শিক্ষার জন্য কেন মেগা প্রকল্প তৈরি হয় না

ড. মনজুর আহমদ। ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক ও বাংলাদেশ ইসিডি (প্রারম্ভিক শিশুবিকাশ) নেটওয়ার্কের চেয়ারম্যান। প্রথম আলোর সঙ্গে তিনি কথা বলেছেন শিক্ষানীতি বাস্তবায়ন, শিক্ষা আইন, বাজেট বরাদ্দ ও নতুন পাঠক্রম নিয়ে।


সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সোহরাব হাসান

মনজুর আহমদ

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: ২০১০ শিক্ষানীতি বাস্তবায়নের জন্য তৈরি খসড়া আইন কীভাবে দেখছেন?

মনজুর আহমদ: ২০১১ সাল থেকে একটি ‘সমন্বিত শিক্ষা আইন’ তৈরির কাজ চলে আসছে। তখন থেকে অন্তত চারটি খসড়া তৈরি করা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট নাগরিক সমাজের সমালোচনার মুখে এবং মন্ত্রিপরিষদের অনুমোদন না পেয়ে এগুলো পুনর্বিবেচনার জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে ফেরত পাঠানো হয়। পূর্ববর্তী ২০১৬ সালের শেষ খসড়া জনমত যাচাইয়ের জন্য মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়েছিল। সাম্প্রতিক খসড়াটি জনসমক্ষে প্রকাশ করা হয়নি। ২০১০ সালে ঘোষিত নীতিতে বলা হয়েছে, শিক্ষাসংক্রান্ত বিভিন্ন বিধিবিধান নির্দেশাবলি ও প্রচলিত প্রক্রিয়াকে একত্র ও সমন্বিত করে এগুলোকে আইনি সমর্থন দেওয়ার জন্য এক সমন্বিত শিক্ষা আইন প্রয়োজন। শিক্ষানীতি বাস্তবায়নে তা সহায়ক হবে বলে মনে করা হয়। প্রশ্ন দাঁড়ায়—১. সমন্বিত শিক্ষা আইনের অভাবেই কি শিক্ষানীতি বাস্তবায়নের সামগ্রিক কোনো উদ্যোগ নেওয়া যায়নি? ২. কেন ১২ বছরেও আইন তৈরি হলো না? ৩. খসড়া আইনে কী আছে, কী নেই এবং কেন?

শিক্ষার মতো জটিল ও বহুমাত্রিক জনসেবা পরিচালনার জন্য সব দেশেই বিভিন্ন আইন, বিধিবিধান ও প্রশাসনিক নিয়মকানুন বিদ্যমান। এগুলো ছাড়াও শিক্ষাকে নাগরিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে রাষ্ট্রের দায়িত্ব ও কর্তব্য নির্ধারণ করে অনেক দেশে বিশেষ আইন প্রণয়ন করা হয়েছে। যেমন ভারতের ২০০২ সালের ৮৬তম সাংবিধানিক সংশোধনীতে ৬ থেকে ১৪ বছরের শিশুদের মানসম্মত শিক্ষার সুযোগদান রাষ্ট্রের দায়িত্ব বলে স্বীকার করা হয়েছে। এই দায়িত্ব পূরণের উদ্দেশ্যে উপায় নিরূপণের জন্য ২০০৯ সালের শিক্ষা অধিকার আইন গৃহীত হয়।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: শিক্ষা আইনের সবলতা ও দুর্বলতা ব্যাখ্যা করবেন?

মনজুর আহমদ: প্রস্তাবিত শিক্ষা আইনের পরিধি ও উদ্দেশ্য সীমিত। ব্যাপকভাবে স্বীকৃত ও আলোচিত এবং শিক্ষানীতিতে উল্লেখিত শিক্ষার বড় চ্যালেঞ্জগুলোর ব্যাপারে বিশেষ বক্তব্য খসড়া আইনে রাখা হয়নি। অন্তত তিনটি চ্যালেঞ্জের কথা বলা যায়, যা আইনের খসড়ায় অবহেলিত—এক. শিক্ষা অধিকারের স্বীকৃতি ঘোষণা করে এ-সংক্রান্ত দায়িত্ব ও কর্তব্য নির্ধারিত করা। দুই. বিকেন্দ্রায়িত ব্যবস্থাপনা ও জবাবদিহির ধরন, পদ্ধতি ও প্রক্রিয়া প্রতিষ্ঠা করে শিক্ষার সুশাসন ও সুব্যবস্থাপনাকে সমুন্নত রাখা এবং তিন. শিক্ষা অর্থায়নের নীতি ও পর্যাপ্ততার মানদণ্ড স্থির করা, যাতে মানসম্মত, সমতাভিত্তিক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক শিক্ষার লক্ষ্য অর্জিত হয়।

এসব পদক্ষেপের অগ্রগতির তত্ত্বাবধান ও নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য শিক্ষানীতিতে এক বিধিবদ্ধ স্থায়ী শিক্ষা কমিশনের সুপারিশ করা হয়। বিষয়টি খসড়া আইনে যুক্ত হয়নি বলেই শোনা যায়। জরুরি চ্যালেঞ্জসমূহ আইনে যেমন বিবেচিত হয়নি, তেমনি যেসব বিষয় উন্নয়ন, গবেষণা ও পর্যালোচনার ব্যাপার—যেমন শিক্ষাক্রমের প্রকৃতি, শিক্ষকের পেশাগত প্রস্তুতি ও মান উন্নয়ন, শিক্ষার্থী মূল্যায়ন—সেসবের ক্ষেত্রে বর্তমান প্রচলনকে আইনে ঢুকিয়ে ভবিষ্যতের উন্নয়ন ও সংস্কার ব্যাহত করার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। এককথায় সামগ্রিক শিক্ষা আইনের অভাব শিক্ষানীতি বাস্তবায়নের প্রধান অন্তরায় নয় এবং ছিল না। শিক্ষানীতির বহুমাত্রিক লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ও কৌশল যথার্থ অনুধাবন করে এসবের ব্যাপারে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক পর্যায়ে নেতৃত্বের অভাবে শিক্ষানীতি বাস্তবায়নে অগ্রগতি হয়নি। এ কারণে ১২ বছরেও একটি সহায়ক আইনি কাঠামো তৈরি হয়নি এবং আইনে কী থাকবে বা থাকবে না, তা নিয়ে মতৈক্যে পৌঁছানো যায়নি। এ কারণেই শিক্ষার জন্য একটা সামগ্রিক খাত উন্নয়ন পরিকল্পনা তৈরি করা যায়নি। ২০২০ সালে এ ব্যাপারে একটি উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল, তা-ও এখন মুখ থুবড়ে পড়ে আছে।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: নোট বই-গাইড বই নিষিদ্ধ, কিন্তু সরকারের অনুমতি সাপেক্ষে সহায়ক পুস্তক চলবে?

মনজুর আহমদ: খসড়া আইনে বাজারে প্রচলিত নোট বই-গাইড বই নিষিদ্ধ করা এবং প্রাইভেট পড়ানো ও কোচিং সেন্টার নিয়ন্ত্রণের বিষয়গুলো ব্যাপক বিতর্ক সৃষ্টি করে। শোনা যায়, প্রধানত এ কারণেই খসড়া আইনটি মন্ত্রিপরিষদ থেকে একাধিকবার ফেরত পাঠানো হয়। ৩১ জুলাই তারিখে গণসাক্ষরতা অভিযানের পক্ষ থেকে সংবাদ সম্মেলনে এ ব্যাপারে কড়া বিধানের দাবি জানানো হয়। এ ব্যাপারে আলোচনায় মূল রোগের পরিবর্তে উপসর্গগুলোকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে বলা অযৌক্তিক হবে না। শ্রেণিকক্ষে শিক্ষণ শিখনের বেহাল অবস্থা, অতিগুরুত্ব দেওয়া ‘হাই-স্টেক’ ও ধাপে ধাপে নেওয়া প্রতিযোগিতামূলক পাবলিক পরীক্ষার ধরন, বিশেষত এগুলোর মুখস্থনির্ভরতা শিক্ষার্থীদের গাইড বই, নোট বই ও কোচিং সেন্টারের দিকে ঠেলে দেয়।

অপরদিকে স্বল্প পারিতোষিক প্রাপ্ত (বেসরকারি বা এমপিওভুক্ত বিদ্যালয়ের) শিক্ষকদের অনেকে পরিবার পোষণের জন্য প্রাইভেট-কোচিং করেন। অদক্ষ ও নিম্ন মেধার শিক্ষকেরা গাইড বই ও নোট বইয়ে নির্ভরশীল হয়ে পড়েন। কোচিং সেন্টার ও গাইড বই নিষিদ্ধ করে ও শাস্তির বিধান দিয়ে কি মূল সমস্যাগুলোর সমাধান হবে?

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: কোচিং সেন্টার রাখার পক্ষে কি যুক্তি আছে?

মনজুর আহমদ: প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার শুরু থেকেই প্রতিষ্ঠান বা শ্রেণিকক্ষবহির্ভূত পাঠদান চলে এসেছে। সাম্প্রতিক কালে বিদ্যালয় শিক্ষার প্রসার, এগুলোর গুণগত মান নিয়ে অসন্তুষ্টি এবং মধ্যবিত্ত পরিবারে তাদের সন্তানদের জন্য উচ্চাভিলাষ ও প্রতিযোগিতার মনোভাব প্রাইভেট কোচিংয়ের বিস্তারে বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে। বিদ্যালয়ের সমান্তরাল এই ‘ছায়াশিক্ষা’ পুরোপুরি নেতিবাচকভাবে দেখা যায় না। যুক্তরাষ্ট্রে সিলভান লার্নিং সেন্টার অন্তত ৭০ লাখ শিশুকে বিদ্যালয়ের বাইরে পাঠদান করে বলে দাবি করে। জাপানে প্রচলিত কুমন সেন্টার জাপানের সীমা ছাড়িয়ে বিভিন্ন দেশে পৌঁছেছে। বাংলাদেশেও ব্র্যাকের সঙ্গে সহযোগিতায় কুমন সেন্টার চালুর কথা হয়েছে। শিক্ষায় উন্নত দেশে ইউরোপ, আমেরিকা, দক্ষিণ কোরিয়া, সিঙ্গাপুর ও হংকংয়ে বইয়ের দোকানে বিদ্যালয় শিক্ষাস্তরে নানা গাইড বই ও নোট বই পাওয়া যায়। এগুলোকে ক্ষতিকর মনে করা হয় না। বরং শিক্ষার্থীদের জন্য সহায়কই মনে করা হয়। কারণ, এগুলো শ্রেণিকক্ষের পাঠদান ও শিক্ষকের কাজের বিকল্প হিসেবে দেখা হয় না। এসব দেশে শিক্ষার্থী মূল্যায়ন পরীক্ষা শুধু মুখস্থবিদ্যাকে পুরস্কৃত করে না।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: সহায়ক পুস্তক অনুমোদন কি উৎকোচ-দুর্নীতির সুযোগ বাড়াবে না? শিক্ষামন্ত্রী চান কোচিংকে শৃঙ্খলার মধ্যে আনতে হবে। কোচিংয়ের অনৈতিকতা বন্ধ করতে হবে। কীভাবে?

মনজুর আহমদ: আইনে যা-ই থাকুক, তার যথার্থ প্রয়োগের বাস্তবতা ও ফলপ্রাপ্তির সম্ভাবনা বিবেচনা করতে হবে। আমাদের দেশে অনেক আইন আছে, যেগুলো প্রয়োগ করা যায় না বা প্রয়োগের চেষ্টায় সুফল পাওয়া যায় না। খসড়া আইন অনুযায়ী গাইড ও নোট বই (অথবা যে নামেই পরিচিত হোক, যেমন খসড়ায় বলা হয়েছে) তৈরি, মুদ্রণ, বাঁধাই ও বিতরণ করা যাবে না। কিন্তু জাতীয় কারিকুলাম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের অনুমোদন নিয়ে পরিপূরক ও ডিজিটাল শিক্ষাসামগ্রী তৈরি ও বিতরণ করা যাবে। অভিজ্ঞতার আলোকে নিঃসন্দেহে বলা যায়, এই বিধান দুর্নীতি ও আমলাতান্ত্রিক অসদাচরণের সুযোগ সৃষ্টি করবে। এ ক্ষেত্রে কারিকুলাম বোর্ডের এই নতুন দায়িত্ব গ্রহণের দক্ষতা ও যোগ্যতার প্রশ্ন আছে। তা ছাড়া বিষয়টি সংবিধানের ৩৯ ধারায় বাক্‌স্বাধীনতা ও ভাবপ্রকাশের স্বাধীনতার সঙ্গে সাংঘর্ষিক কি না, তা-ও প্রণিধানযোগ্য। নোট বই ও গাইড বই শিক্ষার্থীদের দিয়ে বাধ্যতামূলকভাবে ক্রয় করানো দণ্ডনীয় অপরাধ হওয়া উচিত। কিন্তু এগুলোর প্রকাশ নিষিদ্ধ করা কি সংবিধানসিদ্ধ? প্রাইভেট-কোচিংয়ের ক্ষেত্রে নিজের বিদ্যালয়ে শিক্ষকেরা প্রাইভেট পড়াতে পারবেন না। কিন্তু অন্য বিদ্যালয়ের ছাত্রদের জন্য তা জায়েজ থাকবে। বিদ্যালয় থেকে আয়োজিত শ্রেণিকক্ষবহির্ভূত পাঠদান করা যাবে এবং এ জন্য অতিরিক্ত ফির ব্যবস্থাও থাকতে পারে। এসব নমনীয়তা মেনে নেওয়া থেকে বোঝা যাচ্ছে, জটিল সমস্যার সহজ সমাধান নেই। কিন্তু কঠিন সমস্যার সবল সমাধানের প্রত্যাশীরা তাতে সন্তুষ্ট নন। তাঁদের সদিচ্ছা নিয়ে প্রশ্ন না তুলে বলা যায় যে মূল সমস্যাগুলো সমাধানে সবার আরও সোচ্চার ও দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হওয়া দরকার। বিদ্যালয়ে শিক্ষার পরিবেশ ও আবহ সৃষ্টি এবং শিক্ষকের মান, যোগ্যতা, দক্ষতা, নিষ্ঠা ও মর্যাদা বৃদ্ধি ও তাঁদের সাফল্যের মানদণ্ড নির্ধারণ ও স্বীকৃতির ব্যবস্থা করা প্রয়োজন।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: নতুন শিক্ষাক্রমে দশম শ্রেণি পর্যন্ত এক ধারা—তাতে কি বিজ্ঞানশিক্ষা ক্ষতিগ্রস্ত হবে?

মনজুর আহমদ: নবম শ্রেণি থেকে শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ শিক্ষা ও পেশার ক্ষেত্র নির্ধারণ করে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ব্যাপারটি ষাটের দশকে আইয়ুব শাহির সময় শুরু হয়। দশম শ্রেণি পর্যন্ত এক ধারা মানে বিজ্ঞানকে বাদ দেওয়া নয়, বরং সব শিক্ষার্থী ভাষা, গণিত ও বিজ্ঞানের মৌলিক দক্ষতা অর্জন করবে, তা-ই উদ্দেশ্য। একাদশ শ্রেণি থেকে শিক্ষার্থীরা বিশেষায়িত শিক্ষা সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নিতে অধিকতর সক্ষম হবে বলে ধরে নেওয়া হচ্ছে। এই রীতি এবং কড়াকড়ি বিভাজনকে নমনীয়ভাবে দেখা অনেক দেশেই প্রচলিত। কিন্তু এই উদ্দেশ্য সফল করতে হলে দশম শ্রেণি পর্যন্ত সব বিদ্যালয়ের শিক্ষার মান উন্নত করতে হবে। শিক্ষকের যোগ্যতা ও দক্ষতা বাড়াতে হবে। মূল বিষয়গুলো অর্থাৎ গণিত, বিজ্ঞান ও ভাষাশিক্ষার জন্য যথেষ্ট সংখ্যক শিক্ষক সব বিদ্যালয়ে থাকতে হবে।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: শিক্ষার স্তর নিয়েও বিতর্ক আছে। শিক্ষানীতিতে তিন স্তরের কথা বলা হলেও সেটা মানা হয়নি। এখন চার স্তরই বহাল আছে?

মনজুর আহমদ: ঐতিহাসিকভাবে প্রাথমিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক, মাধ্যমিক বিদ্যালয় শিক্ষা (সাধারণত দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত) উচ্চতর শিক্ষা বা কর্মজীবনের প্রস্তুতিপর্ব এবং সীমিতভাবে উচ্চতর শিক্ষার সুযোগ চলে আসছিল। এই উপমহাদেশে দশম শ্রেণিতে মাধ্যমিকের সমাপ্তি নির্ধারিত ছিল এবং উচ্চশিক্ষার প্রস্তুতি হিসেবে দুই বছরের অন্তর্বর্তী শিক্ষার ব্যবস্থা ছিল। কলেজ অর্থাৎ উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এই দুই বছরের পাঠদান করা হতো। আন্তর্জাতিক প্রচলনের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণিকে মাধ্যমিকে অন্তর্ভুক্ত করার সিদ্ধান্ত হয় ষাটের দশকে। কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিকভাবে এগুলো কলেজের অন্তর্ভুক্ত থেকে যায় অধিকাংশ ক্ষেত্রে।

এসব শিক্ষার প্রাতিষ্ঠানিক বা প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনার বিষয়। ২০১০-এর শিক্ষানীতিতে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা ও চার বছরের মাধ্যমিক শিক্ষার সুপারিশ করা হয়। কিন্তু শিক্ষানীতির অন্যান্য সুপারিশের মতোই এটিও বাস্তবায়ন করার যথেষ্ট উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। ইতিমধ্যে টেকসই উন্নয়ন ২০৩০-এর আওতায় দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত মানসম্মত শিক্ষাকে সর্বজনীন করার লক্ষ্য একুশ শতকের জন্য প্রয়োজনীয় বলে স্বীকৃত হয়েছে। বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতে তাই প্রাক্‌-প্রাথমিক থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত প্রাক্‌-উচ্চশিক্ষা স্তরকে সামগ্রিকভাবে দেখা জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিদ্যালয় শিক্ষাকে দুই ভিন্ন মন্ত্রণালয়ের অধীনে রাখা বিদ্যালয় শিক্ষার ধারাবাহিকতা বজায় রেখে সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রয়োগ ব্যাহত হচ্ছে।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: শিক্ষানীতির উদ্দেশ্য ছিল মান উন্নয়ন—তা ঘটেছে? মান নিয়ে সবাই উদ্বিগ্ন কিন্তু কেন কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে না?

মনজুর আহমদ: শিক্ষার মানের সংজ্ঞা বহুমাত্রিক—ব্যক্তির দক্ষতা, যোগ্যতা, প্রাপ্তি ও মূল্যবোধের সঙ্গে সামষ্টিকভাবে সমাজের কল্যাণ, উন্নয়ন, সংহতি, দেশপ্রেম ও ন্যায়বোধ প্রতিষ্ঠায় শিক্ষার অবদান মানের ধারণার অন্তর্ভুক্ত হতে হবে। এভাবেই শিক্ষানীতিতে শিক্ষার উদ্দেশ্য বর্ণিত হয়েছে। ব্যক্তির দক্ষতা ও যোগ্যতার সঙ্গে বৈষম্য নিরসন ও কাউকে পেছনে না রেখে অন্তর্ভুক্তিমূলক শিক্ষাব্যবস্থা গঠনের কথা বলা হয়েছে শিক্ষানীতিতে। কিন্তু রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক নেতৃত্বের পর্যায়ে সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে দৃঢ় পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। সামগ্রিক খাতভিত্তিক উন্নয়ন পরিকল্পনার ব্যাপারে বর্তমান সাংগঠনিক ও প্রশাসনিক কাঠামোতে সুবিধাভোগীরা আগ্রহী নন। শিক্ষার দুরবস্থায় তাঁদের সন্তানেরা ক্ষতিগ্রস্ত হয় না। কারণ, তাদের জন্য আছে ভিন্ন ব্যবস্থা। শিক্ষার জন্য কেন মেগা প্রজেক্ট বা মহা প্রকল্প তৈরি হয় না? আমার সহযোগী (জন রিচার্ডস ও শহিদুল ইসলাম) এবং আমি টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয় প্রেস থেকে সম্প্রতি প্রকাশিত পুস্তক পলিটিক্যাল ইকোনমি অব এডুকেশন ইন সাউথ এশিয়ায় দক্ষিণ এশিয়ার শিক্ষাসংকটের পর্যালোচনায় দেখিয়েছি—রাজনৈতিক সমঝোতার ভিত্তিতে যা গ্রহণযোগ্য তা-ই বাস্তবায়িত হয়। দেশের আর্থরাজনৈতিক সমঝোতার (পলিটিক্যাল ইকোনমি সেটেলমেন্ট) মাধ্যমে মান ও সমতার লক্ষ্য ও কৌশল গ্রহণযোগ্য করে তুলতে হবে। সব অভিভাবক, শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও সচেতন নাগরিক সমাজ সম্মিলিতভাবে লক্ষ্য ও কৌশলের অগ্রাধিকারের বিষয়ে ঐক্যবদ্ধ হতে পারলে শিক্ষাবান্ধব আর্থরাজনৈতিক সমঝোতা সম্ভব হতে পারে।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: মানের জন্য দক্ষ শিক্ষক চাই। এ জন্য কী করা হচ্ছে?

মনজুর আহমদ: মেধাবী ও আদর্শবান তরুণেরা শিক্ষকতাকে আকর্ষণীয় পেশা হিসেবে দেখে না। চাকরি খোঁজার ক্ষেত্রে বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা অধিকাংশ সময় শেষ বিকল্প। বর্তমানে শিক্ষকদের দক্ষতা ও যোগ্যতা বাড়ানোর জন্য যা কিছু করা হচ্ছে, তা প্রচলিত কাঠামোর মধ্যে। এর থেকে যথেষ্ট ফল পাওয়া সম্ভব নয়। শিক্ষক নির্বাচন, প্রশিক্ষণ, পেশাগত মান উন্নয়ন, কৃতিত্বের মাপকাঠি, প্রণোদনা, সামাজিক মর্যাদা ইত্যাদি বিষয়ে নতুন চিন্তাভাবনা দরকার, যাতে সবচেয়ে মেধাবী, সৃজনশীল ও আদর্শবান তরুণদের শিক্ষকতা পেশায় আকৃষ্ট করে ধরে রাখা যায়। এ জন্য অন্যান্য পদক্ষেপের মধ্যে একটি হবে উচ্চমাধ্যমিকের পর চার বছরের কলেজ ডিগ্রি কোর্সে সাধারণ কলেজ ডিগ্রির সঙ্গে শিক্ষাসংক্রান্ত সনদ প্রদানের ব্যবস্থা। দক্ষিণ এশিয়া ছাড়া পৃথিবীর বিভিন্ন উন্নয়নশীল ও উন্নত দেশে এই পদ্ধতি প্রচলিত। কাজটি সহজসাধ্য নয়। সঠিক ফল পেতে হলে এ জন্য দশসালা প্রকল্প গ্রহণ করতে হবে।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: শিক্ষায় বরাদ্দ সর্বনিম্ন—উচ্চশিক্ষায় সরকারের অধিকতর মনোযোগ লক্ষ করা যাচ্ছে। অন্যদিকে প্রাথমিক শিক্ষা অবহেলিত।

মনজুর আহমদ: শিক্ষায় সরকারি বরাদ্দ পৃথিবীর সব দেশের মধ্যে বাংলাদেশ জাতীয় উৎপাদনের (জিডিপি) ২ শতাংশের কাছাকাছি থেকে সর্বনিম্ন স্তরে। প্রতিবছর বাজেট তৈরির সময় এ বিষয় নিয়ে দাবি-বিতর্ক অরণ্যে রোদনে পরিণত হয়েছে। এখানে বলা দরকার, বরাদ্দ বাড়ানোই সমাধান নয়। লক্ষ্য ও কৌশল নিয়ে যেসব কথা বলা হলো, সেসব ক্ষেত্রে পরিবর্তন হতে হবে এবং বরাদ্দ অর্থ সঠিক ব্যবহারের জন্য সুশাসন ও সুব্যবস্থাপনায় কার্যকারিতা বৃদ্ধি পেতে হবে। বর্তমান লক্ষ্য, কৌশল ও সাংগঠনিক বিন্যাসে অতিরিক্ত বরাদ্দ কাজে লাগানো সম্ভব হবে না। অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে সংগতভাবেই এই যুক্তি দেওয়া হয়। এর জবাব দেওয়ার দায়িত্ব দুই শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষের এবং রাজনৈতিক নেতৃত্বে যাঁরা আছেন, তাঁদের।

প্রথম আলো: আপনাকে ধন্যবাদ।

মনজুর আহমদ: আপনাকেও ধন্যবাদ।