প্রথম আলো: আন্তর্জাতিক সংস্থার গবেষণা প্রতিবেদন অনুযায়ী ঢাকা বাসযোগ্য নগরীর তালিকার তলানিতে। কেন এমনটি হলো?
আদিল মুহাম্মদ খান: ঢাকা কেবল তালিকার তলানিতে নয়, সবচেয়ে খারাপ শহরের একটি। যত দিন যাচ্ছে, শহরের পরিবেশ ততই খারাপ হচ্ছে। আমরা যদি ১৫-২০ বছর আগের সঙ্গে তুলনা করি, এখনকার চেয়ে পরিবেশ ভালো ছিল। এর কারণ ভোগ করার দিকেই যত আয়োজন। আমরা ঢাকাকে নিয়েছি জিডিপির কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে। এখানে নতুন নতুন আবাসিক প্রকল্প, শিল্প ও ব্যবসাকেন্দ্র নির্মাণ করতে গিয়ে আমরা পরিবেশকে অগ্রাহ্য করেছি, জলাভূমিগুলো ভরাট করে উন্নয়ন করছি, সবুজ গাছপালা উজাড় করে উন্নয়ন করছি, এমনকি শহর সম্প্রসারণ করতে গিয়েও আমরা পরিবেশকে ধ্বংস করছি। ঢাকায় নতুন নতুন যেসব আবাসন প্রকল্প গড়ে উঠেছে, সেখানে ন্যূনতম মানদণ্ড রক্ষা করা হয় না।
প্রথম আলো: মানদণ্ড রক্ষা করে আবাসন প্রকল্প কী রকম হওয়া উচিত?
আদিল মুহাম্মদ খান: সেখানে খোলা স্থান থাকতে হবে, স্কুল ও স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র থাকতে হবে। প্রয়োজনীয় পরিষেবা সুবিধা থাকতে হবে। ঢাকা শহরে নতুন যেসব আবাসন প্রকল্প হচ্ছে, সেখানে এসব নেই। সরকারি প্রকল্প এলাকায় কিছুটা সুবিধা হয়তো আছে। কিন্তু বেসরকারি উদ্যোক্তারা এসব নিয়ে ভাবেনই না।
প্রথম আলো: এই অপরিকল্পিত নগরায়ণ থামানো যঁাদের দায়িত্ব, তাঁরা কী করছেন?
আদিল মুহাম্মদ খান: রাজউক, সিটি করপোরেশনের দায়িত্ব এসব তদারক করা। ১৯৯৫ সালে যে ডিএমডিপি বা ঢাকা মেট্রোপলিটন ডেভেলপমেন্ট প্ল্যান তৈরি করা হয়, তা ভালো পরিকল্পনা ছিল। এর আগেও অনেক পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। কিন্তু দিন শেষে সেসব একটি কাগজ ছাড়া কিছু নয়। পরিকল্পনাগুলো বাস্তবায়ন করতে হলে যে সুশাসন ও মনিটরিং দরকার, তা ভয়ংকরভাবে দুর্বল।
ঢাকার আশপাশের জলাশয়গুলো নির্বিচার ভরাট করে অনেক সরকারি প্রকল্প হয়েছে। সরকারিভাবে যখন জলাধার ভরাট করে স্থাপনা তৈরি করা হয়, তখন এসব সংস্থা নিশ্চুপ থাকে। অন্যদিকে বেসরকারি খাতের প্রকল্পে তো কোনো নিয়মনীতি মানা হচ্ছে না। এসব প্রকল্প যাঁরা করেন, তাঁরা রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে অনেক ক্ষমতাবান, অনেক সময় রাষ্ট্রের চেয়েও বেশি শক্তিশালী। তাঁরা কেবল ভরাটের মধ্যে সীমিত থাকেন না, নগরায়ণ আইনকেও পাল্টে দেন।
প্রথম আলো: ড্যাপের ক্ষেত্রেও সে রকমটি হয়েছে বলে অভিযোগ আছে। আপনার মন্তব্য কী?
আদিল মুহাম্মদ খান: ড্যাপের ক্ষেত্রে কতগুলো আইন আছে। যেমন আবাসন আইন, ইমারত নির্মাণ বিধিমালা। এসব আইন ও বিধিমালা নমনীয় করার জন্য প্রভাবশালী মহল চাপ দিয়ে আসছে। তাদের কাছে অনেক সময় রাজউক ও সিটি করপোরেশনের মতো প্রতিষ্ঠান নতি স্বীকার করতে বাধ্য হয়। আইনগুলো এতটাই নমনীয় করা হয়েছে যে পূর্বশর্ত না মেনেও তারা অনুমতি পেয়ে যাচ্ছে। এই যদি অবস্থা হয়, তাহলে তো ঢাকা শহরকে বাসযোগ্য করা যাবে না।
প্রথম আলো: নাগরিক পরিষেবার দিক থেকে ঢাকার অবস্থান কোথায়?
আদিল মুহাম্মদ খান: আমি বলব, নাগরিক পরিষেবা খুবই দুর্বল। অনেকে বলেন, ঢাকার যানজট, জলজট প্রধান সমস্যা। কিন্তু আমাদের প্ল্যানিং গবেষণা বলে, ঢাকা শহরের সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো সন্তানকে নিজ এলাকায় মানসম্মত স্কুলে ভর্তি করাতে না পারা। এ কারণেই সন্তানকে নিয়ে এক এলাকা থেকে আরেক এলাকায় অভিভাবকদের ছোটাছুটি করতে হয়। এতে অর্থ ও সময়ের অপচয় হয়। আদর্শ প্ল্যানিং হলো শিশুদের স্কুলকে কেন্দ্র করেই একেকটি মহল্লা গড়ে উঠবে। প্রাথমিক বিদ্যালয়কে কেন্দ্র করে যে শহর সাজাতে হবে, এটা আমরা বেমালুম ভুলে গেছি।
এক লাখ বাসিন্দা থাকলে অন্তত ২০টি মানসম্পন্ন প্রাথমিক বিদ্যালয় থাকতে হয়। আমাদের শহরে তা নেই। এ বিষয়ে রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকদের নজর দেওয়ার সময় এসেছে। এবারের ড্যাপে এলাকাভিত্তিক প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার কথা আছে। প্রশ্ন হলো সেটা বাস্তবায়ন হবে কি না? একই সঙ্গে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রও থাকতে হবে। ঢাকা শহরে অনেক বড় বড় হাসপাতাল আছে। কিন্তু প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র নেই। ঢাকার বাসিন্দারা যে পানি পাচ্ছেন, তা মানসম্পন্ন নয়। মানসম্পন্ন পানি আসবে কোথা থেকে? ঢাকার চারপাশের নদীগুলো দখল ও দূষণে বিপন্ন। সেখান থেকে আসা পানি পরিশোধন করেও খাওয়া যাচ্ছে না।
প্রথম আলো: ঢাকার চারপাশের নদীগুলো আমরা রক্ষা করতে পারলাম না কেন?
আদিল মুহাম্মদ খান: ঢাকা শহরে যে নিয়ন্ত্রণহীন শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে, তার সব বর্জ্য গিয়ে পড়ে এসব নদীতে। বুড়িগঙ্গা হয়তো ট্যানারির বর্জ্য থেকে মুক্ত হয়েছে। অন্যান্য শিল্পকারখানার বর্জ্য ঠিকই সেখানে গিয়ে পড়ছে। প্রশ্ন হলো সরকার কেন তাদের এভাবে নদী ধ্বংস করে শিল্পকারখানা করতে দিল? শিল্পকারখানার মালিকেরা মুনাফার জন্য কারখানা করেছেন। তাঁদের সুবিধার জন্য তো নদী, বন, পরিবেশ ধ্বংস হতে দেওয়া যায় না। সরকারের উচিত ঢাকা শহর থেকে বড় বড় শিল্পকারখানা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সরিয়ে ফেলার ব্যবস্থা করা। আমাদের পরিকল্পনা যদি টেকসই না হয়, পদ্মা-মেঘনা থেকে পানি এনে এই শহরকে বাঁচানো যাবে না। শহর বাঁচাতে হলে চারপাশের নদীগুলোকে রক্ষা করতেই হবে।
প্রথম আলো: প্রতিদিন ঢাকা শহরের লোকসংখ্যা বাড়ছে। আমাদের সব উন্নয়নের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে পড়েছে ঢাকা। এই বাস্তবতায় ঢাকাকে বাসযোগ্য রাখা কতটা সম্ভব?
আদিল মুহাম্মদ খান: ঢাকামুখী ক্রমবর্ধমান জনস্রোত ঠেকাতে না পারলে এই শহরকে বাঁচানো যাবে না। ঢাকা শহরে মানুষ আসে কর্মসংস্থানের আশায়। যদি ঢাকার বাইরে কর্মসংস্থান হতো, তাহলে এমনিতেই জনস্রোত থেমে যেত। আমরা পদ্মা সেতু করেছি, যমুনায় বঙ্গবন্ধু সেতু করেছি। কিন্তু এই দুই সেতুর ওপারে শিল্পায়নের কথা ভাবিনি। শিল্পকারখানা গড়ে উঠলে মানুষ কাজের সন্ধানে সেখানে যেত। ঢাকায় ভিড় করত না। পদ্মা সেতু হওয়ার পর ঢাকা-মাওয়ার মধ্যবর্তী স্থানেও বড় বড় আবাসিক প্রকল্প গড়ে উঠেছে। যার লক্ষ্য এই ঢাকা শহর। দেশের উত্তরাঞ্চল, পূর্বাঞ্চল, দক্ষিণাঞ্চলে শিল্পকারখানা গড়ে তুলতে হবে। ঢাকায় একটা মেট্রোরেল হয়েছে, এরপর হয়তো আরও পাঁচটা হবে। কিন্তু এসব মেগা প্রকল্প করে ঢাকাকে বাঁচানো যাবে না। এ শহর দেশের জন্য বোঝা হয়ে যাবে। ঢাকামুখী কর্মসংস্থান বাইরে নিয়ে যেতে হবে। তুরাগ ও কেরানীগঞ্জ প্রকল্প করলে হবে না।
প্রথম আলো: আপনি শিল্পকারখানা ও ব্যবসা-বাণিজ্যের বিকেন্দ্রীকরণের কথা বলেছেন। কিন্তু আমাদের প্রশাসন তো পুরোপুরি কেন্দ্রীভূত। এই সমস্যার সমাধান কী?
আদিল মুহাম্মদ খান: উন্নয়ন বিকেন্দ্রীকরণের প্রথম শর্ত হলো প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণ। আমি তো মনে করি, আমাদের অনেকগুলো মন্ত্রণালয় আছে, যেগুলোর প্রধান কার্যালয় ঢাকায় থাকার প্রয়োজন নেই। যেমন কৃষি, প্রাণিসম্পদ, বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়। হাওর উন্নয়ন বোর্ড বা পানি উন্নয়ন বোর্ড ঢাকায় থাকার যুক্তি কী? এটা রাজনৈতিক সদিচ্ছার প্রশ্ন। সরকার যদি এই কাজগুলো না করে, তাহলে প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণ হবে না।
প্রথম আলো: ঢাকার ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ মানুষ বস্তিবাসী বলে বিভিন্ন গবেষণায় উঠে এসেছে। তাদের জীবনমান উন্নয়ন না করে কি আদর্শ নগরায়ণ সম্ভব?
আদিল মুহাম্মদ খান: শহরে এই মানুষগুলো তো নগর ও নগরবাসীকে সেবা দিয়ে থাকেন। সরকারের উচিত তাঁদের আবাসনের ব্যবস্থা করা। আমাদের গৃহায়ণ নীতিতে সামাজিক আবাসনের কথা বলা আছে। কিন্তু এই বিপুলসংখ্যক মানুষের আবাসন করতে হলে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগ প্রয়োজন। বেসরকারি আবাসন উদ্যোক্তাদের উৎসাহিত করতে হবে। সমস্যা হলো ঢাকা শহরে তো জমি নেই। এই প্রান্তিক শ্রেণির মানুষের পূর্বাচলে ২ শতাংশ জমি রাখা হয়েছে। এটা খুবই অপ্রতুল। তঁাদের জন্য সুলভে গণপরিবহনের ব্যবস্থা করলে তঁারা বাইরে থেকেও ঢাকা শহরে এসে কাজ করতে পারেন।
প্রথম আলো: ঢাকা শহরের ওপর চাপ কমাতে পূর্বাঞ্চল উপশহর করার উদ্যোগ নেওয়া হলো প্রায় তিন দশক আগে। কিন্তু পূর্বাঞ্চল এখনো বসবাস উপযোগী করা গেল না কেন?
আদিল মুহাম্মদ খান: এ ধরনের উপশহরে মানুষ সরিয়ে নেওয়ার জন্য যে ধরনের পরিকল্পনা নেওয়া এবং তা বাস্তবায়নের সক্ষমতা দরকার, সেটা সরকারের আছে বলে মনে হয় না। ইতিমধ্যে ঢাকা ও পূর্বাঞ্চলের মাঝখানে যেসব জায়গা আছে, সেখানে বিভিন্ন উন্নয়ন ও আবাসিক প্রকল্প গড়ে উঠেছে। মানুষ পূর্বাচলে না গিয়ে সেসব স্থানকেই অগ্রাধিকার দেবে। কেন্দ্রীয় শহরের উন্নয়নযজ্ঞ নিয়ন্ত্রণ না করতে পারলে পূর্বাচলে মানুষ যাবে না। কিন্তু এই দুই শহরের মাঝখানে নতুন নতুন শহর-উপশহর তৈরি হবে। মাঝখানের বাফার এলাকা। আমাদের এখানে উন্নয়ন নিয়ন্ত্রণ বলে কিছু নেই। ড্যাপ বা এ ধরনের পরিকল্পনায় যেসব নিয়মকানুনের কথা আছে, সেগুলো কাগজেই সীমিত থাকছে। বাস্তবে কাজ করছে না।
আমাদের এখানে সরকারি সংস্থা হোক কিংবা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, তারা ইচ্ছেমতো বিভিন্ন প্রকল্প নিয়ে থাকে। প্রকল্প নেওয়ার পর সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের কাছ থেকে ছাড়পত্র আদায় করে। এই ধারা যত দিন চলতে থাকবে, তত দিন কোনো পরিকল্পনা কাজে আসবে না। পূর্বাচল প্রকল্প অকার্যকর হওয়ার উপক্রম হয়েছে। আরও নতুন প্রকল্প নিলে সেটাও অকার্যকর হবে। আমাদের যদি নিয়ন্ত্রণ ও সুশাসন না থাকে, তাহলে কোনো পরিকল্পনাই কাজে আসবে না। আমরা যদি মনে করি, ঢাকার অসীম ক্ষমতা, এটাই হবে দেশের সব উন্নয়নের একমাত্র কেন্দ্রবিন্দু, সেটা ভুল হবে। দুঃখজনক হলো ড্যাপে যখন জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের কথা বলা হয়েছিল, তখন একটি গোষ্ঠী বলতে চাইল, ঢাকাই সারা দেশের সমস্যার সমাধান দেবে। এখানে লোকসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজন নেই। এসব চিন্তা কেবল পরিবেশ বিরোধী নয়, আত্মঘাতীও।
প্রথম আলো: ঢাকার উন্নয়নের জন্য বিভিন্ন সংস্থা কাজ করে, যাদের মধ্যে সমন্বয় নেই। এর প্রতিকারে আপনারা নগর সরকারের কথা বলেছেন। আরও অনেক বিশেষজ্ঞ ও রাজনীতিকেরাও বলেছেন। কিন্তু বাস্তবতা কী।
আদিল মুহাম্মদ খান: নগর সরকারের ধারণাই হলো কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণ বা ক্ষমতা কমিয়ে কিছু দায়িত্ব তাদের হাতে ন্যস্ত করা। নগর সরকারের যে কাজ সেখানে কেন্দ্রীয় সরকারের খুব বেশি কিছু করার থাকে না। রাজনৈতিক সদিচ্ছা ছাড়া এটি বাস্তবায়ন হবে না। বাংলাদেশের বাস্তবতায় এটি দূরবর্তী আশা। আসলে নগর সরকার ও কেন্দ্রীয় সরকারের মাঝামাঝি একটা কিছু করা যেতে পারে। নগরের অধীনে রাজউক, সিটি করপোরেশন, ওয়াসা থাকতে পারে। কিন্তু আমাদের কেন্দ্রীয় সরকারের প্রবণতা হলো সব ক্ষমতা নিজের কাছে রাখা।
প্রথম আলো: অন্যান্য দেশে নগর সরকার কীভাবে কাজ করছে?
আদিল মুহাম্মদ খান: অন্যান্য দেশে নগর সরকার নিজস্ব শক্তিতেই কাজ করছে। টোকিও, নিউইয়র্কের কথা বলেন, সেগুলো কিন্তু নগর সরকারই চালাচ্ছে। তাদের ওপর কেউ খবরদারি করছে না। আমাদের দেশে সেই সংস্কৃতি গড়ে ওঠেনি। সিটি করপোরেশন বলেছিল, নগর উন্নয়নের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো যেন তাদের কর্মপরিকল্পনা তাদের কাছে পাঠায়। সংশ্লিষ্টদের কাজের মধ্যে সমন্বয় করিয়ে দেওয়াই ছিল এর উদ্দেশ্য। কিন্তু সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো রাজি হয়নি। কারণ, প্রতিটি সংস্থার উন্নয়ন প্রকল্পের সঙ্গে অর্থ বরাদ্দের বিষয় থাকে। সেটা তারা ছাড়তে নারাজ। এ ক্ষেত্রে পারস্পরিক আস্থারও সংকট আছে।
প্রথম আলো: নাগরিক সেবা বাড়াতে আওয়ামী লীগ সরকার ঢাকার এক সিটি করপোরেশন ভেঙে দুটি করল। কিন্তু নগরবাসী কি কাঙ্ক্ষিত সেবা পাচ্ছেন?
আদিল মুহাম্মদ খান: যখন ঢাকার এক সিটি করপোরেশন ভেঙে দুই সিটি করপোরেশন করা হয়, তখন এটা সেবার নামে করা হলেও মূল উদ্দেশ্য রাজনৈতিক।
প্রথম আলো: বিএনপির সমর্থিত মেয়রকে ঠেকানোর জন্যই কি এটা করা হয়েছিল? সে সময় ঢাকা সিটির মেয়র ছিলেন বিএনপি নেতা সাদেক হোসেন খোকা।
আদিল মুহাম্মদ খান: অনেকটা সে রকমই। রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে সিদ্ধান্ত নিলে আপনি কখনো প্ল্যানিংয়ের সুফল পাবেন না। এখনো আমরা দেখি দুই সিটি করপোরেশনের কাজের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব আছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তাদের পরিকল্পনায় বৈসাদৃশ্যও লক্ষ করা যায়।
প্রথম আলো: উত্তর সিটি করপোরেশন অনেক আগেই কারওয়ান বাজার সরানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। কার্যকর করতে পারেনি। আবার আগুনে বঙ্গবাজার পুড়ে যাওয়ার পর দক্ষিণ সিটি করপোরেশন সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, ঝুঁকিপূর্ণ সব মার্কেট চিহ্নিত করে ভেঙে ফেলা হবে। কিন্তু কোনোটাই বাস্তবায়িত হয়নি।
আদিল মুহাম্মদ খান: দু্ই ক্ষেত্রেই বাইরের ‘ফ্যাক্টর’ কাজ করছে বলে ধারণা করি। যাঁরা সেখানে ব্যবসা করেন, তাঁদের রাজনৈতিক শক্তির বিষয়টিও দেখতে হবে। তাঁরা যদি সিটি করপোরেশনের চেয়ে শক্তিশালী হন, তাহলে তো সিটি করপোরেশন সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে পারবে না। ঝুঁকিপূর্ণ মার্কেট হলে প্রথম কাজ হবে সেটি খালি করা। সরকারি সংস্থার প্রতি নাগরিকদের আস্থার অভাব আছে। সেখানে যেসব ব্যবসায়ী আছেন, তঁারা মনে করেন, দোকান ভাঙলে আর সেটা ফেরত পাবেন না। অন্য কাউকে বরাদ্দ দেওয়া হবে। দায়িত্বপ্রাপ্ত মানুষেরা আইনের দ্বারা না চলে কোটারি গোষ্ঠীর স্বার্থ দেখেন বলেই এই অবস্থা হয়েছে। সরকারি কাজে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি আদায় করতে না পারলে নাগরিকদের আস্থা ফিরিয়ে আনা যাবে না।
প্রথম আলো: রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ বা রাজউকের কাজ উন্নয়ন প্রকল্প তদারক করা। কোথাও অনিয়ম হলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া। কিন্তু রাজউক গরিব মানুষের জমি অধিগ্রহণ করে ধনবানদের জন্য ফ্ল্যাট বানিয়ে দিচ্ছে কেন?
আদিল মুহাম্মদ খান: এটা অন্যায্য। রাজউকের উচিত পরিকল্পনা ও তদারকির মধ্যে থাকা।
প্রথম আলো: তাহলে ঢাকা শহর বাসযোগ্য তালিকার তলানিতেই থাকবে। উন্নতির কোনো সম্ভাবনা নেই?
আদিল মুহাম্মদ খান: সম্ভাবনা আছে। ঢাকার সমস্যা এটা না যে প্রচুর অবকাঠামো নেই। ঢাকার নিজস্ব একটি শক্তি আছে। এখানকার সাধারণ মানুষ যূথবদ্ধতায় বেঁচে থাকতে চায়। সমস্যা হলো রুল অব ল ও জবাবদিহির অভাব। সুশাসন থাকলে যেকোনো মানুষ ভাববে সরকারি সংস্থার কাছে গেলে প্রতিকার পাবেন। ঢাকার মানুষের যে প্রাণশক্তি আছে, সেটাই ঢাকাকে বাঁচিয়ে রাখবে। ঢাকার নদীগুলোকে বাঁচাতে হলে আলাদা কর্মসূচি নেওয়ার প্রয়োজন নেই।
আপনি নদীর দূষণ বন্ধ করে দিন—পাঁচ বছর পর নদী জীবন্ত হয়ে উঠবে। করোনাকালে আমরা কিছুটা দেখেছি। সেবাদানকারী সংস্থাগুলোর প্রতি নাগরিকদের যে আস্থাহীনতা, তা–ও দূর করতে হবে। বড় বড় মেগা প্রকল্প দিয়ে নয়, সুশাসন ও জবাবদিহির মাধ্যমে এটি সম্ভব। ঢাকার যেকোনো পরিকল্পনার ক্ষেত্রে মুষ্টিমেয় ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর স্বার্থ নয়; বৃহত্তর জনগণের স্বার্থকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। তাহলে মুমূর্ষু ঢাকার পুনরুজ্জীবন সম্ভব।
প্রথম আলো: আপনাকে ধন্যবাদ।
আদিল মুহাম্মদ খান: আপনাকেও ধন্যবাদ।