রোহিঙ্গা প্রশ্নে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান প্রায় একই

অধ্যাপক সি আর আবরার অভিবাসন ও উদ্বাস্তু বিশেষজ্ঞ। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে চার দশক ধরে অধ্যাপনা করেছেন। রোহিঙ্গা সংকট, প্রত্যাবাসনের ক্ষেত্রে সমস্যা, রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি, শিবির ব্যবস্থাপনা, বিশ্ব সম্প্রদায়ের অবস্থান ও আঞ্চলিক নিরাপত্তার ঝুঁকি নিয়ে তিনি কথা বলেছেন প্রথম আলোর সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন এ কে এম জাকারিয়া

অধ্যাপক সি আর আবরার

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠাতে ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে দুই দেশের মধ্যে ‘ফিজিক্যাল অ্যারেঞ্জমেন্ট’ চুক্তি চূড়ান্ত হয়েছিল। তার চার বছর পূর্তি হতে যাচ্ছে। কাউকে তো পাঠানো গেল না।

সি আর আবরার: ওই চুক্তি মিয়ানমারের সঙ্গে ২০১৭ সালের নভেম্বরে সম্পাদিত প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া সম্পর্কিত চুক্তিরই পরিপূরক ছিল। দুঃখজনকভাবে এই উদ্যোগ এবং সরকারি পর্যায়ে আশাবাদ সত্ত্বেও আজ পর্যন্ত একজন রোহিঙ্গাকেও ফেরত পাঠানো যায়নি। এর কারণ এই প্রত্যাবাসনের ব্যাপারে মিয়ানমার কখনোই অঙ্গীকারবদ্ধ ছিল না। আর ওই চুক্তির কিছু অন্তর্নিহিত দুর্বলতা ছিল, যার সুযোগ তারা পুরোটাই গ্রহণ করেছে। রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে মিয়ানমারের ওপর যতটুকু আন্তর্জাতিক চাপ প্রয়োগ করা দরকার ছিল, শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলো নিজেদের স্বার্থের কারণে তা করেনি। সব মিলিয়ে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া অবাস্তবায়িত থেকে গেছে।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: সেই চুক্তিতে বলা হয়েছিল দুই বছরের মধ্যে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন সম্পন্ন হবে। অনেকেই তখন আন্তর্জাতিক কোনো গ্যারান্টি ছাড়া এ ধরনের দ্বিপক্ষীয় চুক্তির সফলতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন। সেটাই তো সত্যি প্রমাণিত হলো?

সি আর আবরার: অবস্থাদৃষ্টে তাই মনে হচ্ছে। সুপ্রতিবেশী হিসেবে বাংলাদেশ যে আস্থার সঙ্গে ওই চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছিল, তার যথাযথ সম্মান মিয়ানমার করেনি। মিয়ানমারের কট্টর সমর্থক ও বাংলাদেশের বন্ধুপ্রতিম একটি দেশ এই চুক্তি স্বাক্ষরের ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছিল বলে বিভিন্ন মহলে আলোচনা আছে। এই চুক্তির যথাযথ বাস্তবায়ন না হওয়ার দায় সেই রাষ্ট্রের ওপরও অনেকটা বর্তায়। তাই অবশ্যই বলা যেতে পারে এই ধরনের প্রত্যাবাসন চুক্তির ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক সম্পৃক্ততার প্রয়োজন ছিল।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: মিয়ানমারে সামরিক শাসন জারি হওয়ার পর অনেকে ভেবেছিলেন প্রত্যাবাসনের কাজ সহজ হবে। কোন বিবেচনা থেকে তা মনে করা হয়েছিল?

সি আর আবরার: মিয়ানমারে সামরিক অভ্যুত্থান সেনাশাসন কায়েমের পর যাঁরা ভেবেছিলেন প্রত্যাবাসনের কাজ সহজ হবে, তাঁদের ওই ধারণাটা ছিল সম্পূর্ণ ভুল। ক্ষমতা দখলের পরপরই গণহত্যার সঙ্গে যুক্ত সামরিক বাহিনীর নতুন শাসকেরা নিজেদের আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তি বৃদ্ধির কৌশল হিসেবে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের ইতিবাচক ধারণা দিয়েছিলেন। এর কোনো নৈতিক বা বাস্তব ভিত্তি কখনোই ছিল না। তাই এর ওপর আস্থা রাখার কোনো কারণ আমি খুঁজে পাই না। আমাদের মনে রাখতে হবে যে রোহিঙ্গা প্রশ্নে সামরিক শাসকদের সঙ্গে অং সান সু চির এনএলডি পার্টির ন্যূনতম পার্থক্য ছিল না এবং এখনো নেই। পরিস্থিতির চাপে পড়ে তারা মাঝেমধ্যে তাদের সুর বদলায়।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: এখন আমরা দেখছি রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে কোনো আলোচনাও নেই। আমরা কি অনেকটা হাল ছেড়ে দেওয়ার মতো অবস্থার মধ্যে পড়েছি?

সি আর আবরার: এটা অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় যে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ায় কোনো রকম অগ্রগতি নেই। তারপরও আন্তর্জাতিক এবং দ্বিপক্ষীয় বিভিন্ন ফোরামে প্রত্যাবাসনের দাবি আমাদের জোরের সঙ্গে অব্যাহতভাবে বজায় রাখতে হবে, তেমনি আমাদের বাস্তবমুখী হয়ে বিবেচনায় রাখতে হবে যে অদূর ভবিষ্যতে এই প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া সম্পন্ন হবে না। তার বড় দুটি কারণ হলো বৃহৎ শক্তিগুলোর অবস্থান এর জন্য অনুকূল নয় এবং মিয়ানমারে সামরিক বাহিনীর সঙ্গে সংখ্যাগরিষ্ঠ বামার জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধি ‘প্রবাসী ন্যাশনাল ইউনিটি গভর্নমেন্টের’ সমর্থকদের গৃহযুদ্ধ চলছে। একই সঙ্গে রোহিঙ্গা–অধ্যুষিত আরাকান অঞ্চলে আরাকান আর্মির মিয়ানমার কেন্দ্রীয় সরকারবিরোধী সামরিক তৎপরতা সাম্প্রতিক কালে বৃদ্ধি পেয়েছে। এ ধরনের একটা জটিল পরিস্থিতিতে আরাকান অঞ্চল যত দিন পর্যন্ত কোনো নির্দিষ্ট একক বিজয়ীর নিয়ন্ত্রণে না আসবে, তত দিন পর্যন্ত রোহিঙ্গাদের স্বভূমিতে প্রত্যাবাসন আশা করা সম্ভবত ঠিক হবে না। তাই রোহিঙ্গা শরণার্থী ব্যবস্থাপনার বিষয়ে আমাদের নতুন করে চিন্তাভাবনা করতে হবে।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: আন্তর্জাতিক পর্যায়ে রোহিঙ্গা ইস্যুতে সরকারের কূটনৈতিক তৎপরতায় কোনো ধরনের ঘাটতি আছে বলে মনে করেন কি?

সি আর আবরার: মুখে যতই মানবাধিকার এবং আইনের শাসনের কথা বলা হোক না কেন, আন্তরাষ্ট্রীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে সব দেশই যে তাদের নিজের স্বার্থকেই প্রাধান্য দিয়ে থাকে, তার জলজ্যান্ত উদাহরণ রোহিঙ্গা গণহত্যার পরও মিয়ানমারের প্রতি বিভিন্ন দেশের অব্যাহত সমর্থন। ওই দেশের ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব এবং দেশটিতে মজুত প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণকে কেন্দ্র করে যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, চীন, ভারতসহ বিভিন্ন দেশ তাদের বিনিয়োগ, বাণিজ্য ও অন্যান্য কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। গণহত্যার অভিযোগে অভিযুক্ত একটা রাষ্ট্রের সঙ্গে বৃহৎ দেশগুলোর এ ধরনের ন্যক্কারজনক সমর্থন খুবই হতাশাজনক। কিন্তু এ ধরনের বাস্তবতা কূটনৈতিক তৎপরতার ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে এক বিশেষ চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দিয়েছে।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: রোহিঙ্গাদের আশ্রয়শিবিরগুলোর ভেতরকার নিরাপত্তা ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি খুব ভালো নয় বলে বিভিন্ন মহল থেকে শোনা যায়। সম্প্রতি রোহিঙ্গাদের এক নেতা শিবিরের ভেতরে খুন হয়েছেন। শিবিরগুলোর নিরাপত্তা ও ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে বিশেষ কোনো উদ্যোগ নেওয়ার সুযোগ আছে কি?

সি আর আবরার: রোহিঙ্গা আশ্রয়শিবিরে আইনশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তার বিষয়টি বেশ কিছুদিন ধরে উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে। তবে নিরাপত্তাবেষ্টনীতে থাকা ক্যাম্পের ভেতরে শরণার্থী নেতার খুন হওয়ার ঘটনাটি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। এর আগেও বেশ কয়েকজন শরণার্থী হত্যার খবর গণমাধ্যমে এসেছে। একই সঙ্গে ইদানীং শিবিরগুলোতে আগুন লাগার ঘটনাও বেড়ে গেছে। অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে যথাযথ সাহায্য দেওয়া যেমন জরুরি, তেমনি জরুরি হচ্ছে এ ঘটনাগুলোর যথাযথ তদন্ত করে দোষী ব্যক্তিদের বিচারের আওতায় আনা। এ ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ ক্যাম্পে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়নের পূর্বশর্ত। এসব কার্যকর করা গেলে ক্যাম্পে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা ও ক্যাম্পসংশ্লিষ্ট সব অংশীদারই কিছুটা স্বস্তি পাবেন।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে যেহেতু দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি দেখা যাচ্ছে না, এমন পরিস্থিতিতে এ শিবিরগুলো নিয়ে সরকারের সামনের উদ্যোগ কী হতে পারে?

সি আর আবরার: আগেই বলেছি, শিগগিরই রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে পাঠানো সম্ভব হবে বলে মনে হয় না। এখানে যা বিবেচনায় রাখা প্রয়োজন তা হচ্ছে যেকোনো শিক্ষাবঞ্চিত, অসচেতন এবং দরিদ্র জনগোষ্ঠী অন্যের প্ররোচনায় সহজেই নানা ধরনের অপকর্মের সঙ্গে যুক্ত হতে পারে। তাই সে বাস্তবতায় একটি সচেতন, সৃজনশীল ও উৎপাদনমুখী জনগোষ্ঠী তৈরি করার জন্য উদ্যোগ নেওয়া বিশেষভাবে জরুরি হয়ে পড়েছে। এর অন্যতম পূর্বশর্ত হচ্ছে তাদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, দক্ষতা বৃদ্ধি ও জীবিকা অর্জনের জন্য কার্যক্রম হাতে নেওয়া এবং এর দায়িত্ব বিশ্ব সম্প্রদায়কেই গ্রহণ করতে হবে।

রোহিঙ্গাদের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে খুব স্বাভাবিকভাবেই বিভিন্ন গোষ্ঠী, যেমন ধর্মীয় জঙ্গিগোষ্ঠী বা মানব, মাদক ও আগ্নেয়াস্ত্র পাচারকারী তাদের অপকর্মে রোহিঙ্গাদের যুক্ত করার চেষ্টা চলিয়ে যাবে। এটা একটা ঝুঁকির জায়গা। তবে শিবিরে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের এসব অপকর্মের মূল হোতা হিসেবে বিবেচনা করার সুযোগ নেই। কারণ, ২০১৭ সালের আগস্টে বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের প্রবেশের ঢল নামার আগে থেকেই কক্সবাজার ও টেকনাফ অঞ্চলে যে ওই ধরনের গোষ্ঠী তৎপর ছিল, তা স্থানীয় এবং জাতীয় বিভিন্ন পত্রপত্রিকার প্রতিবেদন থেকে আমরা জানি। নিঃসন্দেহে এ ধরনের পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হলে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে সচেতন ও সক্রিয় করতে হবে এবং তাদের আস্থা অর্জন করতে হবে। গণহত্যার ভুক্তভোগী শরণার্থী জনগণকে জাতীয় নিরাপত্তার লেন্স দিয়ে না দেখে মানবতার লেন্স দিয়েই দেখতে হবে। মনে রাখতে হবে এ বিবেচনা থেকেই বাংলাদেশ সরকার তাদের আশ্রয় প্রদান করেছে এবং একটি সংবেদনশীল দেশ হিসেবে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিশেষ সম্মানের অবস্থানে অধিষ্ঠিত হয়েছে।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: আপনি রোহিঙ্গা সমস্যাকে জাতীয় নিরাপত্তার লেন্স দিয়ে না দেখে মানবতার লেন্স দিয়ে দেখার কথা বললেন। কিন্তু মিয়ানমার ও আরাকানকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন সশস্ত্র গোষ্ঠী এই অঞ্চলে তৎপর রয়েছে। রোহিঙ্গাদের একটি অংশও এসব তৎপরতায় জড়িত বলে অভিযোগ আছে। ফলে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক নিরাপত্তার একটি ঝুঁকি তো রয়েছেই।

সি আর আবরার: প্রায় ৭০ বছর ধরে সংখ্যাগরিষ্ঠ বামার নিয়ন্ত্রিত বর্মি রাষ্ট্র সেই দেশের বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর সঙ্গে সংঘাতে লিপ্ত। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সেই সংঘাত প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর ওপরও প্রভাব ফেলছে। সে তুলনায় আরাকান অঞ্চল অপেক্ষাকৃত স্থিতিশীল ছিল এবং সেখানকার রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী মূলত শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করছিল। ১৯৭০–এর দশকের শেষ দিক থেকে ওই দেশের সামরিক শাসকেরা রোহিঙ্গা নিধনকারী নানান পরিকল্পনা গ্রহণ করে, পরে রোহিঙ্গা নিপীড়নের অন্যতম হাতিয়ার হয়ে দাঁড়ায় ১৯৮২ সালের নাগরিকত্ব আইন। এই আইনের মাধ্যমেই রোহিঙ্গাদের রাষ্ট্রহীন করা হয়। আরাকান অঞ্চলে ১৯৭৮ এবং ১৯৯১ সালে ব্যাপক রোহিঙ্গা নিধন অভিযান পরিচালিত হয়। এই প্রক্রিয়া পরবর্তী সময়েও অব্যাহত থাকে, যা অল্প তাপের গণহত্যা বা স্লো বার্নিং জেনোসাইড হিসেবে বিবেচিত। ইদানীং আরাকানে বৌদ্ধ সম্প্রদায় নিয়ন্ত্রিত আরাকান আর্মির তৎপরতা বেড়ে গেছে। মিয়ানমার রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে আরাকান আর্মির এই তৎপরতা বৃদ্ধিতে চীন বিশেষভাবে উদ্বিগ্ন, কারণ আরাকান অঞ্চলে তাদের বড় ধরনের বিনিয়োগ রয়েছে। একই সঙ্গে রোহিঙ্গা সমস্যা প্রলম্বিত হলে একদিকে মিয়ানমার রাষ্ট্রের রোহিঙ্গাবিরোধী নির্যাতন-নিপীড়ন এবং অন্যদিকে আরাকানে উগ্র বৌদ্ধদের রোহিঙ্গাবিরোধী তৎপরতা প্রতিরোধে রোহিঙ্গাদের একটি অংশ সশস্ত্র পথ ধরতে পারে, যা পুরো অঞ্চলকেই আরও অস্থিতিশীল করে তুলতে পারে।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: যুক্তরাষ্ট্র-চীনের বৈশ্বিক বিরোধের ছায়া এই অঞ্চলের ওপরও জোরালোভাবে পড়তে যাচ্ছে বলে অনেকে মনে করছেন। এই পরিস্থিতি রোহিঙ্গা সমস্যার ওপর কতটুকু ও কোন ধরনের প্রভাব ফেলতে পারে?

সি আর আবরার: রোহিঙ্গা প্রশ্নে চীন এবং যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানে মৌলিক কোনো পার্থক্য আছে বলে আমি মনে করি না। দেশ দুটির অবস্থান প্রায় একই। দুটি দেশই মিয়ানমারের সরকারকে সমর্থন এবং প্রশ্রয় দিয়ে এসেছে এবং দিচ্ছে। চীন সরাসরিভাবে মিয়ানমারের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে, অন্যদিকে বাইডেন প্রশাসনের অধীনে মিয়ানমার–সংক্রান্ত নতুন নীতি প্রণয়নের যে সম্ভাবনা আশা করা গিয়েছিল, তা ঘটেনি। সম্প্রতি এটা পরিষ্কার হয়েছে যে ডেমোক্রেটিক পার্টির নিয়ন্ত্রণে থাকা মার্কিন কংগ্রেসে মিয়ানমার–সংক্রান্ত পরিবর্তনের চাপ থাকা সত্ত্বেও বাইডেন প্রশাসন মিয়ানমারে নিয়োজিত মার্কিন তেল কোম্পানি শেভরনসহ বিভিন্ন করপোরেশনের স্বার্থে ট্রাম্প প্রশাসনের পূর্ববর্তী নীতিই কার্যকর রেখেছে। সুতরাং সব দিক থেকেই মিয়ানমারে ক্ষমতায় থাকা প্রশাসন একটা সুবিধাজনক অবস্থানের মধ্যেই রয়েছে, অদূর ভবিষ্যতে যা পরিবর্তনের সম্ভাবনা ক্ষীণ।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ায় অগ্রগতি নেই, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও রোহিঙ্গা শরণার্থী বিষয়টি গুরুত্ব হারাচ্ছে, এই ধরনের বাস্তবতায় বাংলাদেশের কী করা উচিত?

সি আর আবরার: নিঃসন্দেহে বলা যায় বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের নিয়ে একটি বড় ধরনের সংকটের মধ্যে আছে। শরণার্থীদের অবস্থান উখিয়া-টেকনাফ অঞ্চলের জনগণ এবং পরিবেশের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলেছে। যদিও শরণার্থীদের দেখভালের মূল খরচ আপাতত আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বহন করছে, তবে বিদ্যমান অস্থির বিশ্ব পরিস্থিতিতে সেটা যে অব্যাহত থাকবে, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। একই সঙ্গে শরণার্থীদের প্রতি একধরনের সহানুভূতির ঘাটতি লক্ষ করা যাচ্ছে, যা তাদের অবস্থা আরও সঙিন করে তুলতে পারে। আমাদের মনে রাখতে হবে রোহিঙ্গারা গণহত্যা থেকে জীবন বাঁচাতে এই দেশে এসেছে, যেমন ১৯৭১ সালে জীবন বাঁচাতে আমরা ভারত এবং বার্মার আরাকান অঞ্চলেই আশ্রয় নিয়েছিলাম। আমাদের সৌভাগ্য যে ৯ মাসেই মুক্তিযুদ্ধ শেষ হয়েছিল।

জাতীয় নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে এই শরণার্থীদের প্রতি মানবিক আচরণ অব্যাহত রাখতে হবে। কারণ, একটি শিক্ষা ও কর্ম সুযোগবঞ্চিত, হতাশ ও বিচ্ছিন্নতাবোধে আক্রান্ত জনগোষ্ঠী যেকোনো সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য বিপদ ডেকে আনতে পারে। আগেই বলেছি এই ধরনের জনগোষ্ঠীর দুষ্টচক্র দ্বারা প্রভাবিত হওয়ার আশঙ্কা অনেক বেশি থাকে। তা ছাড়া গত চার বছরে রোহিঙ্গা বিষয়ে বাংলাদেশ বড় ধরনের নৈতিক পুঁজি বিনিয়োগ করেছে, যা দেশকে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে একধরনের ‘সফট-পাওয়ার’ অর্জনে সাহায্য করেছে। তাই এই স্পর্শকাতর বিষয়ে তড়িঘড়ি বিসদৃশ সিদ্ধান্ত গ্রহণ না করে বাস্তবতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ, নৈতিকভাবে জোরালো এবং সুষ্ঠু ও সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার প্রয়োজন।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: আপনাকে ধন্যবাদ।

সি আর আবরার: আপনাকেও ধন্যবাদ।