বাংলাদেশে পাস করা গাজার চিকিৎসকের সাক্ষাৎকার

‘শেষ রক্তবিন্দু থাকতে ফিলিস্তিনিরা নিজেদের মাটি ছেড়ে যাবে না’

ইদ্রিস ফাওয়াজ। গাজার একটি অলাভজনক উন্নয়ন সংস্থা পরিচালিত হাসপাতালের চিকিৎসক। গাজায় ইসরায়েলি বাহিনীর হামলায় এনজিওটির কার্যক্রম বন্ধ হয়ে গেছে। স্বেচ্ছাসেবী চিকিৎসক হিসেবে কাজ করছেন এ অঞ্চলের বিভিন্ন হাসপাতালে। বর্তমানে অবস্থান করছেন দক্ষিণ গাজার খান ইউনুসে। ২০১৯ সালে বরিশালের শেরেবাংলা মেডিকেল কলেজের সাবেক এই ছাত্র তাঁর অভিজ্ঞতার কথা বলেছেন প্রথম আলোর সঙ্গে। গাজার ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্যে দীর্ঘ প্রচেষ্টায় অনলাইনে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন শেখ সাবিহা আলম

ইদ্রিস ফাওয়াজ
প্রশ্ন:

গাজার সর্বশেষ অবস্থা কী? আইডিএফ আল–শিফা হাসপাতাল ঘিরে ফেলেছে বলে জানতে পারছি আমরা...তারা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রোগীদের অন্যত্র নিয়ে যেতে বলছে।  

ইদ্রিস ফাওয়াজ: আল–শিফা হাসপাতালের কিছু অংশে বোমা হামলা হয়েছে। এ মুহূর্তে এই হাসপাতালের সঙ্গে বাইরের জগতের কোনো যোগাযোগ নেই বললেই চলে। হাসপাতালে বহু মানুষের লাশ স্তূপাকারে জমা হয়েছে। হাসপাতাল চত্বরে তাঁদের গণকবর দিতে হচ্ছে।

এখানে বিদ্যুৎ, পানি ও জ্বালানি সরবরাহ বন্ধ। ইন্টারনেট সংযোগ নেই বললেই চলে। বিভিন্ন বিভাগে বোমা হামলায় তীব্রভাবে দগ্ধ, হাত-পা উড়ে যাওয়া ক্ষতবিক্ষত মানুষ, অপরিণত শিশুরা আছে। তাঁদের এখান থেকে সরানো প্রায় অসম্ভব।

আমরা জানতে পারছি, আল-নসর হাসপাতালে শিশুদের রেখে চিকিৎসকদের চলে যেতে বলা হয়েছে। আর হ্যাঁ, আল–শিফায় বাংলাদেশ থেকে এমবিবিএস পাস করা বেশ কিছু চিকিৎসক আছেন।

প্রশ্ন:

৭ অক্টোবরের পর গাজার হাসপাতালগুলোয় আহত রোগীর সংখ্যা কতটা বেড়েছে?

ইদ্রিস ফাওয়াজ: সক্ষমতার প্রায় ৩০ গুণ রোগী এখন হাসপাতালগুলোয় চিকিৎসা নিচ্ছে। বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও পানির সংকটে থাকা হাসপাতালগুলোয় চিকিৎসকেরা কী করে রোগীদের সামাল দিচ্ছেন, আপনারা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন। তা ছাড়া হাসপাতালে ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী হামলা করবে না, এমন আশা থেকে বহু মানুষ এসব জায়গায় এসে আশ্রয় নিয়েছিলেন। হামলা শুরুর পর থেকেই হাসপাতালগুলোয় বোমা হামলায় সর্বস্ব হারানো মানুষ আশ্রয় নিয়েছিলেন।

প্রশ্ন:

আপনারা কী ধরনের রোগী পাচ্ছেন?

ইদ্রিস ফাওয়াজ: ফসফরাস বার্ন, শ্বাসকষ্ট, অঙ্গহানি হয়েছে এমন এবং পুড়ে যাওয়া ও মাথায় আঘাত পাওয়া রোগী। এ ধরনের আঘাতে বিশেষ ধরনের চিকিৎসা, বিশেষ যত্নের প্রয়োজন হয়। এই যত্ন রোগীদের দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। যে মায়েরা অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে সন্তান জন্ম দিয়েছেন, তাঁরাও হাসপাতালে থাকতে পারছেন না। সন্তান জন্ম দেওয়ার ঘণ্টাখানেকের মধ্যে তাঁদের বেরিয়ে যেতে হচ্ছে।

হাসপাতালগুলোয় চিকিৎসাসামগ্রীর তীব্র সংকট। বিদ্যুৎ ও জ্বালানিসংকট চিকিৎসকদের কাজ আরও জটিল করেছে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বিদ্যুৎ ও জ্বালানির বিকল্প ব্যবস্থা করলে সেখানেও হামলা চালিয়েছে ইসরায়েলি বিমানবাহিনী। তারা সোলার প্যানেলগুলোও ধ্বংস করে দিয়েছে।

টার্কিশ হাসপাতালে ক্যানসার রোগীরা চিকিৎসা নিত। ফিলিস্তিনিদের জন্য এ ধরনের হাসপাতালই আছে দুটি— গাজায় ও পশ্চিম তীরে। গাজার হাসপাতালটি ইসরায়েলি বিমানবাহিনীর হামলায় অকার্যকর হয়ে পড়েছে। আর পশ্চিম তীরে যাওয়ার পথ বন্ধ করে রেখেছে ইসরায়েলিরা। ফলে ক্যানসারে আক্রান্ত রোগীদের বিনা চিকিৎসায় মরতে হচ্ছে।

নিজের একটা অভিজ্ঞতার কথা বলি। আমি একটা শিশুকে পাই যার মা–বাবা, পরিবারের সবাই বোমা হামলায় নিহত হয়েছে। আমি শুধু ওর দিকে তাকিয়ে ভাবছিলাম, এইটুকুন বাচ্চা কীভাবে একা বাঁচবে? যুদ্ধ যত গড়িয়েছে, এমন শিশুর সংখ্যাও তত বেড়েছে। দু-এক বছর এমনকি কয়েক মাসের শিশু অনাথ হয়ে গেছে।

‘আমরা জানি, এই অন্ধকার সময় একদিন শেষ হবে। আমরা ধ্বংসাবশেষের ওপর নতুন করে জীবন গড়ব। কিন্তু দেহের শেষ রক্তবিন্দু যত দিন আছে, ফিলিস্তিনিরা তাদের মাটি ছেড়ে কোথাও যাবে না।’
প্রশ্ন:

ফসফরাস বার্নের রোগীদের কী ধরনের কষ্ট হচ্ছে?

ইদ্রিস ফাওয়াজ: ফসফরাস বোমা হামলার যাঁরা শিকার হয়েছেন, তাঁদের চামড়া ভেদ করে টিস্যুগুলো পুড়ে যাচ্ছে। দগ্ধ রোগীদের মতোই যন্ত্রণা ভোগ করে আক্রান্তরা। সবচেয়ে ভয়ংকর ব্যাপার হলো অক্সিজেনের সংস্পর্শে এলে যন্ত্রণা তীব্র হয়।  

প্রশ্ন:

হাসপাতালে রোগীদের খাওয়াদাওয়ার কী ব্যবস্থা?

ইদ্রিস ফাওয়াজ: গাজায় সত্যিকার অর্থে দুর্ভিক্ষ চলছে। খাবারের দোকানে কিচ্ছু নেই। হয় বন্ধ, নয়তো বোমা হামলায় গুঁড়িয়ে গেছে। এক টুকরো রুটি, এক চুমুক পানির আশায় রাস্তায় বেরিয়ে প্রাণ হারিয়েছে মানুষ। কোথাও পানি নেই। মানুষ ময়লা, নোংরা পানি খাচ্ছে। পানির কারণে রোগে ভুগছে।

প্রশ্ন:

ইসরায়েল বলার চেষ্টা করছে দক্ষিণ গাজা নিরাপদ। বেসামরিক মানুষ যেন দক্ষিণ গাজায় চলে যায়।

ইদ্রিস ফাওয়াজ: দক্ষিণ গাজাতেও ইসরায়েলিরা বোমা ফেলছে। কোথাও গাজার মানুষ নিরাপদ নয়।

প্রশ্ন:

সারা বিশ্বের সাধারণ মানুষ যুদ্ধবিরতির জন্য পথে নেমেছেন। কিন্তু মোটের ওপর প্রভাবশালী দেশগুলো চেয়ে চেয়ে দেখছে। এ নিয়ে কিছু বলতে চান?

ইদ্রিস ফাওয়াজ: আমি তাদের এই আচরণে আশ্চর্য হই না। তাদের এই দ্বিচারিতামূলক আচরণ স্বাভাবিক। কারণ, তারা ফিলিস্তিনিদের জীবনের কোনো মূল্য দেয় না। ১১ হাজারের ওপর মানুষ প্রাণ হারিয়েছে, যাদের মধ্যে ৪ হাজারের ওপর শিশু, ৩০ হাজার মানুষ আহত। আরও প্রায় চার হাজার মানুষ ধ্বংসাবশেষের নিচে আটকা পড়ে আছে। এই মানুষগুলো সংখ্যা না। ওদের নাম ছিল, স্বপ্ন ও বেঁচে থাকার সাধ ছিল।

প্রশ্ন:

আপনি এখন কী অবস্থায় আছেন?

ইদ্রিস ফাওয়াজ: আমি? আমার ঘরবাড়ি বোমা হামলায় ধ্বংস হয়ে গেছে। আমার পরিবারের বেশ কয়েকজন নিহত হয়েছে। অন্তত দুই শ চিকিৎসক নিহত হয়েছেন। চোখের সামনে আমাদের লোকজন হাজারে হাজারে মরছে। কিন্তু আমরা ভেঙে পড়িনি। আমরা জানি, এই অন্ধকার সময় একদিন শেষ হবে। আমরা ধ্বংসাবশেষের ওপর নতুন করে জীবন গড়ব। কিন্তু দেহের শেষ রক্তবিন্দু যত দিন আছে, ফিলিস্তিনিরা তাদের মাটি ছেড়ে কোথাও যাবে না।  

প্রশ্ন:

আপনাকে ধন্যবাদ।

ইদ্রিস ফাওয়াজ: আপনাদের আগ্রহের জন্য ধন্যবাদ। আমি আমাদের শেরেবাংলা মেডিকেল কলেজের শিক্ষকদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করি। তাঁদের বলতে চাই, আমরা তাঁদের গর্বিত করে যাব। আর আমাদের বৃত্তিসহ পড়ার সুযোগ দেওয়ার জন্য বাংলাদেশ সরকারকেও ধন্যবাদ।