ভাগ্য ফেরাতে আমাদের তরুণেরা বিপজ্জনক পথ পাড়ি দিয়ে লিবিয়া থেকে ইউরোপে যাচ্ছেন, মারা যাচ্ছেন। আমাদের মানব উন্নয়ন ভাবনায় তরুণেরা কেন উপেক্ষিত?
সেলিম জাহান: আপনার এই প্রশ্নটা আমাদের জন্য খুব প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন। কারণ, আমরা যখন মানব উন্নয়নের কথা বলছি, তখন সার্বিকভাবে একটা জনগোষ্ঠীর উন্নয়নের কথা বলছি। কিন্তু এটা আমাদের মনে রাখতে হবে, মানব উন্নয়ন শুধু বর্তমানের নয়, মানব উন্নয়ন ভবিষ্যতের। তরুণেরা হচ্ছে সেই ভবিষ্যৎ।
এ দিক বিবেচনায় তরুণদের আশা-আকাঙ্ক্ষা, তাদের প্রত্যাশা, তাদের সম্ভাবনা, তাদের সক্ষমতা—এ বিষয়গুলো আমাদের নীতিনির্ধারকেরা, আমাদের রাজনৈতিক নেতারা যতটা গুরুত্ব দেওয়ার দরকার, ততটা গুরুত্ব দিচ্ছেন না।
যখন সংগ্রাম, আন্দোলনের কথা আসে, যখন দেশবদলের কথা আসে, তখন আমরা তরুণদের সামনে আনি, কিন্তু সংগ্রাম-আন্দোলন শেষে যখন প্রার্থিত ফল এসে যায়, তখন তরুণেরা উপেক্ষিত থেকে যায়।
নিশ্চিত মৃত্যু হতে পারে, সেটা জেনেও তরুণদের একটা অংশ কেন দেশ ছাড়তে এমন মরিয়া?
সেলিম জাহান: এর দুই রকমের কারণ আছে।
এক. অর্থনীতির ভাষায় এটাকে বলা হয় চাহিদার কারণ এবং চাহিদার কারণে সৃষ্ট সংকট। আমাদের তরুণেরা কখনোই বিপজ্জনক পথে ঝুঁকি নিয়ে যেত না, যদি রাষ্ট্র তাদের জন্য সুযোগ তৈরি করতে পারত।
দুই. সব মানুষের মধ্যেই একটা উন্নত জীবন, একটা ভালো জীবন, একটা সম্ভাবনাময় জীবনে যাওয়ার আকাঙ্ক্ষা থাকে। তরুণেরা যখন দেখে তাদের দেশের বাইরে সেই সুযোগগুলো আছে, অন্যান্য দেশের তরুণেরা সেই সুযোগগুলো নিচ্ছে, তখন স্বাভাবিকভাবেই তারা সেই দিকে আকৃষ্ট হয়। কিন্তু তাদের যদি ঝুঁকি নিতে হয়, তাদের প্রাণ হাতে করে সুযোগগুলো নিতে হয়, সেটা কখনোই মেনে নেওয়া যায় না। এখানেই রাষ্ট্রের একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। অন্য রাষ্ট্রের সঙ্গে বৈশ্বিক মণ্ডলে আলাপ-আলোচনা করে আমাদের তরুণদের যে সম্ভাবনা আছে, অন্যান্য দেশ তার সুযোগ কীভাবে তৈরি করে দিতে পারে, তার একটা পথ দ্বিপক্ষীয় ও বহুপক্ষীয় আলোচনার মাধ্যমে বের করা দরকার।
মানব উন্নয়ন, দারিদ্র্য দূরীকরণের মতো ব্যাপারগুলোকে অনেকে এনজিওর ভাবনা বলে মনে করেন। অনেকে বলেন, এগুলো অনেকটাই নীতিনির্ধারকদের আলোচনার বিষয়। কিন্তু জরুরি এই বিষয়গুলো এত দিনেও কেন সাধারণ মানুষের ভাবনায় পরিণত হতে পারল না?
সেলিম জাহান: নীতিনির্ধারণ, নীতি প্রণয়ন এবং নীতি বাস্তবায়নে মানুষ যদি তাদের প্রত্যাশার জায়গাটা খুঁজে পেত, তাহলেই এই ভাবনাগুলোকে তারা নিজেদের ভাবনা বলে মনে করতে পারত। আমরা যখন মানব উন্নয়নের কথা বলছি, তখন সেটাকে আমাদের পরিকল্পনায়, আমাদের বাজেটে এমন বায়বীয়ভাবে উপস্থাপন করছি যে তার সঙ্গে মানুষ ঠিক যোগসূত্র খুঁজে পাচ্ছে না। যেমন মানব উন্নয়নের কথা এলেই মানবসম্পদ উন্নয়ন, মানুষের সম্পদের প্রসার—এসব কথা বলা হচ্ছে।
কিন্তু আমরা যদি সোজাসুজিভাবে বলি, মানবসম্পদ উন্নয়নের মানে হচ্ছে মানুষের কর্মনিয়োজনের সুযোগ দিতে হবে, তাদের প্রশিক্ষণের সুযোগ দিতে হবে, তাহলে এগুলো মানুষের বোধগম্য বিষয় হতো। এই সোজাসুজি বিষয়গুলো আমাদের বাজেটে, আমাদের পরিকল্পনায় উঠে আসছে না।
দারিদ্র্য দূরীকরণের জায়গাতেও দেখছি, আমাদের দারিদ্র্য দূরীকরণ নীতিমালা রয়েছে। সেখানে দারিদ্র্য দূরীকরণের জন্য সম্পদ আহরণের কথা বলা হয়েছে, সম্পদ বিনিয়োগের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু দারিদ্র্য শুধু একটা তাত্ত্বিক বিষয় নয়। যে মানুষটা দরিদ্র, যে মানুষটা প্রান্তিক, তাঁর যাপিত জীবনের প্রতিটি ঘণ্টায় তিনি দারিদ্র্যের মুখোমুখি হচ্ছেন। সুতরাং দারিদ্র্য দূরীকরণের যেসব প্রক্রিয়া রয়েছে, সেগুলোকে যদি মানুষের দোরগোড়ায় নিয়ে যাওয়া হয়, তাহলে কিন্তু মানুষ সেটার সঙ্গে সম্পৃক্ততা খুঁজে পাবেন। যেমন আমরা যদি কৃষককে সার, বীজ, সেচের সুবিধা দিই; গ্রামীণ শিল্পে যাঁরা নিয়োজিত, তাঁদের যদি সরকারি সহায়তা দিই, তখন মানুষ কিন্তু বুঝতে পারবেন দারিদ্র্য দূরীকরণ বিষয়টা শুধু কথার কথা নয়।
বেসরকারি সংগঠনগুলো মানব উন্নয়ন, দারিদ্র্য দূরীকরণের যে প্রক্রিয়া, তারাও একটা অংশীদার। শিক্ষা, স্বাস্থ্য সুপেয় পানি, কর্মনিয়োজন, নারীর ক্ষমতায়নে এনজিওগুলো বড় ভূমিকা রাখছে। তারা মাঠপর্যায়ে কাজ করছে। আমাদের এখানে সরকারি কাজকর্মে আমলাতান্ত্রিকতা আছে, আর সেটা সামষ্টিক পর্যায়ে রয়ে গেছে। এর বিপরীতে এনজিওগুলো মাঠপর্যায়ে কাজ করছে, সে কারণেই এগুলোকে এনজিওর কাজ হিসেবেই সাধারণ মানুষের কাছে দৃশ্যমান হচ্ছে।
আপনি জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচিতে দীর্ঘদিন কাজ করেছেন। সেই অভিজ্ঞতা থেকে বলবেন কি বৈশ্বিক বিবেচনায় বাংলাদেশ মানব উন্নয়নে কতটা গুরুত্ব দিতে পেরেছে?
সেলিম জাহান: আমি সৌভাগ্যবান যে এ ক্ষেত্রে আমি দীর্ঘদিন কাজ করেছি এবং আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকা, আরব বিশ্ব ও এশিয়াতে কাজ করার অভিজ্ঞতা আমার হয়েছে। প্রতিটি দেশ এবং প্রতিটি অঞ্চলের নিজস্ব কিছু সমস্যা, ধ্যানধারণা, সাংস্কৃতিক ব্যাপারস্যাপার থাকে। তবে মানব উন্নয়নের ব্যাপারে সব দেশের মানুষের মধ্যেই একটা প্রত্যাশা আছে।
বাংলাদেশে আমাদের অনেকের মধ্যেই এই ধারণা আছে যে সমস্যার স্বরূপ সব আমরা জানি, সমাধানও সব আমরা জানি। আমার কাছে মনে হয়, এ–জাতীয় উন্নাসিকতা আমাদের নীতিনির্ধারকদের মধ্যে আছে, আমাদের রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের মধ্যে আছে এবং আমাদের বিদ্যায়তনিক যেসব পেশাজীবী আছেন, তাঁদের মধ্যেও আছে।
বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় মানব উন্নয়ন ও দারিদ্র্য দূরীকরণের জন্য নানা ধরনের পরীক্ষা–নিরীক্ষা চলেছে। নানান রকমের সাফল্য ও ব্যর্থতা এসেছে। এসব অভিজ্ঞতা থেকে আমাদের শিক্ষা নেওয়া। বাংলাদেশে উন্নয়ন দর্শনে প্রবৃদ্ধির ওপর অসম্ভব জোর দেওয়া হয়। আমাদের প্রবৃদ্ধি ৬ নাকি ৮ শতাংশ—এই জাতীয় অর্থহীন বিতর্কে আমরা জড়িয়ে পড়ি। প্রবৃদ্ধি ব্যাপারটা তো স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়। প্রবৃদ্ধির আসল কাজ হচ্ছে মানুষের উন্নয়নকে প্রসার করা। বাংলাদেশে প্রবৃদ্ধির ওপর অতি জোর দেওয়ার কারণে মানব উন্নয়নের বিষয়গুলো আমরা সামনে আনতে পারিনি।
কিন্তু আমাদের প্রত্যাশিত গড় আয়ু তো ৭২.৩ বছর হয়েছে, ভারতে যেখানে ৭০; আমাদের অনূর্ধ্ব ৫ বছরের শিশুমৃত্যু হাজারে ২২-এ নেমে এসেছে, ভারতে যেখানে ৩৪। এ রকম আরও কিছু সূচকে আমাদের বলার মতো অগ্রগতি আছে।
সেলিম জাহান: এর অনেকগুলো কারণ আছে। অনেক জায়গায় আমরা সামাজিক সেবা দিতে পেরেছি। আবার বেসরকারি সংস্থাগুলো এসব জায়গায় কাজ করেছে। সে কারণেই এসব জায়গায় আমাদের সফলতা এসেছে। কিন্তু আমাদের প্রবৃদ্ধির সঙ্গে এটার একটা সংযোগ স্থাপন করতে চাইলে দেখা যাবে, প্রবৃদ্ধি কিন্তু মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের জায়গায় খুব একটা ভূমিকা রাখতে পারেনি।
আমরা একটা বৈশ্বিক মণ্ডলে বাস করছি, যেখানে দক্ষিণ-দক্ষিণ সহযোগিতার একটা ব্যাপার আছে। কারণ, আজকের বিশ্বে একমাত্র উন্নত বিশ্বের কাছ থেকে আমরা শিখতে পারব, তাদের প্রযুক্তিই আমরা গ্রহণ করব, সেটা ঠিক নয়। ব্রাজিল, নাইজেরিয়া, ভারতের মতো দেশে দারিদ্র্য দূরীকরণ, সামাজিক সুরক্ষার ব্যাপারে নানান ধরনের পরীক্ষা–নিরীক্ষা হচ্ছে। দক্ষিণ-দক্ষিণ সহযোগিতার পাটাতনে যোগ দিয়েও বাংলাদেশ উপকৃত হতে পারে।
বাংলাদেশে পরিকল্পনা ও বাজেট প্রণয়নের প্রক্রিয়ায় এখনো আমরা সম্পদ নিয়ে মাতামাতি করি, প্রবৃদ্ধি নিয়ে মাতামাতি করি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত উন্নয়নের কেন্দ্রবিন্দুতে মানুষ থাকতে হবে, মানুষের সক্ষমতার কথা বলতে হবে, মানুষের বঞ্চনা দূর করতে হবে। যতক্ষণ পর্যন্ত আমাদের উন্নয়নচিন্তায় এবং উন্নয়নপ্রক্রিয়ায় মানুষের উন্নয়ন, মানুষের জন্য উন্নয়ন এবং মানুষের দ্বারা উন্নয়ন নিশ্চিত করতে না পারব, ততক্ষণ পর্যন্ত মানব উন্নয়ন ও দারিদ্র্য দূরীকরণের প্রত্যাশিত জায়গায় আমরা পৌঁছাতে পারব না।
আপনি অনেকবার বলেছেন, মানব উন্নয়নের নৈতিক একটা দিক আছে। বিষয়টিকে ব্যাখ্যা করবেন কি?
সেলিম জাহান: উন্নয়ন ব্যাপারটাতে একটা দার্শনিক ও নৈতিক পটভূমি থাকা দরকার। উন্নয়ন কোনো বিমূর্ত ধারণা নয়। প্রবৃদ্ধি অর্জন করলাম, দারিদ্র্য কমালাম, এটাই উন্নয়নের শেষ কথা নয়। মানব উন্নয়নে নৈতিকতার বিষয়টিতে আমি তিনটি বিষয়ে জোর দিতে চাই।
এক. বৈষম্য। অনেকে বলতে পারেন, বৈষম্য ব্যাপারটি হচ্ছে অর্থনৈতিক। শেষ বিচারে বৈষম্যের একটা নৈতিক দিক আছে। একটি সমাজে বৈষম্য এমন পর্যায়ে যাওয়া উচিত নয়, যেখানে একজন মানুষ সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা পাবেন, আরেকজন মানুষ মানবেতর জীবন যাপন করবেন। আমাদের উন্নয়নচিন্তায় বৈষম্যের নৈতিক দিকটা আসা দরকার।
দ্বিতীয়ত, আমাদের বস্তুতান্ত্রিক উন্নয়নই কি শেষ কথা? শেষ পর্যন্ত মানুষের সক্ষমতা বৃদ্ধি, তার সুযোগ বৃদ্ধিই কি শেষ কথা? আমার কাছে মনে হয়, প্রত্যেক মানুষের অধিকার, মর্যাদা, প্রত্যেক মানুষকে শ্রদ্ধার জায়গায় সেটা উন্নয়নের একটা বিরাট দিক। আমরা বস্তুগত উন্নয়ন অর্জন করতে পারব, মানুষের সক্ষমতাও বাড়াতে পারব, কিন্তু সমাজে যদি একজন মানুষের অন্য মানুষের প্রতি সৌহার্দ্য, মমত্ববোধ না থাকে, অপরের প্রতি যদি শ্রদ্ধা না থাকে, তাহলে উন্নয়নের মানে কী।
বস্তুগত উন্নয়ন অর্জন করার পর আমাদের যদি সহনশীলতা চলে যায়, পরমতসহিষ্ণুতা আমাদের যদি না থাকে, তাহলে উন্নয়নের প্রকৃত অর্থ, প্রকৃত লক্ষ্য ব্যর্থ হয়ে গেল। আজকের দিনে আমাদের সমাজে সন্ত্রাস আমাদের সংস্কৃতি হয়ে দাঁড়িয়েছে, সহিংসতা আমাদের ভাষা হয়ে গেছে। সে জন্যই আমি বলেছি, উন্নয়নের মধ্য দিয়ে শেষ পর্যন্ত উন্নত মানুষ সৃষ্টি করতে হবে।
গত কয়েক দিনে ধানমন্ডি–৩২–সহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় ভাঙচুর, সহিংসতার ঘটনা আমরা দেখেছি। এ ধরনের সহিংসতা কোনোভাবেই কাম্য নয়। আমাদের মধ্যে মতপার্থক্য থাকতেই পারে। কোনো কারণে আমরা বিক্ষুব্ধও হতে পারি। কিন্তু তা নিষ্পত্তির জন্য কিংবা ক্ষোভ প্রশমনের জন্য আমরা আলাপ–আলোচনা, সভা–সমাবেশের আশ্রয় নিতে পারি, সহিংসতার আশ্রয় নিতে পারি না।
তৃতীয়ত, বাংলাদেশের সমাজ অসম্ভব রকম বস্তুকেন্দ্রিক হয়ে গেছে। অর্থ ও ক্ষমতা একজন সার্থক মানুষের নির্ণায়ক হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখানেও নৈতিকতার ব্যাপারটি গুরুত্বপূর্ণ। শেষ পর্যন্ত আমরা যদি যৌথভাবে সমাজের উন্নয়ন না করতে পারি, তাহলে উন্নয়নের লক্ষ্য ব্যর্থ হয়ে যাবে।
আমরা কি এমন কোনো একটি দেশকে চিন্তা করতে পারি, যে দেশটি এমন উন্নয়নের মডেল?
সেলিম জাহান: আমি এখানে কোস্টারিকার কথা বলতে পারি। লাতিন আমেরিকার মধ্যেও ছোট্ট একটা দেশ কোস্টারিকা কিংবা কিউবার কথা বলতে পারি।
এ দুটি রাষ্ট্র মানুষের মর্যাদা, মানুষের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ এবং উন্নয়নে নৈতিকতার দর্শন—এগুলো খুব শক্তভাবে তাদের উন্নয়নচিন্তা ও উন্নয়ন পরিকল্পনার অংশ করে নিয়েছে। কোস্টারিকায় কোনো সেনাবাহিনী নেই। অন্য দেশ সামরিক খাতে বিশাল একটা খরচ করলেও কোস্টারিকা সেই অর্থ খরচ করে সমাজসেবা, স্বাস্থ্যসেবা ও জনগণের শিক্ষাব্যবস্থার জন্য। এ বিবেচনায় কোস্টারিকা একটা মডেল রাষ্ট্র।
প্রশ্ন হলো, কোস্টারিকা কি উন্নয়নের চূড়ান্ত চূড়ায় পৌঁছাতে পেরেছে, সেখানে কি সমস্যা নেই? নিশ্চয়ই আছে। কিন্তু একটা নৈতিক ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে তারা ক্রমাগত চেষ্টা করে যাচ্ছে বৈষম্য কমিয়ে আনতে, সব মানুষের জন্য সহনশীল সমাজ গড়তে।
বাংলাদেশে তো বৈষম্য বিপজ্জনক জায়গায় চলে এসেছে। এত তীব্র বৈষম্য জিইয়ে রেখে কীভাবে মানব উন্নয়ন সম্ভব?
সেলিম জাহান: যে বৈষম্যের কথা আপনি বলছেন, তার মাত্রিকতার দিকে আমাদের নজর দেওয়া দরকার। বাংলাদেশে এখন গিনি সহগের মান শূন্য দশমিক ৪৯। সূচকের মান ৫ হলেই বলা হয় সেটা একটা বিপজ্জনক জায়গায় চলে এসেছে। গিনি সহগটা পরিমাপ করা হয় শুধু আয়ের দিক থেকে। আমাদের বৈষম্যের আলোচনা অর্থনৈতিক বৈষম্যের এই মাত্রিকতার বাইরে বেরিয়েও করতে হবে।
শহর-গ্রামে বৈষম্য আছে, নর–নারীর মধ্যে বৈষম্য আছে, উত্তর অঞ্চল-দক্ষিণ অঞ্চলের বৈষম্য আছে, আদিবাসীদের সঙ্গে বাঙালিদের বৈষম্য আছে। বৈষম্যের এই বহুমাত্রিকতা একে অপরের সঙ্গে সম্পৃক্ত। কিন্তু অনেক সময় বৈষম্যকে খুব বিভাজিতভাবে উপস্থাপন করি। সেটা কিন্তু ঠিক নয়। বৈষম্য বিচারে আমরা শুধু ফলাফলের দিকে তাকাই। বাংলাদেশের মতো দেশে ফলাফলের বৈষম্যটা সৃষ্টিই হয় যখন সুযোগের বৈষম্য থাকে। শিক্ষা ও স্বাস্থ্যে তিন বা চার রকমের ধারা রেখে কখনোই আমরা সুষম সমাজ বা সুষম অর্থনীতি গড়তে পারব না।
শহরের নামীদামি স্কুলের শিক্ষার্থী যে সুযোগ পাচ্ছে, তার সামান্য অংশ মাত্র পাচ্ছে গ্রামের স্কুলের একজন শিক্ষার্থী। আমরা শিক্ষাক্ষেত্রে তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারের কথা খুব বলছি। কিন্তু কুড়িগ্রামের একটা গ্রামের স্কুলের শিক্ষার্থীর তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারের সুযোগ কতটা রয়েছে?
এখানে আরেকটা বৈষম্যের কথা বিশেষভাবে বলা প্রয়োজন। সেটা হলো বর্তমান প্রজন্মের সঙ্গে ভবিষ্যতে যে মানুষেরা আসবে, তাদের মধ্যকার বৈষম্য। পরিবেশের কথাই ধরা যাক। আমরা পরিবেশকে বর্তমান প্রজন্মের সুযোগ-সুবিধার কাজে ব্যবহার করছি। কিন্তু এটা ভাবছি না যে আমরা যদি পরিবেশকে ধ্বংস করি, তাহলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম তাদের মানবসম্পদ উন্নয়নের কাজে সেটা ব্যবহার করতে পারবে না।
বর্তমানে বাংলাদেশে বৈষম্যের যে প্রকৃতি, বৈষম্যের যে মান, বৈষম্যের যে মাত্রিকতা, সেটা বজায় থাকলে আমরা যে মানব উন্নয়নটা চাইছি, সেটা আমরা অর্জন করতে পারব না।
মানবসম্পদ উন্নয়নে শিক্ষা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। কিন্তু আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে কর্মসংস্থানের সংযোগ খুঁজে পাওয়া কঠিন।
সেলিম জাহান: শিক্ষা মানবসম্পদ উন্নয়নে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ—এ ব্যাপারে কেউ দ্বিমত করবেন না। এখানে মূল প্রশ্ন হলো, শিক্ষার লক্ষ্যটা আসলে কী। আমরা যদি প্রাথমিক শিক্ষার কথা বলি, তবে সেই শিক্ষার উদ্দেশ্য হচ্ছে মানুষের মধ্যে সাক্ষরতা বৃদ্ধি। মাধ্যমিক শিক্ষার উদ্দেশ্য হলো, একধরনের দক্ষতা ও কর্মকুশলতা সৃষ্টি করা। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষায় ব্যক্তি সৃজনশীল গুণাবলি অর্জন করেন, স্বাধীনভাবে চিন্তা ও বিশ্লেষণ করার ক্ষমতা অর্জন করেন।
এই মাপকাঠি দিয়ে যদি বাংলাদেশের শিক্ষা খাতকে বিবেচনা করি, তাহলে দেখতে পাব, আমরা শেষ পর্যন্ত সনদপ্রাপ্ত মানুষের সংখ্যা বাড়াচ্ছি, কিন্তু শিক্ষাপ্রাপ্ত মানুষের সংখ্যা বাড়াচ্ছি না। শিক্ষার গুণগত জায়গাটা উপেক্ষা করে আমরা শিক্ষার পরিমাণগত দিকেই ঝুঁকে পড়েছি। শিক্ষার গুণগত দিকটার সঙ্গে শিক্ষার সুযোগের বৈষম্য অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। নামীদামি স্কুলে যেখানে ২০ জন শিক্ষার্থীর বিপরীতে একজন শিক্ষক রয়েছেন, সেখানে সরকারি বিদ্যালয়ে ১৫০ জন শিক্ষার্থীর জন্য একজন শিক্ষক রয়েছেন। এখানে তো একটা গুণগত পার্থক্য হবেই।
শিক্ষা আসলে মৌলিক অধিকার ছিল, কিন্তু এখন শিক্ষা অনেকটা বিলাসদ্রব্যে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশে একসময় সবার জন্য শিক্ষা—এ জাতীয় কথা আমরা বলেছি। এর ভিত্তিতেই শিক্ষাটা সবার কাছে লভ্য। পরবর্তীকালে আমরা শিক্ষার বিভাজন করেছি। শিক্ষার এই বিভাজন সামাজিক ও অর্থনৈতিক বিভাজনের সঙ্গে সম্পৃক্ত। এই বিভাজন নিশ্চিতভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের মানব উন্নয়নের পরিপন্থী।
একজন শিক্ষার্থী শিখতে পারবে তখনই, যখন শিক্ষক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হবেন, শিক্ষার প্রতি অঙ্গীকারবদ্ধ হবেন, জ্ঞানচর্চায় মনোনিবেশ করতে পারবেন। শিক্ষককে যদি আর দশজন আমলার মতো অন্য সব বিষয় নিয়ে চিন্তিত হতে হয়, শিক্ষকের যে বেতন সেটা যদি সন্তোষজনক পর্যায়ে না হয়, তাহলে নিশ্চিতভাবেই আমরা সেই শিক্ষক পাব না, যাঁরা আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার প্রসার ঘটাতে পারবেন।
তথ্যপ্রযুক্তি বিপ্লবের ফলে বিশ্ব দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে। আগে যে ধরনের দক্ষতার দরকার হতো, এখন তার মাত্রিকতা বদলে গেছে। বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা থেকে যাঁরা বের হচ্ছেন, তাঁদের শুধু এ দেশের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে হবে না, অন্যান্য দেশের শিক্ষার্থীদের সঙ্গেও প্রতিযোগিতা করতে হবে। সুতরাং সেই বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে অন্যদের সঙ্গে প্রতিযোগিতামূলক একটা অবস্থানে থেকে আমরা ভালো করতে পারব কি না, সেই প্রশ্ন আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় আসা উচিত। শিক্ষার ব্যবস্থাপনা, শিক্ষার পরিকল্পনা আজকের জন্য করলে হবে না, সেটা আগামী ১৫-২০ বছরের কথা চিন্তা করে করতে হবে।
আমরা শিক্ষাব্যবস্থার পরিবর্তনকে পাঠ্যসূচি, পাঠ্যক্রম পরিবর্তনের বিষয়ে পরিণত করেছি। এর থেকে বেরিয়ে আসার উপায় কী?
সেলিম জাহান: আমরা পাঠ্যসূচি, পাঠ্যক্রমকে সব সময় একটা রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে দেখতে চেষ্টা করি। যখন যে সরকার আসে, তাদের মনোভাব, দৃষ্টিভঙ্গি পাঠ্যক্রম ও পাঠ্যসূচিতে প্রতিফলিত করতে চেষ্টা করে। কিছু বিষয় আছে যেগুলো সব সময়ের জন্য সত্য, যেগুলো সব প্রজন্মের শিক্ষার্থীকে জানতে হবে, সেগুলোকে আঘাত করে একটা রাজনৈতিক ব্যাপার যদি আমরা সামনে নিয়ে আসি, সেটা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক।
শিক্ষা সংস্কারের ব্যাপারটি স্বল্প সময়ের ব্যাপার নয়। আজকে ধরে কালকেই শিক্ষাকে খোল–নলচে পাল্টে দেওয়া যাবে না। এটা একটা দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া। জনগণের নির্বাচিত যাঁরা প্রতিনিধি, সে রকম একটা জনপ্রতিনিধিত্বমূলক সরকারেরই দীর্ঘমেয়াদি শিক্ষা সংস্কারের সুযোগ আছে।
আমরা শিক্ষা সংস্কারের কথা বললেই পাঠ্যক্রম ও সূচির কথা বলি, কিন্তু পাঠদানের প্রক্রিয়া, শিক্ষকের প্রশিক্ষণ কিংবা ভবিষ্যতের কথা মাথায় রেখে কোন কোন বিষয় যুক্ত করা দরকার, সেগুলো উপেক্ষা করি। রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে শিক্ষা সংস্কার করা হলে সেটা শিক্ষাব্যবস্থার প্রয়োজনীয় পরিবর্তনটা আনতে পারবে না। আমাদের নিষ্পত্তিকৃত সত্য, আমাদের মৌলিক বিষয়গুলো কোনো শিক্ষাব্যবস্থাতেই উপেক্ষা করা যাবে না।
আপনাকে ধন্যবাদ।
সেলিম জাহান: আপনাকেও ধন্যবাদ।