভিবাসন ও উদ্বাস্তু বিশেষজ্ঞ। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে চার দশক ধরে অধ্যাপনা করেছেন। করোনা পরিস্থিতিতে অভিবাসী শ্রমিক ও অভিবাসন সংকট নিয়ে তিনি প্রথম আলোর মুখোমুখি হন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মিজানুর রহমান খান

প্রথম আলো: কোভিড-১৯ বৈশ্বিক মহামারির ফলে আমাদের অভিবাসী শ্রমিকদের অনেকে কাজ হারিয়েছেন; প্রবাসী আয়ের ওপর নির্ভরশীল পরিবারগুলো এখন কেমন আছে?

সি আর আবরার: সেটা বোঝার জন্য আমরা সম্প্রতিবাংলাদেশ সিভিল সোসাইটি মাইগ্র্যান্টসের ৯ সংগঠনের উদ্যোগে একটি জরিপ করেছি। জরিপটি চালানো হয় বিদেশ থেকে ফিরে আসা ২০০ শ্রমিকের (তাঁদের মধ্যে ২৮ জন নারী) পরিবারের ওপর। পরিবারগুলো প্রধানত মধ্যপ্রাচ্যের অভিবাসী শ্রমিকদের। জরিপে দেখা গেছে, করোনাকালে ৬৪ শতাংশ পরিবারে রেমিট্যান্স আসা বন্ধ হয়েছে। ৬১ শতাংশ পরিবারে গত তিন মাসে রেমিট্যান্সের কোনো অর্থই আসেনি। ৩৬ শতাংশ পরিবার টাকা পেয়েছে, তবে আগের তুলনায় কম; গড়ে ৩০ হাজার টাকা। তারা সাধারণ সময়ে পেত ৪৭ হাজার টাকা। জরিপভুক্ত ৫৭ শতাংশ পরিবারের জীবিকার একমাত্র উৎস প্রবাসী আয়। ফলে এই পরিবারগুলোকে জীবনযাত্রার মান কমাতে হয়েছে। আগে গড় মাসিক খরচ ছিল ১৭ হাজার টাকা, এখন ৭ হাজার ৩০০ টাকায় চলছেন। শিশুরা দুধ, ডিম, মাংস কম পাচ্ছে। অনেকের ধারকর্জ করে চলতে হচ্ছে। যেসব পরিবার দারিদ্র্যসীমার ওপরে উঠেছিল, তারা করোনার কারণে দারিদ্র্যসীমার নিচে নামার আশঙ্কায় রয়েছে।

প্রথম আলো: সম্প্রতি নাগরিক সমাজের সঙ্গে প্রবাসীকল্যাণমন্ত্রীর প্রথম বৈঠক হলো। নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে আপনি সেখানে ছিলেন। সেখানে কী আলাপ হয়েছে?

সি আর আবরার: আমরা মন্ত্রীকে আমাদের জরিপের ফলাফল সম্পর্কে বিশদভাবে অবহিত করি। তিনি বলেছেন, বিষয়গুলো বিবেচনায় নেবেন।

প্রথম আলো: আমাদের প্রবাসীদের ফেলে আসা পাওনার পরিমাণ কত হতে পারে?

সি আর আবরার: আইএলও বলেছে,বৈশ্বিকভাবে প্রবাসী শ্রমিকেরা কয়েক বিলিয়ন ডলার হারিয়েছেন। বিশ্বব্যাংকের দীলিপ রাথা একে ‘লস্ট রেমিট্যান্স’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তাঁরা এর পরিমাণ নির্দিষ্ট করার কথা অবশ্য ভাবছেন, যা এখনো অজানা। আমাদের সীমিত জরিপ অনুযায়ী, বাংলাদেশের প্রবাসীরা গড়ে ১ লাখ ৮০ হাজার টাকা ফেলে এসেছেন—বিষয়টি হয়তো তা নয়। তাঁরা হয়তো চেনাজানাদের ধার দিয়েছিলেন। ইকামা পেতে অর্থ দিয়েছিলেন। উপরন্তু, সার্ভিস বেনিফিটও তাঁরা আনতে পারেননি। এসব মিলেই তাঁদের ক্ষতি বিবেচনায় নিতে হবে। তা ছাড়া অভিবাসীদের একটা বড় অংশ বিদেশে টাকা উপার্জন করতে গিয়ে কিছু অনিয়মকেই একটা পদ্ধতি হিসেবে মেনে নিয়েছিলেন। করোনার কারণে সেটার ধূসর দিকগুলো উৎকটভাবে বেরিয়ে পড়েছে। সে কারণে হারানো রেমিট্যান্স উদ্ধারে নাগরিক সমাজের কিছু আন্তর্জাতিক উদ্যোগ চোখে পড়ছে। আন্তর্জাতিক ট্রেড ইউনিয়নগুলো সোচ্চার হচ্ছে। কিছু আন্তসরকারি নেটওয়ার্কও তাতে যুক্ত হয়েছে। কলম্বো প্রক্রিয়া বা আবুধাবি সংলাপ নামের কিছু নন–বাইন্ডিং উদ্যোগও নির্লিপ্ত। অবশ্য ইতিমধ্যে এটা স্পষ্ট যে, এই অর্থ আদায়ে দ্বিপক্ষীয় নয়, বহুপক্ষীয় কিছু উদ্যোগ কাজ করতে পারে। নেগোসিয়েশনগুলো অবিলম্বে শুরু করতে হবে। অতীতে আংশিকভাবে হলেও অভিবাসী শ্রমিকেরা ক্ষতিপূরণ পেয়েছিলেন।

প্রথম আলো: প্রবাসীকল্যাণমন্ত্রী সম্প্রতি দেশে ১৮ বিলিয়ন ডলারের রেমিট্যান্স আসার মধ্যে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হওয়ার বিষয়টি দেখেছেন। কিন্তু চাকরিগত অনিশ্চয়তার কারণে সঞ্চয়টা পাঠানোও একটা বিষয় কি না?

সি আর আবরার: দুর্যোগকালে বেশি টাকা পাঠানো একটি প্রবণতা। বিশ্বব্যাংক বলেছে, অন্তত ২০ শতাংশ কমবেই এবং কমছেও। চাকরি হারানো, রেমিট্যান্স পাঠানোর প্রথাগত পদ্ধতিতে আকস্মিক অনিশ্চয়তা, শ্রমিক নিয়োগকারী সংস্থাগুলোর দ্বারা হুন্ডির ব্যবহার হ্রাস এবং আপনি যেটা বলছেন, সব মিলিয়ে বেড়েছে। একবারে তাঁরা বেশি পাঠাতে পারেন না। হয়তো আরও কয়েক মাস বাড়তি থাকলেও থাকতে পারে। তাই সতর্কতার সঙ্গেই রেমিট্যান্সের উল্লম্ফনকে বিবেচনায় নিতে হবে।

প্রথম আলো: বিদেশে কত লোক চাকরি হারিয়েছেন, কতজন ফিরেছেন বা ফিরতে পারেন—এর কোনো নির্দিষ্ট পরিসংখ্যান আছে কি? সময় টিভি বলেছে, ১৪ লাখ প্রবাসী বেকার হতে পারেন। আপনারা কিছু বুঝতে পারছেন কি?

সি আর আবরার: এটা একটা মস্ত গোলমেলে বিষয়। করোনা শুরুর পরে ছাত্র, পর্যটকসহ যাঁরাই ফিরেছেন, তাঁদের মধ্যে ঠিক কতজন প্রবাসী, তার কোনো হিসাব নেই। তবে মন্ত্রী বলেছেন, ১০ লাখ ফিরে আসার মতো যে তথ্য, তা ঠিক নয়। এটা আগামী চার বছরে ফেরার মতো একটা বিষয়। প্লেনে তুলে যাঁদের বের করে দেওয়া হয়েছে, সরকার বলেছে, চলতি মাসের গোড়া পর্যন্ত তাঁদের সংখ্যা ১৮ হাজার ছিল। এটা ২৭-২৮ হাজারে উন্নীত হবে।

প্রথম আলো: প্রবাসীদের ডেটাবেইস বিষয়ে ২৫ জুলাইয়ের একটি ওয়েবিনারে যুক্তরাষ্ট্রের নিউ অরলিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক এম কবির হাসান এবং গ্রামীণ ব্যাংকের চেয়ারম্যান অধ্যাপক এ কে এম সাইফুল মজিদকে যথেষ্ট গুরুত্ব আরোপ করতে দেখলাম।

সি আর আবরার: এর আগে আমরা রামরুর ওয়েবিনার থেকেও একই দাবি তুলেছি। প্রবাসীদের ডেটাবেইস অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমানে তাঁদের বিষয়ে কোনো পরিসংখ্যানই আছে বলে জানা নেই। অন্য কয়েকটি দেশ কিন্তু ডেটাবেইসের ভিত্তিতে প্রজেকশন করছে, কত লোক ফিরতে পারে। ডকুমেন্টেশন না করলে আমরা বুঝতে পারব না, তাদের কার কী দক্ষতা আছে। বিশেষ করে আমি আগে যেমন বলেছি যে শ্রমিক গ্রহণকারী দেশগুলোর সরকারের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা শুরু করা। এই আলোচনায় যাওয়ার আগে সিভিল সোসাইটিসহ অংশীজনদের সঙ্গে সরকারের বসা উচিত। আর বসতে গেলেই আপনার হাতে দরকারি ডেটা থাকতে হবে। ডেটা যত কম থাকবে, ধরেই নেবেন, আপনার দর-কষাকষির সামর্থ্য তত কম থাকতে বাধ্য। আমি তো মনে করি, তাঁদের মধ্যে ঋণ বিতরণের যে উদ্যোগ, তাকে সফল করতে চাইলেও এই ধরনের ডকুমেন্টেশন অপরিহার্য। আর একটা জরুরি বিষয় বলা দরকার, প্রবাসীদের পুনর্বাসন যতটা জনগুরুত্বসম্পন্ন, তার কোনো প্রতিফল বাজেটে চোখে পড়ল না।

প্রথম আলো: প্রবাসীরা আমাদের অর্থনীতির জন্য সোনার হাঁস, তাঁদের দুর্দিনে রাষ্ট্র যে উদ্যোগ নিয়েছে, তা কি সন্তোষজনক?

সি আর আবরার: প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। প্রথমত বিদেশে তাঁদের খাদ্যসহায়তার জন্য দিয়েছে ১১ কোটি টাকা, বিমানবন্দরে ফেরার সময় প্রত্যেককে নগদ দিয়েছিল ৫ হাজার টাকা, সাকল্যে এর পরিমাণ ২ কোটি টাকা। তো আমাদের জানামতে, সাহায্য বলতে এই ১৩ কোটি টাকা। আর সরকার দেশে ব্যবসা-বাণিজ্য করতে প্রবাসীদের জন্য ৭০০ কোটি টাকার ঋণ কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। রাষ্ট্রের ৫০০ কোটি টাকার ছাড় এখনো বাকি। আর ২০০ কোটি টাকা প্রবাসীকল্যাণ ব্যাংকে প্রবাসীদের সঞ্চয়ের টাকা। যার জন্য প্রবাসীদের ৪ শতাংশ সুদ দিতে হবে। অথচ গার্মেন্টস মালিকদের প্রণোদনার জন্য যে ৫ হাজার কোটি টাকা দিয়েছে, তার সুদের হার ২ শতাংশ। তবে মনে রাখতে হবে, মানুষ একটি সমাজ বা লোকালয় থেকে দীর্ঘদিন অনুপস্থিত থাকলে তার জন্য কিছু সমস্যা তৈরি হয়। কারণ, সামাজিক যোগাযোগও একটা পুঁজি। তো সে রকম পরিবেশে স্থানীয়ভাবে একটা নতুন ব্যবসা গড়ে তুলতে প্রবাসীদের জন্য ঝুঁকি থাকবে। ঋণ অন্যতম উপাদান। তাঁদের প্রশিক্ষণ দিতে হবে। এনজিও বা সমবায় ধরনের কিছুর আওতায় তাঁদের আনতে হবে। মনে করার নেই সব প্রবাসী আপনা–আপনি উদ্যোক্তা।

প্রথম আলো: অধ্যাপক রেহমান সোবহান বলেছেন, কোভিডের পরও মধ্যপ্রাচ্যে লোক নিয়োগে ধস নামবে না। কারণ, শ্রমিক ছাড়া তাদের সমাজ চলবে না। এই পর্যবেক্ষণকে যথার্থ বলে মনে করেন কি?

সি আর আবরার: একমত। সাময়িকভাবে শ্রমিকদের চাহিদার একটা সংকোচন ঘটতে পারে। তবে যেসব ক্ষেত্রে বাংলাদেশের শ্রমিকেরা কাজ করেন, পর্যায়ক্রমে সেই খাতগুলোতে ক্রমান্বয়ে আরও চাহিদা বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তা ছাড়া নারী শ্রমিকদের কাজের সুযোগ তুলনামূলক আরও বেশি বাড়বে বলেও জাতিসংঘ উল্লেখ করেছে। তবে শ্রমিক প্রেরণকারী দেশগুলো যদি ঐক্যবদ্ধভাবে কৌশল নিতে পারে, তাহলে চলতি সংকট আমরা কাটিয়ে উঠতে পারি। এখন পর্যন্ত একজোট হয়ে আমরা কোনো অভিন্ন কৌশল নির্ধারণের প্রক্রিয়া শুরু করছি না। সার্কের সবাই ভুক্তভোগী। অথচ দুঃখজনকভাবে কোনো উদ্যোগ নেই। আসিয়ান আন্ত–অভিবাসন সুরক্ষায় একজোট হয়ে অনেক কিছু করছে। প্রেরণ ও গ্রহণকারী দেশে নারীদের কর্মক্ষেত্রে বৈচিত্র্য বাড়ানো, কাফালা ব্যবস্থার সংস্কারের মতো বিষয়ে দীর্ঘমেয়াদি নীতি প্রণয়নে সার্ক উদ্যোগ নিতে পারে। করোনায় সার্ক তো চাঙা হলো। গত ২৩ জুলাই রামরুর চতুর্থ সিম্পোজিয়াম নারীদের বিষয়ে আমরা সুপারিশমালা রেখেছি। সরকার চাইলে এ বিষয়ে কৌশলপত্রের খসড়া তৈরিতে সহায়তা দিতে প্রস্তুত আছি।

প্রথম আলো: এ মুহূর্তে সরকারকে কোন বিষয়ে বেশি অগ্রাধিকার দিতে বলবেন? আপনারা সম্প্রতি রামরু থেকে নারীদের ওপর ওয়েবিনার করেছেন?

সি আর আবরার: জবরদস্তি করে যাঁদের পাঠানো হচ্ছে, তাঁদের বিনা পাওনায় পাঠানো বন্ধ করা। প্রত্যাগতদের সুষ্ঠু পুনর্বাসন। উপযুক্তরূপে দক্ষ করে তাঁদের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে নিয়ে আসা। নারী অভিবাসী কর্মীদের বিষয়ে গ্রহণকারী সরকারগুলোর কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ জরুরি। করোনা-পরবর্তী শ্রমবাজার খুঁজতে চাইলে দেশের বিদ্যমান প্রবাসী শ্রমিক প্রশিক্ষণ কেন্দ্রগুলোকে স্বাস্থ্যকর্মীমুখী িহসেবে তৈরি করতে হবে। পাঠ্যসূচিতে সংস্কার আনতে হবে, যার লক্ষ্য হবে ভোকেশনাল প্রশিক্ষণকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া। আমরা যদি দক্ষতা বাড়াতে পারি, তাহলে আমাদের সামনে নতুন বাজার পেতে অসুবিধা হবে না। শেষে বলব, প্রেরণকারী ও গ্রহণকারী—উভয় সরকারের উচিত হবে একটি লিঙ্গ সংবেদনশীল মূল্যায়নের (জেন্ডার রেসপনসিভ অ্যাসেসমেন্ট) কাজ হাতে নেওয়া। এর লক্ষ্য হবে উপযুক্ত ও টেকসই পদক্ষেপ নেওয়া। লিঙ্গনির্বিশেষে অভিবাসী শ্রমিকদের জন্য বিনা মূল্যে করোনা টেস্ট নিশ্চিত করা।

প্রথম আলো: ধন্যবাদ।

সি আর আবরার: ধন্যবাদ।