অচিরেই বাংলাদেশ এ অঞ্চলের বড় বাণিজ্যকেন্দ্র হবে

ড. মজিবুর রহমান

ড. মজিবুর রহমান। বাংলাদেশ ট্যারিফ কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান ও বাংলাদেশ ফরেন ট্রেড ইনস্টিটিউটের সাবেক প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা। সম্প্রতি ভারত পণ্য পরিবহনের জন্য বাংলাদেশের চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দর ব্যবহারের অনুমতি পেয়েছে। এর মাধ্যমে ভারত মূল ভূখণ্ড থেকে উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোয় তাদের পণ্য পরিবহনের সুযোগ পাবে। বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার ট্রানজিট ও ট্রান্সশিপমেন্ট চুক্তির সার্বিক বিষয় নিয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন এই বিশেষজ্ঞ। 

সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সোহরাব হাসানরাফসান গালিব

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: সরকার ভারতকে চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দর ব্যবহারের অনুমতি দিল। এর বিনিময়ে বাংলাদেশ কী পাবে? 

মজিবুর রহমান: অবশেষে ট্রানজিট চালু হওয়ায় আমি খুশি। দক্ষিণ এশিয়া পৃথিবীর একমাত্র অঞ্চল, যেখানে পণ্য, সেবা ও মানুষের অবাধ চলাচলের সুযোগ নেই। ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা, দক্ষিণ আমেরিকা এমনকি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যেও সেই সুযোগ রয়েছে। আমাদের এ অঞ্চলেও বিমান ও নৌপথে চলাচল আছে। কিন্তু সড়ক ও রেলপথে নেই। আমরা মিয়ানমার, নেপাল, ভুটানের সঙ্গে যুক্ত নই। ভারত ও চীনের সঙ্গেও সেভাবে যুক্ত নই। আরেকটু দূরে গেলে পাকিস্তান, আফগানিস্তানেও একই অবস্থা। 

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: এর একটি ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট আছে। 

মজিবুর রহমান: ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট ইউরোপেও আছে। সেখানকার দেশগুলোর মধ্যে হানাহানি আরও বেশি ছিল। যুদ্ধ থাকবে। এর মধ্যেও মানুষ ও পণ্য চলাচল অব্যাহত আছে। আমাদের এ অঞ্চলেও ১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের আগে অবাধ চলাচল ছিল। এই যোগাযোগ বন্ধের কারণে এলাকার অর্থনীতি ও মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কেউ লাভবান হয়নি। সংযুক্তি বা কানেকটিভিটি থাকলে সবাই লাভবান হবে। তবে কে কতটা বেশি লাভবান হবে, তা নির্ভর করবে সংশ্লিষ্ট দেশের দক্ষতা, পণ্য উৎপাদন ও মান রক্ষা এবং রপ্তানির সক্ষমতার ওপর। দেশের আকারের ওপর নয়। 

আরেকটি বিষয় হলো এ অঞ্চলে আমি যদি বাংলাদেশকে কেন্দ্র ধরে নিই, তাহলে এর পরিধি বিশাখাপট্টনম থেকে শুরু করে নেপাল, ভুটান, মিয়ানমার হয়ে চীন পর্যন্ত বিস্তৃত করতে পারি। বাংলাদেশ হলো ট্রানজিটের জন্য আদর্শ স্থান। এর আশপাশে যেসব সমুদ্রবন্দর আছে, সেগুলো বাংলাদেশের মতো নয়। আমরা যদি দক্ষতা ও বিচক্ষণতার সঙ্গে এটি ব্যবহার করতে পারি, তবে বিরাট লাভবান হব। ইউরোপে সুইজারল্যান্ড কিন্তু এই সুবিধা নিয়েছে। ট্রানজিটের ক্ষেত্রে আমি সুইস মডেলের পক্ষে। তারা বছরে এক বিলিয়ন ডলারের বেশি আয় করে ট্রানজিট দিয়ে। 

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: এ মুহূর্তে বাংলাদেশ কতটা লাভবান হবে?

 মজিবুর রহমান: চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দরে ট্রানজিট-সুবিধা দেওয়ায় এ মুহূর্তে ভারত বেশি লাভবান হবে। বাংলাদেশ কম লাভবান হবে। আমাদের মনে রাখতে হবে, মোংলা বন্দরের উন্নয়ন সেভাবে হয়নি, যেটুকু হয়েছে, তা-ও ব্যবহার করা যাচ্ছে না। বন্দর উন্নয়ন করলেই হবে না, এর ব্যবহার থাকতে হবে। অন্যদিকে চট্টগ্রাম বন্দরে মাঝেমধ্যে জাহাজজট হয় ব্যবস্থাপনার দুর্বলতার কারণে, সক্ষমতার ঘাটতির কারণে নয়। বিভিন্ন সংস্থার গবেষণায় দেখা গেছে, চট্টগ্রাম বন্দরের সক্ষমতা পুরোপুরি ব্যবহৃত হচ্ছে না। আমি ট্যারিফ কমিশনে থাকতেও গবেষণা করে দেখেছি, প্রশাসনিক ও ব্যবস্থাপনা অদক্ষতা ও দুর্নীতির কারণে জাহাজজট তৈরি হয়। প্রাথমিকভাবে মনে হতে পারে, ট্রানজিট থেকে ভারত বেশি লাভবান হচ্ছে, বাংলাদেশ কম লাভবান হচ্ছে। কিন্তু ট্রানজিট পুরোদমে চালু হলে বাংলাদেশ অনেক বেশি লাভবান হবে। এমনকি সিঙ্গাপুরের চেয়েও। সত্তরের দশকে সিঙ্গাপুরের কী অবস্থা ছিল, আমরা জানি। এখন সেটি পরিবহন হাব বা কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশও ট্রানজিট কেন্দ্রে পরিণত হলে ব্যবসা-বাণিজ্য বহুগুণ বাড়বে। প্রশ্ন হলো আগামী বাংলাদেশকে সেই জায়গায় নিয়ে যেতে চাই কি না। আরেকটি কথা, এখন যে ট্রানজিট শুরু হয়েছে, খুবই সীমিত। কিন্তু ট্রানজিট থেকে বেশি লাভ তুলে নিতে প্রয়োজন সমন্বিত পদক্ষেপ। 

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: আপনি ট্রানজিটে সমন্বিত পদক্ষেপের কথা বলেছেন। যে চুক্তি হয়েছে, তাতে তার প্রতিফলন আছে কি? 

মজিবুর রহমান: এনবিআরের যে পরিপত্র দেখলাম, সেটা তো আংশিক। এরপর সড়ক বিভাগ, বন্দর থেকেও আলাদা পরিপত্র আসবে। নিরাপত্তার বিষয়টিও আসবে। তবে আমি বলব, এর মধ্য দিয়ে শিশুর হাঁটা শুরুমাত্র। হাঁটতে হাঁটতে একসময় শক্তভাবে দৌড়াবে। ২০১২ সালে আমি সরকারকে যে রিপোর্ট দিয়েছিলাম, সেটি আমলে নিলে বিষয়টি আরও সুন্দর হতো। আমি মনে করি, আরও প্রস্তুতি নিলে বিষয়টি ভালো হতো। 

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: তার মানে ট্যারিফ কমিশনের সুপারিশ তারা পুরোপুরি গ্রহণ করেনি? 

মজিবুর রহমান: তারা ট্রানজিটের গভীরতা ধরতে পারেনি। এটি বিক্ষিপ্ত বিষয় নয়; সমন্বিত কাজ। এর মনিটরিং ও ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম থাকতে হবে। এর সঙ্গে যুক্ত বিভিন্ন সংস্থা তাদের মতো হিসাব-নিকাশ করবে। কিন্তু মিসিং লিংকগুলোকে যোগ করার জন্য একটি কর্তৃপক্ষ থাকতে হবে। কোনো বিষয়ে বিরোধ দেখা দিলে সেটি কে মীমাংসা করবে? এ কারণে কর্তৃপক্ষকে শক্তিশালী করতে হবে। বিভিন্ন অঞ্চলের মডেল পর্যালোচনা করে যেটি আমাদের জন্য বেশি সুবিধাজনক, সেটি নিতে হবে। সেই সঙ্গে নিজেদের অভিজ্ঞতাকেও কাজে লাগাতে হবে। 

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: জনমনে এই ধারণা আছে, ভারত চেয়েছে বলেই তারা চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দর ব্যবহারের অনুমতি পেয়েছে কিন্তু বাংলাদেশের যে প্রধান চাওয়া বিবিসিইএনের আওতায় এক দেশের পরিবহন অন্য দেশে যাবে, সেই সুবিধা এখনো আমরা পাচ্ছি না। 

মজিবুর রহমান: আমি বলব, যাত্রাটা তো শুরু হলো। এরপর নেপাল, ভুটানের সঙ্গেও একই ধরনের ট্রানজিট-সুবিধা আমরা পাব। আমাদের গাড়িও ভারতের ওপর দিয়ে নেপালে যাবে। আজ যেসব ব্যবসায়ী ভারতের মূল ভূখণ্ড থেকে উত্তর-পূর্ব ভারতে পণ্য পাঠাচ্ছেন, তাঁরাই এই ট্রানজিট-সুবিধা বাড়ানোর দাবি জানাবেন। কেননা কলকাতা বন্দর খুব সুবিধাজনক অবস্থানে নয়। তাঁরা মোংলা ও চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ব্যবহার করবেন এবং সেটি করতে তাঁদের সরকারকে চাপ দেবেন। শুধু ভারতের সরকার চাইছে বলে ট্রানজিট চালু হয়নি। আমাদেরও তো আয় প্রয়োজন। আমরা যদি চট্টগ্রাম বন্দরের সক্ষমতা আরও বাড়াতে পারি, তখন আমরা এখান থেকে মিয়ানমার ও চীনেও পণ্য পাঠাতে পারব। 

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দরে ট্রানজিট তো পুরোদমে চালু হয়ে গেছে। এখন নতুন কোনো মডেল নেওয়ার সুযোগ আছে কি না? 

মজিবুর রহমান: কেন থাকবে না? ট্রানজিট হলো অব্যাহত প্রক্রিয়া। পর্যায়ক্রমে উন্নয়ন ও নবায়ন করা যাবে। এ বিষয়ে সরকার বিশেষজ্ঞদের নিয়ে একটি কমিটি গঠন করতে পারে। ট্রানজিটে কী কী সমস্যা দেখা দিয়েছে, সেগুলো সমাধানে তারা নিয়মমতো বসবে। এখানে এমন একটি কর্তৃপক্ষ থাকতে হবে, যারা বিরোধগুলো নিষ্পত্তি করবে। কী ধরনের পণ্য কোন রুটে যাবে, কী ধরনের যানবাহন চলবে, সেগুলো সুনির্দিষ্ট করতে হবে। অপারেশনে গিয়েও কিছু সমস্যা দেখা দেবে। যেমন আমাদের এখানে বাংলাদেশি টাকায় মাশুল ধরা পড়েছে। একজন ভারতীয় ব্যবসায়ী বাংলাদেশি টাকা কোথায় পাবেন? তাঁকে তো ভারতীয় মুদ্রায় অথবা ডলারে এটি শোধ করতে হবে। এনবিআরের পরিপত্রে এসব বিষয়ে স্পষ্ট করে কিছু বলা হয়নি। 

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: অনেক বিশেষজ্ঞ বলেছেন, ট্রানজিটের বিনিময়ে মাশুল ধরা হয়েছে, তা ন্যায্য হয়নি। অনেক কম ধরা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে পরিবেশগত সমস্যা, সড়কের ক্ষতি ইত্যাদি বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে কি? 

মজিবুর রহমান: ডব্লিউটিওর হিসাব অনুযায়ী, ট্রানজিট-সুবিধা পেতে সব খরচ ধরার পর ট্রানজিট প্রদানকারী দেশ ২৫ শতাংশ মার্জিন নিতে পারে। সড়কের ব্যবহার মূল্য এখানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। পত্রপত্রিকায় দেখছি, এনবিআর যা ধার্য করেছে, সেটা কমই বলব। প্রতি কিলোমিটারে ১ টাকা ৮৫ পয়সা। এ ক্ষেত্রে সড়ক অবকাঠামো, ভূমি অধিগ্রহণ ইত্যাদি বিবেচনা করে মাশুল ঠিক করা উচিত। আমাদের হিসাব অনুযায়ী সাড়ে ৩ টাকার বেশি। 

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দর ব্যবহার করার কারণে ভারতের যে আর্থিক সাশ্রয় হচ্ছে, তার একটি অংশ বাংলাদেশ পেতে পারে বলে অনেক বিশেষজ্ঞ বলেছেন। আপনি কী মনে করেন? 

মজিবুর রহমান: ওই যে বললাম সব খরচ দিয়েও ট্রানজিট প্রদানকারী দেশ ২৫ শতাংশ পর্যন্ত মাশুল নিতে পারে। আমি এর জন্য একটি গাণিতিক মডেল দিয়ে এসেছিলাম। এগুলো হিসাব করা মোটেই কঠিন নয়। আমরা যে কমপ্লিট ট্রানজিটের কথা বলেছি, এখনই না হলেও সেটি পর্যায়ক্রমে চালু হতে পারে। 

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: কিন্তু চিকেন নেক মানে শিলিগুড়ি করিডরের দিকে ভারত বাংলাদেশকে ট্রানজিট দিতে চায় না, কারণ তখন নেপাল-ভুটান কলকাতা বন্দর ব্যবহার করবে না। এমন একটি আলোচনা আছে। আপনি কী বলেন? 

মজিবুর রহমান: সেটা হবে খুবই আন-সায়েন্টিফিক। আন্তর্জাতিক আইন ও জাতিসংঘের চার্টার অনুসারে এখানে নেপালের অধিকার আছে। ল্যান্ডলক দেশের ট্রানজিট তার জন্য সবচেয়ে সহজ রুটে দিতে হবে। ভারত চাইলেও সেখানে বাধা দিতে পারবে না। 

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: কয়েক বছর আগে ভারত-নেপাল সীমান্তে মদেশীয় আন্দোলনের কারণে ভারত নেপালের ট্রানজিট বন্ধ করে দিয়েছিল। এ কারণে নেপাল বিপদেই পড়েছিল। ভারতের সঙ্গে তার প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে এ ধরনের সমস্যা আছে। যেমন আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে ভাটির দেশ হিসেবে আমাদের পানির হিস্যা পাওয়ার কথা থাকলেও ভারত থেকে তা আমরা পাচ্ছি না। 

মজিবুর রহমান: বাংলাদেশ তো চেষ্টা করে যাচ্ছে। সমুদ্রসীমা নিয়ে আমরা অনেক বছর চেষ্টার পর একপর্যায়ে আন্তর্জাতিক আদালতে গিয়ে রায় পেয়েছি। একইভাবে পানির হিস্যা নিয়েও সেই চেষ্টা করতে হবে। নদী নিয়ে জাতিসংঘের একটি প্রটোকল আছে। যদিও সে ক্ষেত্রে দুই দেশকে সেই প্রটোকলের স্বাক্ষরকারী দেশ হতে হবে। দ্বিপক্ষীয় আলোচনা, সমঝোতার মধ্যে সমাধান না হলে আন্তর্জাতিক আদালতে গিয়ে আমাদের পানির হিস্যা বুঝে নিতে হবে। কারণ, এটি আমাদের অধিকার। 

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: কিন্তু বাস্তবতা কী? ৫১ বছর তো হয়ে গেল। আর কত প্রচেষ্টা চালাতে হবে? 

মজিবুর রহমান: ৫১ বছর কেন, এর চেয়ে বেশি বছর ধরে চলতে থাকা সমস্যার উদাহরণ বিশ্বে আরও বহু আছে। ইউক্রেন বা তাইওয়ানের যে সমস্যা, সেটি কত বছর ধরে চলছে। তো, ওরা কি ধৈর্য ধরছে না। তাদের পেছনে অন্যান্য শক্তি আছে। আমাদের পেছনে নেই। এ জন্য আমাদের আরও বেশি ধৈর্য ধরে থাকতে হচ্ছে। 

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: আপনি ট্রানজিট নিয়ে যেভাবে উজ্জ্বল সম্ভাবনা দেখালেন, পানির হিস্যা নিয়ে সেটি কেন দেখা যায় না? 

মজিবুর রহমান: ট্রানজিটে শুধু ভারত বা বাংলাদেশের স্বার্থ আছে, তা নয়। সেখানে আরও বড় অংশীদার হচ্ছেন দুই দেশের ব্যবসায়ীরা। তাঁরাই তখন দুই দেশের সরকারের ওপর চাপ তৈরি করবেন। দুই দেশের মানুষও চাপ সৃষ্টি করবে। তবে পানির ক্ষেত্রে বিষয়টি ভিন্ন। এখন নদীতে পানি যেহেতু কম আসে, ফলে ভারতে সেটি ভোটের রাজনীতির বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। ২০১১ সালে তো চুক্তি প্রায় চূড়ান্ত হয়ে গিয়েছিল। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আপত্তির কারণে শেষ মুহূর্তে চুক্তিটি হলো না। এখন ভারত তাদের স্বার্থটাই দেখছে, ভাটির দেশের কথা ভাবছে না। কিন্তু আমি মনে করি, এখানেও পরিবর্তন আসবে যদি চীন ব্রহ্মপুত্র নদের পানি অন্যত্র সরিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা শেষ পর্যন্ত বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়। তখন ভারতের যে ক্ষতি হবে, তাতে নদী নিয়ে নতুন করে তারা ভাবতে বাধ্য হবে। আমাদের কথা শুনবে। 

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: ট্রানজিটের বিনিময়ে তিস্তার পানি আদায়ের বড় একটি সুযোগ ছিল বলে মনে করা হয়। আমরা কি সুযোগটি হারালাম? 

মজিবুর রহমান: একটি সুযোগ ছিল, সেটি ঠিক। ২০১১ সালে শেখ হাসিনা-মনমোহন সিং বৈঠকে স্থির হয়েছিল যে তিস্তার পানি আর ট্রানজিট নিয়ে একসঙ্গে প্রটোকল সই হবে। প্রটোকলও প্রস্তুত ছিল। আমিও তখন সেখানে ছিলাম। কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অনুপস্থিতির কারণে সেই প্রটোকলে আর সই হলো না। এখন আপনি বলতে পারেন, ওরা তিস্তার পানি দিল না, আমরাও ট্রানজিট দেব না। তাতে হবে কী, ও ব্যাটা আমাকে খেতে দেয়নি, আমিও তাকে খেতে দেব না, তাতে দুজনই না খেয়ে থাকবে। আরেকটা হতে পারে, এই ট্রানজিটের ওপর যখন ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ও উত্তর-পূর্ব অঞ্চলের বেশির ভাগ ব্যবসায়ী অভ্যস্ত হয়ে যাবেন, তখন তঁারাও পানি দিয়ে দেওয়ার কথা বলবেন। সম্পর্ক তো একতরফা হয় না। দুই পক্ষকেই এগিয়ে আসতে হবে। 

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: বিষয়টা অনেকটা ভারতের সদিচ্ছার ওপর নির্ভর করছে না কি?

 মজিবুর রহমান: ভারত আমাদের সবচেয়ে বড় প্রতিবেশী। ভারতের তুলা, পেঁয়াজসহ আরও অনেক কিছুর ওপর আমরা নির্ভরশীল। তা এক দিনে কাটিয়ে ওঠা সম্ভব নয়। ফলে বড় প্রতিবেশীর সঙ্গে আমাদের সুসম্পর্ক রাখতেই হবে। 

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: এ বিষয়ে আমরা ন্যায়সংগত দর-কষাকষি করতে পারছি কি? 

মজিবুর রহমান: ন্যায়সংগত দর-কষাকষি আমরা করছি। আবার আমাদের অসহায়ত্বের কথা আমরা বারবার প্রকাশ করছি। ভারতের সঙ্গে প্রতিটি মিটিংয়ে তিস্তার কথা ওঠে। এমনকি মিটিংয়ের অ্যাজেন্ডা না থাকলেও ওঠে। এটা অব্যাহত রাখতে হবে।

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: ট্রানজিট তো বাস্তবায়ন হয়ে গেল। এখানে কোনো নিরাপত্তার হুমকি আছে কি না। 

মজিবুর রহমান: বিশ্বব্যাপী ট্রানজিট নিয়ে আমার যে অভিজ্ঞতা, তার পরিপ্রেক্ষিতে বলছি, সেসব ট্রানজিটে এখন পর্যন্ত নিরাপত্তার কোনো সমস্যা হয়নি। যেমনটি জিএমএস দেশগুলোর মধ্যে ট্রানজিট আছে। সেখানে পরস্পরবিরোধী দেশ আছে। তাতে নিরাপত্তাজনিত কোনো সমস্যা হয়নি। আফ্রিকাতেও এমন কিছু হয়নি। 

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: সেসব ট্রানজিটে তো অনেকগুলো দেশ যুক্ত। আর এখানে তো শুধু দুটো দেশ। 

মজিবুর রহমান: ট্রানজিট এখন হয়তো দুটি দেশের মধ্যে শুরু হচ্ছে। কিন্তু ট্রানজিট তো আমরা দুটি দেশ নিয়ে চিন্তা করিনি। আমরা সেটি চিন্তা করেছি বিবিআইএন নিয়ে। শুধু তাই নয়, বিমসটেকভুক্ত দেশগুলো নিয়ে ভেবেছি। আমরা চিন্তা করেছি মিয়ানমার, চীনও এর সঙ্গে যুক্ত হবে। 

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে অনেকে মনে করেন, ভারত চাইলে সেটি হয়, ভারত না চাইলে হয় না। এর থেকে বেরিয়ে আসার উপায় কী? 

মজিবুর রহমান: বিশ্বে অনেক কিছুই আমেরিকা চাইলে হয়, না চাইলে হয় না। চীনের ক্ষেত্রেও সেটি বলা যায়। ভারত হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র, চীনের সঙ্গে তার বৈরিতা আছে। সীমান্তে সংঘাত লেগে আছে। কিন্তু তার জন্য কি দুই দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য থেমে আছে? সাংহাই কো-অপারেশন কাউন্সিলের বৈঠক হচ্ছে ভারতের গোয়ায়। বৈরিতা থাকলেও চীনের সঙ্গে ভারতের ব্যবসা এক ট্রিলিয়ন ডলারের। প্রতিবছর এই ব্যবসার পরিমাণ বাড়ছে। ফলে প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে এমন বৈপরীত্য সম্পর্ক থাকবে। আমাদের সক্ষমতা বাড়াতে হবে। 

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: একসময় আমরা শুনেছি, ভারতকে ট্রানজিট দিলে তার আয় থেকে বাংলাদেশ সিঙ্গাপুর হয়ে যাবে। এখন তো ট্রানজিট বাস্তবায়ন হলো, মাশুলসহ নানা ধরনের ফিও নির্ধারণ হলো। বাস্তবতা কী বলে? 

মজিবুর রহমান: সিঙ্গাপুর অনেক গরিব বলে একটা সময় কনফেডারেশন থেকে তাদের আলাদা করে দিল মালয়েশিয়া। সেই সিঙ্গাপুরে কোনো ধরনের খনিজ বা প্রাকৃতিক সম্পদ নেই। তারা এখন বিশ্বের অন্যতম ধনী দেশ। চট্টগ্রামে গভীর সমুদ্রবন্দরসহ যেসব উন্নয়ন হচ্ছে, সেগুলো যদি দক্ষতার সঙ্গে সামাল দিতে পারে, তাহলে বাংলাদেশও সিঙ্গাপুরের মতো বড় ট্রান্সপোর্টেশন হাব হয়ে উঠবে। ট্রানজিট সেখানে বড় ভূমিকা রাখবে। আর ভারত তো উত্তর-পূর্ব অঞ্চলে উন্নয়ন করবে, তার প্রভাব তো বাংলাদেশেও পড়বে। কারণ, এ রাস্তা দিয়েই তাদের যেতে হবে। আর সড়ক, ট্রেন, জলপথে সবখানে একযোগে ট্রানজিট চালু হলে বাংলাদেশ বছরে কয়েক শ মিলিয়ন ডলার আয় করতে পারবে। সেটিও হয়তো অচিরেই আমরা দেখব। বিশ্বের অন্যান্য বহুমুখী ট্রানজিটের আদর্শ মডেল অনুসরণ করলে একটা সময় বাংলাদেশকে ঘিরে এ অঞ্চল গোটা এশিয়ার গ্রোথ সেন্টার হবে। 

প্রথম আলো: আপনাকে ধন্যবাদ। 

মজিবুর রহমান: আপনাদেরও ধন্যবাদ।