ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার স্বৈরাচারী শাসনের পতনের কিছুদিন পর আপনারা জাতীয় নাগরিক কমিটি নামে একটি প্ল্যাটফর্ম গঠন করেছেন। এটাকে নতুন একটি রাজনৈতিক দল গঠনের প্রক্রিয়া হিসেবেই সবাই দেখছে। সেই নতুন রাজনৈতিক দল গঠন এখন কোন পর্যায়ে আছে?
আখতার হোসেন: জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানে সব শ্রেণি-পেশার মানুষ অংশ নিয়েছিলেন। সেই সময়েই আমরা বাংলাদেশে একটি নতুন রাজনৈতিক শক্তির উত্থানের আভাস পেয়েছিলাম। তারই পরিপ্রেক্ষিতে আমরা গত ৮ সেপ্টেম্বর জাতীয় নাগরিক কমিটির যাত্রা শুরু করি। জাতীয় নাগরিক কমিটি একটা রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম এবং ‘প্রেশার গ্রুপ’ হিসেবে কাজ করছে, রাজনীতির নতুন ভাষা নির্মাণ করার চেষ্টা করছে। এরই ধারাবাহিকতায় জাতীয় নাগরিক কমিটি ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বাইরেও আরও অনেককে নিয়ে আমরা রাজনৈতিক দল গঠনের দিকে অগ্রসর হচ্ছি। আশা করি, আগামী ফেব্রুয়ারির মধ্যে আমরা নতুন দলের ঘোষণা দিতে পারব।
জাতীয় নাগরিক কমিটিতে সাবেক ডান-বাম-মধ্যপন্থী বিভিন্ন ধরনের লোকজনের একটা সংমিশ্রণ দেখা যাচ্ছে। এর ফলে আপনাদের নতুন রাজনৈতিক দলের আদর্শ কী হবে, সেটা নিয়ে অনেকের মধ্যে আগ্রহ ও প্রশ্ন আছে।
আখতার হোসেন: জাতীয় নাগরিক কমিটিতে এমন ব্যক্তিরা আছেন, যাঁদের কেউ ডানপন্থী, কেউ বামপন্থী রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। আবার এমন ব্যক্তিরাও আছেন, যাঁরা মধ্যপন্থী রাজনীতি করতেন। আমাদের লক্ষ্য একটি মধ্যপন্থী এবং বাংলাদেশপন্থী রাজনীতি নির্মাণ করা। ধর্মনিরপেক্ষতার নামে বাংলাদেশে ইসলামবিদ্বেষের যে চর্চা হয়েছে, তার বাইরে আমরা আসতে চাই। একই সঙ্গে ইসলাম বা অন্য কোনো ধর্মের নামে উগ্রবাদী রাজনীতিকেও সমর্থন করি না। মোটাদাগে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের আকাঙ্ক্ষাগুলোকে বিবেচনায় নিয়ে এবং একটি মধ্যমপন্থী আদর্শ ধারণ করে আমরা রাজনীতি করতে চাই।
বাংলাদেশের পটভূমিতে নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করা বেশ কঠিন ব্যাপার। কিন্তু আপনারা প্রায় প্রতিদিনই কোথাও কোথাও জাতীয় নাগরিক কমিটি বা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নতুন কমিটি গঠন করছেন। টাকাপয়সা জোগাড় করা থেকে শুরু করে সংগঠন গোছানো—এগুলো এত অল্প সময়ের মধ্যে কীভাবে হচ্ছে? আপনারা কি সরকারের পক্ষ থেকে কোনো আনুকূল্য বা সহায়তা পাচ্ছেন?
আখতার হোসেন: জুলাই-আগস্টের আগপর্যন্ত বাংলাদেশে স্বাভাবিক রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড করা সম্ভব ছিল না। এখন দেশে একটি মুক্ত পরিবেশ বিরাজ করছে। এর ফলে আমরা আমাদের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের পরিধি বিস্তৃত করার সুযোগ পাচ্ছি। এ সুযোগ শুধু জাতীয় নাগরিক কমিটি নয়, ফ্যাসিবাদবিরোধী যত সংগঠন আছে, তারাও পাচ্ছে। সরকারের পক্ষ থেকে এখন কোনো রাজনৈতিক পক্ষকে কোণঠাসা বা নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে না। এর ফলে আমাদের সংগঠন দ্রুত বিস্তার লাভ করছে। আর অর্থ বা টাকাপয়সা জোগাড় হচ্ছে সদস্য ও শুভাকাঙ্ক্ষীদের দেওয়া চাঁদা থেকে।
বিএনপির কোনো কোনো নেতা এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা আপনাদের ‘কিংস পার্টি’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। এমনকি গোয়েন্দা সংস্থার লোকেরা আপনাদের দল গঠনের সঙ্গে যুক্ত, এমন অভিযোগও উঠেছে। এ অভিযোগগুলো নিয়ে আপনার মতামত কী?
আখতার হোসেন: বাংলাদেশে এখন রাজনৈতিক শূন্যতা বিরাজ করছে। একই সঙ্গে দেশের মানুষ একটি নতুন রাজনৈতিক শক্তিরও প্রত্যাশা করছেন, যার নেতৃত্বে থাকবেন তরুণেরা। এ রকম অবস্থায় আমরা একটি নতুন রাজনৈতিক উদ্যোগ নিয়েছি। ‘কিংস পার্টি’ বলা হলেও এ রকম পার্টির কোনো আলামত বা বৈশিষ্ট্য আমাদের মধ্যে নেই। একইভাবে গোয়েন্দা সংস্থার সংশ্লিষ্টতার যে অভিযোগ উঠেছে, সেটারও কোনো ভিত্তি নেই। কারণ, এ রকম কোনো দলকে এখন আর দেশের মানুষ মেনে নেবেন না। মানুষের স্বতঃস্ফূর্ততার ভিত্তিতেই আমাদের উদ্যোগ পরিচালিত হচ্ছে।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে হত্যা, সন্ত্রাসসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিচার চলছে। আপনাদের মধ্য থেকে কেউ কেউ দাবি করেছেন, বিচার শেষ হওয়ার আগে নির্বাচন দেওয়া যাবে না। বিচার যদি তিন, চার, পাঁচ বছর ধরে চলে, তাহলে কি সেই সময় পর্যন্ত নির্বাচন স্থগিত থাকবে?
আখতার হোসেন: জুলাই-আগস্টে যাঁরা হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ছিলেন, তাঁদের প্রত্যেকের বিচার হোক—এটা দেশের মানুষের চাওয়া। এ ছাড়া ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪-এর ভুয়া নির্বাচনগুলোর সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের বিচার হওয়া উচিত। একই সঙ্গে যাঁরা দুর্নীতি, লুটপাট, টাকা পাচারের সঙ্গে জড়িতদের বিচার করতে হবে। কিন্তু এসব বিষয়ে উল্লেখযোগ্য কোনো অগ্রগতি হয়নি। নির্বাচনের আগে সব মামলার রায় না হোক, বিচারপ্রক্রিয়ার একটা উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হবে—সেটাই আমাদের প্রত্যাশা।
আগামী নির্বাচন নিয়ে আপনাদের পরিকল্পনা কী? আপনারা কি জাতীয় নির্বাচনের আগে গণপরিষদ নির্বাচন চাইছেন? কেন এটা চাইছেন?
আখতার হোসেন: বাংলাদেশের মানুষ একটি নতুন সংবিধান প্রত্যাশা করে। কারণ, বাহাত্তরের সংবিধান একাত্তর এবং চব্বিশের আকাঙ্ক্ষাকে ধারণ করতে পারছে না। নতুন সংবিধানের যে আকাঙ্ক্ষা, সেটাকে প্রায়োগিক করতে হলে একটি কনস্টিটিউট অ্যাসেম্বলি বা ‘গণপরিষদ’ প্রয়োজন। এই গণপরিষদের নির্বাচিত সদস্যরা নতুন সংবিধান প্রণয়ন করবেন। একই সঙ্গে তাঁরা আইনসভা বা পার্লামেন্ট সদস্য হিসেবে কাজ করবেন। যাঁরা নির্বাচন চাইছেন, তাঁরা শুধু পার্লামেন্ট নির্বাচনের কথা বলছেন। আমরা একই সঙ্গে দুটি নির্বাচনের (গণপরিষদ ও পার্লামেন্ট) কথা বলছি। নতুন সংবিধান প্রণয়নের বৈধ ম্যান্ডেটের প্রশ্নটি মীমাংসার জন্য নির্বাচন নিয়ে আমাদের এ রকম অবস্থান।
গত ৩১ ডিসেম্বর আপনাদের জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্র দেওয়ার কথা ছিল। পরে সরকারের তরফ থেকে বলা হলো, তারাই এই ঘোষণাপত্র তৈরি করবে। এ ব্যাপারে অগ্রগতি কতটুকু?
আখতার হোসেন: গত ৩১ ডিসেম্বর জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্র পাঠের কথা ছিল। তার আগের রাতে সরকারের তরফ থেকে জানানা হয়েছিল যে সব রাজনৈতিক পক্ষের ঐকমত্যের ভিত্তিতে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র তৈরি করবে। কিন্তু এখন পর্যন্ত সরকারের তরফ থেকে কোনো দৃশ্যমান উদ্যোগ দেখছি না। আশা করি, সরকারের তরফ থেকে এ বিষয়ে দৃশ্যমান তৎপরতা স্পষ্ট হবে এবং অতি দ্রুত ঘোষণাপত্র জারি করা হবে।
আপনারা নতুন সংবিধান চাইছেন। রাজনৈতিক ঐকমত্য ছাড়া সংবিধান পরিবর্তনের দাবি সফল হবে বলে মনে করেন?
আখতার হোসেন: আমরা নতুনভাবে সংবিধান প্রণয়নের পক্ষে। এ জন্য গণপরিষদ নির্বাচনের দাবি জানাচ্ছি এবং জনগণের পক্ষ থেকে ইতিবাচক সাড়া পাচ্ছি। বিএনপি সব সময় সরকার পরিবর্তনের রাজনীতি করেছে, আর আমরা ব্যবস্থা পরিবর্তনের রাজনীতি করছি। এরপরও এ বিষয়ে অন্য সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে ঐকমত্যে পৌঁছানো সম্ভব হবে বলে মনে করি।
গত ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নিয়েছিল। এরই মধ্যে পাঁচ মাস পেরিয়ে গেছে। সরকারের এই পাঁচ মাসকে কীভাবে মূল্যায়ন করবেন।
আখতার হোসেন: সরকার খুব ঢিমেতালে চলছে, খুবই ধীরগতিতে এগোচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির তেমন কোনো উন্নতি হয়নি। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির জন্য জনগণের নাভিশ্বাস উঠছে। স্বৈরাচারের অনেক দোসরকে এখনো বিচারের মুখোমুখি করা সম্ভব হয়নি। অন্যদিকে অন্তর্বর্তী সরকার ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে নতজানু পররাষ্ট্রনীতি থেকে সরে এসে একটা আত্মমর্যাদাপূর্ণ অবস্থান নিয়েছে। এ ছাড়া মানুষের বিভিন্ন দাবিদ শোনার ক্ষেত্রে আন্তরিকভাবে সাড়া দিচ্ছে। এগুলোকে ইতিবাচক পরিবর্তন হিসেবে দেখতে চাই।
প্রথম আলো: আপনাকে ধন্যবাদ।
আখতার হোসেন: আপনাকেও ধন্যবাদ।