ঢাকা ও চট্টগ্রামে একের পর এক টার্গেট কিলিংয়ের ঘটনা দেখছি। এসব হত্যাকাণ্ডের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ছে, জনমনে আতঙ্ক তৈরি হচ্ছে। সন্ত্রাসীরা কেন এমন বেপরোয়া হয়ে উঠেছে, তাদের ঠেকাতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কেন এমন ব্যর্থ হচ্ছে?
আ ন ম মুনীরুজ্জামান : সম্প্রতি আমরা লক্ষ করছি ঢাকা, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় আইনশৃঙ্খলাজনিত দুর্ঘটনা ঘটছে। বাংলাদেশে সাধারণত নির্বাচনের আগের সময়টাতে এ ধরনের সহিংসতা দেখা যায়। তবে এবার এর প্রবণতাটা আগের চেয়ে বেশি মনে হচ্ছে। এর বিশেষ কারণ হচ্ছে পুলিশের দক্ষতা ও কর্মক্ষমতা আগের চেয়ে এখন অনেক কম। চব্বিশের জুলাই বিপ্লব-পরবর্তী সময়ে পুলিশ বাহিনী কার্যত সম্পূর্ণরূপে ভেঙে পড়েছিল। এরপর পুলিশ পুনর্গঠনে নানা প্রচেষ্টা নেওয়া হয়েছে। পরিতাপের বিষয়, প্রায় দেড় বছর সময় পার হয়ে গেলেও অন্তর্বর্তী সরকার পুলিশ বাহিনীকে পুনর্গঠন করে উঠতে পারেনি। আমার মনে হয়, পুলিশ বাহিনীকে পুনর্গঠন করে কর্মদক্ষতা আগের কাছাকাছি নিয়ে যাওয়ার জন্য যথেষ্ট সময় পেয়েছে সরকার। কিন্তু সেটি করতে তারা ব্যর্থ হয়েছে। এ সুযোগে সন্ত্রাসীরা বেপরোয়া হয়ে উঠছে।
তা ছাড়া বর্তমান পরিস্থিতির পেছনে রাজনৈতিক একটি মাত্রাও আছে। বিভিন্ন অঞ্চলে রাজনৈতিক দলগুলোর নেতা-কর্মীদের মধ্যে সংঘর্ষ যেমন ঘটছে, আবার আন্তদলীয় সংঘাত ও প্রাণহানির ঘটনাও দেখা যাচ্ছে। এখানে রাজনৈতিক দলগুলোর নেতৃত্বে যাঁরা আছেন, তাঁদের অবশ্যই সতর্ক হতে হবে। নেতা-কর্মীরা যাতে এ ধরনের কোনো সংঘাতে জড়িয়ে না পড়েন, সে ব্যাপারে তাঁদের ব্যবস্থা নিতে হবে।
চব্বিশের ৫ আগস্টের আগে-পরে দেশের কয়েকটি কারাগার ভেঙে আসামিরা পালিয়ে গিয়েছিলেন। তাঁদের মধ্যে অনেকে শীর্ষ সন্ত্রাসী ও জঙ্গিও ছিলেন, যাঁদের অনেককে গ্রেপ্তার করা যায়নি। সে সময় যেসব অস্ত্র খোয়া গিয়েছিল, সেসবের অনেকগুলোই উদ্ধার করা যায়নি। এ রকম বাস্তবতা বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তাঝুঁকি কতটা বাড়িয়েছে?
আ ন ম মুনীরুজ্জামান: আমরা সব সময় বলে আসছি, এ ধরনের পরিস্থিতি বাংলাদেশের নিরাপত্তা পরিস্থিতিকে আরও নাজুক করে তুলেছে। পুলিশ ও সরকারের অন্যান্য সংস্থার অস্ত্রাগার থেকে যেসব অস্ত্র লুট হয়ে গিয়েছিল, সেগুলো এখনো সম্পূর্ণভাবে পুনরুদ্ধার করা যায়নি। প্রায় ৩০ শতাংশ অস্ত্র এখনো সরকারের হাতে ফিরে আসেনি। একই সঙ্গে বিভিন্ন কারাগার থেকে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িত কিছুসংখ্যক কয়েদি পালিয়ে গিয়েছিলেন, তাঁদের সবাইকে আবার ধরে আনা যায়নি। এ ছাড়া বিমানবন্দরে কার্গো ভিলেজে অগ্নিকাণ্ডের পর ভল্ট ভেঙে আমদানি করা অস্ত্র চুরি হয়েছে। এই সব পরিস্থিতি আমাদের আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থাকে আরও নাজুক ও ভঙ্গুর করে তুলেছে। কিন্তু অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার ও সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষেত্রে যে ধরনের গুরুত্ব দেওয়া দরকার, সেটি মোটেই দেখা যাচ্ছে না। সম্প্রতি ভারতের দিল্লিতে সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা ঘটেছে। সুতরাং সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের ব্যাপারে আমাদের সজাগ দৃষ্টি দিতে হবে।
জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তিন মাস সময়ও বাকি নেই। একদিকে ভঙ্গুর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, অন্যদিকে কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের কর্মসূচি ঘিরে ককটেল বিস্ফোরণ, বাসে আগুনের মতো সহিংসতা আমরা দেখছি। নির্বাচন সামনে রেখে আইনশৃঙ্খলা ক্ষেত্রে মূল কী চ্যালেঞ্জ দেখতে পাচ্ছেন?
আ ন ম মুনীরুজ্জামান: প্রাক্-নির্বাচন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ সব সময় কিছুটা নাজুক অবস্থার মধ্য দিয়ে যায়। তবে এবার পরিস্থিতিটা বেশি জটিল। আমরা একটা গণ-অভ্যুত্থান পরবর্তী পরিস্থিতির ভেতর দিয়ে অগ্রসর হচ্ছি। বলা চলে রাজনৈতিক ও অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার দিক থেকে আমরা একটি ক্রান্তিকাল পার করছি। এ পরিস্থিতিতে নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জটা বহুমুখী হবে, সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে, চ্যালেঞ্জ অনুধাবনের ক্ষেত্রে সরকারের দুর্বলতা বা ঘাটতি দেখা যাচ্ছে। এ ধরনের দুর্বলতা থাকলে সামনের দিনগুলোতে দেশের বিভিন্ন জায়গায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি আরও ভেঙে পড়তে পারে। হত্যাকাণ্ড, টার্গেট কিলিং, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের সংখ্যা আরও বেড়ে যেতে পারে। কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বিভিন্ন জায়গায় ককটেল হামলা ও বাসে আগুন দেওয়ার মতো নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড বেড়ে যেতে পারে। সার্বিকভাবে জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টি করাটাই এসব গোষ্ঠীর প্রধান লক্ষ্য থাকবে। সে কারণে একটা সঠিক নির্বাচনী পরিবেশ সৃষ্টি করতে হলে সরকারকে অবশ্যই আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির দিকে খুব সতর্ক নজর দিতে হবে।
সরকারকে মনে রাখতে হবে, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির যদি উন্নতি না হয় এবং মানুষ যদি পরিবেশের ওপর আস্থা রাখতে না পারে, তাহলে অনেকেই
ভোটদান থেকে বিরত থাকবেন। বিশেষ করে নারী ও সংখ্যালঘু ভোটাররা নিরুৎসাহিত হবেন। এটা কোনোভাবেই কাম্য নয়।
আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক শক্তিগুলোর প্রতিযোগিতা ও স্বার্থের প্রেক্ষাপটে নির্বাচন ঘিরে কোনো নিরাপত্তাঝুঁকি দেখেন কি না।
আ ন ম মুনীরুজ্জামান : একটা বিপ্লব-উত্তর সমাজে যে ধরনের বিভাজন সৃষ্টি হয়, বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও সে রকম কিছু বিভক্তি সৃষ্টি হয়েছে। এটা যদি একটা সীমিত পর্যায়ে আটকে রাখা না করা যায়, তাহলে আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক যেসব শক্তি ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করার জন্য সুযোগের অপেক্ষায় থাকে, তারা নিজেদের স্বার্থ হাসিল করার চেষ্টা করতে পারে। প্রত্যক্ষভাবে না হোক পরোক্ষভাবে তারা এখানে জড়িয়ে পড়তে পারে এবং আমাদের ভেতরে যে বিভাজনটা সৃষ্টি হয়েছে, সেটিকে কাজে লাগিয়ে এক পক্ষকে আরেক পক্ষের বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে পারে। একটা প্রক্সি সংঘাতের বিস্তার তারা ঘটাতে পারে। এ রকম কিছু ঘটলে সেটি হবে আমাদের জন্য চরম বিপর্যয়ের।
আপনি প্রক্সি সংঘাতের আশঙ্কা করছেন। বিষয়টাকে একটু বিশদভাবে ব্যাখ্যা করবেন?
আ ন ম মুনীরুজ্জামান : আমাদের বিশেষ করে নজর রাখতে হবে যে আমাদের পরিস্থিতিটা বিশ্বের অন্যান্য দেশ, যারা একই পরিস্থিতি অতিক্রম করেছে, তাদের চেয়ে ভিন্ন নয়। আমরা বিশ্লেষণ করে দেখেছি যে তাদের সঙ্গে আমাদের পরিস্থিতি অনেক ক্ষেত্রে সাদৃশ্য আছে। অনেক দেশেই আমরা দেখেছি যে ছোটখাটো একটা সমস্যা বা বিভাজনের পরে সেখানে গৃহযুদ্ধ ছড়িয়ে পড়েছে। সেসব গৃহযুদ্ধে অভ্যন্তরীণ গোষ্ঠীগুলোকে বিভিন্ন শক্তির প্রক্সি হিসেবে কাজ করতে দেখেছি।
ফলে এ দৃষ্টান্ত থেকে আমাদের শিক্ষা নিতে হবে। আমাদের বিভাজনটা কোনোভাবেই যেন এমন একটা পরিস্থিতির সৃষ্টি না করতে পারে, যেখানে বাইরের শক্তি এসে প্রক্সি সংঘাত সৃষ্টির সুযোগ পায়। এ রকম নাজুক পরিস্থিতিতে স্থিতিশীলতা ও অস্থিতিশীলতার মাঝখানের সীমারেখাটি খুব ক্ষীণ। একবার যদি সেই সীমারেখাটি ভেঙে অস্থিতিশীলতার ভেতর প্রবেশ করে তাহলে স্বাভাবিক অবস্থায় ফেরাটা অনেক দুরূহ হয়ে পড়ে। যেমনটা আমরা দেখছি বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে, যেখানে গৃহযুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে।
বর্তমানে নাগরিকদের বড় উদ্বেগের কারণ আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি। ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা নিয়ে মাঠে সেনাবাহিনী মোতায়েন আছে। এরপরও কেন আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতিতে দৃশ্যমান অগ্রগতি দেখা যায়নি?
আ ন ম মুনীরুজ্জামান : পুলিশের কর্মক্ষমতা কমে যাওয়ার কারণে যে ধরনের শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছে, সেটি সেনাবাহিনীর সদস্যদের দিয়ে পূরণ করার চেষ্টা করা হয়েছে। দেশব্যাপী বিভিন্ন জায়গায় সেনাসদস্যরা মোতায়েন আছেন। তাঁরা যথেষ্ট ভালো কাজ করছেন। বলতে গেলে তাঁদের অবদানের কারণেই আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিটা সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়নি। কিন্তু পুলিশের যে কর্মকাণ্ড বা ব্যাপ্তি, অন্য কোনো বাহিনী এসে সেই ঘাটতি কখনোই সম্পূর্ণভাবে পূরণ করতে পারে না। এসব বাহিনী সহযোগীর ভূমিকা পালন করতে পারে। এখানে পুলিশের ভূমিকাটা আগের জায়গায় ফিরে আসতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই।
হাসিনার আমল শুধু নয়, পূর্ববর্তী সরকারগুলোর সময়েও ডিজিএফআই, এনএসআই, ডিবির মতো সামরিক ও রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থাকে দলীয় স্বার্থে ব্যবহার করা হয়েছে। হাসিনার আমলে তারা গুম ও গোপন নির্যাতনকেন্দ্র আয়নাঘরে ভিন্নমত দমনের কাজে জড়িয়ে পড়েছিল। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে গুমের ঘটনায় কয়েকজন বর্তমান ও সাবেক সেনা কর্মকর্তার বিচার শুরু হয়েছে। আপনি এ বিচারকে কীভাবে দেখছেন?
আ ন ম মুনীরুজ্জামান : এই সংস্থাগুলোকে খুব সংকীর্ণ দলীয় দৃষ্টিকোণ থেকে হাসিনা সরকার ব্যবহার করেছিল। যার কারণে এসব সংস্থার অনেক সদস্য বেআইনি কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সরাসরি জড়িয়ে পড়েছিলেন। এ ধরনের বেআইনি কর্মকাণ্ড যেসব ব্যক্তি করেছেন, তার সম্পূর্ণ দায়ভার সংস্থার ওপর পড়ে না। ব্যক্তি হিসেবে যে ধরনের বিবেচনা বোধ থাকা দরকার ছিল, সেটি তাঁদের ছিল না। অনেক ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত স্বার্থে তাঁরা বেআইনি কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েছিলেন। বেশ কিছু ব্যক্তিকে সরকারের নির্দেশে আইনের আওতায় আনা হয়েছে। সেনাবাহিনী সরকারের নির্দেশ অনুযায়ী তাঁদের কাস্টডিতে নিয়েছে।
এখানে মনে রাখা দরকার যে দেশের প্রচলিত আইনই সর্বোচ্চ আইন। যেসব কর্মকাণ্ড সেনা আইনের আওতায় আসে না, সেগুলো সাধারণ আইনের আওতায় ডিল করতে হবে।
ভবিষ্যতে এ ধরনের সংস্থাগুলোকে যাতে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা না যায়, তার জন্য কী ধরনের সংস্কার প্রয়োজন বলে মনে করেন?
আ ন ম মুনীরুজ্জামান : এ ধরনের কর্মকাণ্ড যাতে ভবিষ্যতে পুনরাবৃত্ত না হয়, সে জন্য সংস্থাগুলোর ভেতরে ব্যাপক সংস্কারের প্রয়োজন আছে। কিন্তু বর্তমান সরকার সেদিকে এখন পর্যন্ত কোনো দৃষ্টি দেয়নি। নিরাপত্তা খাতের মধ্যে শুধু পুলিশের সংস্কারের জন্য একটা কমিশন গঠন করা হয়েছিল, যেটা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে আলোর মুখ এখন পর্যন্ত দেখেনি। নিরাপত্তা খাতে শুধু পুলিশ এককভাবে কাজ করে না। সশস্ত্র বাহিনী, গোয়েন্দা সংস্থা, আধা সামরিক বাহিনীসহ নানা বাহিনী ও সংস্থা নিরাপত্তার ক্ষেত্রে কাজ করে।
এসব বাহিনী, সংস্থা সংস্কারে পরিষ্কার কিছু বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি আছে। বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে কী কী পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন, সে ব্যাপারে বিশদভাবে আলাপ-আলোচনা করা প্রয়োজন। সর্বোপরি বাহিনী ও সংস্থাগুলোর ওপর গণতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণটা সর্বোচ্চ হতে হবে। অর্থাৎ গণতান্ত্রিক বেসামরিক নিয়ন্ত্রণ যেটি নিরাপত্তা খাতের সংস্থাগুলোর ওপর থাকে, সেটি সম্পূর্ণভাবে প্রয়োগ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে জাতীয় নির্বাচনের মধ্য দিয়ে যে সংসদ আমরা নির্বাচন করতে যাচ্ছি, সেই সংসদে যে কমিটিগুলো কাজ করবে, তারা যাতে সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারে, সে ধরনের দক্ষতা তাদের থাকতে হবে। কিছু ক্ষেত্রে নতুন সংসদীয় কমিটি সৃষ্টি করতে হবে। যেমন বর্তমানে গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর ওপর নজরদারি বা নিয়ন্ত্রণ করার জন্য বাংলাদেশের সংসদে কোনো কমিটি নেই। এ ধরনের সংসদীয় কমিটি গঠনের প্রয়োজন আছে। এ ছাড়া এসব বাহিনী ও সংস্থার স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিতে আরও কিছু পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। যেমন অনেক দেশে প্রতিবছর শ্বেতপত্র প্রকাশ করা হয়। গণমাধ্যমের সঙ্গে নিরাপত্তা খাতের একটা নিবিড় সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে, যাতে তাদের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের ওপরে সাংবাদিকেরা প্রতিবেদন করতে পারেন। এ অনুশীলনগুলো গণতান্ত্রিক দেশগুলোতে হয়ে আসছে। আমাদের দেশের ক্ষেত্রেও এ অনুশীলনগুলো চর্চা করা প্রয়োজন।
সশস্ত্র বাহিনীগুলো ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর শীর্ষ পদগুলোতে নিয়োগের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক আনুগত্য ও বিবেচনা থেকে বের হয়ে আসার উপায় কী বলে মনে করেন?
আ ন ম মুনীরুজ্জামান : নিয়োগের ক্ষেত্রে যে ধরনের অনিয়ম হয়, সেগুলো অবশ্যই বন্ধ করতে হবে। এটা করার দায়িত্ব প্রধানত রাজনৈতিক নেতাদের। এখানে বিভিন্ন বাহিনী বা সংস্থায় নিয়োগ ও পদোন্নতির ব্যাপারে পরিষ্কার লিখিত আইন ও নীতিমালা থাকতে হবে। তার ভিত্তিতেই নিয়োগ বা পদোন্নতি হতে হবে। রাজনৈতিক প্রভাবে যখনই নিয়োগ হবে, তখন এ ধরনের সমস্যা সৃষ্টি হতে বাধ্য। এখানে আনুগত্য থাকতে হবে, কিন্তু সেটা পেশাগত ও প্রাতিষ্ঠানিক আনুগত্য। এখানে ব্যক্তিগত আনুগত্যের প্রশ্ন আসার কথা নয়। কিন্তু আমরা দেখেছি যে এসব পদে নিয়োগটা ব্যক্তিগত আনুগত্যের পর্যায়ে চলে গিয়েছিল। যার কারণে দায়িত্বে যাঁরা ছিলেন, তাঁদের অনেকেই পেশাগত মানদণ্ডটা বজায় রাখতে পারেননি।
প্রধান উপদেষ্টা শান্তিপূর্ণ নির্বাচন আয়োজনে সেনাবাহিনী ও পুলিশের সহযোগিতা কামনা করেছেন। এ মুহূর্তে পুলিশের যে সামর্থ্য, তাতে জননিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কাটা কাটছে না। সে ক্ষেত্রে একটি সুষ্ঠু নির্বাচনী পরিবেশ তৈরিতে সেনাবাহিনীর কতটা এবং কী ভূমিকা থাকা উচিত।
আ ন ম মুনীরুজ্জামান : আমাদের এখানে সেনাবাহিনী সব সময়ই নির্বাচনের সঙ্গে জড়িত থাকে এবং বড় ভূমিকা পালন করে। তবে এবার সেনাবাহিনীর ওপরে দায়িত্বটা আগের চেয়ে অনেক বেশি। বলা চলে, তাদের ওপর গুরুদায়িত্ব এসে পড়েছে। সেনাবাহিনী এরই মধ্যে ঘোষণা দিয়েছে, নির্বাচনের সময় এক লাখের বেশি সেনা মাঠে মোতায়েন করবে। সংখ্যার দিক থেকে এটা বিপুল। সশস্ত্র বাহিনী আশা করছে, নির্বাচনের আগে ও পরে, নির্বাচনের সময় মাঠপর্যায়ে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে যে ঘাটতি আছে, সেটা তারা পূরণ করতে পারবে। নির্বাচনের একটা সুষ্ঠু পরিবেশ সৃষ্টির ব্যাপারে সশস্ত্র বাহিনী বদ্ধপরিকর। আমরা সবাই আশা করি, তারা এ গুরুদায়িত্ব পালন করতে সক্ষম হবে।
বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা বলছে, নির্বাচন-পরবর্তী সহিংসতাও শঙ্কার একটি বড় কারণ। এ ক্ষেত্রে সরকারকে আগাম কী ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন?
আ ন ম মুনীরুজ্জামান : বাংলাদেশে নির্বাচন-পরবর্তী সময়টা বরং আরও বেশি নাজুক থাকে। আমি আগেই বলেছি, একটা বিপ্লব-উত্তর পরিস্থিতির কারণে বাংলাদেশের পরিস্থিতি আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে জটিল। ফলে নির্বাচন-পরবর্তী সময়টা আমাদের জন্য আরও বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠতে পারে। এ বিষয়ে আমাদের এখন থেকে দৃষ্টি দেওয়া প্রয়োজন।
দেশে একটা নির্বাচনী আবহ তৈরি হয়ে গেছে। নির্বাচন কমিশন শিগগিরই তফসিল ঘোষণা করবে বলে আশা করি। বর্তমান বাস্তবতায় অন্তর্বর্তী সরকার কার্যত নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার। সরকার যদি নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠুভাবে নির্বাচন পরিচালনা করতে পারে, তাহলে নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা সম্পূর্ণভাবে থাকবে। এখানে যদি কোনোরকম অনিয়ম বা ব্যত্যয় ঘটে, তাহলে যে দল পরাজিত হবে, তারা সেটাকে ব্যবহার করে নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করার একটা সুযোগ পেয়ে যেতে পারে। সরকারের ভূমিকা যে নিরপেক্ষ, সেটা দৃশ্যমান হতে হবে। মানুষ যাতে বুঝতে পারে তারা সম্পূর্ণভাবে নিরপেক্ষ। নির্বাচন পরিচালনার ক্ষেত্রে সর্বাত্মকভাবে নির্বাচন কমিশনকে সহায়তা করতে হবে।
সরকারকে এখনই অঙ্গীকার করা উচিত এবং রাজনৈতিক দলগুলোর এখনই ঘোষণা করা উচিত যে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টামণ্ডলীতে এবং সমপর্যায়ে যাঁরা আছেন, তাঁরা কেউই পরবর্তী সরকারের যোগ দিতে পারবেন না। এ ধরনের কিছু ঘটলে তাতে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আস্থাহীনতার পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারে। সেই সুযোগ কোনোভাবেই রাখা যাবে না।
আপনাকে ধন্যবাদ।
আ ন ম মুনীরুজ্জামান : আপনাকেও ধন্যবাদ।