বিশেষ সাক্ষাৎকার: মাইকেল কুগেলম্যান

যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতিতে ‘টেস্ট কেস’ হিসেবে থাকবে বাংলাদেশ

গত ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে যুক্তরাষ্ট্র। এরপরও দেশটি দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক এগিয়ে নিতে চায়। ভবিষ্যতে বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক কেমন হতে পারে, তা নিয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন ওয়াশিংটনভিত্তিক নীতি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান উইলসন সেন্টারের দক্ষিণ এশিয়া ইনস্টিটিউটের পরিচালক মাইকেল কুগেলম্যান। জানুয়ারির শেষ সপ্তাহে ফোনে তাঁর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন প্রথম আলোর কূটনৈতিক প্রতিবেদক রাহীদ এজাজ

প্রথম আলো:

বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পরদিন, অর্থাৎ ৮ জানুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর নির্বাচন ‘অবাধ ও সুষ্ঠু হয়নি’ বলে জানায়। পররাষ্ট্র দপ্তর এই বিবৃতির মধ্য দিয়ে প্রকারান্তরে স্বীকার করে নেয় যে বাংলাদেশ নিয়ে ওয়াশিংটনের নীতিগত অবস্থান বড় ধরনের হোঁচটই খেল। নীতিগত ব্যর্থতার কারণ কী?

মাইকেল কুগেলম্যান: অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করতে যুক্তরাষ্ট্র যথাসাধ্য চেষ্টা করেছিল। যুক্তরাষ্ট্র কেন তাদের লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হয়েছে, সেটা দুই দেশের পটভূমি থেকেই দেখা যেতে পারে।

যুক্তরাষ্ট্রের পটভূমি থেকে দেখতে চাইলে লক্ষ করবেন, ওয়াশিংটন অনেকবারই বিভিন্ন দেশে নীতিগত অবস্থানের প্রতিফলন ঘটাতে নানা ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছিল।

এসব ক্ষেত্রে ব্যর্থতার অনেক দৃষ্টান্তও যুক্তরাষ্ট্রের রয়েছে। কাজেই যে কেউ চাইলে বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সর্বশেষ ব্যর্থতাকে আরেকটি দৃষ্টান্ত হিসেবে দেখাতেই পারেন।

প্রথম আলো:

আর বাংলাদেশের পটভূমি থেকে দেখলে?

মাইকেল কুগেলম্যান: প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যুক্তরাষ্ট্রের চাপের বিষয়ে তাঁর অস্বস্তি খোলামেলাভাবে প্রকাশ করেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের নীতিগত নানা ভূমিকা নিয়ে তিনি তাঁর অস্বস্তির কথা জানিয়েছেন।

আবার এটাও অস্বীকার করার উপায় নেই যে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ যেকোনো মূল্যে ক্ষমতায় থেকে যাওয়ার বিষয়ে মরিয়া ছিল।

রাজনীতির মাঠে সবার জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত হলে, নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হলে, কোনো সহিংসতা না হলে, ভোট কারচুপি না হলে বিএনপির ক্ষমতায় ফেরার পথ সুগম হতো।

বিএনপি ক্ষমতায় এলে প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে উঠত বলে প্রচার করা হয়েছিল। এমন এক পরিপ্রেক্ষিতে ক্ষমতাসীন দল যুক্তরাষ্ট্রের মতো গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য অংশীদারের চাপ উপেক্ষা করেই নির্বাচন করতে মরিয়া ছিল। বাস্তবে সেটাই ঘটেছে।

প্রথম আলো:

যুক্তরাষ্ট্রের চাপের পরও বাংলাদেশে নির্বাচন হয়েছে। আওয়ামী লীগ টানা চতুর্থবারের মতো ক্ষমতায় এসেছে। এ পরিস্থিতিতে ভবিষ্যতে ঢাকা-ওয়াশিংটন সম্পর্ক কেমন হতে পারে?

মাইকেল কুগেলম্যান: আমার ব্যক্তিগত মত, বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র সরকার যথেষ্ট সতর্ক থাকবে। ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের অবস্থানকে বিবেচনায় নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র কোনো ঝুঁকি নেবে না।

বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ হওয়ার পেছনে অন্যতম কারণ হচ্ছে এ অঞ্চলকে ঘিরে বৃহৎ শক্তিগুলোর প্রতিযোগিতা। বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোয় চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিযোগিতা, ভারতের সঙ্গে নিকট প্রতিবেশী বাংলাদেশের নিবিড় সম্পর্ক, সাম্প্রতিক বছরগুলোয় বাংলাদেশের সঙ্গে চীনের বাণিজ্যিক ও প্রতিরক্ষা সম্পর্ক উত্তরোত্তর বৃদ্ধি এবং অতীতের মতো রাশিয়ারও বেশ উপস্থিতি আছে বাংলাদেশে।

কাজেই যুক্তরাষ্ট্র এমন কিছু করবে না, যা বাংলাদেশকে আরও বেশি মাত্রায় চীন বা রাশিয়া কিংবা উভয় দেশের প্রতি ঘনিষ্ঠ হতে বাধ্য করবে।

অন্যদিকে বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য সম্পর্কের পরিধি বাড়ছে। বাংলাদেশি পণ্যের সবচেয়ে বড় বাজার হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র গুরুত্বপূর্ণ। ব্যাপক পরিসরে আমরা দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সহযোগিতা বাড়ার প্রবণতা লক্ষ করছি।

যুক্তরাষ্ট্র চাইছে না বাংলাদেশে বিপুল বিনিয়োগের সুবিধাটা শুধু চীনই উপভোগ করুক। তাই কৌশলগত ও বাণিজ্য সহযোগিতার নিরিখে এবং বড় শক্তিগুলোর মধ্যে প্রতিযোগিতার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কে নিবিড় করার বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের মনোযোগ থাকবে।

প্রথম আলো:

বাইডেন প্রশাসন বাংলাদেশে গণতন্ত্রের অ্যাজেন্ডা বাস্তবায়নে যথেষ্ট জোর দিয়েছে। অথচ এই ইস্যুতে ট্রাম্প প্রশাসনের অবস্থান ততটা জোরালো ছিল না। এর কারণটা কী?

মাইকেল কুগেলম্যান: জো বাইডেনের মতো এতটা জোরালো না হলেও ডোনাল্ড ট্রাম্পের আমলেও বাংলাদেশে গণতন্ত্রের কথা যুক্তরাষ্ট্র প্রচার করে গেছে।

ট্রাম্পের আমলে বাংলাদেশে যাঁরা যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত ছিলেন, বিশেষ করে মার্শা বার্নিকাট দায়িত্ব পালনকালে ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস থেকে মানবাধিকার ও গণতন্ত্র সমুন্নত রাখার পাশাপাশি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের বিষয়গুলো প্রচার করে গেছেন।

কাজেই বিষয়টি অপ্রত্যাশিতভাবে চলে এসেছে, এমনটা ভাবার কারণ নেই। এটা বাইডেন এবং ট্রাম্পের নীতিগত ধারাবাহিক অবস্থারই প্রতিফলন।

তবে বাইডেন প্রশাসনের সময় গণতন্ত্রের অ্যাজেন্ডা বাস্তবায়নের পেছনে কয়েকটি কারণ রয়েছে। প্রথমত, মানবাধিকার ও গণতন্ত্র এই প্রশাসনের পররাষ্ট্রনীতির গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। দ্বিতীয়ত, কৌশলগত অবস্থানের কারণে বাংলাদেশ গুরুত্বপূর্ণ। তাই বাংলাদেশে মানবাধিকার ও গণতন্ত্র সমুন্নত থাকুক, এটা যুক্তরাষ্ট্র চায়।

মার্কিন কর্মকর্তারা মনে করেন, বাংলাদেশে গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিক ঐতিহ্য রয়েছে। তাই তাদের পক্ষে গণতন্ত্র বিকাশের অ্যাজেন্ডা সফলভাবে বাস্তবায়ন করা সম্ভব।

প্রথম আলো:

সম্প্রতি পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদের সঙ্গে দেখা করে ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত পিটার হাস সম্পর্ক এগিয়ে নেওয়ার কথা বলেছেন। নির্বাচন নিয়ে দুই পক্ষের মতপার্থক্যের নিরিখে এ বিষয়কে কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?

মাইকেল কুগেলম্যান: বাংলাদেশ সঙ্গে সম্পর্কের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে চায় যুক্তরাষ্ট্র। বিশেষ করে নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় সেটা বেশ স্পষ্ট। এতে বলা হয়েছে, মানবাধিকার ও গণতন্ত্রে গুরুত্ব অব্যাহত থাকবে।

যুক্তরাষ্ট্রের মূল্যবোধভিত্তিক পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে ‘টেস্ট কেস’ হিসেবে বিবেচিত হতে থাকবে বাংলাদেশ। একই সময়ে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কের কৌশলগত দিককেও বিবেচনায় নেবে যুক্তরাষ্ট্র। চীনের সঙ্গে বাণিজ্যযুদ্ধ মোকাবিলাসহ নানা ইস্যুতে বাংলাদেশের সঙ্গে অংশীদারত্ব প্রতিষ্ঠায় গুরুত্ব থাকবে।

বেশ কয়েক বছর ধরে কৌশলগত দিক থেকে মূল্যবোধের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে ট্রাম্পের আমলেও বাংলাদেশের গুরুত্বের প্রসঙ্গটি যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা ও পররাষ্ট্র দপ্তরের দলিলে এসেছে। বিশেষ করে ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় কৌশল–সম্পর্কিত দলিলে বাংলাদেশের উল্লেখ আছে। সন্ত্রাসবাদ, দস্যুতা দমনসহ নানা বিষয়ের কথা এতে বলা হয়েছে।

আমি মনে করি, ভবিষ্যতে মূল্যবোধ ও স্বার্থের বিষয়গুলো পাশাপাশি রেখে সম্পর্ক এগিয়ে চলবে। ভবিষ্যতে হয়তো যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে স্বার্থের বিষয়গুলো অগ্রাধিকার পাবে।

প্রথম আলো:

বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের চর্চায় জোর দেওয়ার পাশাপাশি ব্যবসা সম্প্রসারণের কথা বলা হচ্ছে। মতপ্রকাশের স্বাধীনতার পরিপ্রেক্ষিতে উপাত্ত সুরক্ষা আইনের (ডিপিএ) মতো বিষয়গুলোকে ভবিষ্যতে কীভাবে দেখা হবে?

মাইকেল কুগেলম্যান: বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কে যুক্তরাষ্ট্র মূল্যবোধ এবং স্বার্থের মাঝে ভারসাম্য আনতে চায়, কাজটা কিন্তু সহজ নয়। এর একটি কারণ হচ্ছে বাংলাদেশের গণতন্ত্র নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের উদ্বেগের বিষয়টি সম্পর্কের ঘনিষ্ঠতার ক্ষেত্রে নেতিবাচক ভূমিকা রাখবে।

যুক্তরাষ্ট্রের ব্যবসায়ীদের মধ্যে বিশেষ করে প্রভাবশালী মহলের মধ্যে বাংলাদেশে বিনিয়োগ বাড়ানোর বিষয়ে আগ্রহ রয়েছে। আগ্রহী এই ব্যবসায়ী মহলের অনেকেরই প্রযুক্তিভিত্তিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে। তাঁরা চাইছেন প্রযুক্তি খাতে বিনিয়োগ বাড়াতে। কিন্তু ইন্টারনেটে স্বাধীনতাচর্চার ক্ষেত্রে নিপীড়নমূলক পরিবেশ তো এর জন্য সহায়ক নয়।

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের (ডিএসএ) প্রয়োগ, ফেসবুকে সরকারের সমালোচনার কারণে গ্রেপ্তার ও আটক অবস্থায় মৃত্যুর মতো দুর্ভাগ্যজনক ঘটনাও ঘটেছে। ডিজিটাল বাংলাদেশ যখন প্রযুক্তি খাতের বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করছে, তখন ইন্টারনেট চর্চার এমন চিত্র স্বস্তিদায়ক নয়।

প্রথম আলো:

বাংলাদেশের নির্বাচনকে ঘিরে বৃহৎ শক্তিগুলোর প্রতিযোগিতা একেবারে স্পষ্ট হয়েছে। নির্বাচনে আওয়ামী লীগের জয়লাভের পর একধরনের মেরুকরণও আমরা লক্ষ করেছি। এ বিষয়টিও বাংলাদেশ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রকে সতর্ক হতে বাধ্য করছে কি?

মাইকেল কুগেলম্যান: ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতার কারণে বাংলাদেশে মূল্যবোধভিত্তিক পররাষ্ট্রনীতি এগিয়ে নেওয়া থেকে যুক্তরাষ্ট্র পিছিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছে।

নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অব্যাহত চাপ বাংলাদেশকে সংক্ষুব্ধ করেছে। আর এ সুযোগকে কাজে লাগিয়েছে চীন ও রাশিয়া। তারা বোঝাতে পেরেছে, মানবাধিকার ও গণতন্ত্রের বিষয়ে চাপ দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র নাক গলাচ্ছে, বাংলাদেশে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করছে।

অন্য যে ভূরাজনৈতিক কারণে যুক্তরাষ্ট্র পিছিয়ে এসেছে, সেটি হলো ওয়াশিংটন-দিল্লি সম্পর্ক। দক্ষিণ এশিয়ায় অনেক বিষয়ে দুই দেশ একে অন্যের চোখের ভাষা পড়ে নিজেদের অবস্থান বুঝে নেয়। কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে, বিশেষ করে মানবাধিকার ও গণতন্ত্র নিয়ে তাদের অবস্থান এক নয়। কারণ, ভারত ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক রাখে। তাই আওয়ামী লীগের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের চাপ প্রকারান্তরে ভারতকে উপেক্ষা করা হিসেবে বিবেচিত হয়েছে।

নির্বাচনোত্তর পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্র যদি পিছিয়ে আসে, তবে তা দিল্লি ও ওয়াশিংটনের মতপার্থক্য দূর করতে সহায়ক হবে। যুক্তরাষ্ট্র যদি জনসমক্ষে বিবৃতি দেওয়া বন্ধ করে এবং নতুন করে কঠোর কোনো পদক্ষেপ না নেয়, তবে তা বাংলাদেশ নিয়ে দুই পক্ষের দূরত্ব ঘোচাবে।

প্রথম আলো:

শুধু বাংলাদেশ বা দক্ষিণ এশিয়া নয়, অনেক ইস্যুতেই যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের ঘনিষ্ঠতা রয়েছে, অংশীদারত্ব রয়েছে। এটা তো কোনো গোপন বিষয় নয় যে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিয়ে আওয়ামী লীগ সরকারের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের চাপের বিষয়ে ভারত একই অবস্থানে ছিল না। ভারত পাশে ছিল না বলে কি যুক্তরাষ্ট্রের নীতিগত অবস্থান হোঁচট খেল?

মাইকেল কুগেলম্যান: বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের জোরালো অবস্থানের সঙ্গে ভারত একমত ছিল না। বাংলাদেশের অনেক পর্যবেক্ষক বিশ্বাস করেন, ভারত শুধু বাংলাদেশের রাজনীতিই নয়, বাংলাদেশ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের দৃষ্টিভঙ্গির ওপর বেশ প্রভাব বিস্তার করেছে।

ভারত যদি যুক্তরাষ্ট্রের ওপর প্রভাব বিস্তার করে থাকে তাহলে ওয়াশিংটন এত দীর্ঘ সময়জুড়ে কেন বাংলাদেশের গণতন্ত্রের বিষয়টি নিয়ে অব্যাহতভাবে বলে গেছে?

আমরা এটাও দেখেছি গত দু-তিন মাসে বাংলাদেশের মানবাধিকার ও গণতন্ত্রের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র আগের মতো ততটা উচ্চকণ্ঠ ছিল না। অনেকে মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্রের এমন অবস্থানের পেছনে ভারতের ভূমিকা রয়েছে।

গত সেপ্টেম্বরে নতুন ভিসা নীতির আওতায় বিধিনিষেধ কার্যকরের ঘোষণা ছাড়া নির্বাচন পর্যন্ত নতুন কোনো পদক্ষেপ যুক্তরাষ্ট্র নেয়নি। ভারত যদি মনে করে যুক্তরাষ্ট্র তার উদ্বেগের বিষয়টিকে বিবেচনায় নিচ্ছে, তবে সেটা দুই দেশের সম্পর্কের জন্য সহায়ক হবে।

তবে আমার মনে হয়েছে, নির্বাচনের আগে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি বেশ উত্তেজনাকর ও অস্থির হয়ে পড়েছিল। এমন এক পরিস্থিতিতে নির্বাচন নিয়ে জোরালো অবস্থান থেকে পিছিয়ে আসাকেই যুক্তরাষ্ট্র শ্রেয় মনে করেছে।

প্রথম আলো:

বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে ওয়াশিংটনের নীতিগত অবস্থান বড় ধরনের একটা হোঁচটই খেল। এরপরও কি বাংলাদেশকে ‘টেস্ট কেস’ হিসেবে বিবেচনা করবে যুক্তরাষ্ট্র। বিশেষ করে ওয়াশিংটনে ক্ষমতার পালাবদল ঘটিয়ে ডেমোক্র্যাটদের পরিবর্তে রিপাবলিকানরা ক্ষমতায় ফিরলেও কি এমনটা চলবে?

মাইকেল কুগেলম্যান: মানবাধিকার ও গণতন্ত্র যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতির অগ্রাধিকারের তালিকায় থাকবে। কিছুদিন আগেও যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি কর্মকর্তাদের টেলিগ্রামে সেটা উঠে এসেছে।

অনেক দেশেই যুক্তরাষ্ট্র জোরালোভাবে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের বিষয়টি সামনে আনে না। আবার যুক্তরাষ্ট্র তার প্রতিপক্ষ রাষ্ট্রগুলোকে বিবেচনায় নিয়ে এ বিষয়টি নিয়ে আসে।

নানা সময় চীন, রাশিয়া ও মিয়ানমারে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়গুলো যুক্তরাষ্ট্র প্রকাশ্যে বললেও তাতে সে দেশগুলোয় কোনো পরিবর্তন আসে না। কারণ, সেই দেশগুলোয় একনায়কতন্ত্র রয়েছে।

বাংলাদেশ একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। কেউ কেউ হয়তো যুক্তি দিতে পারেন যে বাংলাদেশ একনায়কতন্ত্রের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশে কিন্তু গণতন্ত্রের ঐতিহ্য রয়েছে। এ জন্য টেস্ট কেস হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে বাংলাদেশ নিয়ে একধরনের কৌতূহল তো আছেই।

রিপাবলিকানরা ক্ষমতায় এলে মূল্যবোধভিত্তিক পররাষ্ট্রনীতিতে জোর কম থাকবে। কিন্তু আমরা এটাও দেখেছি যে ট্রাম্পের আমলেও বাংলাদেশের গণতন্ত্রের বিষয়টি যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তারা সামনে এনেছেন।

এ ক্ষেত্রে ঢাকায় সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত মার্শা বার্নিকাটের গাড়িতে হামলার বিষয়টি মনে করিয়ে দিতে চাই। কাজেই যুক্তরাষ্ট্র ক্ষমতার পালাবদলের পর বাংলাদেশের ‘টেস্ট কেস’ হিসেবে অব্যাহত থাকার সম্ভাবনা নাকচ করে দেওয়া যায় না।

প্রথম আলো:

আপনাকে ধন্যবাদ।

মাইকেল কুগেলম্যান: আপনাকেও ধন্যবাদ।