অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মেয়াদ প্রায় আট মাস হতে চলল। কিন্তু এখনো রাজনৈতিক পরিস্থিতি ঠিক স্বস্তিদায়ক বলে মনে হচ্ছে না। রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে এই অস্বস্তি কেন?
হোসেন জিল্লুর রহমান: রাজনৈতিক পরিস্থিতির মূল্যায়ন করতে হলে কয়েকটি দিক বিবেচনায় রাখতে হবে। সামষ্টিক অর্থনীতির বেশ কিছু সূচকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার স্থিতিশীলতা আনতে সক্ষম হয়েছে, যদিও বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান-খরা চলছেই। রমজান মাসটাও তুলনামূলকভাবে স্বস্তিতে কেটেছে।
কিন্তু রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার প্রশ্নটি ভিন্ন। এখানে নিয়ামক একটি বিষয় হচ্ছে সংস্কার ও নির্বাচন নিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের রোডম্যাপ। সেই রোডম্যাপ আছে কি না এবং থাকলে সেটা নিয়ে সবার একটি স্বচ্ছ ধারণা ও আস্থা আছে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। সরকারের নিয়তটাই-বা কী এবং তা দৃশ্যমান ও সুস্পষ্টভাবে প্রতিভাত হচ্ছে কি না, এটিও একটি বিবেচ্য বিষয়।
রোডম্যাপ নিয়ে দু-তিনটি ইস্যু আছে। একটি হচ্ছে নির্বাচনের সম্ভাব্য তারিখ। আরেকটি ইস্যু হলো অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মধ্যে যে বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে এবং রাজনৈতিক অঙ্গনে যে বিভিন্ন গোষ্ঠী রয়েছে, তাদের আসলে আকাঙ্ক্ষাটা কী? নির্বাচন নিয়ে নানা ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি দেখা যাচ্ছে—কেউ (নির্বাচন) আগে চায়, কেউ দেরিতে চায়। কারও কারও ধারণা, কোনো একটি নির্দিষ্ট গ্রুপের প্রয়োজনে নির্বাচনের তারিখ পেছানোর কথাবার্তা উঠছে। এসব বিবিধ কারণে একধরনের অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। অনিশ্চয়তা তৈরি হওয়ার মূল কারণ খুবই স্বচ্ছ ও জোরালো একটি রোডম্যাপ না থাকা। ফলে বেশ কিছু বিতর্ক তৈরি হয়েছে।
এ রকম একটি বিতর্ক হচ্ছে সংস্কার বনাম নির্বাচন। আরেকটি বিতর্ক হচ্ছে স্থানীয় সরকার নির্বাচন আগে, নাকি জাতীয় নির্বাচন আগে। রোডম্যাপ শুধু একটি টেকনিক্যাল বিষয় নয়, এটি রাজনৈতিক বিষয়ও বটে। তাই সরকারের তরফ থেকে একতরফা একটি রোডম্যাপ চাপিয়ে দেওয়াও কাজের কাজ হবে না।
রোডম্যাপের জন্য কি রাজনৈতিক ঐকমত্যের প্রয়োজন হবে না?
হোসেন জিল্লুর রহমান: ইদানীং ঐকমত্য শব্দটা বেশ চালু হয়েছে। কিন্তু ঐকমত্যের প্রয়োজনীয় জায়গা বা বিষয়গুলো সেই অর্থে স্পষ্ট হয়নি। ঐক্য তৈরির প্রচেষ্টার মধ্যেও নানামুখী ঘাটতি দেখতে পাচ্ছি। ঐকমত্য তৈরির কাজটাকে একটি চলমান রাজনৈতিক প্রচেষ্টা হিসেবেও দেখা দরকার। কারণ, এখানে বিভিন্ন রাজনৈতিক গোষ্ঠী ও মহল আছে। নতুন প্রতিযোগীও আবির্ভূত হয়েছে। সবার আকাঙ্ক্ষাকে স্বচ্ছ বোঝাপড়ার মাধ্যমে একটি জায়গায় নিয়ে আসা প্রয়োজন।
এ ক্ষেত্রে আমার অবজারভেশন হলো ঐকমত্য তৈরির বিষয়টিকে খুবই আমলাতান্ত্রিকভাবে দেখা হচ্ছে। ঐকমত্য তৈরি আমলাতান্ত্রিক নয়, একটি রাজনৈতিক বিষয়। এ ক্ষেত্রে আস্থা তৈরি করার বিষয় আছে। রাজনৈতিকভাবে ঐকমত্য তৈরির কথা যদি বলি, এটা ধরে নিতে হবে রাজনীতির মাঠে বিভিন্ন ধরনের প্রতিযোগী আছে, তাদের নানা ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি ও চাহিদা আছে, কিন্তু এগুলোর চেয়েও বৃহত্তর একটি বিষয় রয়েছে। সেটি হলো দেশটাকে মানে দেশের স্বার্থ-উন্নয়ন-অগ্রগতিকে সবকিছুর ঊর্ধ্বে রাখা।
এই যে গত ১৫-১৬ বছর আমরা গণতন্ত্রের ভয়াবহ পশ্চাদপসরণ দেখেছি, স্বৈরাচারী শাসনকাঠামোর চূড়ান্ত প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ দেখেছি, আমরা সেখান থেকে উত্তরণের একটি সুযোগ পেয়েছি। এখন আবার খুবই পরিবর্তনশীল একটি ভূরাজনৈতিক পরিপ্রেক্ষিত দেখা যাচ্ছে। এ রকম অবস্থায় আমাদের কিছু মৌলিক বিষয়ে ঐকমত্য লাগবেই। যতই প্রতিযোগিতা থাকুক, নিজস্ব চাহিদা ও দৃষ্টিভঙ্গি থাকুক—এগুলোর ঊর্ধ্বে সবাইকে এক জায়গায় আনার একটি বিষয় আছে, বাংলাদেশের বৃহত্তর যে স্বার্থ, সেগুলোর সঙ্গে সম্পৃক্ত করার প্রয়োজন আছে।
রাজনৈতিক ঐকমত্য তৈরি করতে না পারলে আমরা কি নতুন কোনো সংকটে পড়ব?
হোসেন জিল্লুর রহমান: বাংলাদেশ সব সময় সংকটে থাকে। আজকে যদি প্রাকৃতিক সংকট, কালকে রাজনৈতিক সংকট, আরেক দিন আরেকটা কিছু সংকট! সংকট নিয়ে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। কিন্তু অযৌক্তিক সংকট কেন তৈরি হবে?
ধরেন, দুটি জোরালো মত রয়েছে, দুই পক্ষেরই কিছু যুক্তি আছে। এটাকে সংকট হিসেবে দেখলে তো হবে না, এখানে চ্যালেঞ্জ হচ্ছে ভিন্ন ভিন্ন মতকে কীভাবে একত্র করা যায়; একটি রাজনৈতিক বোঝাপড়ার মাধ্যমে কীভাবে ঐকমত্য তৈরি করা যায়।
এখানে সুস্পষ্ট কিছু ঘাটতি দেখতে পাচ্ছি। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের যে ওয়ার্কিং স্টাইল বা কার্যপদ্ধতি, সেটার মধ্যেই এই সংকটগুলো তৈরির একটা কারণ হয়েছে। এই যে এমসিকিউ পরীক্ষার পদ্ধতিতে ঐকমত্যের জায়গা চিহ্নিত করার উদ্যোগ তা অভিনব বটে, তবে তা ডেস্কমুখী বিশেষজ্ঞ ও আমলাতান্ত্রিক চিন্তাপ্রসূত বলে ধারণা করা যায়।
কয়েক মাস ধরেই সংস্কার নিয়ে অনেক কথাবার্তা শোনা গেছে। সংস্কার নিয়ে আপনার পর্যবেক্ষণ কী?
হোসেন জিল্লুর রহমান: সংস্কার বর্তমান সময়ে খুব চালু একটি শব্দ, কিন্তু সংস্কার বিষয়টি আসলে কী? প্রথম থেকেই একটি ধারণা তৈরি হয়েছে, যাতে মনে হতে পারে সংস্কার মানে হচ্ছে সবকিছু ওলট-পালট করে ফেলা এবং বড় ধরনের কাঠামোগত পরিবর্তন নিয়ে আসা। আমাদের দেখা দরকার সংস্কারের প্রয়োজনীয়তাগুলো আসলে কোথায়। আমি মনে করি, তিনটি দৃষ্টিকোণ থেকে এই প্রয়োজনীয়তাগুলো দেখা জরুরি।
প্রথমত, আমাদের রাষ্ট্রযন্ত্রের কার্যকারিতা বাড়ানো। আমাদের বিস্তৃত রাষ্ট্রযন্ত্র রয়েছে, কিন্তু সেখানে কাঙ্ক্ষিত সেবা ও তা ডায়নামিকভাবে পরিচালনার ক্ষেত্রে ব্যাপক ঘাটতি রয়েছে। কাগুজে নীতির আধিক্য রয়েছে, কিন্তু বাস্তবায়নের অক্ষমতার বৃত্তে আটকে থাকার বাস্তবতা রয়েছে। স্বাস্থ্য বিভাগ বলেন, শিক্ষা বিভাগ বলেন, ওয়ান-স্টপ সার্ভিসের কথা বলেন বা অন্য বহু বিভাগের কথা বলেন, সংস্কারের অন্যতম লক্ষ্য হওয়া উচিত এসব ক্ষেত্রে রাষ্ট্রযন্ত্রের কার্যকারিতা ও সেবার মানসিকতায় আমূল পরিবর্তন আনা।
এখানে সবচেয়ে বড় বাধা হচ্ছে গেড়ে বসা প্রশাসনিক সংস্কৃতির, যেখানে মেধা, দক্ষতা ও সেবাধর্মী মানসিকতার পরিবর্তে বিভিন্ন গোষ্ঠীচিন্তা ও দাপটের রাজত্ব লক্ষণীয়। প্রশাসন ক্যাডারের আলোচিত বিষয়টি এখানে উল্লেখ্য, যেমন উল্লেখ্য স্থানীয় সরকারগুলোকে ক্ষমতাহীন করে রাখার মানসিকতা। এখানে আরও উল্লেখ্য বিভিন্ন সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গির বিভিন্ন দলীয় পেশাজীবীর বিভাগীয় কর্মকাণ্ডে অযৌক্তিক দাপট।
দ্বিতীয়ত, যে ক্ষেত্রে সংস্কার জরুরি, তা হলো ক্ষমতাকাঠামো ও ক্ষমতাবিন্যাসের সংস্কার। স্বৈরাচারী প্রবণতাগুলো রোধে সুনির্দিষ্ট কাঠামোগত ও প্রায়োগিক জায়গাগুলো চিহ্নিত করা এই কাজের একটি অংশ। অন্য অংশটি হচ্ছে কার্যকর পরিবর্তনের সুপারিশ নিয়ে বোঝাপড়ার মধ্য দিয়ে ঐকমত্য তৈরি করা, গত ১৫ বছরের স্বৈরতান্ত্রিক শাসনামলের অন্যতম স্তম্ভগুলো ছিল প্রধানমন্ত্রী পদের অতি ক্ষমতায়ন, এলাকায় ‘এমপিরাজ’ প্রতিষ্ঠা, পুলিশ প্রশাসন ও বিচার প্রশাসনের চূড়ান্ত ও নিষ্ঠুর অপব্যবহার। ন্যূনতম এই তিন জায়গায় ক্ষমতাকাঠামোর সংস্কার ছাড়া অর্থবহ সংস্কার প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়।
রাষ্ট্রযন্ত্রের কার্যকারিতা বাড়ানো ও স্বৈরাচারী প্রবণতা রোধে ক্ষমতাকাঠামোর সংস্কারের বাইরে তৃতীয় একটি দৃষ্টিকোণ থেকেও সংস্কারের আলোচনা প্রাসঙ্গিক। সেটি হচ্ছে একটি উন্নত সমাজ তৈরির জন্য কিছু সংস্কার। একটা সময়ে আমরা একটি দারিদ্র্যক্লিষ্ট দেশ ছিলাম। এখন আমাদের একধরনের আর্থিক সক্ষমতা তৈরি হয়েছে, সমাজে নানা ধরনের গতিময়তার দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছে। বাসযোগ্য শহর, উন্নত মানের কানেকটিভিটি, জ্ঞানভিত্তিক সমাজ—আমাদের চাহিদার পরিধি সম্প্রসারিত করার সুযোগ রয়েছে। এ ক্ষেত্রে নতুন চিন্তা, নতুন উদ্ভাবনের প্রয়োজন হবে, সেটাও সংস্কারের অংশ।
এই তিন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে সংস্কারের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক তৈরি হবে। সংস্কারের গ্রহণযোগ্যতা আরও বাড়বে। আমরা কেন সংস্কার চাইছি? শেষ বিচারে সেটা তো এ রকম যে মানুষের জীবন যেন আরেকটু সুস্থির হয়, আরেকটু উন্নত হয়। তাঁরা যেন মনে করেন যে তাঁরাও এই দেশের একজন অংশীদার। এই দেশের ভবিষ্যৎ নির্মাণে তাঁদেরও ভূমিকা রাখার অধিকার রয়েছে। কিন্তু সংস্কার নিয়ে এখন যে আলোচনাগুলো হচ্ছে, আমি তার মধ্যে একটি একমাত্রিক প্রবণতা লক্ষ করছি।
আরেকটি বহুল আলোচিত বিষয় হলো ‘নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত’। এ বিষয়ে আমাদের অগ্রগতি কত দূর?
হোসেন জিল্লুর রহমান: ‘রাজনৈতিক বন্দোবস্ত’ শব্দটা হয়তো তাত্ত্বিক কর্মকাণ্ড বা একাডেমিক জগৎ থেকে আমাদের এখানে এসেছে। কিন্তু আমি এখন একটু চিন্তিত, একটু উদ্বিগ্ন এই কারণে যে সংস্কারের মতো রাজনৈতিক বন্দোবস্তের আলোচনায়ও সাধারণ মানুষ মানে জনগণের উপস্থিতি দেখা যাচ্ছে না। এই বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনায় একধরনের ‘এলিটিস্ট অ্যাপ্রোচ’ লক্ষ করা যাচ্ছে। মনে হচ্ছে এগুলো ‘ওপর মহল’-এর একটা আলোচনা। যে নতুন দল গঠিত হয়েছে, তাদের বক্তব্যে সংস্কার, নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত—এসব শব্দ বেশি বেশি করে শোনা গেলেও তাদের ক্ষেত্রেও একই ‘এলিটিস্ট অ্যাপ্রোচ’ই দেখা যাচ্ছে।
রাজনৈতিক বন্দোবস্ত শুধু রাজনৈতিক খেলোয়াড়দের বিষয় নয়, এতে জনগণেরও অংশীদারত্ব থাকতে হয়। রাজনৈতিক প্রতিযোগিতার মাঠে যারা আছে, অর্থনীতির মাঠে যারা আছে, শুধু তারা মিলেই বন্দোবস্ত তৈরি করবে—এটা একটা এলিটিস্ট ধারণা। এভাবে বন্দোবস্ত তৈরি হলে তাতে জনগণের চেয়ে এলিটদের স্বার্থই প্রাধান্য পাবে।
সবাই দাবি করছে, জনগণের পক্ষে তারাই দায়িত্বপ্রাপ্ত, ক্ষমতাপ্রাপ্ত, নৈতিকভাবে তারাই দাবিদার। কিন্তু সত্যিকার অর্থে জনগণ কোথায়? এসব আলোচনায় জনগণের ভয়েসটা কোথায়? রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ড ও রাজনৈতিক পরিসরে আমি গত সাত মাসে সবচেয়ে বড় অনুপস্থিত ‘ফ্যাক্টর’ যেটা দেখছি, তা হলো জনগণ।
জনগণকে যুক্ত করার প্রক্রিয়াটা কেমন হতে পারে বলে আপনি মনে করেন?
হোসেন জিল্লুর রহমান: সরকারের কথা যদি বলি, উপদেষ্টা পরিষদের সদস্যরা নিজেদের মূলত দাপ্তরিক কাজের মধ্যে সীমাবদ্ধ রেখেছেন। জনসম্পৃক্ততার কাজে তাঁরা পুরোপুরি অনুপস্থিত। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে এটাই তাঁদের একটা প্রধান কাজ বলে আমি মনে করি।
রাজনীতিবিদেরা কীভাবে জনসম্পৃক্ত হবেন, সেই প্রক্রিয়া তাঁদেরকেই উদ্ভাবন করতে হবে। তাঁদের যদি সে রকম উদ্দেশ্য থাকে, আমরা তা বুঝতে পারব। তাঁরা কি চেষ্টা করছেন কৃষকের সঙ্গে বসে কৃষির সমস্যা বোঝার, শ্রমিকদের সঙ্গে বসে তাঁদের কথাগুলো শোনার? এই যে বিভিন্ন ফ্যাক্টরি বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, বিনিয়োগের জায়গাগুলো কেন স্থবির হয়ে আছে, উদ্যোক্তাদের সঙ্গে, ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কি এগুলোর সমাধানের বিষয়ে কোনো আলোচনা করা হচ্ছে?
কিছু আনুষ্ঠানিক আলোচনা হয়তো হচ্ছে। কিন্তু এগুলো খুবই একতরফা। এখানে অল্প কিছু লোক বলেন, অন্যরা ‘অডিয়েন্স’ (দর্শক বা শ্রোতা) হিসেবে উপস্থিত থাকেন। এ ধরনের আলোচনায় জনসম্পৃক্ততা বা জনগণের সঙ্গে সংযোগ তৈরি হয় না।
আমাদের রাজনৈতিক ইতিহাসে ছাত্ররা সব সময়ই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। বিভিন্ন আন্দোলন, সংগ্রাম, এমনকি সরকারের পতনেও তাঁদের বড় ভূমিকা ছিল; কিন্তু ছাত্ররা এর আগে কখনো সরাসরি ক্ষমতার অংশীদার হতে চাননি। কিন্তু এবার তাঁরা প্রথমে সরকারের অংশ হলেন এবং পরবর্তী সময়ে নিজেরা একটা দলও গঠন করলেন। বিষয়টাকে কীভাবে দেখছেন?
হোসেন জিল্লুর রহমান: রাজনীতিতে অংশ নেওয়া বা রাজনৈতিক দল গঠনের বিষয়টিকে আমি ইতিবাচক হিসেবেই দেখি। দলটি যেহেতু নতুন, তাই তাদের নিয়ে আমি এখনই কোনো চূড়ান্ত মন্তব্য করতে চাই না। আমাদের দেখার বিষয় হলো, নতুন দলটি রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে কোন ধরনের পরিবর্তনের কথা বলছে।
নতুন দলকে আমরা শিক্ষার্থী ও তরুণদের দল বলছি। এই তারুণ্যের বিষয়টাকে আমরা আলাদা করে কেন বলি? তারুণ্যের বিষয় তো শুধু বয়স নয়। আমরা যখন তারুণ্যের বিষয়ে বলি, আমরা ধরে নেই যে এখানে আদর্শের জায়গাটা গুরুত্ব পাবে; এখানে স্যাক্রিফাইসের (আত্মত্যাগ) প্রবণতাগুলো আরও বেশি থাকবে; এখানে উদ্ভাবনী চিন্তার চর্চা বেশি হবে।
লক্ষণীয় হলো, নতুন দলের আলাপ-আলোচনাতেও অন্য যেকোনো কিছুর চেয়ে ক্ষমতা বিষয়টা বেশি প্রাধান্য পাচ্ছে। তাদের বক্তব্য অনেকটা এ রকম, ‘ওরা ক্ষমতায় গিয়ে ঠিক কাজ করেনি। তাই আমাদের ক্ষমতায় যেতে হবে।’ উন্নততর ও সক্ষম রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে এবং জনগণের সামনে মূল্যায়িত হয়ে ক্ষমতার দাবিদার হওয়ার আলোচনা একেবারেই কম।
নতুন দলের মধ্যেও পুরোনো রাজনৈতিক সংস্কৃতি রয়েছে। এর মধ্যে একটি হলো ‘শোডাউন টাইপ’ রাজনীতি। এটি অনুষ্ঠানভিত্তিক ও জনসংযোগের ব্যয়বহুল একটি পদ্ধতি, যা পুরোনো রাজনীতিরই অংশ। তাহলে নতুন রাজনৈতিক সংস্কৃতি কীভাবে তৈরি হবে?
নির্বাচন প্রসঙ্গে আসি। নির্বাচন কবে হবে, এটা যেমন একটা বিতর্ক, তেমনি নির্বাচন অন্তর্ভুক্তিমূলক হবে কি না কিংবা সবাই অংশগ্রহণ করতে পারবে কি না, সেটা নিয়েও বিতর্ক তৈরি হয়েছে। সোজাসুজি যদি বলি, আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টিসহ অন্য দলগুলো, যারা গত স্বৈরাচারী সরকারের অংশ ছিল, এদের নির্বাচনে অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে বিবেচনাটা আসলে কী হওয়া উচিত?
হোসেন জিল্লুর রহমান: এ বিষয়ে আমার সুস্পষ্ট কিছু বক্তব্য আছে। আমি নীতিগতভাবে মনে করি, আগামী নির্বাচন ইনক্লুসিভ বা অন্তর্ভুক্তিমূলক হওয়া দরকার। কারও জন্য ‘দরজা বন্ধ করা’ আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি হওয়া উচিত নয়। জুলাই-আগস্টের অভ্যুত্থানের যে স্পিরিট, সেটার মধ্যেও কাউকে বাদ দেওয়া নয়, বরং সবাইকে অন্তর্ভুক্তির বিষয়টা রয়েছে।
এখানে যে জটিলতা তৈরি হয়েছে, তা হলো বিগত স্বৈরাচারী সরকারকে ব্যাপক জনরোষের মুখে বিদায় নিতে হয়েছে। সেই সরকারের নির্দেশে বহু মানুষের প্রাণহানি হয়েছে, অনেকে আহত হয়েছেন। সার্বিকভাবে পুরো জাতিকে একধরনের মানসিক ট্রমার মধ্যে ফেলে রাখা হয়েছিল। এগুলো তো ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ।
এই ধরনের মানবতাবিরোধী অপরাধগুলোর বিচার হতে হবে। শুধু এগুলো নয়, গত আমলে যাঁরা বড় বড় অর্থনৈতিক অপরাধের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, তাঁদেরও বিচারের মুখোমুখি করতে হবে। নির্বাচন কমিশন তাদের আইনকানুন, শর্তাবলির মাধ্যমে এসব অপরাধের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের নির্বাচনে অংশগ্রহণে অযোগ্য ঘোষণা করতে পারে। এ ধরনের অভিযুক্তদের যেকোনো দলীয় দায়িত্বে থাকাটাও অযোগ্য ঘোষণা করা যেতে পারে।
কিন্তু নির্বাহী আদেশে বা প্রশাসনিকভাবে কোনো দলকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হলে কিংবা নির্বাচন না করতে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হলে সেটা খুব বিবেচনাপ্রসূত হবে না। এখন এ রকম সিদ্ধান্ত নিলে তা ভবিষ্যতের জন্য একটা প্রিসিডেন্স (দৃষ্টান্ত) তৈরি করবে। এর ফলাফল ভালো হবে না। এ কারণে দল নিষিদ্ধ করা নয়, বরং অপরাধীদের বিচারের বিষয়ে জোর দেওয়া উচিত।
অপরাধের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের বিচারের মুখোমুখি হওয়ার পাশাপাশি দল হিসেবে আওয়ামী লীগের ক্ষমাপ্রার্থনা ও অনুশোচনা প্রকাশেরও প্রয়োজন রয়েছে। তাদের উপলব্ধির যে একটা পরিবর্তন হয়েছে, জনগণের কাছে তা বিশ্বাসযোগ্যভাবে প্রমাণ করতে হবে। এই পর্বগুলো অতিক্রম করেই নির্বাচনে অংশগ্রহণের প্রশ্নটা আসে। এরপর জনগণই সিদ্ধান্ত নেবে আওয়ামী লীগের ভবিষ্যৎ কী হবে।
সম্প্রতি ‘রিফাইন্ড’ আওয়ামী লীগ নিয়ে কিছু কথাবার্তা শোনা যাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে আমার বক্তব্য হলো আওয়ামী লীগ দল হিসেবে কীভাবে, কোন প্রক্রিয়ায় ‘পরিবর্তিত’ বা ‘সংশোধিত’ হবে, সেটা তাদের নিজেদেরই খুঁজে বের করতে হবে। অন্য কোনো কোয়ার্টার বা মহল থেকে এটা নিয়ে ফ্যাসিলিটেট করা উচিত হবে না। মোদ্দাকথা, দলের ভেতর থেকেই পরিবর্তনটা আসতে হবে এবং তাদের উদ্যোগ ও সক্ষমতার মাধ্যমেই এটা করতে হবে।
আওয়ামী লীগ পুনর্বাসন ইস্যুতে সেনাবাহিনীকে জড়িয়ে জাতীয় নাগরিক পার্টির এক নেতার বক্তব্যকে কেন্দ্র করে সম্প্রতি উত্তেজনা তৈরি হয়েছিল। আমরা জানি যে সেনাবাহিনী গণ-অভ্যুত্থানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। সেনাবাহিনীকে জড়িয়ে এ ধরনের অভিযোগ ও পারস্পরিক সন্দেহ-অবিশ্বাসের পরিস্থিতি দেশের বর্তমান বাস্তবতায় আদৌ কাম্য কি?
হোসেন জিল্লুর রহমান: প্রথমেই বলা দরকার, এ ধরনের পরিস্থিতি আদৌ কাম্য নয় এবং এটি বলা ভালো যে এই পরিস্থিতি ডালপালা গজিয়ে আরও বিস্তৃতি ও অনাকাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছায়নি। সব মহলের এটা উপলব্ধি করা দরকার যে বাংলাদেশ একটি বৈরী ভূরাজনৈতিক অবস্থানে রয়েছে। পার্শ্ববর্তী দেশের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক এখন শীতল। এমন প্রেক্ষাপটে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ও শক্তিগুলোর মধ্যে একটি সংহত ও ঐক্যবদ্ধ অবস্থান জরুরি।
সেনাবাহিনী আমাদের রাষ্ট্রীয় সক্ষমতার অন্যতম একটি স্তম্ভ। হুটহাট কোনো অপরিপক্ব আলোচনার মাধ্যমে এই ক্ষমতাগুলোকে দুর্বল ও বিতর্কিত করা শেষ বিচারে নিজের পায়ে কুড়াল মারার শামিল। কখনো কখনো ছোট কোনো বিষয় বা সংকীর্ণ দলীয় বা ব্যক্তিগত স্বার্থে বড় সমস্যা তৈরি করা হচ্ছে কি না, সেদিকে আমাদের সজাগ দৃষ্টি রাখা খুবই জরুরি। একই সঙ্গে আওয়ামী লীগের পুনর্বাসনকে কোনোভাবেই রাষ্ট্রীয় এজেন্ডায় পরিণত হতে দেওয়া যাবে না। কারণ, এই দল ও এর নেতাদের বিরুদ্ধে গণহত্যা, মানবতাবিরোধী ও আর্থিক অপরাধের গুরুতর অভিযোগ রয়েছে।
বাংলাদেশে নতুন করে ধর্মীয় উগ্রপন্থার উত্থান নিয়ে বিভিন্ন মহল থেকে কিছু সতর্কবার্তা দেওয়া হচ্ছে। এ বিষয়ে আপনার বক্তব্য কী?
হোসেন জিল্লুর রহমান: বাংলাদেশে ধর্মীয় উগ্রপন্থার যেমন কিছু উদাহরণ আছে, তেমনি এগুলোকে দেখার ক্ষেত্রে একধরনের অতি সরলীকৃত দৃষ্টিভঙ্গি আছে। এ ছাড়া প্রতিবেশী দেশের প্রচার-প্রোপাগান্ডাও রয়েছে। উগ্রপন্থা মোকাবিলার বিষয়টা শুধু আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নয়, এটাকে মোকাবিলা করতে হবে দার্শনিকভাবে এবং রাজনৈতিকভাবে।
বাংলাদেশ একটি বহুত্ববাদী দেশ। এখানে বহু মত-পথের মানুষের দীর্ঘদিন ধরে একসঙ্গে থাকার ইতিহাস রয়েছে। ডান, বাম—কোনো ধরনের উগ্রপন্থাই বাংলাদেশের জন্য ইতিবাচক কিছু হবে না। এখানে সজাগ দৃষ্টির পাশাপাশি উসকানিমূলক যেকোনো কর্মকাণ্ডকে প্রশাসনিক দক্ষতা ও আদর্শিক উদ্যোগের মাধ্যমে মোকাবিলা করতে হবে।
সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
হোসেন জিল্লুর রহমান: আপনাদেরও ধন্যবাদ।