সাক্ষাৎকার নিয়েছেন: সাজ্জাদ শরিফ

‘মুক্তিযুদ্ধ আমাকে এখনো স্বপ্ন দেখতে অনুপ্রাণিত করে’

২০২১ সালে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে প্রথম আলোর ‘তোমাকে পাওয়ার জন্য হে স্বাধীনতা’ ম্যাগাজিনে সাক্ষাৎকারটি প্রকাশিত হয়েছিল। তাঁর ৯০তম জন্মদিন উপলক্ষে কিছুটা সংক্ষিপ্ত আকারে সাক্ষাৎকারটি পুনঃপ্রকাশ করা হলো

সাজ্জাদ শরিফ:

১৯৬০-এর দশকে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের অর্থনৈতিক বৈষম্যের ব্যাপারে আপনি আগ্রহী হয়ে উঠলেন কীভাবে?

রেহমান সোবহান: অধ্যাপক কবীর চৌধুরী সে সময়ে ব্যুরো অব ন্যাশনাল রিকনস্ট্রাকশন বা বিএনআরের কাজ করতেন। ১৯৫৯ সালের কোনো একসময় তিনি আমাকে পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনীতি সম্পর্কে বিএনআরের প্রকাশিতব্য জার্নালে একটা অধ্যায় লিখতে বললেন। প্রকাশনাটির উদ্দেশ্য ছিল সম্ভবত রাষ্ট্রপতি আইয়ুব খানের সামরিক শাসনব্যবস্থার কৃতিত্ব প্রচার করা। লেখাটির জন্য গবেষণা করতে গিয়ে আমি পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের অর্থনৈতিক বৈষম্যের বেশ কিছু প্রমাণ পেয়ে গেলাম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের নুরুল ইসলাম অথবা অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাকসহ আরও কয়েকজন সহকর্মীর সঙ্গে আলোচনার সুবাদে এ সম্পর্কে আগেও কিছু ধারণা আমার ছিল। বিএনআরের প্রকাশনায় আমার লেখাটিও অন্তর্ভুক্ত হলো। লেখাটিতে অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যকার বৈষম্য বিশদভাবে তুলে ধরেছিলাম। স্বাভাবিকভাবেই পাকিস্তান সরকার বিষয়টি একদমই পছন্দ করেনি। তাদের হুকুমে আমার লেখা প্রত্যাহার করে অর্থনীতি বিষয়ে অধ্যাপক আবদুল্লাহ ফারুকের লেখা একটি ইতিবাচক নিবন্ধসহ জার্নালটি আবার নতুন করে ছাপা হয়।

এরপর আমি বৈষম্য বিষয়ে আরও নিয়মিত লিখতে শুরু করলাম। বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় আমি নিবন্ধ লিখতাম, সভা-সমিতিতে বিষয়টি নিয়ে বলতাম। ১৯৬১ সালের অক্টোবরে যখন লাহোরে এক জাতীয় সম্মেলনে এই দুই অর্থনীতি নিয়ে আমার নিবন্ধটা পড়লাম, তখন তার ব্যাপক প্রচার হয়েছিল। ঢাকার পাকিস্তান অবজারভার পত্রিকায় পুরো লেখা ছাপা হয়েছিল।

সাজ্জাদ শরিফ:

আমরা দেখতে পাচ্ছি, আপনি কখনো পেছন থেকে, কখনো পাশে থেকে শেখ মুজিবকে সহায়তা করেছেন—সত্তরের নির্বাচনের আগে–পরে, মুক্তিযুদ্ধের সময়ে। খুব কাছ থেকে আপনি ইতিহাসের পালাবদল দেখেছেন। রাজনীতির শর্ত তখন তৈরি হচ্ছিল পথে-প্রান্তরে ছড়িয়ে থাকা মানুষের সপ্রাণ অংশগ্রহণে। একাডেমির মানুষ হিসেবে আপনি কী দেখছিলেন, কী শিখছিলেন?

রেহমান সোবহান: ১৯৭০ সালের নির্বাচনী প্রচার ছিল বেশ ব্যতিক্রমধর্মী। কারণ, সেটির কারণেই বঙ্গবন্ধুর মতো রাজনীতিবিদেরা ১৯৫৪ সালের পর প্রথমবারের মতো জনতার সামনে দাঁড়াতে পেরেছিলেন। আমি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তাঁর বেশ কিছু জনসভায় গিয়েছি। তিনি যেভাবে মানুষের হৃদয় স্পর্শ করতেন, যেভাবে তাদের কাছে তিনি কেবল একজন রাজনৈতিক নেতা নন; বরং একটি আইকনে পরিণত হয়ে উঠেছিলেন। তাঁর পাশে দাঁড়িয়ে সেসব দেখতে পাওয়া আমার জন্য ছিল একটি অনন্য অভিজ্ঞতা। ছয় দফা দাবির মাধ্যমে বাঙালি জাতীয়তাবাদের বার্তা যাতে ঘরে ঘরে, এমনকি একেবারে অজপাড়াগাঁয়ে গিয়েও পৌঁছায়—১৯৭০ সালের প্রচারের সময় সেদিকে লক্ষ রাখাই ছিল আমার দায়িত্ব।

ডিসেম্বর ১৯৭০-এর ভোটেই শুধু নয়, ১৯৭১ সালের মার্চেও যখন বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পরাক্রমকে চ্যালেঞ্জ করেছিলেন—এই জনতাই তাদের সবকিছু দিয়ে তাঁকে সমর্থন করেছে। ঐতিহাসিক অসহযোগ আন্দোলন সর্বস্তরের সব শ্রেণির মানুষের সমর্থন পেয়েছে। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের পর স্বতঃস্ফূর্তভাবে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে বাঙালি সেনাবাহিনী আর সাধারণ মানুষকে এ সমর্থন শক্তি জুগিয়েছে।

এসব ঐতিহাসিক ঘটনার অভিজ্ঞতা থেকে আমি সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিলাম, অভিজাত শ্রেণিকে কেন্দ্র করে অসম যে সমাজব্যবস্থা পাকিস্তানের উন্নতিকে আকার দিয়েছে, কিছুতেই তা স্বাধীন বাংলাদেশে চলতে দেওয়া যাবে না। বঙ্গবন্ধুসহ স্বাধীনতাযুদ্ধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়া আরও অনেকের মতো আমিও বিশ্বাস করতাম, আমাদের অবশ্যই একটা ন্যায়পরায়ণ ও সমতাভিত্তিক সমাজ গড়ে তুলতে হবে।

সাজ্জাদ শরিফ:

মুক্তিযুদ্ধ চলে এল। সেটা তো স্নায়ুযুদ্ধের যুগ। বিশ্বশক্তির মধ্যে নানা বিভেদ। বঙ্গবন্ধু বন্দী। নেতাদের নানা অংশে নানা মত। অথচ সব পেরিয়ে মুক্তিযুদ্ধে বিরাট সাফল্য এল। এত বাধা পেরিয়ে এই সফলতার পেছনে প্রধান কারণগুলো কী ছিল?

রেহমান সোবহান: বঙ্গবন্ধু তখন পশ্চিম পাকিস্তানের জেলে বন্দী থাকা সত্ত্বেও মুক্তিযুদ্ধে আমাদের সফলতার মূল কারণ ছিল যুদ্ধটি তাঁর মতো একজন অবিসংবাদিত নেতার নামে পরিচালিত হয়েছে। তাঁর দল আওয়ামী লীগের পেছনে ছিল নির্বাচনে তাদের আকাশচুম্বী জয়। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ নাগাদ বঙ্গবন্ধু সারা বিশ্বে সুপরিচিত ব্যক্তিত্ব হয়ে উঠেছিলেন। এ কারণে ১৯৭১ সালে আমাদের যুদ্ধ আন্তর্জাতিক দৃশ্যমানতা ও বিশ্বাসযোগ্যতা পেয়েছে।

একটি স্বাধীন–সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের জন্য আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির প্রচারণায় পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের প্রবাসী বাঙালিরা যুক্ত হয়েছিলেন। এটি বিভিন্ন রাজনৈতিক পরিমণ্ডল, জনগোষ্ঠী আর গণমাধ্যমে খুব কার্যকরভাবে আমাদের স্বাধীনতাসংগ্রামের বার্তা পৌঁছে দিয়েছে। ফলে যুক্তরাষ্ট্রে ইয়াহিয়া সরকারের প্রতি নিক্সন সরকারের সমর্থনে বাধা দেওয়ার ক্ষেত্রে আমাদের আন্তর্জাতিক প্রচারণা চালু করা গেছে, ইয়াহিয়ার সমর্থনে যুক্তরাষ্ট্রের বেশি পরিমাণে অর্থনৈতিক সাহায্য আর অস্ত্রের জোগান দেওয়ার সামর্থ্য সংকুচিত হয়েছে। মুজিবনগর সরকারের অর্থনৈতিক কার্যক্রমের দূত হিসেবে আমি এ রকম একটি প্রচারণার সঙ্গে যুক্ত ছিলাম। আমরা চেষ্টা চালাচ্ছিলাম, যাতে পাকিস্তানি এইড কনসোর্টিয়াম পাকিস্তানে নতুন সাহায্য পাঠানো বন্ধ রাখে। যুক্তরাষ্ট্রের চাপ থাকা সত্ত্বেও আমরা কার্যকর হয়েছিলাম। বিশ্বব্যাংকের নেতৃত্বে পাকিস্তানের সাহায্য সংস্থাগুলো ১৯৭১ সালের মার্চ থেকে ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত পাকিস্তানে সাহায্য পাঠানো বন্ধ রেখে ইয়াহিয়া সরকারকে খুব সমস্যায় ফেলেছিল।

সাজ্জাদ শরিফ:

বিশ্ববাসী যেসব আদর্শ সভ্যতার উত্তরাধিকার হিসেবে সহজেই পেয়েছে—যেমন গণতন্ত্র, অসাম্প্রদায়িকতা, সাম্য ইত্যাদি—এসব আমাদের অর্জন করতে হয়েছে রক্তের মূল্যে। এটা কি জাতি হিসেবে আমাদের ওপর অতিরিক্ত কোনো দায় অর্পণ করেছে?

রেহমান সোবহান: যে জনতা প্রথম সারিতে দাঁড়িয়ে মুক্তিযুদ্ধ করেছে এবং নিজের জীবন ও বিষয়সম্পত্তি হারিয়ে সবচেয়ে বড় মূল্য দিয়েছে, তাদের কাছে আমাদের রক্তের ঋণ আছে। ক্ষমতাবানেরা যেভাবে ক্ষমতা ও সম্পদ আত্মসাৎ করছে, বাড়তে থাকা অর্থনৈতিক ব্যবধান আর সামাজিক বৈষম্য ইঙ্গিত দেয় যে আমাদের সে রক্তের ঋণ এখনো শোধ হয়নি।

সাজ্জাদ শরিফ:

আমরা দেখেছি, স্বাধীনতার পরও রাজনীতি আর বিদ্যাচর্চার যোগসূত্র শুরুতে কিছুদিন কাজ করেছে। কিন্তু গত ৫০ বছরে আস্তে আস্তে এই দুইয়ের মধ্যে ব্যবধান শুধু বাড়েইনি, একপর্যায়ে ছিন্ন হয়ে গেছে। কখনো কখনো মুখোমুখিও দাঁড়িয়ে গেছে। ক্ষমতা কি বিদ্যাচর্চার কাছে শুধু আনুগত্যই চায়?

রেহমান সোবহান: একটি সক্রিয় গণতন্ত্রের দেশে জ্ঞানচর্চা ও ক্ষমতা পাশাপাশি না থাকতে পারার তো কোনো কারণ নেই। পশ্চিমে এনলাইটেনমেন্টের কেন্দ্রে জন্ম নেওয়া এ বার্তা তো আমাদের সংবিধানেও আত্মস্থ করা হয়েছিল। কিন্তু বিদ্যাচর্চার মাধ্যমে সত্যের অনুসন্ধান এবং লেখালেখির মাধ্যমে তার প্রকাশকে ক্ষমতার অপব্যবহার করে যখন দমন করা শুরু হলো, তখনই সমস্যার সূত্রপাত। যে সমাজব্যবস্থায় বিদ্যাচর্চার পায়ে শিকল পরানো হয়, সেখানে শিক্ষার মান পড়ে যায় এবং স্বল্পশিক্ষিত জনতা সহজেই চতুর জননেতাদের কথার ফাঁদে আটকে পড়তে পারে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের শাসনকালে যুক্তরাষ্ট্র সম্ভবত এ রকমই এক সমাজের সবচেয়ে বড় উদাহরণ হয়ে উঠেছিল যে সমাজ মিথ্যাচারকে ক্ষমতাবানদের রাজনৈতিক সংস্থান বানিয়ে নিয়েছে। অবশ্য আমাদের ঘরের কাছে এবং নিজেদের অভিজ্ঞতার মধ্যেও এই ব্যবস্থার সঙ্গে আমাদের পরিচয় ঘটেছে।

সাজ্জাদ শরিফ:

আপনি একটি দীর্ঘ জীবন পাড়ি দিয়ে এসেছেন। মুক্তিযুদ্ধ আপনার সেই জীবনে কী ভূমিকা রেখেছে?

রেহমান সোবহান: আমার জীবনে মুক্তিযুদ্ধ ছিল এক সন্ধিক্ষণ। বাংলাদেশের জন্য বিদেশে ৯ মাস প্রচারণার কাজ চালানোর পর ১৯৭১ সালের ৩১ ডিসেম্বর যখন ঢাকার বিমানবন্দরে নামলাম, তখন এমন এক পরিপূর্ণতার অনুভূতি হয়েছিল, সেটি ভাষায় প্রকাশ করা কঠিন। স্বাধীন বাংলাদেশের নাগরিক হতে পারা আমাকে একটি গৌরব ও আত্মমর্যাদার বোধ দিয়েছিল। কারণ, এ দেশের প্রতিষ্ঠায় আমিও যৎসামান্য ভূমিকা রাখতে পেরেছিলাম। মুক্তিযুদ্ধ আমাকে অনুপ্রাণিত করেছে, এমনকি এই ৮৫ বছর বয়সেও এমন স্বপ্ন দেখতে অনুপ্রাণিত করে চলেছে যে আমরা সেই ন্যায়পরায়ণ সমাজ গড়ে তুলতে পারব, যার জন্য একদিন যুদ্ধ করেছি এবং বহু মানুষ প্রাণ দিয়েছে।