যদি কোনো মতবাদে বিশ্বাস থেকে থাকে, মার্ক্সবাদের ওপর বিশ্বাস অবশ্যই আছে

কমরেড অজয় রায়ের জন্ম ১৯২৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জে। রাজনীতিবিদ ও লেখক। তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ ‘বাঙলা ও বাঙালী’, ‘আমাদের জাতীয়তার বিকাশের ধারা’, ‘বাংলাদেশের বামপন্থী আন্দোলন ১৯৪৭-৭১’, ‘গণ-আন্দোলনের নয় বছর’, ‘তীরের অন্বেষায়’ প্রভৃতি। সত্তরের দশকের মাঝামাঝি থেকে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য ছিলেন। আজ ৮৮ বছর বয়সে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা।
পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টি, ষাটের দশকের আন্দোলন-সংগ্রাম, বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জন—এই কালপর্বে কমিউনিস্ট পার্টির কর্মতৎপরতাসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে প্রবীণ রাজনীতিক অজয় রায়ের সঙ্গে ২০১৫ সালের ৮ জানুয়ারি এবং চলতি বছরের ৬ মার্চ—দুই পর্বে কথা হয় প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমানের সঙ্গে। তাঁদের এই আলাপচারিতাটি প্রকাশিত হয় ত্রৈমাসিক পত্রিকা প্রতিচিন্তার জুলাই-সেপ্টেম্বর সংখ্যায়। আলাপচারিতাটির কিছু চুম্বক অংশ তুলে ধরা হলো প্রথম আলোর পাঠকদের জন্য।
মতিউর রহমান : শুরুতেই জানতে চাইছি, মার্ক্সবাদে কি আপনার এখনো বিশ্বাস আছে?
অজয় রায় : যদি কোনো মতবাদে বিশ্বাস থেকে থাকে, বিশেষ করে ইতিহাসের বিবর্তন সম্পর্কে কার্ল মার্ক্সের যে বক্তব্য, সমাজবিকাশের বিষয়ে যে বক্তব্য, সেই জায়গায় মার্ক্সবাদের ওপর আমার ধারণা-বিশ্বাস অবশ্যই আছে। সেটা আক্ষরিক অর্থে নয়, তাঁর মূল যে বিষয়, সেখানে বিশ্বাস অবশ্যই আছে।
মতিউর রহমান : মার্ক্সবাদের পর্ব বা এর ধারাবাহিক ইতিহাসের মধ্য দিয়ে যদি আপনি আসতে থাকেন, বিশেষ করে অর্থনীতি ও দর্শনের ক্ষেত্রে দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের প্রভাব...
অজয় রায় : আমার কাছে যেটা মনে হয়, দ্বান্দ্বিক প্রক্রিয়া সব সমাজেই যে একই রকম হবে, তার কোনো মানে নেই। আরও নির্দিষ্টভাবে বললে, উৎপাদিকা শক্তি এবং উৎপাদন সম্পর্কের পরস্পরের যে সংঘাত, এর মধ্য দিয়ে সমাজের যে পরিবর্তন, সেটা আমি গ্রহণ করি।
মার্ক্সবাদ শেখা নিয়ে আমাদের একটা সমস্যা আছে। কারণ আমরা মার্ক্সবাদ শিখেছি কার কাছ থেকে? আপনারা শিখেছেন পাকিস্তান আমলে। আর আমরা শিখেছি আরেকটু আগে থেকে। আমাদের উৎস ছিল প্রধানত বিলেত। বিলেত কোত্থেকে শিখেছে? উনিশ শতকের দ্বিতীয় ও তৃতীয় দশকের সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিএসইউ) নিয়ন্ত্রণাধীন তৃতীয় আন্তর্জাতিক অর্থাৎ মস্কো থেকে। তার পরবর্তী সময়ে আমরা আরও শিখলাম চীন থেকে। তা ছাড়াও কিন্তু মার্ক্সবাদের আরও কিছু কেন্দ্র ছিল। এর মধ্যে ছিল জার্মানি, ইতালি, স্পেন ও ফ্রান্স। পরে যেহেতু মস্কো তাদের মতভিন্নতা গ্রহণ করতে পারল না; তাই আমরাও বাতিল করলাম।
মতিউর রহমান : সবকিছুর পরে আপনি কী বলবেন, সমাজতন্ত্র বা মার্ক্সবাদ কি শেষ হয়ে গেল? এর কি পুনরুজ্জীবন আর সম্ভব? কিংবা নতুন কেন্দ্র কি তৈরি হওয়া সম্ভব?
অজয় রায় : আমি তো একটা দেখছি, যেমন ওয়ান পার্সেন্ট ভার্সেস নাইন্টি নাইন পার্সেন্টের লড়াই। বিশ্বে তো দেখলাম—আজকের পুঁজিবাদ ঘুরে ঘুরে একটা জায়গায় আবর্তিত হচ্ছে। বিভিন্ন জায়গায় যে নানা ধরনের প্রতিরোধ গড়ে উঠেছে, সেগুলো তো গুরুত্বপূর্ণ। এমনকি আমাদের এখানে শাহবাগ স্কয়ারে তার কিছুটা স্ফুরণ দেখেছি। তবে এসবের মধ্য দিয়ে শ্রমিকশ্রেণির নেতৃত্বে সমাজ পরিবর্তিত না হোক, দ্বন্দ্বের মধ্য দিয়ে ভবিষ্যতের দিকে যে অগ্রগতির পথ, সেটা তো দেখাই যায়।
মতিউর রহমান : বিশ্বব্যাপী সোভিয়েত সমাজতন্ত্র বা পূর্ব ইউরোপে সমাজতন্ত্র ভেঙে পড়ার মধ্য দিয়ে মার্ক্সবাদ কি ব্যর্থ হয়ে গেল? এর পুনরুজ্জীবনের সম্ভাবনা কতটুকু?
অজয় রায় : পুনরুজ্জীবনের কোনো উপায় নেই। কারণ পুনরুজ্জীবনের সম্ভাবনা জীবনই ঠিক করে দেবে। ড. নজরুল ইসলাম (বর্তমানে জাতিসংঘে কাজ করছেন) ১৯১৭ সালের অক্টোবরের সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবকে ‘ফল্স স্টার্ট’ বলেছেন। কিংবা যা-ই বলুক, একটা বিষয় হলো সোশ্যালিজম ওয়াজ প্র্যাকটিসড বাই মস্কো। এর কিছু সুফল তো আছে।
সুতরাং সারা বিশ্বে সামগ্রিক পরিবর্তন না আনতে পারলেও ইতিবাচক পরিবর্তনের ক্ষেত্রে বিশ্বব্যাপী বড় ভূমিকা তো রেখেছেন কমিউনিস্টরা। তার মধ্যে উপনিবেশবাদ-বিরোধী জাতীয় মুক্তি আন্দোলন, আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধ ইত্যাদিতে অনেক বড় অবদান রেখেছে। মার্ক্সবাদের একটা বড় দর্শন হচ্ছে জীবনের চলিষ্ণুতা। বারবার সমাজের এই পরিবর্তন, এটা কিন্তু জীবনই দেখিয়ে দিচ্ছে। এই জীবনটা ডগম্যাটিক মার্ক্সিজম, তা না।
মতিউর রহমান : বিভিন্ন দেশে তো মার্ক্সবাদী বড় বড় পণ্ডিত, নেতা, সংগঠক ছিলেন, তাঁরাও বিকল্প কিছু করতে পারলেন না, শুধু সোভিয়েত নীতি বা পরামর্শ অনুসরণ করলেন। তাঁদেরও পতন হলো। এর দায় কি শুধু দ্বিতীয় বা তৃতীয় আন্তর্জাতিককে দেবেন, নাকি ত্রিশ-চল্লিশ-পঞ্চাশের দশক ধরে দেশে দেশে যাঁরা নেতৃত্ব দিলেন, তাঁদের? মার্ক্সবাদ যদি আপনার কথামতো চলমান-চলিষ্ণু একটা ব্যাপার হয়, তবুও বলা যায়, বড় বড় পণ্ডিত-বিপ্লবী-পরিবর্তনমুখী মানুষ তো ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বেও ছিলেন, তাঁরাও তো পারলেন না নতুন কোনো পথের সন্ধান দিতে।
অজয় রায় : ভারতবর্ষের কথা বলছেন, সেটাই বলি। ভারতের কমিউনিস্টরা কংগ্রেসের মধ্যে থেকে কাজ করতেন। কংগ্রেস-নেতৃত্বের কাছে ব্যাপারটা জানা ছিল—অন্তত পণ্ডিত নেহরু ও মাওলানা আজাদ জানতেন চিনতেন তাঁদের। মন্বন্তরটা শুরু হলো ১৯৪২ সালে আগস্ট আন্দোলনের সময়। অল ইন্ডিয়া কংগ্রেস কমিটিতে সম্ভবত ১২-১৫ জন কমিউনিস্ট ছিলেন। যদি আমার ভুল না হয়, খুব সম্ভবত সরদার শাহ ছিলেন তাঁদের মুখপাত্র। তাঁরা বিরোধিতা করলেন ‘কুইট ইন্ডিয়া’ (ভারত ছাড়) মুভমেন্টের। কেন? ওয়ার ইজ পিপল’স ওয়ার অর্থাৎ যুদ্ধটা সাধারণ মানুষের হয়ে গেছে। যখন কমিউনিস্টরা বিরুদ্ধে ভোট দেবেন, তখন মাওলানা আজাদ সরদার শাহকে মঞ্চে ডেকে নিয়ে গেলেন। সেখানে তাঁকে বললেন, তোমাদের যুক্তি আমি বুঝি। কিন্তু এখন এটার বিরুদ্ধে তোমরা যেয়ো না, তোমরা বিরুদ্ধে ভোট দিয়ো না। ভোট দিলে তো তোমাদের ১৫-২০টা ভোটে কিছু আসবে-যাবে না। তারপর কী হলো?
আমার অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, আমি তখন বেনারসে থাকি। ক্লাস নাইনে পড়ি। এক দিন বেনারস ইউনিভার্সিটির গেটে ছাত্ররা মিছিল করতে বেরোবে, বাইরে পুলিশসহ সরকারের বাহিনী আছে। তারা বেরোলেই আক্রমণ করা হবে। তার আরেক পাশে কয়েকজন কমিউনিস্ট মাইকে প্রচার করছেন, এই আন্দোলন ভুল। তাঁরা ওই আন্দোলনের পুরোপুরি বিরুদ্ধাচরণ করছেন। এই ঘটনা, এই বিচ্ছিন্নতা, এর দায়টা কার?
১৯৪২-এর পরে ’৪৫-’৪৬-এ গান্ধী সম্পর্কে যে নিন্দাসূচক কথাবার্তা কমিউনিস্টরা বলেছেন, তা ঠিক ছিল না। আমার মনে আছে, পাকিস্তান হওয়ার পরপরই তো আর সংকীর্ণ অতি বিপ্লবী বামধারা আসেনি। পাকিস্তান হওয়ার পর কয়েক মাস সময় ছিল। ১৯৪৮ সালে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির দ্বিতীয় কংগ্রেসের পর তা শুরু হলো। এসবের আগে কমিউনিস্ট পার্টির একটা বুকলেট বের হলো ‘স্বাধীন সুখী পাকিস্তান গড়ে তুলুন’। তখন তো একটাই পাকিস্তান ছিল। আমিও রংপুরে রাস্তায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এটা বিক্রি করেছি ছাত্রদের কাছে। অনেক বিক্রি হয়েছে। কারণ, সেটা ছিল জাতীয় আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ। যেই উল্টোটা হয়ে গেল, অর্থাৎ সমাজতন্ত্রের জন্য সশস্ত্র বিপ্লবের সিদ্ধান্ত হয়ে গেল—সবকিছুর বদল ঘটে গেল।
মতিউর রহমান : আমি ’৮৭ কি ’৯০-এর দিকে কলকাতায় গিয়েছিলাম। সেখানে নেপাল নাগের স্ত্রী আমাকে একটা প্যাকেট দিয়েছিলেন। সেটাতে দুটো পুরোনো শিখা আর নেপালদা মস্কোতে ’৮১-এর সম্মেলনে সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির নেতাদের সঙ্গে কী আলাপ করবেন, সেসব পয়েন্ট ছিল। সেখানকার আলোচ্যসূচির কিছু বিষয় আমার মনে আছে। সেসব নিয়ে হয়তো পরামর্শ করা হয়েছে। তারপরও আমরা ধরে নিতে পারি, একাত্তরে নিজেরা স্বাধীনভাবেই যুদ্ধে অংশ নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে জাতীয় আন্দোলনে বড় ভূমিকা পালন করেছে কমিউনিস্ট পার্টি।
অজয় রায় : ঠিক তা-ই।
মতিউর রহমান : আমরা যদি এভাবে দেখি, ’৫০-’৬০-এর দশকে একধরনের উত্থানপতন-দ্বন্দ্বসংঘাত এসবের মধ্য দিয়ে এগোল সিপিবি। পঞ্চাশের দশকে ছাত্র-যুবক আর ষাটের দশকের দিকে কিছুটা শ্রমিক আর কৃষকশ্রেণির সঙ্গে যোগাযোগ বাড়ে। কিন্তু জাতীয় আন্দোলনে অংশগ্রহণ করা-গণতন্ত্র, স্বায়ত্তশাসন, ভাষা-সংস্কৃতির জন্য কাজ করার ব্যাপারে নেতৃত্বে না থাকলেও পার্টি বিশেষ উদ্যোগী ভূমিকা পালন করতে পেরেছিল। এই পর্বটাকে আপনি কীভাবে দেখেন?
অজয় রায় : আমি মনে করি, সেটা ছিল সঠিক ভূমিকা এবং আমাদের দেশের মানুষের জন্য স্বাধীনতা যদি একটা ল্যান্ডমার্ক হয়, তাহলে স্বাধীনতা অর্জনের ক্ষেত্র প্রস্তুতের ব্যাপারে আমরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পেরেছি। স্বাধীনতা আনার ক্ষেত্রে চিন্তাচেতনা বিনির্মাণে দ্বিজাতিতত্ত্বের বাইরে আসার চেষ্টা করা হয়, সেখানেও আমরা ভূমিকা রাখতে পেরেছি।
মতিউর রহমান : ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময়ের কমিউনিস্ট পার্টির ভূমিকাকে এখন কীভাবে মূল্যায়ন করেন?
অজয় রায় : আমি মূল্যায়ন করি এভাবে, মুক্তিযুদ্ধের প্রতি যে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি ছিল, আগে থেকে যদি আরও প্রস্তুতি থাকত, তবে কমিউনিস্ট ও সমগোত্রীয় আন্দোলনগুলো আরও বেশি ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে সক্ষম হতো। কারণ, স্বাধীনতা আন্দোলনটা স্বাধীনতার জন্য আন্দোলন-সংগ্রাম কি না, অনেক সময় পর্যন্ত তা নিয়ে আমাদের মধ্যে দোদুল্যমানতা ছিল। সমগ্র পাকিস্তান একটা ফেডারেল কাঠামোর মধ্যে থাকবে, যদি ফেডারেল কাঠামো অসম্ভব হয়ে ওঠে, তাহলে সেটা স্বাধীনতাসংগ্রামে পর্যবসিত হবে—এ রকম একটা অবস্থান ছিল।
মতিউর রহমান : পঁচিশে মার্চের পর কী হলো?
অজয় রায় : আপনার কি মনে আছে, ময়মনসিংহ জেলা কমিটির একটা বৈঠক হয়েছিল? কোনো একজন অবাঙালি সহানুভূতিশীল ব্যবসায়ীর বাসায়—জায়গাটা ছিল ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের কাছাকাছি। তখন অনিল মুখার্জি, খোকা রায়, বারীণ দত্ত—এঁরা দেশে ছিলেন না। বড় ভাই (মণি সিংহ) জেল থেকে বেরিয়ে আন্ডারগ্রাউন্ডে ছিলেন। আন্ডারগ্রাউন্ড অবস্থা থেকেই বড় ভাই সেই মিটিংয়ে এসেছিলেন।
মতিউর রহমান : আমরা জানি, মুক্তিযুদ্ধের মাঝামাঝি সময়ে সিপিবির নেতৃত্বে মণি সিংহ, আবদুস সালাম ও মোহাম্মদ ফরহাদ দিল্লিতে গিয়ে ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে দেখা করেন।
অজয় রায় : ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে দেখা হয় দিল্লিতেই। সেখানে তাঁরা ইন্দিরার কাছে প্রস্তাব করেন, আলাদা প্রশিক্ষণ নেওয়ার ব্যাপারে। সেই সময়ে সিপিআইয়ের চাপও ছিল। এমনকি শুধু সিপিআইয়ের প্রভাব নয়, ইন্দিরা গান্ধীর একাধিক উপদেষ্টা ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের সময় তাঁর সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ সহযোদ্ধা। তাঁরা ইন্দিরা গান্ধীর ওপর একটা প্রভাব সৃষ্টি করে বলে আমি শুনেছি। শেষ পর্যন্ত তিনি সেটা মেনে নেন। একদিকে ছিলেন ভূপেশ গুপ্তসহ সিপিআইয়ের নেতারা। আরেক দিকে ছিলেন এঁরা। তবে সোভিয়েত ইউনিয়নের ভূমিকাটা সব সময় সপক্ষে ছিল, তা নয়। সেই সময় কেরালাতে সিপিআইয়ের একটা কংগ্রেস হয়; সেই কংগ্রেসে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট নেতৃত্বও সেখানে আমন্ত্রিত ছিল—মণি সিংহ, খোকা রায় ও বারীণ দত্ত। সেখানে সোভিয়েত থেকে পার্টির উচ্চপদস্থ এক নেতা এসেছিলেন। আর তিনি এসেছিলেন মূলত বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রামে ভারতের ভূমিকা এবং আমাদের মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে আরও জানতে। এরপর থেকে সোভিয়েত অবস্থানও বদল হতে শুরু করে।
মতিউর রহমান : স্বাধীনতার পর আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গে সিপিবির সম্পর্ক ও ভূমিকাকে এখনকার বিবেচনায় আপনি কীভাবে দেখেন? বিশেষ করে আওয়ামী লীগের সঙ্গে সিপিবির ঐক্য ও সংগ্রামের নীতি, সমর্থনের বা সহযোগিতার নীতিকে এখন কীভাবে মূল্যায়ন করেন?
অজয় রায় : একটা কথা স্পষ্টভাবে বলি, মুক্তিযুদ্ধ তো হলো। অনেক ত্যাগের মধ্য দিয়ে দেশ স্বাধীনও হলো। কিন্তু স্বাধীনতার পরও বিষয়টা আসলে কী হয়েছে, কী এর প্রভাব, সে সম্পর্কে আমাদের স্পষ্ট কোনো বোধ বা সামগ্রিক কোনো ধারণা ছিল না। মনে পড়ে, স্বাধীনতার পরপরই আবুল মনসুর আহমদ দুটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন। তিনি সেখানে বলেছিলেন, স্বাধীনতাটা হলো লাহোর প্রস্তাবের বাস্তবায়ন। দ্যাট ওয়াজ অলসো অ্যান্ড অ্যাসেন্স অব দ্য টোটাল স্ট্রাগল। এর প্রমাণ পাওয়া যায় ষাটের শুরুতে অনুষ্ঠিত এক গোপন বৈঠকে। ওই বৈঠকে মানিক মিয়ার সঙ্গে মণি সিংহ, খোকাদারাও ছিলেন। সেখানে স্বাধীনতার প্রশ্নে আমাদের নেতারা সম্মত হননি। তখন বঙ্গবন্ধু বললেন, মানলাম কথা। তবে আই ডোন্ট অ্যাগ্রি উইথ ইউ।
মতিউর রহমান : স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের ভূমিকা, সরকারের অবস্থান, তার সঙ্গে সিপিবির ভূমিকাকে কীভাবে দেখেন?
অজয় রায় : আমার ধারণা, সিপিবি ওই সময় তার কর্তব্যটাই ঠিক করতে পারেনি। আমি যদি মনে করি, এটা ন্যাশনালিস্ট গভর্নমেন্ট—দ্যাট ওয়াজ মাই আন্ডারস্ট্যান্ডিং, তাহলে এক বিষয়। আর যদি মনে করি, আবুল মনসুর আহমদের বক্তব্যের মতো, তাহলে তো আরেক বিষয়। সুতরাং এভাবে নিজেদের ভূমিকাকে স্পষ্ট করা যায়নি।
মতিউর রহমান : বাকশাল গঠিত হওয়ার পর আমরা তাতে সমর্থন দিলাম, তাতে যোগও দিলাম। তাতে কি কোনো ভিন্নমত ছিল?
অজয় রায় : যোগ দেওয়াতে ভিন্নমত ছিল না। তবে এটা সঠিক সিদ্ধান্ত ছিল না। এর একটা কারণ হলো ‘ফেইট আকমপ্লি’ অর্থাৎ বাধ্য হলাম। আরেকটা হলো, না হলে ভালো হতো, কিন্তু হলো।
মতিউর রহমান : বঙ্গবন্ধু একক দল করে ফেললে আর তো উপায় নেই, ব্যাপারটি কি এ রকম?
অজয় রায় : হ্যাঁ, তিনি করে ফেললে তখন আর কী করব, আর উপায় নেই। আমরা যারা কমিউনিস্ট পার্টির, তারা যোগ দেব।
মতিউর রহমান : আচ্ছা, বাকশাল হলো, বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করা হলো, আমরা প্রতিবাদ জানালাম, বিচার চাইলাম, আবার গণতান্ত্রিক সংগ্রাম করলাম, মানুষকে জাগ্রত করারও চেষ্টা করলাম। কিন্তু জিয়া ক্ষমতায় এলে তাঁর প্রসঙ্গে একটা বিতর্ক আমাদের মধ্যে দেখা দিল। যদিও সংখ্যাগরিষ্ঠ পাস করল, জিয়াউর রহমানের খালকাটা কর্মসূচিতে অংশ নেওয়া এবং তাঁকে ‘হ্যাঁ’ ভোট দেওয়া। এ সম্পর্কে আপনার এখনকার মতামত কী?
অজয় রায় : এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে সম্পাদকমণ্ডলীর মিটিংয়ে সবচেয়ে বেশি বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন আপনি। আর আপনার সঙ্গে মণি সিংহ ছিলেন।
মতিউর রহমান : আপনার মতে, জিয়াকে পুরোপুরি আমরা বুঝতে পারিনি। তাঁকে সহযোগিতা করা, হ্যাঁ ভোট দেওয়া—এগুলো বামপন্থী হিসেবে ঠিক ছিল না। আবার ধরুন, জিয়াকে হত্যা করা হলো, এরশাদ ক্ষমতায় এল—এই সময়টায় সিপিবির ভূমিকাটা কেমন দেখেন?
অজয় রায় : বরং এই সময়টায় একটু ভালো ছিল। চেষ্টা করেছে সবাইকে নিয়ে সবার সঙ্গে মিলে কাজ করার। সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে লড়াই করা। সেখানে সিপিবি-আওয়ামী লীগ-ন্যাপসহ অন্যান্য বাম দলকে নিয়ে এক থাকাটাও ইতিবাচক ছিল। এ ছাড়া কৃষক আন্দোলন, শ্রমিক আন্দোলন ও ছাত্রদের জাগ্রত করার মতো কিছু এ সময় হয়েছে।
মতিউর রহমান : এরশাদের বিরুদ্ধে আন্দোলনে সিপিবির একটা ইতিবাচক ভূমিকা ছিল। কিন্তু ১৯৮৭ সালের পর সোভিয়েত ইউনিয়নের পরিবর্তন, পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোর পরিবর্তন হলো, তার প্রভাব সিপিবিতে এসে পড়ল এবং পার্টি ভাঙতে শুরু করল, আমাদের ভেতর বিভ্রান্তি বাড়তে থাকল। ফলে আমাদের পার্টি দ্বিখণ্ডিত হলো প্রথমে, পরে আরও খণ্ডিত হতে থাকলে। একপর্যায়ে পার্টির অনেকে আওয়ামী লীগ, গণফোরামে যোগ দিতে থাকল। এ সময়কাল সম্পর্কে আপনি কী বলবেন?
অজয় রায় : এ সময়ের কথা আমি নিজেকে দিয়েই শুরু করি। আমি খুব স্পষ্ট ছিলাম না। থাকলে হয়তো আরেকটু জোরেশোরে ভূমিকা রাখতে পারতাম। সিপিবির যে অংশ অতি বাম পন্থার চিন্তার দিকে চলে গেল, তারা এখনো সেই নীতি দ্বারা অনেকখানি প্রভাবিত। আজকের প্রেক্ষাপটে বিবেচনা করলে আপনাকে খেয়াল করতে হবে, বিশ্বটা যদি নাইনটি নাইন পার্সেন্ট ভার্সেস ওয়ান পার্সেন্ট হয়, তবে তো নাইনটি নাইন পার্সেন্টকে অ্যাকোমডেট করতে হবে, নাকি?
মতিউর রহমান : এখন আপনি আওয়ামী লীগের মধ্যে কী দেখেন? স্বৈরতন্ত্রের পতনের পর তো বাংলাদেশের ২৬ বছরের অভিজ্ঞতা হয়ে গেল। স্বৈরতন্ত্রের পতনের পর আমরা খুব উৎসাহী ছিলাম, গণতন্ত্র ফিরে এল—ভাবনাটা ছিল, এই দুই দলের মধ্য দিয়ে গণতন্ত্রটা যদি ঠিকমতো চলে মন্দ কী? কিন্তু আজকে কী দেখি?
অজয় রায় : আমরা দেখি, অ্যাগেইন গো ব্যাক টু আবুল মনসুর আহমদ। অর্থাৎ সমাজ দুই ভাগে বিভক্ত।
মতিউর রহমান : তার মানে আপনি দেখেন, ধর্মের প্রভাব বেড়েছে? যা থেকে জঙ্গিবাদসহ আরও কিছু সামাজিক সমস্যার উদ্ভব ঘটেছে। একই সঙ্গে এ রকম কিছু কি দেখেন, স্বৈরতান্ত্রিক মনোভাবও বেড়েছে? অগণতান্ত্রিক ধ্যানধারণা-চিন্তাধারা বেড়েছে। তাহলে গত আড়াই দশকে কি এটাই পাওয়া?
অজয় রায় : না, কিছুই পাওয়া হলো না। এই না পাওয়া, এর পেছনে আমরাও দায়ী। কারণ আমরা যদি একটা গণতান্ত্রিক ধারায় অপজিশন বা যেখানে থাকি, রাজনীতিটা গণতান্ত্রিক রাখতে পারতাম, তাহলে আওয়ামী লীগের ওপর কিঞ্চিৎ হলেও একটা প্রভাব পড়তে পারত। আওয়ামী লীগের মধ্যে তো এখন নানান চিন্তার লোক আছে। এর মধ্যে বর্তমান সময়ে শঙ্কা বা সংকটটা বোঝে, এমন লোকও আছে। সুতরাং আমরা আজ যদি আওয়ামী লীগকে দোষ দিই—হ্যাঁ, যেহেতু তারা ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনীতি করে, তারা এখন ক্ষমতায়, তাই দায়িত্ব তাদের সবচেয়ে বেশি। কিন্তু আমাদেরও একটা ভূমিকা আছে বলে দাবি করি; সেটি যদি বুঝে থাকি, তাহলে সেই অনুসারে সুযোগ বা সম্ভাবনা কতটুকু ছিল, সেটা বাস্তবায়নের জন্য আমরা কি কোনো চেষ্টা করেছি?
মতিউর রহমান : আপনাকে ধন্যবাদ।
অজয় রায় : আপনাকেও ধন্যবাদ।
[ঈষৎ সংক্ষিপ্ত]