আমরা যদি গত ৭৫ বছরের ইতিহাসকে বিবেচনা করি, তাহলে দেখব, ২০২৪-সহ অন্তত চারবার এ ভূখণ্ডের মানুষেরা বড় পরিবর্তনের সম্ভাবনার সামনে দাঁড়িয়েছি। ’৪৭, ’৭১, ’৯০—প্রতিবারই আমরা সুযোগকে হারিয়েছি। জুলাই অভ্যুত্থানের সাত মাস চলছে। সামগ্রিক বিবেচনায় আমাদের রাজনৈতিক দল ও অন্তর্বর্তী সরকার ইতিহাস থেকে কতটা শিক্ষা নিতে পেরেছে বলে মনে করছেন?
আসিফ মোহাম্মদ শাহান: প্রথম কথা হচ্ছে, এখানে অ্যাক্টর কারা? অন্তর্বর্তী সরকারকে আমরা যদি প্রথম অ্যাক্টর হিসেবে ধরি, তাহলে সরকারের কাজটা হচ্ছে জুলাই অভ্যুত্থানের যে আশা-আকাঙ্ক্ষা, সেটাকে বাস্তবায়ন করা। দ্বিতীয় অ্যাক্টর হচ্ছে রাজনৈতিক দলগুলো। তাদের সাহায্য বা মতামত ছাড়া সরকার সেই আশা-আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়ন করতে পারছে না। এখানে একটা বড় ধরনের সমস্যা হচ্ছে।
রাজনৈতিক দলগুলো কী চাইছে, কতখানি চাইছে, সেটা স্পষ্ট নয়। সংস্কার প্রশ্নে আমরা এখন পর্যন্ত কোনো মতৈক্য দেখতে পাচ্ছি না। বরং নির্বাচন বনাম সংস্কার—এই একটা বাইনারিতে আলোচনাটাকে দাঁড় করানো হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে আমরা রাজনৈতিক দলগুলোকে দোষ দিতেই পারি, কিন্তু তারা ক্ষমতায় যেতে চাইবে, সেটাও স্বাভাবিক বিষয়। এখন এই চাওয়াকে নিয়ন্ত্রণ করা বা সেই চাওয়া নিয়ে একটা সমঝোতায় যাওয়ার ব্যাপারে অন্তর্বর্তী সরকারের যে দায়িত্ব, সেটা তারা পুরোপুরি পালন করতে পারছে না।
সংস্কারের মাত্রা কতখানি হবে না হবে, সেটা নির্ভর করে অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর যে দায়িত্বগুলো আছে, সেগুলো তারা কতটা ঠিকভাবে করছে, তার ওপর। জনগণের নিরাপত্তা বিধান করা, মব সহিংসতা বন্ধ করা, অর্থনীতি ঠিক করা—সরকার যতটা সফলতার সঙ্গে এ কাজগুলো করতে পারত, সরকার তত বেশি সংস্কারের সময় পেত, সংস্কারের যৌক্তিকতা নিয়ে আলোচনাও তত বেশি হতো। সরকার এ কাজগুলো করতে যত বেশি ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে, মানুষ তত বেশি চিন্তা করছে তাহলে আর কিছু দরকার নেই, এবার নির্বাচন হোক। রাজনৈতিক দলগুলো এ সুবিধাই নিচ্ছে।
মোদ্দাকথা, রাজনৈতিক দলগুলো একদিকে তাদের চাওয়া অনুযায়ী চালিত হচ্ছে, অন্যদিকে অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর যে দায়িত্ব, সেটা বাস্তবায়নে তারা যথাযথ সফলতার পরিচয় দিতে পারছে না। এ দুটি জায়গা থেকে আমার মনে হয়, আমরা অনেকটাই অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে গেছি। অতীত ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেওয়ার কথাটি যদি বলি, রাজনৈতিক দল বা অন্তর্বর্তী সরকার কেউই বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিচ্ছে না।
সরকারের সাত মাসে এসে আমরা দেখছি, ছিনতাই, অপহরণ, ডাকাতি, ধর্ষণ ও নারী নির্যাতনের মতো অপরাধগুলো বেড়ে গেছে। মানুষের মধ্যে একধরনের নিরাপত্তাহীনতার বোধ তৈরি হচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির এই অবনতিকে সরকার কতটা আমলে নিচ্ছে?
আসিফ মোহাম্মদ শাহান: অন্তর্বর্তী সরকারের লেজিটিমেসি বা বৈধতা নির্বাচনের মাধ্যমে আসেনি। এটা একটা অভ্যুত্থান–পরবর্তী সরকার। জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে সরকার যতটা মিল রেখে চলতে পারবে, তার বৈধতা তত বাড়বে। এই বৈধতা বাড়া গুরুত্বপূর্ণ এই কারণে যে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি খারাপ হলে অপরাধ দমনে শক্ত পদক্ষেপ নিতে হবে। সরকারের বৈধতা যখন বেশি থাকে, তখন ব্যবস্থা নিলে জনগণ একভাবে নেবে। আর বৈধতা যত কমবে, ততই সরকার দমন করতে দ্বিধাগ্রস্ত হবে, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি তত হাতের বাইরে চলে যাবে। সরকার এ রকম একটা ফাঁদের মধ্যে পড়ে যাচ্ছে কি না, সেটা একটা বড় প্রশ্ন।
গত ১৫-১৬ বছরে আওয়ামী লীগ যেভাবে সরকার পরিচালনা করেছিল; পুলিশ, আমলাতন্ত্র ও বিচার বিভাগকে যেভাবে দলীয়ভাবে ব্যবহার করেছিল, তাদের নিয়ে কাজ করতে গিয়েও সরকারকে সমস্যায় পড়তে হচ্ছে?
আসিফ মোহাম্মদ শাহান: আমরা সবাই পুলিশ, আমলাতন্ত্র, বিচার বিভাগের কথা বলছি। কিন্তু এখানে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ও আছে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানে আমরা বলি, প্রতিটা সমাজই উত্তরাধিকারসূত্রে সহিংস। এরপরও সমাজগুলো কেন সহিংসতায় যায় না? এর বড় কারণ হলো, প্রতিটা সমাজের ভেতরে কিছু ইনস্টিটিউশন থাকে। এখানে ইনস্টিটিউশন বলতে পুলিশ বা এ ধরনের সংগঠনকে বোঝাচ্ছি না। সমাজে কার প্রতি কেমন ব্যবহার করা হবে, কোন জায়গাটায় এসে সীমানা টানা হবে, তার একটি ইনফরমাল আন্ডারস্ট্যাডিং থাকে। গত ১৫-১৬ বছরে রাষ্ট্রীয় সংগঠনগুলোর কথা বাদই দিলাম, এ ধরনের সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলোও ভয়াবহ মাত্রায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
রাজনৈতিক দল যখন সমাজের প্রতিটি জায়গায় হস্তক্ষেপ করে, তখন সমাজের নিজস্ব শক্তির জায়গাটা ধ্বংস হয়ে যায়। রাজনৈতিক শক্তি সেখানে ক্ষমতা বিস্তার করে। ফলে সহিংসতা ঠেকানোর জন্য আমাদের সমাজের নিজস্ব যে ক্ষমতা, সেটা নষ্ট হয়ে গেছে। কিন্তু এরপরও সমাজ কিছুটা অসহিংস ছিল কীভাবে? কারণ, রাষ্ট্রীয় সংগঠনগুলো ভয়াবহ মাত্রায় দমন–পীড়ন করেছিল। এখন ৫ আগস্ট–পরবর্তী সময়ে আমরা দেখছি, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর এই দমন করার ক্ষমতাটা চলে গেছে।
তারা যে অবৈধভাবে এটা করেছিল, সেটা জনগণের কাছে পরিষ্কার হয়ে গেছে। পুলিশ বলি, আমলাতন্ত্র বলি—তারা সবাই-ই তো রাজনৈতিক দলের অংশে পরিণত হয়েছিল। ফলে পুলিশ, প্রশাসনের যে নিরপেক্ষতার কাঠামো, সেটা নষ্ট হয়ে গেছে। পুরো সমাজটা একটা ভঙ্গুর অবস্থায় এসে পৌঁছেছে।
কিন্তু এরপরও কথা থেকে যায়। সরকারের বয়স সাত মাস হয়েছে। প্রতিষ্ঠানগুলো ঠিক করার ক্ষেত্রে সরকার কী কী পদক্ষেপ নিয়েছে? সরকারের কাছ থেকে সুস্পষ্ট কোনো অবস্থান দেখছি না। যেমন একটা স্বাধীন পুলিশ কমিশন গঠনের ক্ষেত্রে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় নিজেই আপত্তি জানিয়েছে। পুলিশের নিয়োগ, পদোন্নতি এবং পুলিশ কীভাবে ব্যবহার করবে, সেটা আমরা যেভাবে নিয়ন্ত্রণ করেছি, সেটা কাজ করেনি। সেখান থেকে বেরিয়ে আসার পথটাকেও আবার বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে।
মাজার ভাঙা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান বন্ধ, মব সহিংসতা ও রাস্তায় নারী নিপীড়নের ঘটনায় সরকার কেন কঠোর কোনো বার্তা দিতে পারছে না?
আসিফ মোহাম্মদ শাহান: মব সহিংসতা নিয়ন্ত্রণে সরকার সুস্পষ্ট অবস্থান নিতে পারেনি। এই মব যে ছোট একটা গোষ্ঠী, তারা যে আমাদের এই জনগোষ্ঠীর আশা-আকাঙ্ক্ষা ও সাংস্কৃতিক অবস্থানকে প্রতিফলন করে না, এটা সরকার বুঝতে পারছে না, অথবা বুঝেও এটার বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নিতে পারছে না। সরকার কি ভাবছে, মবের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলে তাদের বৈধতা কমে যাবে? কিন্তু সরকারের বৈধতা বা গ্রহণযোগ্যতা কি শুধু এই একটি গোষ্ঠীর ওপর নির্ভর করে? বিভিন্ন জায়গা থেকে বারবার সরকারকে আশ্বস্ত করা হচ্ছে, এটা যারা করছে, সেটা একটা ছোট গোষ্ঠী। সরকার তারপরও কোনো পদক্ষেপ নিতে পারছে না।
এখানে সোজা একটা বিষয় সরকারকে পরিষ্কার করা দরকার ছিল। ধর্মীয়, লিঙ্গীয়, ধর্মীয় আচার প্রকাশ করার দৃষ্টিভঙ্গিতে মানুষে মানুষে পার্থক্য থাকতে পারে। তার সঙ্গে কেউ একমত না–ও হতে পারেন। কিন্তু কারও ওপর কেউ আক্রমণ করতে পারবে না। রাষ্ট্রের দায়িত্ব হচ্ছে সবাইকে সুরক্ষা দেওয়া। কারও দৃষ্টিভঙ্গি, কারও আচরণ কারও না–ও পছন্দ হতে পারে, কিন্তু কাউকে যখন কেউ আক্রমণ করার কথা বলছে, সেটা একটা রেডলাইন। সরকার কোনোভাবেই এই রেডলাইনটা টেনে দিতে পারছে না।
এই প্রশ্নগুলো যখনই সরকারকে করা হয়, তখনই বলা হয়, এমন প্রগতিশীল উপদেষ্টা পরিষদ কোথায় পাবেন? প্রগতিশীলতা কিন্তু কারও পরিচয় কী তার ওপর নির্ভর করে না, প্রগতিশীলতা নির্ভর করে কেউ কী কাজ করছে, তার ওপর। আমি মাঝেমধ্যে বিস্মিত হয়ে ভাবি, উপদেষ্টা পরিষদে যাঁরা আছেন, তাঁরা তাঁদের লিগ্যাসি নিয়ে চিন্তা করেন কি না। সরকার যখন দায়িত্ব ছেড়ে দেবে, তখন যদি এমনটা হয়, যে সময়কালটা তাঁরা শাসনকার্য চালিয়েছেন, সেই সময়কালে বিভিন্ন জাতি–গোষ্ঠী আক্রান্ত হয়েছেন, তাদের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হয়েছে, অথচ সরকার শক্ত কোনো অবস্থান ঘোষণা করেনি। এটা কি সরকারের লিগ্যাসির জন্য ভালো হবে?
আমাদের মূলধারার দলগুলোর টিকে থাকার অন্যতম ভিত্তিই তো চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, কমিশনবাজি। সাত মাসে আমরা যা দেখলাম, তা হলো এক দলের বদলে আরেক দল তার জায়গা নিয়ে নিয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলোর এই সংস্কৃতি থেকে বের হওয়ার কোনো লক্ষণ তো আমরা দেখছি না।
আসিফ মোহাম্মদ শাহান: রাজনৈতিক দলগুলো যেভাবে কাজ করছে, সেই কাজ করার উপায় বদলে ফেলার জন্য যদি কোনো ইনসেনটিভ না থাকে, তাহলে তারা কেন বদলে যাবে। সংস্কারবিষয়ক আলোচনা যখন হয়, তখন অনেকে বলেন, মানুষের চরিত্র ভালো করতে হবে। এটা কি আপনা–আপনি হবে। নেতা–কর্মীরা যখন দেখে চাঁদাবাজি করলে তার কোনো জবাবদিহি নেই। চাঁদাবাজি করে দলের তহবিলে টাকা দিলে তাদের পুরস্কৃত করা হচ্ছে, তাহলে কেন তারা সেটা করবে না।
তাহলে রাজনৈতিক সংস্কৃতি কীভাবে বদলাবে? এখানেই সংস্কারের প্রশ্নটি জড়িত। রাজনৈতিক দল পরিচালনার যে নিয়মবিধি আছে, সেই জায়গায় বদল আনা জরুরি। আরপিওর কিছু জায়গায় আইনকানুনের সংস্কার দরকার। অর্থায়ন কোথা থেকে আসছে, সেই স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা দরকার। নির্বাচন সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে এ রকম কিছু প্রস্তাব এসেছে। কিন্তু এখানে আরও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে রাজনৈতিক দলগুলো এগুলো অনুসরণ করছে কি না, সেটা নিশ্চিত করার জন্য প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি তৈরি করা এবং নির্বাচন কমিশনকে এ ধরনের ক্ষমতা দেওয়া। মূল পরিবর্তনটা আনতে হবে প্রাতিষ্ঠানিক স্তরে।
একটা প্রতিষ্ঠান তৈরি করার পর সেটা সমাজে ভিত্তি গড়ার জন্য সময় লাগে। সেটা থেকে কিছু নিয়ম ও মূল্যবোধ তৈরি হয়। রাজনৈতিক দলগুলো চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি করলে, নির্বাচন কমিশন যখন সেটার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে, অথবা তার একটা প্রতিফলন ভোটের ফলাফলে গিয়ে পড়বে, তখনই শুধু রাজনৈতিক দলগুলো এ সংস্কৃতি থেকে বের হবে।
নতুন দলের অর্থায়নের উৎস নিয়েও তো প্রশ্ন আসছে...
আসিফ মোহাম্মদ শাহান: নির্বাচন একটা প্রতিযোগিতা। নতুন কোনো রাজনৈতিক দল যখন দেখে তারা ভালো কাজগুলো করতে চায়, কিন্তু তার ফলে নির্বাচনী প্রতিযোগিতায় তারা পিছিয়ে পড়ছে আর যারা চাঁদাবাজি করছে, তারা এগিয়ে যাচ্ছে, সে ক্ষেত্রে তাদের প্রণোদনাটি কী? সে জন্যই শুধু ভোটারদের জন্য নয়, রাজনৈতিক দলগুলোর জন্যও লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড করতে হবে। আমরা অনেক সময় দায়টা নতুন দলের ওপর দিচ্ছি। কারণ, তাদের ওপর আমাদের প্রত্যাশাটা বেশি। নতুন দল যদি এ প্রশ্ন করে, আমাদের তো প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হবে, তার উত্তরটা কী হবে, সেটা তো আমাদের বের করতে হবে।
অনেক দেশে রাজনৈতিক দলগুলোর নির্বাচন পরিচালনার তহবিলটা সরকার থেকে দেওয়া হয়। আমরা এটাও ভেবে দেখতে পারি। টাকার খেলা তো পৃথিবীর সব দেশেই আছে। যুক্তরাষ্ট্রের সিটিজেন ইউনাইটেড বনাম ফেডারেল ইলেকশন কমিশনের যে মামলাটি আছে, সেখানে বলা হচ্ছে, মানি ইজ ইকুয়াল টু ফ্রি স্পিচ। এর মানে, নির্বাচনে যত সম্ভব টাকা খরচ করা যাবে। কিন্তু পার্থক্যটা কোথায় তৈরি হচ্ছে? রাজনৈতিক দলের তহবিলে বা কংগ্রেসম্যান ও সিনেটরের তহবিলে কী পরিমাণ টাকা যাচ্ছে, সেটা সবাই দেখছে। নির্দিষ্ট কিছু নাগরিক সমাজ সংগঠন আছে, তারা এটা অনুসরণ করছে। আইনসভায় কোনো একটা বিষয় নিয়ে যখন ভোটাভুটি হয়, তখন সেই আইনপ্রণেতা কেন ভোট দিচ্ছেন, কেনই–বা ভোট দিচ্ছেন না, সেই আলোচনা হয়। ফলে যদি কোনো কাজের জন্য প্রতিফল পাওয়া যায়, তখনই কেবল রাজনীতিকেরা তাঁদের আচরণ পাল্টাবেন।
একটি ঐকমত্য কমিশন গঠন হয়েছে। সংস্কারের আলোচনা এখন কি অনেকটা গৌণ বলে মনে হচ্ছে?
আসিফ মোহাম্মদ শাহান: আমরা সংস্কারের বিষয়টাকে সংস্কার বনাম নির্বাচন—এই বিতর্কে নিয়ে এসেছি। কেউ কিন্তু বলছেন না নির্বাচনটা করার জন্যই সংস্কারটা দরকার। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, গণতন্ত্রের সংজ্ঞাটি আসলে কী? নির্বাচন গণতন্ত্রের জন্য জরুরি। নির্বাচন হওয়া মানে একটা রাষ্ট্র গণতন্ত্রের রাস্তায় উঠল। কিন্তু নির্বাচন একটা রাষ্ট্রকে গণতান্ত্রিক করে না। এরপর আমরা যদি উদার গণতন্ত্রের দিকে যেতে চাই, তাহলে আমাদের প্রতিষ্ঠান তৈরি করতে হবে, নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। সেটা না হলে আমরা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র পাব না।
আমরা কিন্তু শুধু আগামী নির্বাচনটা ঠিকঠাকমতো হোক, সেটা চাইছি না। আমরা চাইছি, প্রতিটা নির্বাচন ঠিকঠাকমতো হোক। তাহলে শুধু তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা নিয়ে আসাটাই কি যথেষ্ট? কারণ, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা ১৯৯৬ সালে আনার পর ২০০১–পরবর্তী সময়কালে আমরা দেখেছি, সংবিধান সংশোধন করে কীভাবে সেটাকে নির্বিষ করা হয়েছে। পরে সংবিধান সংশোধন করে সেটা বাতিলও করা হয়েছে। এগুলো তো বৈধ পন্থাতেই করা হয়েছে।
এখন যদি নির্বাচন করতে চায়, তাহলে পুলিশ ও প্রশাসনের নিরপেক্ষতা নিয়ে আমরা কি নিশ্চিত? পরের নির্বাচনে যাঁরা আসবেন, তাঁরা ক্ষমতার কেন্দ্রীভবন করার চেষ্টা করবেন না, সেটা কি আমরা নিশ্চিত? এই বিষয়গুলো নিশ্চিত না করে নির্বাচন বনাম সংস্কার বিতর্কটা কেন সামনে আনা হচ্ছে। নির্বাচনটা করার জন্যই আমাদের সংস্কারটা দরকার। সংস্কারটা দরকার পুলিশে, সংস্কার দরকার প্রশাসনে, সংস্কার প্রয়োজন এমন একটা ব্যবস্থা তৈরি করার জন্য, যে ব্যবস্থাটি নির্বাচন হয়ে যাওয়ার পরও ক্ষমতার কেন্দ্রীভবনটাকে প্রতিরোধ করতে পারে।
নির্বাচনের জন্য সংস্কার—এই বিতর্কেই সবার মনোযোগ দেওয়া দরকার। কাউকে না কাউকে এই আলাপ দিতে হবে। সেটা ঐকমত্য কমিশন থেকে আসতে পারে। সরকারের দিক থেকে সেটা আসতে পারে। কিন্তু সরকার বলছে, আপনারা চাইলে সংস্কার হবে, না চাইলে হবে না। এটা তো কোনো অবস্থান হতে পারে না। অভিমানী বক্তব্য থেকে দূরে সরে এসে শক্তিশালী বক্তব্যটা দিতে হবে।
যদি এ রকম চলতে থাকে, তাহলে আমরা সর্বোচ্চ ভালো ফেরত যেতে পারব ১৯৯১ সালে। একানব্বই সালের পথপরিক্রমাতেই আমরা ২০২৪ সালে এসেছি। ফলে ২০২৫ সালে আমরা যদি আবার ১৯৯১ সালে ফেরত যাই, তাহলে ২০৩৫–৪০-এ গিয়ে একই ঘটনা ঘটবে না, তার নিশ্চয়তা কী? তাহলে ইতিহাসের যে শিক্ষা, সেটা তো আমরা নিচ্ছি না।
জাতীয় নির্বাচন আগে না স্থানীয় সরকার নির্বাচন—এ নিয়ে পরস্পরবিরোধী অবস্থান দেখছি। আপনি কী মনে করেন, কোন নির্বাচনটা আগে হওয়া দরকার, কেন সেটা?
আসিফ মোহাম্মদ শাহান: ৫ আগস্ট–পরবর্তী সময়ে স্থানীয় সরকারে বিশাল শূন্যতা তৈরি হয়েছে। লোকজন সেবা পাচ্ছেন না। প্রশাসন দিয়ে এই সেবা দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। প্রশাসনে যাঁরা আছেন, তাঁদের তো অন্যান্য দায়িত্ব আছে, এই বাড়তি দায়িত্ব নেওয়া তাঁদের জন্য কঠিন। তাঁরা সেখানকার জনসাধারণকে চেনেন কি না, তাদের কষ্টটা, দুর্ভোগটা বুঝতে পারেন কি না, সেটাও একটা সমস্যা। বাংলাদেশে মানুষজন সেবা নেওয়ার জন্য মেম্বারের কাছে যান। কারণ, মেম্বারকে তিনি চেনেন। মানুষ সেবা নেওয়ার জন্য ইউএনও বা আমলার কাছে যাবেন, সেটা তাঁরা ভাবতে পারেন না। কারণ, তাঁরা ভয় পান, দ্বিধায় থাকেন, যাওয়ার জন্য যে সময়টা লাগবে, সেটা তাঁর আয়ের জন্য ক্ষতির কারণ। সামাজিক সুরক্ষার যে কর্মসূচি, সেটার জন্যও বিশাল একটা জনগোষ্ঠী স্থানীয় সরকারের ওপর নির্ভর করে। সেদিক থেকে মনে হয়, স্থানীয় সরকার নির্বাচনটা আগে হলে ভালো।
নির্বাচন সংস্কার কমিশন দেশজুড়ে একটা জরিপ করে। সেখানে একটা প্রশ্ন ছিল, আপনি স্থানীয় সরকার নির্বাচন আগে চান কি না। সেখানে ৬৫ শতাংশ মানুষ বলেছেন, তাঁরা স্থানীয় সরকার নির্বাচন আগে চান। এখন আমরা যখন রাজনৈতিক দলগুলোকে বলতে শুনি, জনগণ চায় না স্থানীয় সরকার নির্বাচন আগে হোক। এটা কোন জনগণ? কমিশন একটি মেথডোলজি অনুসরণ করে একটা জরিপ করেছে। সেই জরিপের ফলাফল যদি খারিজ করতে হয়, তাহলে তো শক্ত যুক্তি দিতে হবে।
স্থানীয় সরকার নির্বাচন যদি করতে হয়, তাহলে সরকারকে তার কর্মদক্ষতা দেখাতে হবে। যতই প্রতীক বাদ দেওয়া হোক, রাজনৈতিক দলগুলোর তো পছন্দের প্রার্থী থাকবে। তাঁদের মধ্যে যে দ্বন্দ্ব-সংঘাত হবে, সেটা ঠিকঠাকভাবে মোকাবিলা করার সক্ষমতা সরকারের আছে কি না, সেটা তো একটা বড় প্রশ্ন।
ইউনিয়ন বা উপজেলা না হোক, সিটি করপোরেশন পর্যায়ে নির্বাচন তো হতে পারে?
আসিফ মোহাম্মদ শাহান: নির্বাচন কমিশন একটা টেস্ট কেস হিসেবে সিটি করপোরেশন নির্বাচন করতেই পারে। প্রায় সাড়ে ৪ হাজার ইউনিয়ন, ৪৯৫টির মতো উপজেলা আছে। এত বড় পর্যায়ে নির্বাচন করা কঠিন। সিটি করপোরেশন নির্বাচন হলে সরকারের সামনে চ্যালেঞ্জগুলো কী, কোথায় সক্ষমতা বাড়াতে হবে, তার একটা পরীক্ষা হয়ে যেতে পারে।
আমরা অতীতে দেখেছি, যে রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় থাকে, স্থানীয় সরকারও তারা দখল করে নেয়। বিএনপি স্থানীয় সরকার নির্বাচন জাতীয় নির্বাচনের পরে চাওয়ার ক্ষেত্রে এই চিন্তা কি কাজ করছে না?
আসিফ মোহাম্মদ শাহান: সরকার যদি ঠিকঠাকভাবে কাজ করত, তাহলে বিএনপি কি স্থানীয় সরকার নির্বাচন নিয়ে এত শক্ত অবস্থানে থাকতে পারত? বিএনপি কেন স্থানীয় সরকার নির্বাচন পরে চায়? কারণ, তারা চায় স্থানীয় সরকারের ওপর তাদের নিয়ন্ত্রণ থাকুক। অন্যরা কেন আগে চায়, কারণ তারা মনে করছে, বিদ্যমান পরিস্থিতি তাদের সবচেয়ে ভালো ফলাফলটা দিতে পারবে। প্রত্যেকে নিজের স্বার্থের জায়গা থেকে এগোচ্ছে। জনগণের স্বার্থের কথা চিন্তা করে অন্তর্বর্তী সরকার এখানে সিদ্ধান্ত নিতে পারত, কিন্তু সেটা তারা নিচ্ছে না। কারণ, কর্মপরিধি বলি আর সক্ষমতা বলি, সেটা নিয়ে সরকারের সংশয় আছে। সরকারের একটা ভিশন তো থাকতে হবে।
ছাত্রদের নতুন দলের সম্ভাবনাকে কীভাবে দেখছেন?
আসিফ মোহাম্মদ শাহান: ছাত্রদের নতুন রাজনৈতিক দলকে সব অর্থেই আমি ইতিবাচক বলে মনে করছি। আমাদের রাজনৈতিক স্পেকট্রামের দিকে যদি আমরা তাকাই, তাহলে এ মুহূর্তে বিএনপি সবচেয়ে প্রভাবশালী দল। বিএনপি মোটামুটি মধ্যপন্থী রাজনৈতিক দল, যাদের একটু ডান দিকে ঝোঁক আছে। এর ডানে জামায়াতে ইসলামী আছে। আরও ডানে হেফাজতে ইসলাম ও অন্যরা আছে। বাম দিকে কমিউনিস্ট পার্টিগুলো আছে। আমরা একসময় আওয়ামী লীগকে দেখতাম মধ্যপন্থা থেকে একটু বাম দিকে ঝুঁকে থাকা দল হিসেবে। আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত। দলটি আদৌ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারবে কি না, আমরা জানি না। আওয়ামী লীগ নেই, বাম দলগুলোর অবস্থা নড়বড়ে, আবার কিছু সেক্যুলার-লিবারেলদের ভোটও আছে। ফলে বিশাল একটা জায়গা তো ফাঁকা পড়ে আছে।
আগামী নির্বাচনে হয় এই ভয়েসগুলোর কোনো প্রতিনিধিত্ব থাকবে না, অথবা বিএনপি যদি একটু বামে সরে আসে, তাহলে এই ভোটগুলো বিএনপির দিকে যেতে পারে। বিএনপি যদি বামে সরে আসে, তাহলে মাঝখানের যে মধ্যপন্থী জায়গাটা, সেটা ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে। এখানে ছাত্রদের নতুন রাজনৈতিক দলের অবস্থান সৃষ্টি করার সুযোগ আছে। ছাত্রদের সামনে আরেকটি বিকল্প হলো, বাম দিকে ঝুঁকে পড়া মধ্যপন্থী ভোটটা ধরা। তবে তাঁরা সেদিকে যাবেন বলে এখন মনে হচ্ছে না। অভ্যুত্থান–পরবর্তী যে রাজনৈতিক গতিপথ, সেখানে বিকল্প রাজনৈতিক দলের একটা ভালো সম্ভাবনা আছে।
আপনাকে ধন্যবাদ।
আসিফ মোহাম্মদ শাহান: আপনাদেরকেও ধন্যবাদ।