বিশেষ সাক্ষাৎকার এম হুমায়ুন কবির

ভারত-চীনের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করা সহজ হবে না

বাংলাদেশের নির্বাচন ও নতুন সরকারের দায়িত্ব নেওয়ার প্রেক্ষাপটে আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক সম্পর্কের গতিপ্রকৃতি, ভূরাজনীতি, বড় শক্তিগুলোর সঙ্গে সম্পর্কের ভারসাম্য, বাণিজ্যিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থ এবং পররাষ্ট্রনীতির চ্যালেঞ্জগুলো নিয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ুন কবির। তিনি বর্তমানে বাংলাদেশ এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউটের সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন এ কে এম জাকারিয়া

প্রথম আলো:

বাংলাদেশের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিশ্বশক্তিগুলোর বিভক্তি ছিল স্পষ্ট। একদিকে চীন, ভারত ও রাশিয়া, অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমের দেশগুলো। বাংলাদেশের এই নির্বাচন কি বৈশ্বিক পক্ষগুলোর কোনো একটিকে বিজয়ী বা কোনো পক্ষকে পরাজিত করল?

এম হুমায়ুন কবির: বাংলাদেশের নির্বাচনের ফলাফল বা প্রক্রিয়া আমাদের জন্যই বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এটা সেই অর্থে বাইরের পৃথিবীকে খুব প্রভাবিত করবে না। নির্বাচন ভালো হলে সরকার শক্তিশালী হয়, বৈধতার বিষয়টি নিশ্চিত হয় এবং কাজ করার সক্ষমতা বাড়ে। আর তা না হলে রাজনৈতিক ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা দুর্বল হয়, প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো নষ্ট হয়। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয় দেশের মানুষ। তাই আমি মনে করি, বাংলাদেশের নির্বাচন শেষ বিচারে বাংলাদেশের জনগণের বিষয়।

আর বাইরের পৃথিবীর যে কথা আপনি বলছেন, সেদিক থেকে দেখলে তারা আসলে তাদের স্বার্থ ও নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই কথা বলে এবং ভবিষ্যতেও বলবে। এখন বিষয়টিকে আমরা কীভাবে পরিচালিত করব, আমাদের নিজস্ব স্বার্থকে কীভাবে যুক্ত করব, সেটা হচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ। আর এটা নির্ভর করবে আমাদের দক্ষতা ও সক্ষমতার ওপর।

প্রথম আলো:

সেটা কী রকম?

এম হুমায়ুন কবির: দেখুন, আমাদের দক্ষতা থাকলেই আমরা হয়তো কোনো পক্ষের দিকে ঝুঁকে পড়ব না। যদি তা না থাকে, তবে কোনো পক্ষের দিকে ঝুঁকে পড়ার ঝুঁকি থাকবে। এটা আমাদের জাতীয় স্বার্থ, নিরাপত্তা, অর্থনীতি বা কূটনীতি—কোনো কিছুর জন্যই ভালো হবে বলে মনে করি না। আমাদের সক্ষমতার ওপর নির্ভর করবে আমরা অন্যের কাছ থেকে কতটা নিজেদের স্বার্থ রক্ষা ও সম্মান আদায় করতে পারব। প্রথমত, আমাদের মনে রাখতে হবে যে আমাদের ভাবমূর্তি গণতান্ত্রিক দেশের ভাবমূর্তি। আমাদের সংবিধান ও রাজনৈতিক কাঠামো গণতান্ত্রিক। এটা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের মন্ত্র, রাষ্ট্রের মন্ত্র। গণতন্ত্রের ওপর ভিত্তি করেই আমরা দাঁড়াতে চাই। দ্বিতীয়ত, অর্থনৈতিক দিক থেকে দেখলে আমদানি, রপ্তানি বা সহায়তা—এসব বিবেচনায় যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ, কানাডা, জাপান, ভারত, চীন—সব দেশের সঙ্গেই আমাদের স্বার্থের সম্পর্ক রয়েছে। এখানে এক পক্ষকে ছেড়ে অন্য পক্ষকে গুরুত্ব দেওয়ার সুযোগ খুব বেশি নেই।

আমি মনে করি, এই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে আমরা বিজয়ী হলাম কি না, সেটাই আসলে বড়। আমরা বিজয়ী হলেই যুক্তিসংগত ও বাস্তবসম্মতভাবে আমরা সবার সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখতে পারব। আর আমরা যদি হেরে যাই, তবে আমরা আমাদের জাতীয় স্বার্থ রক্ষা করতে পারব না।

প্রথম আলো:

বাংলাদেশের নতুন সরকারকে চীন, ভারত বা রাশিয়ার মতো দেশগুলো অভিনন্দন জানাবে, এটা প্রত্যাশিত ছিল। কিন্তু নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রসহ ইউরোপীয় দেশগুলো কী অবস্থান নেয়, তা নিয়ে সংশয় ছিল। কিন্তু সেখান থেকেও অভিনন্দন এসেছে। সরকারের জন্য এটা বেশ স্বস্তির বিষয়। আমাদের নির্বাচন নিয়ে পশ্চিমা দেশগুলোর অবস্থান কি নির্বাচনের পর বদলে গেছে?

এম হুমায়ুন কবির: এখানে বুঝতে হবে, কোনো দেশের সঙ্গে সম্পর্কের বিষয়টি কয়েক স্তরে কাজ করে। রাষ্ট্রে রাষ্ট্রে সম্পর্ক, সরকারের সঙ্গে সরকারের সম্পর্ক এবং নাগরিক পর্যায়ে সম্পর্ক। কূটনীতির ক্ষেত্রে এই বিষয়গুলো বিবেচনায় নেওয়া উচিত। যুক্তরাষ্ট্র যা বলেছে, সেখানে নাগরিক সমাজ ও জনগণের সঙ্গে সম্পর্কের বিষয়টিতে জোর দেওয়া হয়েছে। আর রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কের বিষয়টি তো যুক্তরাষ্ট্রের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। ফলে একটা স্তরে শিষ্টাচার বজায় রাখা জরুরি। নির্বাচনের পর কূটনৈতিক শিষ্টাচার বজায় রেখেই যুক্তরাষ্ট্র তার অবস্থান প্রকাশ করেছে।

ইউরোপীয় ইউনিয়ন বাংলাদেশের সঙ্গে কাজ করার কথা বলেছে, তবে সঙ্গে এটাও পরিষ্কার করে দিয়েছে যে অধিকারসংক্রান্ত বিষয়ে তাদের শর্ত পূরণ করতে না পারলে বাংলাদেশ জিএসপি প্লাস সুবিধা থেকে বঞ্চিত হতে পারে। মানে বাংলাদেশের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। আমরা সম্পর্কের বহুমাত্রিক দিকগুলো না দেখে সরকারের দিক থেকে দেখে অভ্যস্ত। এভাবে দেখলে পরিষ্কার চিত্র পাওয়া যাবে না। সবগুলোকে একসঙ্গে দেখতে হবে। এটা আমাদের মনে রাখতে হবে যে বিদেশের সঙ্গে সম্পর্কের বিষয়টি দেশের রাজনীতির মতো নয়। এটা বহুস্তরে কাজ করে।

প্রথম আলো:

বিরোধী দলের ভোট বর্জন, ভোট পড়ার কম হার ও নানা অনিয়মের অভিযোগের কারণে এ নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে বিভিন্ন মহলে প্রশ্ন আছে। বর্তমান আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে কোনো দেশের নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হলো কি হলো না, তার গুরুত্ব কতটা?

এম হুমায়ুন কবির: আমার বিবেচনায় এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। একটি রাষ্ট্রের চরিত্র কী বা তা কোথায় যাচ্ছে, তা বলে দেয় একটি নির্বাচন। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের কাউন্সেলর ডেরেক শোলে বলেছিলেন, বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা শক্তিশালী না হলে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক সীমিত হতে পারে। ইইউ থেকে অনেকবার বলা হয়েছে যে বাংলাদেশের নির্বাচন ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা শক্তিশালী হলে জিএসপি প্লাস সুবিধা পাওয়া সহজ হবে। তার মানে এই নির্বাচনের সঙ্গে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের বিষয়টি জড়িত।

তা ছাড়া ২০২৬ সালে বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশের পর্যায়ে প্রবেশ করছে। এর একটি রাজনৈতিক দিক আছে। এতে বাংলাদেশের মানমর্যাদা বাড়বে। কিন্তু এর সঙ্গে কিছু বাড়তি চাহিদাও তৈরি হবে। বাণিজ্য, বিনিয়োগ, সহায়তা, ঋণ, রেমিট্যান্স, প্রযুক্তি স্থানান্তর—সব ক্ষেত্রেই বাংলাদেশকে এক নতুন বাস্তবতার মুখোমুখি হতে হবে। আমরা এসব ক্ষেত্রে এখন পর্যন্ত বিশেষ রেয়াত পেয়ে আসছি। ২০২৬ সালের পর তা আর থাকবে না।

কাজটি কিন্তু সহজ হবে না। বলা যায়, ৫৫ বছর ধরে একভাবে চলার পর নতুন করে শুরু করতে হবে। বাইরের বিশ্বের সঙ্গে তখন প্রতিযোগিতা করে টিকে থাকতে হবে। সে জন্য আমাদের অভ্যন্তরীণ অনেক সংস্কার লাগবে। ট্যাক্সব্যবস্থা বদলাতে হবে, দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য শিক্ষাব্যবস্থা বদলাতে হবে, ব্যাংকিং ব্যবস্থাকে বৈশ্বিক মানের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হবে। এগুলোর সঙ্গে কিন্তু আমাদের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সম্পর্ক রয়েছে। কাজেই আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে আমাদের নির্বাচনের গুরুত্ব রয়েছে। আপনি দেখবেন, অনেক দেশেই নির্বাচন একটি দেশের ভাগ্যকে ইতিবাচক-নেতিবাচক নানা দিকে নিয়ে গেছে।

প্রথম আলো:

বিশ্বে যেসব দেশ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে বিবেচিত, তারা নিজ দেশের অর্থনৈতিক ও অন্যান্য কৌশলগত স্বার্থের বাইরে অন্য দেশের গণতন্ত্র নিয়ে আসলে কতটা চিন্তিত? বিশ্বের সবচেয়ে বড় গণতান্ত্রিক দেশ ভারত নাকি এখন অন্য দেশের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে গণতন্ত্রকে বিবেচনার মধ্যেই রাখে না। এটাই কি বাস্তবতা?

এম হুমায়ুন কবির: বিশ্বে যারা গণতান্ত্রিক দেশ, তারা দুই স্তরে সম্পর্ক রক্ষা করে। যুক্তরাষ্ট্র থেকে শুরু করে ইউরোপীয় দেশগুলো এবং কানাডা বা অস্ট্রেলিয়ার মতো বড় দেশগুলো চায়, তাদের আদর্শ ও ব্যবস্থা অন্য দেশগুলোতে সম্প্রসারিত হোক। আপনি বললেন, ভারত বিশ্বের সবচেয়ে বড় গণতান্ত্রিক দেশ, এটা তাদের জন্য একটি মর্যাদার বিষয়। বর্তমান বিশ্বব্যবস্থার কেন্দ্রীয় উপাদানই হচ্ছে নিজেদের শাসনব্যবস্থার ধরন অন্য দেশে সম্প্রসারণ। পশ্চিমা দেশগুলো যখন গণতন্ত্রের কথা বলে, তখন কিন্তু তারা নিজস্ব মূল্যবোধের বিস্তারের অংশ হিসেবেই বলে।

এর বাইরে আছে কৌশলগত দিক। বর্তমান বিশ্ব যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের প্রতিযোগিতার মধ্যে পড়েছে। এখন এই প্রতিযোগিতায় যুক্তরাষ্ট্র তার জাতীয় স্বার্থে গণতন্ত্র, ভূরাজনৈতিক কৌশল—সবকিছুকেই কাজে লাগাতে পারে। বিশ্ব অর্থনৈতিক কাঠামো যেহেতু এখন ইউরো-আটলান্টিক থেকে ইন্দো-প্যাসিফিকের দিকে সম্প্রসারিত হচ্ছে, তাই চীনের উত্থান যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমকে চিন্তিত করেছে। তারা এ অঞ্চলে চীনের উত্থান ঠেকাতে চায়। যদিও তারা চীনের সঙ্গে কোনো ধরনের সংঘাতে যেতে চায় না। এ অঞ্চলকে ঘিরে যেহেতু এখন বিশ্ব ভূরাজনীতি আবর্তিত হচ্ছে, তাই বঙ্গোপসাগরের দেশ হিসেবে বাংলাদেশও এর অংশ হয়ে পড়েছে। আমরা চাই বা না চাই বাংলাদেশ এই ঘূর্ণাবর্তের মধ্যে ঢুকে যাচ্ছে। সবাই চাইছে, বাংলাদেশ তার পক্ষে থাকুক। চীন বাংলাদেশে তার প্রকল্পগুলোকে বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের সঙ্গে যুক্ত করতে চায়, আর যুক্তরাষ্ট্র সবকিছু দেখতে চায় তার ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলের প্রেক্ষাপটে।

আগেই বলেছি যে গণতান্ত্রিক দেশগুলো কাজ করে দুই স্তরে। একটি মূল্যবোধ, অন্যটি স্বার্থ। ভারত এ অঞ্চলের উদীয়মান শক্তি, কিন্তু বিশ্বরাজনীতির ক্ষমতার খেলায় তারা প্রধান শক্তি নয়। কিন্তু দক্ষিণ এশিয়ায় তারা অবশ্যই প্রধান শক্তি। ফলে এখানে তারা আসলে নিজেদের প্রভাব বিস্তার করতে চায় এবং এ ক্ষেত্রে স্বার্থই বড় হয়ে দাঁড়ায়। গণতন্ত্র বা মূল্যবোধ এখানে প্রধান নয়, যদিও তারা বিশ্বের সবচেয়ে বড় গণতন্ত্র। এটাই বাস্তবতা।

প্রথম আলো:

ভারত ও চীন বাংলাদেশের ৭ জানুয়ারির নির্বাচনে সরকারের প্রতি প্রকাশ্যে তাদের অবস্থান ও সমর্থন জানিয়েছে। কিন্তু আঞ্চলিক প্রভাব বিস্তারে কৌশলে চীন ও ভারতের সম্পর্ক বিরোধপূর্ণ। কেউ বলছেন এই দুটি দেশের চাওয়া-পাওয়ার হিসাব-নিকাশে ভারসাম্য রক্ষায় বাংলাদেশ খুব সমস্যায় পড়বে না। আবার অনেকে মনে করছেন, কাজটি সহজ হবে না। আপনার মন্তব্য কী?

এম হুমায়ুন কবির: আমি মনে করি, এই দুই দেশের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা বাস্তব এবং এ নিয়ে প্রতিক্রিয়াটাও বাস্তব। এই পরিস্থিতি আমাদের ওপর প্রভাব বিস্তার করবে। সেই কারণে আমি মনে করি যে দুই দেশের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষার কাজটি বাংলাদেশের জন্য সহজ হবে না। আমাদের এ ক্ষেত্রে বেশ কৌশলী হতে হবে। কূটনীতিতে সাম্প্রতিক সময়ে আমরা একটি টার্ম ব্যবহার করি, ‘মাল্টি অ্যালাইনমেন্ট’, সেই কৌশল নিতে হবে। আমাদের কৌশলী হতে হবে। কারণ, ভারতের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কের ক্ষেত্রে নিরাপত্তার বিষয়টি সম্পৃক্ত। ভারতের নিরাপত্তার ব্যাপারে আমাদের সংবেদনশীল থাকতে হবে। ভারতের সঙ্গে আমাদের অর্থনৈতিক যুক্ততাও গভীর। এ ছাড়া ভারতের যে ভূরাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি, তার সঙ্গেও আমরা সম্পৃক্ত। এই তিন বিষয় ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে আমাদের সব সময় মনে রাখতে হবে।

আবার বাংলাদেশের যে অর্থনৈতিক সমর্থন প্রয়োজন, তা ভারতের পক্ষে পূরণ করা সম্ভব নয়। ফলে আমাদের চীনের কাছে যেতে হয়। এ ছাড়া একটি পরাশক্তি হিসেবেও চীনের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখা জরুরি। চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক মূলত অর্থনৈতিক ও কৌশলগত। তবে চীন ও ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের ভারসাম্য বজায় রাখার কাজটি বাংলাদেশের জন্য সহজ হবে না। কারণ, বাংলাদেশের কাছে দুই দেশেরই কিছু চাওয়া আছে, যা পরস্পরের কাছে গ্রহণযোগ্য না-ও হতে পারে।

প্রথম আলো:

এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের কৌশল কী হওয়া উচিত বলে আপনি মনে করেন?

এম হুমায়ুন কবির: কৌশলী হওয়ার উপাদান হিসেবে আমি কয়েকটি বিষয় বলতে চাই। প্রথমত, এর জন্য দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক সংহতি জোরদার করতে হবে। অর্থনৈতিক পরিকল্পনাকেও শক্তিশালী করতে হবে, অভ্যন্তরীণভাবে নিজেদের সক্ষমতা বাড়াতে হবে। সম্পর্কের ভারসাম্য রক্ষার কাজটি আমরা করি, তবে এ ক্ষেত্রে আমরা সাধারণত রিঅ্যাকটিভ ভূমিকা পালন করি। কিন্তু আমি মনে করি, এটা প্রোঅ্যাকটিভ হওয়া উচিত। কোনো কিছু আগেই জানানো। আমি যদি ভারতের সঙ্গে কথা বলি, তবে তা চীনকে জানানো যে আমি ভারতের সঙ্গে এই বিষয়ে কাজ করছি বা চীনের সঙ্গে যদি কিছু করি, তা ভারতকে জানানো যাতে কোনো ভুল-বোঝাবুঝি না হয়। আমি প্রোঅ্যাকটিভ বলতে এটা বোঝাচ্ছি। মানে, কৌশলী হয়ে আপনাকে আগেই বলে দিতে হবে যে আপনি কী করছেন। এই কৌশলে অনেক কিছুই নিউট্রালাইজড করা সম্ভব।

প্রথম আলো:

বাংলাদেশের নির্বাচনের বেশ আগে থেকেই যুক্তরাষ্ট্রের বেশ দৌড়ঝাঁপ লক্ষ করা গিয়েছিল। কিন্তু নির্বাচনের ঠিক আগে আগে তারা অনেকটাই চুপচাপ হয়ে যায়। যুক্তরাষ্ট্রের এ অবস্থান কি কৌশলগত?

এম হুমায়ুন কবির: আমি মনে করি, এটা তাদের ধারাবাহিক কাজের অংশ। সেখানে তারা তাদের প্রয়োজন অনুয়ায়ী কখনো সরব থাকে, কখনো নীরব। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের যে লক্ষ্য, তা থেকে তারা সরেছে বলে মনে হয় না। তারা যে তাদের লক্ষ্য থেকে সরেনি, তা নির্বাচনের পরপরই ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিলের মুখপাত্র জন কারবি পরিষ্কার করেছেন। তিনি বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানের কোনো পরিবর্তন হয়নি। এখানে আমাদের কিছু বিষয় মনে রাখা প্রয়োজন। যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত পিটার হাস যখন শপথ অনুষ্ঠানে বঙ্গভবনে গেছেন এবং সেখানে তাঁর হাসিখুশি ভাব দেখে অনেকেই বলতে শুরু করেছেন, সব ঠিক হয়ে গেছে। বিষয়টি আসলে তা নয়। মার্কিনরা অনেক গভীরে কাজ করে। তারা তথ্য-উপাত্ত বিবেচনায় নিয়ে বিচার-বিশ্লেষণ করেই সিদ্ধান্তে আসে। তারা আপনার সঙ্গে হাসি দিয়ে কথা বলল তার অর্থ এই নয় যে তারা আপনার সঙ্গে একমত হয়েছে বা আপনার বিষয়গুলো মেনে নিয়েছে। আমি মনে করি, তাদের যে লক্ষ্য তা অর্জনে তারা কাজ করে যাচ্ছে, তা নীরবে হোক অথবা সরবে।

প্রথম আলো:

৭ জানুয়ারির নির্বাচন যে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে পছন্দ হয়নি, তা তারা পরিষ্কার করেছে। এর আগে সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য চাপ দিতে তারা ভিসা নীতি প্রয়োগ করেছে এবং এ ব্যাপারে কঠোর অবস্থান নেওয়ার কথা বলেছে। নির্বাচনের পর এখন সামনে নতুন কোনো চাপ আসতে পারে কি?

এম হুমায়ুন কবির: এটা বলা মুশকিল। প্রতিটি দেশ তার স্বার্থ ও দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সিদ্ধান্ত নেয়। তবে আমি মনে করি, নির্বাচনের পর সরকার কী করে বা কোন দিকে যায়, সেদিকে তাদের নজর থাকবে এবং তার ওপর ভিত্তি করেই তারা তাদের সিদ্ধান্ত নেবে। আমার ধারণা, সরকার যদি রাজনৈতিক পরিস্থিতি সহজ করার পথ ধরে, সে ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র তা বিবেচনায় নেবে। বিষয়টি অনেকটা আমাদের ওপরই নির্ভর করছে। আমরা কী করছি, তা বিবেচনায় নিয়েই তারা সামনে সিদ্ধান্ত নিতে পারে।

প্রথম আলো:

বাংলাদেশের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রহের কারণ ভূরাজনৈতিক। এ অঞ্চলে চীনকে মোকাবিলায় যুক্তরাষ্ট্র ভারতের সঙ্গে কাজ করে আসছে। কিন্তু অবস্থাদৃষ্টে এটা মনে হচ্ছে যে ভারত এ অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের সরাসরি উপস্থিতি পছন্দ করছে না। বাংলাদেশের নির্বাচন সম্ভবত তা আরও স্পষ্ট করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলে কোনো পরিবর্তন আসবে কি?

এম হুমায়ুন কবির: আমার তা মনে হয় না। যুক্তরাষ্ট্র কয়েক স্তরে পররাষ্ট্রনীতি পরিকল্পনা করে—দ্বিপক্ষীয়, আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক। দ্বিপক্ষীয়ভাবে বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কে সমস্যা আছে। আঞ্চলিক পর্যায়ে ভারত-যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে মতপার্থক্য আছে। বাংলাদেশ প্রশ্নে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যে ভারতের অবস্থান এক নয়, তা ভারত জানিয়েছে। কারণ, বাংলাদেশসহ এ অঞ্চলকে ভারত তার প্রভাববলয়ের মধ্যে রাখতে চায়। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র এখন চায় বাংলাদেশ সরাসরি তাদের সঙ্গে কাজ করুক। বাংলাদেশ একটি স্বতন্ত্র অবস্থান নিক। আবার বৈশ্বিক পর্যায়ে চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের যে প্রতিযোগিতা, সেখানে বাংলাদেশের নির্বাচন কোনো প্রভাব ফেলবে না। এই অঞ্চলে চীনের প্রভাব ঠেকাতে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশ ও ভারতকে চায়, কিন্তু কোনো কারণে এই দুটি দেশ না থাকলেও যুক্তরাষ্ট্রের কৌশল বা অবস্থানের কোনো পরিবর্তন হবে বলে মনে হয় না।

প্রথম আলো:

নতুন সরকার চীন, ভারত ও রাশিয়ার মতো দেশগুলোর সমর্থন পেয়েছে। অথচ আমাদের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের নির্ভরশীলতা কার্যত যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলোর ওপর। এ বাস্তবতায় পশ্চিমের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক রাখার বিষয়টিকে কীভাবে দেখছেন?

এম হুমায়ুন কবির: পশ্চিমের সঙ্গে বিরোধটি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করা উচিত বলে আমি মনে করি। এ জন্য যা করতে হবে, তা হচ্ছে আমাদের ভাবমূর্তির উন্নয়নের উদ্যোগ নেওয়া। একসময় আমরা উন্নয়নের গল্প ছড়িয়ে দিতে পেরেছিলাম, কিন্তু সেটা ছাপিয়ে এখন যা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে, তা হচ্ছে গণতন্ত্র থাকবে কি থাকবে না। পশ্চিমের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের ক্ষেত্রে এই ভাবমূর্তির বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। রাজনীতিতে যে বিভাজন তৈরি হয়েছে, সরকারকে এখন সেটা দূর করার পদক্ষেপ নিতে হবে। আমরা জানি যে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমের সঙ্গে বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ভারসাম্য আমাদের অনুকূলে। অন্যদিকে চীন-ভারতের ক্ষেত্রে বাণিজ্যের ভারসাম্য তাদের অনুকূলে। যাদের সঙ্গে আমাদের বাণিজ্য সম্পর্ক অনুকূলে, তাদের আমাদের বিশেষ গুরুত্ব দিতেই হবে। বিনিয়োগ ও রেমিট্যান্স শুধু পশ্চিম থেকেই বেশি আসে, নানা আর্থসামাজিক ক্ষেত্রে সহায়তাও পাওয়া যায়। এই সম্পর্ক উন্নয়নে, ভাবমূর্তি উন্নয়নে আমাদের জোর দিতে হবে। আর পশ্চিমের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন মানে তো চীন, ভারত বা রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ করা নয়।

প্রথম আলো:

আপনাকে ধন্যবাদ।

এম হুমায়ুন কবির: আপনাকেও ধন্যবাদ।