বিশেষ সাক্ষাৎকার: এম শামসুল আলম

বিদ্যুৎ খাতের নীতি–পরিকল্পনায় অনেক বড় বিভ্রান্তি রয়েছে

অধ্যাপক এম শামসুল আলম। জ্বালানিবিশেষজ্ঞ। ড্যাফোডিল ইউনিভার্সিটির প্রকৌশল অনুষদের ডিন ও ভোক্তাদের স্বার্থ রক্ষায় গঠিত কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানিবিষয়ক উপদেষ্টা। বিদ্যুতের দাম বাড়ানোসহ জ্বালানিসংকটের পূর্বাপর নিয়ে তিনি কথা বলেছেন প্রথম আলোর সঙ্গে।

 সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সোহরাব হাসান

প্রথম আলো:

সরকার তো বিদ্যুতের দাম আরেক দফা বাড়াল। এর কি বিকল্প ছিল না?

এম শামসুল আলম: বিকল্প তো ছিলই। আইনের চোখে অন্যায় ও অযৌক্তিক ব্যয়বৃদ্ধি প্রতিরোধ করলেই হতো। সরকার সেই পথে হাঁটেনি। যখন-তখন বিদ্যুতের দাম বাড়ানো ভোক্তার ওপর জুলুমের শামিল। দ্বিতীয়ত, বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর সময় তারা ভোক্তাদের জিজ্ঞেস করেনি। বিইআরসি বা বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি আইন তো বহাল আছে। গণশুনানির মাধ্যমে দাম বাড়ালে জনগণ জানতে পারত সরকার কোন খাতে কী খরচ করেছে, কেন সরকারকে ভর্তুকি দিতে হচ্ছে।

বাংলাদেশে ভোক্তার অধিকার সংরক্ষণে তিনটি আইন আছে—ভোক্তা অধিকার আইন, প্রতিযোগিতা আইন এবং বিইআরসি আইন, এগুলো সরকারেরই করা। তারাই আবার ভোক্তার জ্বালানি অধিকার খর্ব করে। ভোক্তার ওপর জবরদস্তিমূলক মূল্যহার বৃদ্ধির কোনো সিদ্ধান্ত জনগণের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার সুযোগ নেই। অথচ আমরা সেটাই দেখছি।

প্রথম আলো:

বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ ২৯ ফেব্রুয়ারি ঘোষণা দিলেন ১ ফেব্রুয়ারি থেকে বিদ্যুতের বর্ধিত দাম দিতে হবে। সরকার কি এই ভূতাপেক্ষ সিদ্ধান্ত নিতে পারে?

এম শামসুল আলম: সরকার এটি করতে পারে না। ভোক্তার সঙ্গে সরকারের যে চুক্তি, তা এখানে লঙ্ঘন করা হয়েছে। আর সরকার ভূতাপেক্ষ দাম বাড়াতে পারলে ভোক্তাদের কাছ থেকে অতীতে জ্বালানি তেলের যে বেশি দাম নেওয়া হয়েছে, সেটাও ফেরত দিতে হবে। জনগণের করের অর্থে পরিচালিত পেট্রোবাংলা বা বিপিসি তাদের আইনমতে মুনাফা করতে পারে না। অথচ তারা সেটা করেছে।

সরকার জনগণের স্বার্থ উপেক্ষা করে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে যে বাণিজ্যিক উন্নয়ন কৌশল নিয়েছে, তা গ্রহণযোগ্য নয়। তা ছাড়া সে উন্নয়নে বিনিয়োগ প্রতিযোগিতামূলক হতে হবে। মূল্যহার নির্ধারণ করতে হবে ভোক্তার কথা শুনে। ভোক্তাকে মতামত দেওয়ার সুযোগ দিতে হবে। আইন করে বা অন্য কোনোভাবে এসব কোনোভাবেই রহিত করা যায় না। অথচ ভোক্তারা সেই অবস্থার শিকার।

প্রথম আলো:

মন্ত্রী বলেছেন, বিদ্যুতের দাম বাড়ানোয় জনজীবনে কোনো প্রভাব পড়বে না। 

এম শামসুল আলম: এটা একেবারেই ঠিক নয়। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাব পড়বে। বিদ্যুতের বিল কত বৃদ্ধি হলো সেটি যতটা গুরুত্বপূর্ণ, তার থেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো, এই বৃদ্ধি প্রতিটি পণ্য ও সেবার মূল্যবৃদ্ধি করবে। তাতে ভোক্তার জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়বে। ভোগব্যয় কমিয়ে দেওয়ার কারণে পণ্যসেবা কেনাবেচা কমবে। ফলে ট্যাক্স, ভ্যাট, শুল্ক ইত্যাদি বাবদ সরকারের রাজস্ব আদায় কমবে। তাতে সরকারের বাজেট ঘাটতি বাড়বে। সে হিসাব বিদ্যুৎ বিভাগের কাছে নেই।

প্রথম আলো:

সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে দাম বাড়ানোর পরও ভর্তুকি দিতে হবে। ভবিষ্যতে বাজার দামেই বিদ্যুৎ, গ্যাস ও জ্বালানি তেল কিনতে হবে।

এম শামসুল আলম: তাহলে সরকার গণশুনানি করল না কেন? ভোক্তারা তো বলেননি যে তাঁদের ভর্তুকি দিতে হবে। স্বাধীন সংস্থা দিয়ে হিসাব করতে হবে কোথায় কত টাকা অন্যায় ও অযৌক্তিকভাবে সরকার যদি দুর্নীতি ও অপচয় করে কিংবা কাউকে অন্যায্য বাণিজ্যিক সুবিধা পাইয়ে দিতে বেশি খরচ করে, তার দায় ভোক্তারা নেবেন কেন?

গণশুনানি এমন একটি প্রক্রিয়া, যেখানে মানুষ সরকারের নীতি–পরিকল্পনা ও কার্যক্রম নিয়ে প্রশ্ন করতে পারত। ২০২২ সালে বিইআরসি আইন সংশোধন করে মন্ত্রণালয় বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দাম নির্ধারণের ক্ষমতা নিজের হাতে নিয়েছে। সংশোধন মানে বিইআরসি আইনটি বাতিল হয়ে যায়নি। গণশুনানিও রহিত হয়নি। বিইআরসি আইনমতে প্রবিধান দ্বারা নির্ধারিত পদ্ধতিমতে মূল্যহার নির্ধারণের বিধানও রদ হয়নি। ফলে কথিত ভর্তুকি কৃত্রিম। ন্যায্য ও যৌক্তিক নয়।

প্রথম আলো:

জ্বালানি খাতে ভোক্তার জ্বালানি অধিকার কতটা সুরক্ষিত?

এম শামসুল আলম: জনগণের যে জ্বালানি সুবিচার বা এনার্জি জাস্টিস পাওয়ার কথা, সেটা থেকে তারা বঞ্চিত। এটা চলতে পারে না। যেসব আইনের আওতায় ভোক্তার জ্বালানি অধিকার খর্ব করা হয়েছে, সরকার সেটা উপেক্ষা করতে পারে না। অথচ বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সরবরাহ আইন ২০১০ দ্রুত বলবৎ এবং বিইআরসি আইন ২০০৩ পরিবর্তন করে ভোক্তার অধিকার করল। ভোক্তা জ্বালানি সুবিচার থেকে বঞ্চিত হলো। সামাজিক মূল্যবোধ ও ন্যায়বিচার ধ্বংস হলে তো রাষ্ট্র ও সমাজ থাকে না।

প্রথম আলো:

জ্বালানি খাতে এই পরিস্থিতি তৈরি হলো কেন?

এম শামসুল আলম: জ্বালানি খাতে ভয়াবহ লুণ্ঠনের সুযোগ সৃষ্টি করা হয়েছে। ২০১০ সালে সরকার রেন্টাল ও কুইক রেন্টালের নামে বেসরকারি খাতে বিদ্যুৎ উৎপাদনের সুযোগ করে দিল। বেসরকারি খাতে সুযোগ মানে উন্মুক্ত প্রতিযোগিতা। কিন্তু সেটি না করে সরকার গোষ্ঠীবিশেষকে প্রতিযোগিতাহীন বিনিয়োগের সুযোগ করে দিয়েছে। তারা ইচ্ছেমতো দাম বাড়িয়েছে।

ক্যাপাসিটি চার্জের নামে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। প্রথমে আইনটি করা হয়েছিল দুই বছরের জন্য। সর্বশেষ পাঁচ বছর মেয়াদ বাড়ানো হলো। এখন শোনা যাচ্ছে ২০২৬ সাল পর্যন্ত এটি চলবে। আইনটি নিয়ে আদালতে যাতে কোনো প্রশ্ন করা না যায়, সে জন্য দায়মুক্তিও দেওয়া হয়েছে। কাউকে দায়মুক্তি দেওয়ার অর্থ, এর পেছনে রহস্য আছে।

প্রথম আলো:

জ্বালানি খাতে বর্তমানে যে সংকট চলছে, তা থেকে উত্তরণের উপায় কী?

এম শামসুল আলম: প্রথম প্রশ্ন হলো, জ্বালানি খাতকে আমরা কী দৃষ্টিতে দেখব। যদি সরকার এটিকে বাণিজ্যিক দৃষ্টিতে দেখে, তাতে মুষ্টিমেয় কিছু লোক লাভবান হবে। আর যদি এটি সেবা খাত হিসেবে দেখে, তাহলে জনগণ লাভবান হবে, তাদের জীবনমানও বাড়বে। অর্থনীতি সচল হবে। জ্বালানি হলো অর্থনীতির চালিকা শক্তি।

তাই বিদ্যুৎ, জ্বালানি তেল বা গ্যাসের দাম বাড়ানোর আগে সরকারের উচিত ছিল এর প্রভাব-প্রতিক্রিয়ার কথা ভাবা। সরকার এমন এক সময়ে বিদ্যুতের দাম বাড়াল, যখন নিত্যপ্রয়োজনীয় প্রায় প্রতিটি পণ্যের দাম চড়া। কিন্তু মানুষের আয় তো বাড়েনি। এখন বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির কারণে কৃষি ও শিল্পপণ্যের দাম বাড়বে। পরিবহন ব্যয় বাড়বে। বিদেশিদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা কঠিন হবে।

সত্তরের দশকে যেখানে সাড়ে সাত কোটি মানুষের খাদ্য জোগানো যেত না, সেখানে আমরা এখন অনেকটা খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। এটি কীভাবে হয়েছে? সরকারের কৃষি সহায়ক নীতির কারণে। সরকার সার, বীজ ও সেচে ভর্তুকি দিয়েছে। জ্বালানি খাতে ভর্তুকির চেয়েও জরুরি হলো সহায়ক নীতি এবং তার যথাযথ বাস্তবায়ন।

প্রথম আলো:

২০১৬ সালে জ্বালানি খাতের উন্নয়নে সরকার যে মহাপরিকল্পনা নিল, সেটা কতটা জনবান্ধব বলে মনে করেন?

এম শামসুল আলম: ১৯৯৬–এর জ্বালানি নীতি, ২০১০–এর পরিপ্রেক্ষিত পরিকল্পনা কিংবা ২০১৬ এর মাস্টারপ্ল্যানে কিন্তু প্রতিযোগিতা ও স্বল্প খরচের বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সরবরাহের কথা বলা হয়েছিল। আন্তর্জাতিক বাজারে যখন জ্বালানির দাম কম ছিল, সরকার তেল আমদানি করে ভোক্তাদের কাছ থেকে বেশি দাম নিয়েছে। মুনাফা করেছে। বিদ্যুৎ ও জ্বালানির মূল্য স্থিতিশীল রাখার জন্য তহবিল গঠনের কথা বলেছিলাম। অনেক আগেই দেশীয় গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনের ওপর জোর দিয়েছিলাম। কিন্তু সরকার আমাদের কোনো কথা আমলে নেয়নি। এখন নড়েচড়ে বসেছে। এর ফল কী হবে, যদি বাণিজ্যিক বিবেচনায় এ খাত উন্নয়নের নীতি থেকে সরকার সরে না আসে? 

প্রথম আলো:

বিইআরসি কি সরকারের সিদ্ধান্তের বাইরে যেতে পারবে? গণশুনানি করেও তো সরকার ইচ্ছেমতো বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে দিতে পারে।

এম শামসুল আলম: অতীতে এলপিজির ক্ষেত্রে গণশুনানি হয়নি। আদালতের নির্দেশে এখন গণশুনানি হয়। আমরা বলেছি, শুধু এলপিজি নয়, সব পেট্রোলিয়াম পণ্যের মূল্য নির্ধারণের ক্ষেত্রে বিইআরসির মাধ্যমে গণশুনানি করতে হবে। আমরা যুক্তি দিয়েছিলাম, তেলের দাম পাঁচ বছর ধরে কম ছিল, তখন সমন্বয় করা হয়নি। এখন সমন্বয়ের কথা বলা হচ্ছে কেন? বিভিন্ন মহলের দাবির মুখে তখন সরকার ডিজেলের দাম লিটারপ্রতি তিন টাকা কমিয়েছিল।

সরকার একটি তহবিল করুক, যেটা হবে প্রাইজ স্টাবিলাইজেশন ফান্ড, যদি তেলের দাম বেড়ে যায়, সেখান থেকে টাকা নিয়ে ঘাটতি সমন্বয় করা হবে। ভোক্তাদের ওপর মূল্যবৃদ্ধির চাপ পড়বে না। বিইআরসি সরকারের সরকারের সিদ্ধান্তের বাইরে যায়নি। তবে গণশুনানির কারণে বিইআরসি ও সরকার উভয়ই চাপে ছিল। আদালতেও জবাবদিহির সম্মুখীন হয়েছিল। এভাবে সরকার ও রাষ্ট্রের শাসন বিভাগ রেগুলেটরি কালচারে অভ্যস্ত হয়।

প্রথম আলো:

একদিকে বিদ্যুতের লোডশেডিং হচ্ছে, অন্যদিকে দফায় দফায় দাম বাড়ানো হচ্ছে?

এম শামসুল আলম: বিদ্যুৎ খাত উন্নয়নের প্রধান বাধা সরকারের নীতি-পরিকল্পনায় বড় ধরনের বিভ্রান্তি। সরকার ভোক্তার স্বার্থ না দেখে প্রতিযোগিতাবিহীন বিনিয়োগে উন্নয়ন করে এবং গণশুনানি ছাড়া মূল্যহার বৃদ্ধি দ্বারা ব্যবসায়িক স্বার্থকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে। এ কারণেই আর্থিক ও বিদ্যুৎ উভয়সংকটই তৈরি হয়েছে।

প্রথম আলো:

কিন্তু সরকার তো বিদ্যুৎ খাতে ব্যাপক উন্নয়ন হচ্ছে বলে দাবি করছে?

এম শামসুল আলম: প্রকৃত অর্থে বিদ্যুৎ খাতের উন্নয়ন হয়নি। বরং বড় ধরনের বিপর্যয়ের মধ্যে পড়েছে। বিদ্যুৎ সরবরাহে ব্যয় বাড়ানো হয়েছে অন্যায় ও অযৌক্তিকভাবে। ভর্তুকি কমানোর জন্য বিদ্যুৎ উৎপাদনও এখন কম করা হয়। বাস্তবে দেখা যায়, সক্ষমতা উন্নয়নে মান রক্ষা না হওয়ায় চাহিদার তুলনায় উৎপাদন, সঞ্চালন ও বিতরণের ক্ষমতা পর্যাপ্ত থাকা সত্ত্বেও বিদ্যুৎ-বিভ্রাট চলছে। এতে শিল্পকারখানায় উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে।

গ্যাস–সংকটের কারণে কম দামে সরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদন কমানো হয়েছে। অথচ সেই গ্যাস ব্যক্তি খাতের বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে দিয়ে সেখান থেকে বেশি দামে বিদ্যুৎ কেনা হয়েছে। নিজস্ব গ্যাস ও কয়লা সাশ্রয়ী মূল্যে উত্তোলন ও ব্যবহারের দিকে গুরুত্ব না দিয়ে আমদানি করা কয়লা, এলএনজি ও তেলভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। সবকিছু মিলিয়ে কৌশলে বিদ্যুৎ খাতের এমন সব উন্নয়ন হয়েছে, যা ভোক্তা বা গণবান্ধব নয়। লুণ্ঠনমূলক ব্যয়বান্ধব।

প্রথম আলো:

রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়ে অনেক বিতর্ক হয়েছে। এগুলো কবে অবসায়ন হচ্ছে?

এম শামসুল আলম: বিদ্যুৎ-সংকটের দোহাই দিয়ে সরকার অনেক ব্যক্তিমালিকানাধীন কোম্পানিকে প্রতিযোগিতাহীন বিনিয়োগে ওইভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদনের সুযোগ দিয়েছিল। রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের ধারণাটি ছিল জাতীয় স্বার্থপরিপন্থী। কোম্পানিগুলো থেকে সরকার উৎপাদন ব্যয়ের চেয়ে অনেক বেশি দামে বিদ্যুৎ কিনেছে। ১০ শতাংশ হারে সার্ভিস চার্জ দিয়ে তাদের তেল আমদানির সুযোগ করে দিয়েছে, বিদ্যুৎ ব্যবসার পাশাপাশি তেলের ব্যবসাও দিয়েছে। তা ছাড়া উৎপাদন করুক বা না করুক, ভোক্তাকে ভাড়া গুনতে হচ্ছে। এখনো এই ব্যবস্থা কেন বিদ্যমান? এ প্রশ্নের ন্যায্য ও যৌক্তিক কোনো জবাব নেই। 

প্রথম আলো:

সরকার বলছে, দাম না বাড়ালে ভর্তুকির পরিমাণ আরও বেড়ে যাবে।

এম শামসুল আলম: আমরা গবেষণায় দেখিয়েছি, বিদ্যুতের দাম বাড়ানো নয়; কমানো যায়। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতকে আর্থিক ও কারিগরি দিক থেকে স্বনির্ভর করা যায়। বিশ্ববাজারে তেলের দাম কমছে। বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর কারণ দেখি না। জ্বালানিসংক্রান্ত বিভিন্ন সংস্থায় যত টাকা মজুত আছে, সেটাসহ গ্যাস ও বিদ্যুৎ উন্নয়ন তহবিল এবং জ্বালানি নিরাপত্তা তহবিলের অর্থে এ খাতে আর্থিক ও কারিগরি সক্ষমতা অনায়াসেই অর্জিত হতে পারে।

আমরা বলেছি, দুর্নীতি ও অপচয়ের কারণেই মানুষ সঠিক দামে, সঠিক মাপে ও সঠিক মানে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি পাওয়ার অধিকার থেকে বঞ্চিত। এ অধিকার সুরক্ষা নিশ্চিত না হলে ভর্তুকি বাড়তেই থাকবে। মূল্যবৃদ্ধি ও লোডশেডিং বৃদ্ধি দ্বারা তা নিয়ন্ত্রণে আনা যাবে না। এখানেই সরকার বিভ্রান্তির শিকার। 

প্রথম আলো:

এ সমস্যা থেকে উত্তরণের উপায় কী?

এম শামসুল আলম: স্বাধীনতার পর পেট্রোবাংলা করা হয়েছিল জ্বালানি খাতকে স্বনির্ভর করতে। কিন্তু পূর্বাপর সরকার সেটিকে পরনির্ভরশীল করে ফেলেছে। জ্বালানি বা বিদ্যুৎ খাত কীভাবে চলবে, সেই সিদ্ধান্ত আমলারা নিলে চলবে না। বিইআরসি (বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন) অংশীজনের সঙ্গে কথা বলুক। বিদ্যুৎ বিভাগেরও কথা শুনুক। দেশের সম্পদ কীভাবে রক্ষা করা যাবে, কীভাবে মানুষের কাছে বিদ্যুৎ সহজলভ্য হবে, সেটা ভাবতে হবে। আমরা আগেও বলেছি, বাইরের কারও পরামর্শে জ্বালানি খাত চললে দেশের সর্বনাশ হবে। জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করার স্বার্থে সরকারকে ব্যবসার চিন্তা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। 

প্রথম আলো:

সারা বিশ্ব এখন নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ উৎপাদনের দিকে ঝুঁকছে। এ ক্ষেত্রে তো আমরা পিছিয়ে আছি?

এম শামসুল আলম: এখানেও সরকারের ভুল নীতি। ইতালির মতো অনেক দেশ রুফটপ ব্যবহার করে সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদন করছে। শহরের ভবনগুলোর সিংহভাগ বিদ্যুৎ চাহিদা এই বিদ্যুতেই মেটানোর পরিকল্পনা নিয়েছে। আমরা খরচ বেশির দোহাই দিয়ে সৌরবিদ্যুৎ উন্নয়নে আগ্রহ দেখাচ্ছি না। আবার গ্রিড সৌরবিদ্যুতের সীমাবদ্ধতাও বিবেচনায় নেই। বায়ু ও সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় কমানোর গবেষণা নেই। স্থানীয়ভাবে সৌরবিদ্যুতের উৎপাদন ও সরবরাহ সম্ভব। কিন্তু আমরা সব গ্রাহককে জাতীয় গ্রিডে আনার ব্যয়বহুল ভুল পথ নিয়েছি এবং বিদ্যুৎ–বঞ্চিত করেছি। জাতীয় গ্রিডের মাধ্যমে বিদ্যুৎ সরবরাহ করলে অর্থ চুরি ও তছরুপ বেশি করা যায়। আমরা তেলভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন ৩০ শতাংশ বাড়িয়েছি। ভর্তুকি দিচ্ছি। অথচ সে ভর্তুকি প্রত্যাহার চলছে। এর দায়ভার জনগণের। 

প্রথম আলো:

গ্যাস খাতের উন্নয়নে সরকার কী করেছে?

এম শামসুল আলম: গ্যাসক্ষেত্রের উন্নয়নে কোটি কোটি টাকা খরচ করা হয়েছে। এ টাকার জোগান দিয়েছে জনগণ। অথচ গ্যাসক্ষেত্রের গ্যাস সরবরাহের সক্ষমতা বাড়ানো হয়নি। গ্যাসক্ষেত্র অনুসন্ধান করেছে বাপেক্স। কিন্তু গ্যাস উত্তোলন করা হয়েছে বিদেশি কোম্পানি দিয়ে। ভোলার গ্যাসক্ষেত্রে অনুসন্ধান করল বাপেক্স। কিন্তু কাজ দেওয়া হলো রাশিয়ান কোম্পানিকে। ভোলায় গ্যাস পর্যাপ্ত। বাপেক্স উত্তোলন করলে দাম কম পড়ত। বিদেশিরা উত্তোলন করায় বেশি পড়ছে। মডেল পিএসসিতে বিদেশি কোম্পানির সাগরের গ্যাস ক্রয়মূল্য যেভাবে বৃদ্ধি করা হচ্ছে, তাতে একসময় বলা হবে গ্যাস তুলে লাভ নেই। আমদানি করাই ভালো। তাতে ভোক্তার ব্যয় কম হবে। ভোলার গ্যাস দিয়ে খুলনাসহ গোটা দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের চাহিদা মেটানো যেত। তেলভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে হতো না। খুলনার ডুয়েল ফুয়েল বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো গ্যাস বা ডিজেল কোনো ফুয়েলই পায় না। বিদ্যুৎ উৎপাদন করে না অথচ উৎপাদন ব্যয় বাড়ায়।

প্রথম আলো:

সরকার জ্বালানির দাম সমন্বয়ের কথা বলছে। জ্বালানি তেলের দাম কমল নামমাত্র। আপনি এটাকে কীভাবে দেখছেন?

এম শামসুল আলম: অকটেন ও পেট্রলের দাম যতটুকু কমানো হয়েছে, তাতে বিত্তবানেরা হয়তো কিছুটা লাভবান হবেন। তাঁদের জ্বালানি ব্যয় কিছুটা হলেও সাশ্রয় হবে। ডিজেলের দাম যতটুকু কমানো হয়েছে, তাতে পরিবহন ভাড়া, কৃষিপণ্যের উৎপাদন ব্যয়, ডিজেলভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় ইত্যাদি কমবে বলে মনে হয় না। জ্বালানি তেলের মূল্যহার অন্যায় ও অযৌক্তিক তথা লুণ্ঠনমূলক ব্যয়মুক্ত না করে, গণশুনানি ছাড়া নির্বাহী আদেশে এ দাম কমানো এর আগে গণশুনানি ছাড়া নির্বাহী আদেশে জ্বালানি তেলের যে লুণ্ঠনমূলক ব্যয়বৃদ্ধি করা হয়েছে, তা সুরক্ষার শামিল। 

প্রথম আলো: আপনাকে ধন্যবাদ।

এম শামসুল আলম: আপনাকেও ধন্যবাদ।