আপনার বই নিয়েই আলোচনা শুরু করি। প্রথমা থেকে প্রকাশিত আপনার বইয়ের নাম ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান: নতুন পথে বাংলাদেশ। আসলেই বাংলাদেশ নতুন পথ খুঁজে পেয়েছে কি?
আল মাসুদ হাসানউজ্জামান: ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানটি শুরু হয়েছিল সরকারি চাকরিতে কোটাব্যবস্থার প্রতিবাদে। পরবর্তী সময়ে আন্দোলনটি কর্তৃত্ববাদী ও স্বৈরাচারবিরোধী শাসনের বিরুদ্ধে গণবিস্ফোরণে রূপ নেয়। এটি বাংলাদেশের একটি সন্ধিক্ষণ বলা যায়। এর মাধ্যমে রাজনীতির পথযাত্রা মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে। দীর্ঘদিনের স্বৈরশাসনের অবসান হয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকার রাষ্ট্র সংস্কারে অনেকগুলো কমিশন গঠন করে। বেশির ভাগ কমিশন রিপোর্ট জমা দিয়েছে এবং জাতীয় ঐকমত্য কমিশন রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপও শুরু করেছে। এর মাধ্যমে দেশবাসী রাজনৈতিক দলগুলোর মনোভাব জানতে পারবে। তারা কতটা সংস্কার চায়, কত দ্রুত নির্বাচন চায়।
প্রধান উপদেষ্টা তাঁর ভাষণে বলেছেন সরকারের প্রথম পর্ব বা ইনিংস শেষ হয়েছে। দ্বিতীয় পর্ব শুরু হলো। সরকারের গত ছয় মাসের কার্যক্রমকে কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন? তারা কতটা সফল বা ব্যর্থ?
আল মাসুদ হাসানউজ্জামান: অন্তর্বর্তী সরকার এসেছে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মাধ্যমে। সে ক্ষেত্রে তারা জনগণের ব্যাপক সমর্থন পেয়েছে। আবার আদালতের কাছে যে পরামর্শ চাওয়া হয়েছিল, তাঁরাও সম্মতি দিয়েছেন। এক অর্থে বলা যায়, এটি অভূতপূর্ব ঘটনা। তবে জনগণের আকাঙ্ক্ষা ছিল প্রশাসনিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে বিরাট পরিবর্তন আসবে, সেটা হয়তো হয়নি। ছয় মাসে সম্ভবও নয়। অনেক ক্ষেত্রে সরকারের সাফল্য যেমন আছে, তেমনি ব্যর্থতাও আছে। আমি বলব, সরকার জনসমর্থনকে পুঁজি করে আরও সাহসী পদক্ষেপ নিতে পারত।
একজন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী হিসেবে আপনার কাছে জানতে চাই, গত ছয় মাসে রাষ্ট্রকাঠামোয় মৌলিক কোনো পরিবর্তন লক্ষ করেছেন কি?
আল মাসুদ হাসানউজ্জামান: পুরোনো কাঠামোর মধ্যে সরকার যেহেতু কাজ করছে, সেহেতু মৌলিক পরিবর্তন দেখতে পাইনি। জনপ্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কিংবা অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে বড় ধরনের পরিবর্তন হয়নি। কিছু রদবদল হয়েছে।
পরিবর্তন বলতে আপনি কী বোঝাতে চাইছেন? অনেকে বলেন, এটা বিপ্লব ছিল না, ছিল গণ-অভ্যুত্থান। সে ক্ষেত্রে বিকল্প কোনো পথ ছিল কি?
আল মাসুদ হাসানউজ্জামান: যখন বিষয়টি আলোচনায় এসেছে, তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। একটি বিপ্লবী ধরনের সরকার হলে হয়তো সংবিধানকে পাশ কাটিয়ে অনেক কিছু করা যেত। কিন্তু সংবিধানের অধীনে সরকার গঠিত হওয়ায় সেই সুযোগ থাকল না। প্রধান উপদেষ্টা নিজেই স্বীকার করেছেন, উপদেষ্টা পরিষদে রাষ্ট্রশাসনের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন মানুষ বেশি নেই। পুরোনো যে কাঠামো রয়ে গেছে, তাতে সাহসী পদক্ষেপ ছাড়া রাষ্ট্রের আমূল পরিবর্তন করা সম্ভব নয়। অর্থাৎ জনগণের প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির মধ্যে ফাঁক রয়ে গেছে।
রাষ্ট্র সংস্কারে সরকার অনেকগুলো কমিশন গঠন করেছে। এগুলো নিয়ে কিছু বিতর্কও হচ্ছে। কমিশন গঠনপ্রক্রিয়াটি যথার্থ ছিল বলে মনে করেন?
আল মাসুদ হাসানউজ্জামান: সরকার অংশীজনদের সঙ্গে খুব একটা আলোচনা করেনি। প্রথমে সংবিধান সংস্কার কমিশনে যাঁকে প্রধান করা হয়েছিল, তিনি থাকলেন না। নতুন একজনকে নিয়ে আসা হলো। তারপরও বলব, যাঁরা বিভিন্ন কমিশনে এসেছেন, তাঁরা যোগ্য ব্যক্তি। তাঁরা যেসব সুপারিশ করেছেন, তা সুচিন্তিত। অন্তর্দৃষ্টির ছাপ আছে।
প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সূচনা বৈঠকে বলেছেন, যাত্রাটা শুরু হলো, কিন্তু এটা কত দিন চলা উচিত বলে মনে করেন?
আল মাসুদ হাসানউজ্জামান: প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্যে সামনে চলার ইঙ্গিত আছে। প্রথমে জুলাই ঘোষণাপত্রের মাধ্যমে আগামী দিনের রূপরেখা তৈরি হবে ধারণা করি। কোন কোন বিষয়ে সহমত আছে, কোন কোন বিষয়ে দ্বিমত আছে, সেগুলোও ধারাবাহিক সংলাপে উঠে আসবে আশা করা যায়। আমি মনে করি, রাজনৈতিক দলগুলোর পাশাপাশি নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গেও আলোচনা হওয়া প্রয়োজন। এত দিন নাগরিক সমাজ বিভক্ত ছিল বলে তারা কাঙ্ক্ষিত ভূমিকা পালন করতে পারেনি। সংস্কার নিয়ে কিছু মতামতও তাদের কাছ থেকে এসেছে। এটা ইতিবাচক। নাগরিকদের মধ্যে অনেকেরই এসব বিষয়ে গভীর জ্ঞান ও চিন্তাভাবনা আছে। ফলে সংস্কারপ্রক্রিয়ায় তাদেরও অবদান রাখার সুযোগ আছে।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের মেয়াদ রাখা হয়েছে ছয় মাস। এর মধ্যে সংলাপ শেষ হবে বলে মনে করেন? যেখানে রাজনৈতিক দলগুলো প্রায় সব বিষয়ে ভিন্নমত পোষণ করে?
আল মাসুদ হাসানউজ্জামান: আমি মনে করি, এর মধ্যেই শেষ করা উচিত। এ ক্ষেত্রে সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোর সদিচ্ছা-আন্তরিকতা খুবই প্রয়োজন। তবে এ কথাও বলতে হবে, ৫ আগস্টের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের সময় রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যে ঐক্য লক্ষ করেছি, সেই ঐক্যটা এখন ধরে রাখা যাচ্ছে না। স্বার্থের দ্বন্দ্ব বড় হয়ে উঠেছে। গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে একটি ইতিবাচক পরিবর্তনও লক্ষ করছি। এত দিন আমাদের রাজনীতিতে দ্বিদলীয় ব্যবস্থা ছিল—আওয়ামী লীগ ও বিএনপি। এখন আর সেটি নেই। আওয়ামী লীগ যেহেতু মাঠে নেই, সেহেতু বিএনপিই আন্দোলনের প্রধান সুবিধাভোগী হবে বলে অনেকের ধারণা। অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামীও নিজেকে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবে। ছাত্ররা নতুন দল গড়ছে, তারাও একটা বড় শক্তি। সব দলই আগামী নির্বাচনে নিজেদের শক্তি দেখাতে চাইবে। ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানের পর মানুষের মনোজগতে যে একটা পরিবর্তন এসেছে, রাজনৈতিক দলগুলোকে সেটা উপলব্ধি করতে হবে। তাদের নীতি-পরিকল্পনায় পরিবর্তনটা ধারণ করতে হবে। বুঝতে হবে যেনতেনভাবে একটা নির্বাচনই শেষ কথা নয়। অতএব, রাজনৈতিক দলগুলোকে সংস্কারের জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। সংস্কারের লক্ষ্যে বিএনপি, জামায়াত ও অন্যান্য দল কিছু কিছু প্রস্তাবও দিয়েছে।
রাজনৈতিক দলগুলো সংস্কারের জন্য কতটা প্রস্তুত বলে মনে করেন?
আল মাসুদ হাসানউজ্জামান: রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্রচর্চায় ব্যাপক ঘাটতি আছে। তৃণমূল থেকে কেন্দ্রীয় পর্যায় পর্যন্ত নির্বাচনের মাধ্যমে নেতৃত্ব তৈরি হতে তো দেখছি না। বরং ওপর থেকে নিচে চাপিয়ে দেওয়া নীতিই চলছে। নির্বাচনী ব্যয়সহ অনেক বিষয়ে অস্বচ্ছতা আছে। নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশন কিছু কিছু সুপারিশ করেছে। তারাও রাজনৈতিক দলগুলোর মনোজগতের পরিবর্তন আশা করছে। অতীতে ভোটের মাঠে বিএনপি ও আওয়ামী লীগের জনসমর্থন কাছাকাছি লক্ষ করা গেছে। জামায়াতের সেই সমর্থনের জন্য প্র্যাগম্যাটিক হতে হবে। তদুপরি ক্যাডারতান্ত্রিক এই দলটি বৃহত্তর জনগণের সমর্থন পেতে চাইলে নতুন করে ভাবতে হবে।
সংবিধান সংস্কার প্রসঙ্গে এবার আসি প্রধানমন্ত্রীর একচ্ছত্র ক্ষমতার বিষয়ে। অনেকে বলেন, ১৯৭২ সালের সংবিধানেই এর বীজ রোপিত ছিল।
আল মাসুদ হাসানউজ্জামান: বাহাত্তরে সংবিধান প্রণয়নের পর যেসব সংশোধনী আনা হয়েছিল—যেমন জরুরি আইন, নিবর্তনমূলক আইন জারি—এসব প্রধানমন্ত্রীকে আরও বেশি ক্ষমতাবান করেছে। পরবর্তী সময়ে যাঁরা ক্ষমতায় এসেছেন, তাঁরা কেউই সেটি পরিবর্তন করেননি। ফলে বাহাত্তরের সংবিধানকে এককভাবে দায়ী করা ঠিক হবে না। আমাদের দেশে একই ব্যক্তি যখন সংসদ নেতা, প্রধানমন্ত্রী ও দলীয় প্রধান হন, তখন তো তাঁর ক্ষমতার কোনো সীমা থাকে না। আবার আমাদের সমাজে পারসোনালিটি কাল্ট বা ব্যক্তিপূজার চল আছে, সেটাও প্রধানমন্ত্রীকে মহাক্ষমতাবান করেছে। নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থানের পর সংসদীয় শাসনব্যবস্থা চালু হয়। সেখানে রুলস অব বিজনেসে রাষ্ট্রপতির যে ক্ষমতা ছিল, পুরোটা প্রধানমন্ত্রীর হাতে ন্যস্ত করা হয়। এ ছাড়া কর্তৃত্ববাদী শাসনে একজন ব্যক্তিই যে সব ক্ষমতার উৎস হন, সেটা আমরা গত ১৫ বছরে কিংবা তারও আগে থেকে দেখে এসেছি।
সংবিধান সংস্কার কমিশন নিয়েই বেশি আলোচনা ও বিতর্ক হচ্ছে। আপনার মূল্যায়ন কী?
আল মাসুদ হাসানউজ্জামান: ধরে নেওয়া হচ্ছে সংসদীয় পদ্ধতিতে দেশ চলবে। এটা এমন পদ্ধতি, যেখানে রাষ্ট্রপতি পদটি আলংকারিক। সংস্কার প্রস্তাবে সংসদীয় পদ্ধতি রেখে রাষ্ট্রপতিকে ক্ষমতায়িত করার কথা বলা হয়েছে। প্রত্যক্ষ নির্বাচনের কথাও এসেছে। রাষ্ট্রপতিকে ক্ষমতায়িত করা হলে এটি আর সংসদীয় পদ্ধতি থাকবে না, হাইব্রিড পদ্ধতিতে রূপান্তরিত হবে। আমি মনে করি, এমন ব্যবস্থা করতে হবে, যাতে রাষ্ট্রপতি সংসদে গৃহীত কোনো আইনকে নাকচ করতে না পারেন। যুক্তরাষ্ট্রে যেমন আছে। অনেকে ভারতের সংসদীয় ব্যবস্থার উদাহরণ টানেন। ফেডারেল পদ্ধতি থাকায় সেখানে যিনিই রাষ্ট্রপতি হোন না কেন, নিরপেক্ষতা বজায় রাখেন। বাংলাদেশের সঙ্গে সেটা মিলবে না। কেননা এখানে প্রধানমন্ত্রী যাঁকে চান, তিনিই রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন।
৭০ অনুচ্ছেদ নিয়েও সংস্কার প্রস্তাবে কিছু সুপারিশ করা হয়েছে। এটা পুরোপুরি বাতিল করলে অসুবিধা কোথায়?
আল মাসুদ হাসানউজ্জামান: আমরা ৭০ অনুচ্ছেদ নিয়েছিলাম পাকিস্তানের অভিজ্ঞতা থেকে। সেখানে ১০ বছরে সাতবার সরকার পরিবর্তন হয়েছিল। সংসদ সদস্য বেচাকেনা বন্ধ করতে এটা চালু করা হয়। কিন্তু যেসব শর্ত জুড়ে দেওয়া হয়, তাতে সংসদ সদস্যের স্বাধীনতাকে মারাত্মকভাবে খর্ব করা হয়েছে। সংসদের মূল কাজ হলো আইন প্রণয়ন ও নির্বাহী বিভাগের তদারকি। বর্তমান ব্যবস্থায় সেই সুযোগ নেই। ৭০ অনুচ্ছেদের সঙ্গে দলীয় শৃঙ্খলার বিষয়টিও জড়িত। বর্তমান দলীয় কাঠামো রেখে ৭০ অনুচ্ছেদ শিথিল করলেও সংসদ সদস্যদের ক্ষমতা বাড়বে বলে মনে হয় না।
দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদের প্রস্তাব করা হয়েছে। সেখানে আনুপাতিক ভোটের কথা বলা হয়েছে। আবার আসনসংখ্যা বাড়ানোর কথাও আছে।
আল মাসুদ হাসানউজ্জামান: আমাদের ট্রায়াল অ্যান্ড এররের মাধ্যমেই এগোতে হবে। সংবিধান সংস্কার কমিশন যে আসন বাড়ানোর প্রস্তাব করেছে, এটা যৌক্তিক বলেই মনে করি। বাংলাদেশে যখন ৩০০ সংসদীয় আসন করা হয়েছিল, তখন জনসংখ্যা ছিল সাড়ে সাত কোটি। এখন ১৮ কোটি। নিম্নকক্ষে আমরা সর্বত্র দলীয় আধিপত্য লক্ষ করি। দ্বিকক্ষব্যবস্থা সে ক্ষেত্রে ভারসাম্য আনতে পারে। সেখানে আনুপাতিক আসনের কথা বলা হয়েছে। পুরোটা নয়। দলের মনোনয়নপ্রক্রিয়ায় পরিবর্তন আনতে হবে, যাতে অভিজ্ঞতাসম্পন্ন রাজনীতিকেরা আসতে পারেন।
অন্তর্বর্তী সরকার যেসব সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছে, এগুলো বাস্তবায়ন করা গেলে আমরা একটি ভালো নির্বাচন পাব আশা করি। কিন্তু কোনো ভালো নির্বাচন কার্যকর সংসদ ও গণতন্ত্রের নিশ্চয়তা দিতে পারবে কি? অতীতেও আমরা ভালো নির্বাচন দেখেছি—১৯৯১, ১৯৯৬, ২০০১ ও ২০০৮ সালে।
আল মাসুদ হাসানউজ্জামান: যদি প্রতিনিধিত্বের ক্ষেত্রে গুণগত পরিবর্তন আসে—যেমন নারী প্রতিনিধিত্ব, সমাজের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে অন্তর্ভুক্ত করা—তাহলে সংসদে গুণগত পরিবর্তন আসবে আশা করি। আমাদের খেয়াল রাখতে হবে, একচ্ছত্র সংখ্যাগরিষ্ঠতা গণতন্ত্রের ঝুঁকি তৈরি করে। এটা সরকারের জন্যও ভালো নয়। সংসদীয় ব্যবস্থা মানে হলো নির্বাহী বিভাগের ওপর কঠোর তদারকি। একচ্ছত্র সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলে সেটা থাকে না। সংসদীয় কমিটিকে কার্যকর করতে হলে সংসদে বিরোধী দলের গুরুত্ব ও ভূমিকা বাড়াতে হবে। গুরুত্বপূর্ণ কমিটির প্রধান করতে হবে বিরোধী দল থেকে। যেমন যুক্তরাজ্যে আছে।
আন্দোলনকারী ছাত্রদের নেতৃত্বে নতুন দল হতে যাচ্ছে। তাঁরা বলেছেন, এটা রাজনীতির নতুন বন্দোবস্ত। পুরোনো দলগুলো জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে পারছে না। আপনিও তা-ই মনে করেন কি না?
আল মাসুদ হাসানউজ্জামান: ঐতিহ্যবাহী যেসব দল আছে, সেগুলোর কার্যক্রম দেখলে তো একটা শূন্যতা আছে মনে হয়। সে ক্ষেত্রে তরুণদের দল হলে সেই ঘাটতি পূরণ করার প্রশ্নটি সামনে আসে। কিন্তু নতুন দল গঠনপ্রক্রিয়ায়ও তো অনেক সমস্যা দেখতে পাচ্ছি। নিজেদের মধ্যে বিরোধ আছে। নতুন দলের নেতৃত্ব, গঠনতন্ত্র, দলীয় অর্থায়ন, নারীর ও অন্যান্য গোষ্ঠীর অংশগ্রহণ কেমন হবে, এখনো স্পষ্ট নয়। বহুমাত্রিক রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষা ধারণ করতে না পারলে জনগণকে যে স্বপ্ন তারা দেখাচ্ছে, সেটা ফিকে হয়ে যাবে। নতুন দলকে তো শহরে সীমিত থাকলে হবে না, প্রত্যন্ত গ্রামেও যেতে হবে। দলে অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্রচর্চা নিশ্চিত করতে হবে। তাদের অনেক বেশি সহিষ্ণু হতে হবে। সম্পর্কটা হবে দ্বান্দ্বিক কিন্তু সাংঘর্ষিক নয়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে সেই সাংঘর্ষিক অবস্থা দেখা যাচ্ছে।
জুলাই-আগস্টের ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের অবসান হয়েছে। এটা যেমন ইতিবাচক, তেমনি রাষ্ট্র ও সমাজে একধরনের উগ্রপন্থার উত্থানও ঘটেছে। বিভিন্ন স্থানে ভাস্কর্য, মাজার, দরগাহ ইত্যাদি ভাঙা হচ্ছে। বাউলগান, মেয়েদের ফুটবল খেলা বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে। এটাকে কীভাবে দেখছেন?
আল মাসুদ হাসানউজ্জামান: আগে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে মৌলবাদী জঙ্গিবাদী ট্যাগ লাগানো হতো। এখন ভিন্ন রাজনৈতিক বয়ানে এসব করা হচ্ছে। তারপরও আমি বলব, বাংলাদেশ উদার ও সহনশীল গণতান্ত্রিক দেশ। এসব কাজ বৃহত্তর জনগণের সমর্থন পাবে না। এখানে যে কেউ তার মত প্রকাশ করতে পারবে, কিন্তু সেটি সংবিধানের ও গণতন্ত্রের চেতনার বাইরে গিয়ে কোনো মত চাপিয়ে দেওয়া যাবে না। চরমপন্থা কোনোভাবে কাম্য নয়।
আপনি বলেছিলেন, দীর্ঘদিন আমরা দ্বিদলীয় ব্যবস্থায় ছিলাম। আওয়ামী লীগ ও বিএনপিই পালাক্রমে দেশ শাসন করেছে। এখন তো আওয়ামী লীগ মাঠে নেই। ভবিষ্যতের রাজনৈতিক চেহারাটি কী দাঁড়াবে?
আল মাসুদ হাসানউজ্জামান: ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানের পর আওয়ামী লীগের প্রায় সব স্তরের নেতা-কর্মী মাঠছাড়া। অনেকে দেশত্যাগ করেছেন, অনেক কারাগারে বা আত্মগোপন অবস্থায় আছেন। এ অবস্থায় তো কোনো দল চলতে পারে না। এত বড় অভ্যুত্থান হলো, সে বিষয়ে তাদের কোনো বক্তব্য নেই। আওয়ামী লীগকে রাজনীতি করতে হলে ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানের সময়ে যে হত্যাকাণ্ড ঘটেছে, তার দায় স্বীকার করতে হবে। ছাত্রদের মধ্য থেকে চাপ আছে, আওয়ামী লীগ যেন নির্বাচনে না আসতে পারে। আবার আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বলছে, নির্বাচন অন্তর্ভুক্তিমূলক হতে হবে। বস্তুত আওয়ামী লীগের রাজনীতি এবং আগত নির্বাচনে সুযোগ তাদের বর্তমান প্রাসঙ্গিকতার সঙ্গে জড়িত। আওয়ামী লীগকে বাংলাদেশের নতুন বাস্তবতা মেনেই রাজনীতি করতে হবে। যাঁরা প্রকৃত অপরাধী আর এই জন্য যাঁদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে, তঁাদের সুষ্ঠু বিচার হতে হবে। এই দেশের দলীয় ব্যবস্থায় ও রাজনীতিতে সংকীর্ণ রাজনৈতিক সংস্কৃতির অবসান আর সহনশীলতা বিশেষভাবে কাম্য।
আপনাকে ধন্যবাদ।
আল মাসুদ হাসানউজ্জামান: আপনাকেও ধন্যবাদ।