উত্তরাধিকারসূত্রে একটা ভেঙে পড়া অর্থনীতি পায় অন্তর্বর্তী সরকার। সরকারের সাড়ে আট মাসে অর্থনৈতিক খাতে সংস্কারের প্রশ্নটিকে কতটা অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে বলে মনে করছেন? শ্বেতপত্র কমিটিই অভিযোগ করেছে, অর্থনৈতিক খাতের সংস্কারে সরকারের মনোযোগ কম।
সৈয়দ আখতার মাহমুদ: অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য সামষ্টিক অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা আনাটা জরুরি ছিল। আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বেশ কিছু সময় ধরে ক্রমে কমে যাচ্ছিল। রিজার্ভ যাতে না কমে এবং আস্তে আস্তে বাড়তে শুরু করে, সে ব্যবস্থা করার দরকার ছিল। বাংলাদেশ ব্যাংক সে ব্যবস্থাগুলো নিয়েছে। আমাদের মুদ্রাস্ফীতির হারও নিয়ন্ত্রণে আনার দরকার ছিল। বাংলাদেশ ব্যাংক মুদ্রানীতির মাধ্যমে, বিশেষ করে সুদের হার বাড়িয়ে সামগ্রিক চাহিদা কমিয়ে, মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করেছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের সরবরাহ বাড়ানোর চেষ্টাও সরকার করেছে।
এরই পরিপ্রেক্ষিতে ধরে নেওয়া যায়, আরেকটু মধ্যমেয়াদি বা দীর্ঘমেয়াদি যে সংস্কারগুলো করা দরকার ছিল, সেগুলোর প্রতি সরকারের মনোযোগ হয়তো একটু কম ছিল। কিন্তু এমনও হতে পারে যে ভেতরে–ভেতরে কাজ হচ্ছে, যেটা আমরা বাইরে থেকে জানি না। কয়েক দিন আগে অর্থ উপদেষ্টা একটি সাক্ষাৎকারে এ ধরনের ইঙ্গিত দিয়েছেন। ফলে শ্বেতপত্র কমিটি যে অভিযোগটি করেছে, সেটি হয়তো পুরোপুরি ঠিক নয়। তবে সরকারের উচিত ভেতরে–ভেতরে যে কাজটি তারা করছে, সেটা সবাইকে জানানো।
আপনার কাছে কি মনে হয়, সংস্কারের ব্যাপারে সরকার তার মেয়াদ নিয়ে দ্বিধার মধ্যে আছে?
সৈয়দ আখতার মাহমুদ: সরকারের কেউ কেউ মনে করতে পারেন, আমাদের মেয়াদ এক বছর বা তার কমও হতে পারে, তাই সংস্কার কর্মসূচি হাতে নেওয়া ঠিক হবে না, সংস্কারের কাজগুলো পরবর্তী নির্বাচিত সরকারের হাতে ছেড়ে দেওয়াই ভালো হবে। এ রকম ধারণা করাটা ঠিক হবে না। তার কারণ হলো, বিশ্ব দ্রুত বদলাচ্ছে এবং বিশ্ব অর্থনীতিতে অনেক ধরনের ব্যাঘাত সৃষ্টিকারী ঘটনাও ঘটছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প নতুন করে শুল্কের ঘোষণা দিয়েছেন, চীন তার প্রতিশোধে পাল্টা পদক্ষেপ নিয়েছে। বিশ্ব অর্থনীতিতে তো আগে থেকেই একটা অনিশ্চয়তা ছিল। প্রযুক্তির কারণেও বিশ্ব অর্থনীতি দ্রুত পরিবর্তন হচ্ছে। এর ওপরে পাল্টাপাল্টি শুল্কের কারণে নতুন অনিশ্চয়তা তৈরি হলো।
এই অনিশ্চয়তা কি কোনো কোনো ক্ষেত্রে আমাদের জন্য সুযোগ তৈরি করছে না?
সৈয়দ আখতার মাহমুদ: এসব অনিশ্চয়তার মধ্যে আমাদের জন্য যে সুযোগ আসছে না, সেটা নয়। শুল্কযুদ্ধের কারণে চীন থেকে হয়তো বিনিয়োগ অন্যান্য অনেক দেশে যাবে। সেটা আমাদের দেশেও আসতে পারে। সে কারণে সংস্কারের একটা জরুরি প্রয়োজনীয়তাও আছে। আমাদের যদি সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে হয়, আর ঝুঁকি যদি সামাল দিতে হয়—দুই ক্ষেত্রেই অর্থনৈতিক নীতিমালা ও বিধিবিধানে অনেক সংস্কার দরকার। আমরা সেটা আরও ৯ মাস বা এক বছর পিছিয়ে দিতে পারব না। এ ছাড়া ২০২৬ সালে আমরা এলডিসি থেকে বেরিয়ে যাব। সুতরাং, সংস্কারগুলোর সব কটি না হলেও অনেকগুলো এখনই শুরু করা দরকার।
একটা বিষয় হলো, কোনো সংস্কারই রাতারাতি করে ফেলা যায় না। কোনো একটা সংস্কার প্রস্তাব সরকারের মধ্যে প্রথমে অলোচিত হয়। একসময় সেটা সরকারের আনুষ্ঠানিক এজেন্ডায় স্থান পায়। তখন সরকার একটি কমিটি করে, অন্যান্য প্রক্রিয়া শুরু করে। তখন সংস্কার কাজটি কারা করবে, কী ধরনের রিসোর্স দরকার হবে—এর সবকিছুই ঠিক হয়। বিশ্বব্যাংকের এক কর্মকর্তা হিসেবে বিদেশেও অনেক সংস্কারপ্রক্রিয়ার সঙ্গে আমি জড়িত থেকেছি। অভিজ্ঞতা থেকে আমি দেখেছি, প্রথম ধাপের কাজটি মানে সংস্কার প্রস্তাব সরকারের আনুষ্ঠানিক এজেন্ডায় পরিণত করাটাই এবং কে কোন দায়িত্বে থাকবে, সেটা ঠিক করাটাই সংস্কারের ৫০ শতাংশ কাজ।
আমি মনে করি, অন্তর্বর্তী সরকার রাজনৈতিক সরকারের টানাপোড়েন থেকে অনেকটাই মুক্ত। সে কারণে সংস্কারের প্রাথমিক ধাপের কাজগুলো তাদের শুরু করা প্রয়োজন।
এ মাসেই ঢাকায় একটি বিনিয়োগ সম্মেলন হয়ে গেল। বিনিয়োগ সম্মেলন ঘিরে একটা বড় প্রত্যাশা তৈরি হয়েছে। সামগ্রিকভাবে আপনি কীভাবে এ সম্মেলনকে মূল্যায়ন করবেন?
সৈয়দ আখতার মাহমুদ: বিনিয়োগ সম্মেলন আমরা আগেও অনেক দেখেছি। আমাদের দেশেও হয়েছে, বাইরেও অনেক রোড শো করা হয়েছে। ইউরোপ, আমেরিকার বিভিন্ন শহরে প্রচুর সময় ব্যয় করে, প্রচুর টাকা ব্যয় করে এমন সম্মেলন হয়েছে। সেখানেও কিন্তু প্রত্যাশা তৈরি হতো। বলা হতো যে অনেক বিনিয়োগকারী আগ্রহ দেখাচ্ছেন। কিন্তু পরবর্তী সময়ে আমরা দেখেছি, বিনিয়োগ সেভাবে আসেনি। এবার ঢাকায় বিনিয়োগ সম্মেলনটি একটু অন্যভাবে করা হয়েছে। যারা সম্ভাব্য বিনিয়োগকারী, তাদের শুধু ঢাকায় নয়, ইপিজেড ও বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোতে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
এ ধরনের সম্মেলনের একটি প্রয়োজনীয়তা আছে। বিনিয়োগকারীরা, বিশেষ করে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের সিদ্ধান্ত নেওয়ার বিষয়টি একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়ার বিষয়। এটা হুট করে হয় না। বিদেশি বিনিয়োগকারীরা প্রথমে একটা লম্বা তালিকা করেন, সেখানে ১০-১৫টা দেশ থাকে। এরপর তারা সবকিছু বিবেচনায় নিয়ে ৪-৫টি দেশের সংক্ষিপ্ত তালিকা তৈরি করে। সবশেষে তাঁরা একটি বা দুটি দেশে বিনিয়োগ করার সিদ্ধান্ত নেন।
বাংলাদেশের সমস্যাটা ছিল, আমরা অনেক সময় বিনিয়োগকারীদের দীর্ঘ তালিকাতেও জায়গা পেতাম না। এ বাস্তবতায় এ ধরনের বিনিয়োগ সম্মেলনের উপকারিতা হচ্ছে অনেক বিনিয়োগকারীর লম্বা তালিকায় আমরা হয়তো স্থান পাব। আবার যেসব বিনিয়োগকারীর লম্বা তালিকায় আমরা আগে থেকেই স্থান পেয়েছিলাম, এবার তারা সম্মেলনে আসায় তাদের সংক্ষিপ্ত তালিকাতেও আমরা স্থান করে নিতে পারি।
কিন্তু একটা বিনিয়োগ সম্মেলনে অংশ নেওয়া আর প্রকৃতপক্ষে বিনিয়োগ করা—এর মধ্যে অনেকগুলো ধাপ আছে। যে দেশগুলো খুব সফলভাবে বিনিয়োগে আকৃষ্ট করতে পেরেছে, তারা কিন্তু সব সময় ট্র্যাকিং করে। আজকে আমাদের সম্মেলনে কারা কারা এলেন, এরপর তাঁরা কী করলেন, কোথায় তাঁরা ঠেকে গেলেন—এগুলো তাঁরা পর্যবেক্ষণ করেন। বিনিয়োগকারীরা কোথাও আটকে গেলে সেই বাধা দূর করার ব্যবস্থা তাঁরা করেন। আমাদের দেশে এ ধরনের ট্র্যাকিং করার ব্যবস্থা খুব একটা নেই। সাধারণত বড় বড় জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠানের ব্যাপারে আমাদের আগ্রহ থাকে। কারণ, সেসব আয়োজন নিয়ে পাবলিসিটি হয়, সংবাদপত্রের শিরোনাম হয়। কিন্তু যে প্রক্রিয়াগুলো আসলে কাজে দেবে, সেগুলো নীরবে হয়, তাতে আমাদের আগ্রহ কম থাকে।
একটা বিনিয়োগ সম্মেলন হয়েছে, প্রত্যাশাও তৈরি হয়েছে। কিন্তু বিনিয়োগকারী যাঁরা আসবেন, তাঁদের সামনে যত বাধা আছে, সেসব সমস্যা সমাধানের জন্য আমরা কী করছি, সেটাই আসল কথা।
বাংলাদেশকে ১০ বছরে সিঙ্গাপুর হতে পারে, এমন আশা করেছেন বিডার চেয়ারম্যান। কিন্তু অর্থনৈতিক বাস্তবতা কি সেটা বলছে?
সৈয়দ আখতার মাহমুদ: বিডা চেয়ারম্যান কী অর্থে সিঙ্গাপুরের কথা বলেছেন, সেটা আমি জানি না। যদি তিনি বলেন, সিঙ্গাপুরের বিনিয়োগ পরিবেশ যেমন আছে, আমরা তার কাছাকাছি যেতে চাই, তাহলে বিষয়টা ঠিক আছে। কিন্তু আমাদের সিঙ্গাপুর হতে চাওয়াটা ঠিক কি না, সেটাও একটা প্রশ্ন। কারণ, সিঙ্গাপুর একটা বিশেষ ধরনের দেশ। সেটা একটা সিটি স্টেট। আয়তনে ঢাকা শহরের দ্বিগুণ। একটা স্বাভাবিক দেশে যেমন অনেক ধরনের গ্রামাঞ্চল ও শহর থাকে, সিঙ্গাপুর এমন দেশ নয়। ফলে একটা সিঙ্গাপুরের মতো দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের তুলনা চলে না। আমরা তুলনা করতে পারি ভিয়েতনাম কিংবা দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে। একটা বিষয় হচ্ছে, আমরা যখন একটা দেশের সঙ্গে তুলনা করি, তখন আমরা শুধু এর ফলাফলটা নিয়েই চিন্তা করি। আমরা সিঙ্গাপুর হতে চাই নাকি কোরিয়া হতে চাই, তার থেকেও বড় বিষয় হচ্ছে, যে প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে তারা আজকের সিঙ্গাপুর ও দক্ষিণ কোরিয়া হয়েছে, সেই যাত্রাপথ আমাদের গভীরভাবে জানা।
প্রবৃদ্ধির বিপরীতে বাংলাদেশে কর্মসংস্থান তৈরি হচ্ছে না। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তরুণদের বেকারত্ব, বিশেষ করে শিক্ষিত তরুণদের বেকারত্ব আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েছে। উন্নয়নের গল্পের বিপরীতে বিনিয়োগের গল্পটা কেন এমন ম্লান?
সৈয়দ আখতার মাহমুদ: কেন আমাদের এখানে বিনিয়োগটা হচ্ছে না? প্রথমত, অনেকেই বিনিয়োগ করতে চান, কিন্তু বিনিয়োগ করতে পারছেন না। দ্বিতীয়ত, অনেকে বিনিয়োগ করতে চান না। যাঁরা বিনিয়োগ করতে চাইছেন, তাঁরা কেন বিনিয়োগ করতে পারছেন না—এটা নিয়ে অনেক জরিপ হয়েছে। মোটাদাগে আমরা দেখি, অনেকে অর্থায়নের অভাবে বিনিয়োগ করতে পারেন না। বিশেষ করে ছোট ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের ক্ষেত্রে এটা সত্যি। তাঁরা প্রয়োজনীয় টাকা পাচ্ছেন না, সুদের হার বেশি, প্রয়োজনীয় জমি ও বিদ্যুৎ-গ্যাস পাচ্ছেন না।
যাঁরা বিনিয়োগ করতে চান, তাঁরা মূলত দুটি সমস্যার মুখে পড়েন। একটা প্রণোদনার বিষয়, আরেকটি অনিশ্চয়তার বিষয়। প্রণোদনার ক্ষেত্রে একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। আমরা প্রায়ই বলি, আমাদের রপ্তানি বাড়ানো উচিত এবং রপ্তানিতে আরও বহুমুখী করা উচিত। পোশাকশিল্পের ওপর একক নির্ভরতা কাটানো উচিত। কিন্তু সেটা কেন হচ্ছে না? আমাদের দেশে দেশীয় বাজারকে সেবা করার জন্য বিনিয়োগটা অনেক বেশি আকর্ষণীয়। কারণ হচ্ছে, আমাদের এখানে যে শুল্কনীতি আছে, সেখানে বিদেশ থেকে কোনো পণ্য এলে অনেক উচ্চ হারে শুল্ক বসানো হয়। এ কারণে এসব পণ্যের দাম অনেক বেড়ে যায়। আমাদের ব্যবসায়ীরা দক্ষ না হলেও দেশীয় বাজারে একটা সংরক্ষিত পরিবেশে ব্যবসা করে প্রচুর মুনাফা করার সুযোগ পান। এ কারণে আমাদের বিনিয়োগকারীরা রপ্তানিমূলক শিল্পে বিনিয়োগ করতে উৎসাহী হন না।
আবার বিনিয়োগকারীরা যদি রপ্তানিমূলক কাজে বিনিয়োগ করতে চান, তাহলে তাঁরা তৈরি পোশাক খাতেই সেটা করেন। কারণ, এ খাতে নীতিগত পক্ষপাতিত্ব আছে। এখানে বিনিয়োগ করলে কিছু নীতিগত সুবিধা পাওয়া যায়, যেটা অন্যান্য রপ্তানির বেলায় পাওয়া যায় না। আবার রেগুলেটরি (বিধিবিধানসংক্রান্ত) অনিশ্চয়তা ও নীতিগত অনিশ্চয়তার কারণে বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগে নিরুৎসাহিত হন। আজ একধরনের নীতি আছে, কালকে সেটা থাকবে কি না, সে ব্যাপারে অনিশ্চয়তা আছে। বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আশ্বাস দেওয়া হলো, ‘তোমরা এলে অনেক সুবিধা দেওয়া হবে।’ কিন্তু তাঁরা আসার পর দেখলেন, সেই সুবিধাগুলো দেওয়া হচ্ছে না। কিন্তু দেওয়া হলেও অনেকটা সময় লেগে যাচ্ছে।
এসব কারণে প্রায় দুই দশক ধরে আমাদের ব্যক্তিমালিকানাধীন বিনিয়োগের হার ২২-২৩ শতাংশে স্থির হয়ে আছে।
বিনিয়োগের ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক পরিবেশ নাকি রাজনৈতিক পরিবেশকে আপনি এগিয়ে রাখবেন? কেন এগিয়ে রাখবেন?
সৈয়দ আখতার মাহমুদ: আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো যেসব কর্মসূচি নিচ্ছে, যে কথাবার্তা বলছে, সেটাকেই আমরা সচরাচর রাজনীতি বলতে বুঝি। কিন্তু আমি এখানে অন্য ধরনের রাজনীতির কথাও বলতে চাই। একটি সমাজে বিভিন্ন গোষ্ঠী থাকে, প্রতিটি গোষ্ঠীর ভিন্ন স্বার্থ থাকে। তারা অবশ্যই চাইবে তাদের স্বার্থ আদায় করে নিতে। কে কতটা স্বার্থ আদায় করতে পারবে, সেটা নির্ভর করবে কার কতটা ক্ষমতা তার ওপর। এই যে বিভিন্ন গোষ্ঠী তাদের ক্ষমতা ব্যবহার করে নিজেদের স্বার্থ আদায় করে নিতে চাইছে এবং স্বার্থ আদায় করতে গিয়ে সরকারের নীতিকে প্রভাবিত করতে চাইছে, সেটাও একধরনের রাজনীতি। এই রাজনীতির সঙ্গে অর্থনীতির সম্পর্ক খুব নিবিড়। এ কারণে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক পরিবেশ নাকি অর্থনৈতিক পরিবেশ বেশি গুরুত্বপূর্ণ, সেটা বলাটা সমস্যাজনক। বরং অর্থনীতি ও রাজনীতির মধ্যকার মিথস্ক্রিয়াটা আমাদের বুঝতে হবে। এই মিথস্ক্রিয়ার মধ্য দিয়ে আমরা যাতে আমাদের আলোচনাকে কর্মসংস্থান সৃষ্টি, রপ্তানি বহুমুখী করা ও উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর দিকে নিয়ে যেতে পারি, সেদিকে মনোযোগ দিতে হবে।
বাংলাদেশে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে প্রধান বাধা কী কী? এ থেকে উত্তরণে সরকার কী করতে পারে?
সৈয়দ আখতার মাহমুদ: বিনিয়োগকারী ও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে সরকারের নিয়মিত সংলাপ হওয়া দরকার। আমাদের এখানে এই সংলাপ খুব খাপছাড়াভাবে হয়। সেটা খুব সুপরিকল্পিতভাবে হওয়া দরকার। বিদেশি হোক, দেশি হোক—বিনিয়োগ বাড়ানোর ব্যাপারটা শুধু শিল্প মন্ত্রণালয় ও বিডার দায়িত্ব নয়, সমগ্রটাই সরকারের এজেন্ডা হতে হবে। এখানে আইন মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ব্যাংক, এনবিআরের অনেক কাজ আছে। এসব প্রতিষ্ঠান নিজেদের ম্যান্ডেট অনুযায়ী পৃথক পদক্ষেপ নেয়। কিন্তু তাদের পদক্ষেপ বিনিয়োগকারীদের নিরুৎসাহিত করছে কি না, সেটা তারা খেয়াল করে না। তাদের পদক্ষেপের সঙ্গে বিডার কাজটা সাংঘর্ষিক হয়ে গেল কি না, সেটা চিন্তা করা দরকার। আমাদের সরকারি ব্যবস্থায় বড় দুর্বলতা হলো সমন্বয়ের অভাব। এদিকে সরকারকে নজর দেওয়া দরকার।
সরকার যদি কোনো সংস্কারকাজ শুরু করে, সেটা নিয়মিত তদারকি ও ফলোআপ করা দরকার। সংস্কারের ফলে যারা লাভবান হওয়ার কথা, তাদের কাছ থেকে যাচাই করে নেওয়া দরকার, সেটা ঠিকমতো হচ্ছে কি না।
ট্রাম্পের শুল্কযুদ্ধে বাংলাদেশের ওপর কতটা প্রভাব পড়বে?
সৈয়দ আখতার মাহমুদ: এই শুল্কযুদ্ধ কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে, সেটা আমরা এখনই বুঝতে পারছি না। এখানে বড় ধরনের অনিশ্চয়তা আছে। অনিশ্চয়তা অর্থনীতির জন্য, বিনিয়োগের জন্য বিরাট একটা সমস্যা। সারা পৃথিবীতে অনিশ্চয়তা থাকলে বিনিয়োগকারীদের কিন্তু বাংলাদেশ সম্পর্কেও একটা অনিশ্চয়তা থাকবে। ফলে বিনিয়োগকারীরা এখন একটু দেখেশুনেই সিদ্ধান্ত নেবেন।
রপ্তানির সঙ্গে শুল্কের একটা বিরাট সম্পর্ক আছে। এখানে দুটি প্রবণতা আমাদের মাথায় রাখতে হবে। প্রথমত, যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে আমরা যে পোশাক রপ্তানি করি, সেটা তুলনামূলকভাবে সস্তা। আমাদের প্রতিযোগীরা যেটা রপ্তানি করে, সেটা তুলনামূলকভাবে দামি। ট্রাম্পের শুল্কযুদ্ধের কারণে অনেকে যুক্তরাষ্ট্রে একটা অর্থনৈতিক মন্দার শঙ্কা করছেন, সে ক্ষেত্রে মানুষের প্রকৃত আয় কমে যেতে পারে। প্রকৃত আয় কমে গেলে মানুষ অপেক্ষাকৃত কম দামি পণ্যটা কেনে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশে খানিকটা সুবিধা পেতে পারে। দ্বিতীয়ত, দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে সামগ্রিকভাবে চাহিদা কমে যাচ্ছে। যে কারণে বাংলাদেশের পণ্যেরও চাহিদা কমে যাবে। যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে এই দুটি বিষয়ের ভারসাম্যে বাংলাদেশ কোথায় থাকবে, সেটা এখনই বলা যাচ্ছে না।
শুল্কযুদ্ধের কারণে সামগ্রিকভাবে বিশ্বে যদি একটা মন্দা তৈরি হয়, সেই মন্দার কারণেও আমাদের প্রবাসীদের কর্মসংস্থান কমে যেতে পারে, তাদের প্রকৃত আয়ও কমে যেতে পারে। কেননা, আমরা এখন শুধু প্রবাসী আয়ের জন্য মধ্যপ্রাচ্যের ওপর নির্ভর করি না। এখন আমাদের প্রবাসী আয়ের বড় একটা অংশ যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ ও পূর্ব এশিয়া থেকে আসে। ফলে বৈশ্বিক মন্দা হলে আমাদের প্রবাসী আয়ের প্রবাহও কমে যেতে পারে। সুতরাং বিনিয়োগ, রপ্তানি ও প্রবাসী আয়—তিন ক্ষেত্রেই একটা বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে। তবে রপ্তানি খাতে একটা মিশ্র প্রভাব পড়তে পারে।
বাংলাদেশের অবস্থানগত কারণেই দক্ষিণ ও দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়ার মধ্যে সংযোগকারী দেশ হতে পারে বাংলাদেশ। সে ক্ষেত্রে তো অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ও বিনিয়োগের একটা বড় সম্ভাবনা আছে। এটাকে কাজে লাগাতে ভূরাজনৈতিক বাধা দেখছেন কতটা?
সৈয়দ আখতার মাহমুদ: পৃথিবীতে যত অঞ্চল আছে, তার মধ্যে দক্ষিণ এশিয়াকে বলা হয় লিস্ট ইন্ট্রিগ্রেটেড অঞ্চল। এর মানে হলো পরস্পরের সঙ্গে অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক আদান–প্রদানের দিক থেকে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো সবচেয়ে পিছিয়ে আছে। আসিয়ান দেশগুলো কিন্তু এখানে অনেকটা এগিয়ে আছে। দক্ষিণ এশিয়ায় ঐতিহাসিক যেসব বিরোধ আছে, সে কারণে একে-অপরের প্রতি বিরোধ, সন্দেহ, অবিশ্বাস আছে। আরেকটি ব্যাপার হতে পারে, দক্ষিণ এশিয়ায় ভারত অন্য দেশগুলোর তুলনায় আকারে অনেক বড়। আবার পূর্ব এশিয়ার প্রধান দেশ চীন ও দক্ষিণ এশিয়ার বড় দেশ ভারতের মধ্যে সম্পর্ক ভালো নয়। এই দুই দেশের মধ্যে যদি সম্পর্ক ভালো হতো, তাহলে অনেক সমস্যার সমাধান হয়ে যেত। এটা একটা বড় ভূরাজনৈতিক সমস্যা। এ বাস্তবতায় দক্ষিণ এশিয়া ও পূর্ব এশিয়ার সংযোগকারী দেশ বাংলাদেশ—এটা ভাবা দূরবর্তী একটা ভাবনা হবে। বরং পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর সঙ্গে আলাদাভাবে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক এবং আসিয়ানের সঙ্গে যুক্ত হয়ে জোটবদ্ধ সম্পর্ক কীভাবে আরও উন্নত করা যায়, সে ব্যাপারে আমাদের ভাবতে হবে।
এটা সত্য যে আমাদের দেশে বিনিয়োগ দরকার। কিন্তু সব বিনিয়োগকেই আমরা কি স্বাগত জানাব?
সৈয়দ আখতার মাহমুদ: বিদেশি বিনিয়োগ আমরা কেন চাই—প্রশ্নটির উত্তর খুব স্পষ্ট থাকা চাই। যেকোনো বিদেশি বিনিয়োগকারী এলেই কি আমরা তাকে জামাই আদর করে নিয়ে আসব, সেটা কিন্তু ঠিক নয়। আমাদের একটা বিষয় মনে রাখতে হবে, বিদেশি বিনিয়োগকারীরা অনেক কিছু আনে, এটা ঠিক। কিন্তু আমাদেরও তো তাদের অনেক কিছু দিতে হবে। আমাদের জমি দিতে হচ্ছে, আমাদের ইউটিলিটি সেবা দিতে হবে, আমাদের মানবসম্পদের জোগান দিতে হবে। এসব সম্পদ তো আমাদের সীমিত। এইগুলো অসীম নয়। আমরা যখন আমাদের সীমিত সম্পদ বিদেশি বিনিয়োগকারীদের দিচ্ছি, তার বিনিময়ে আমরা কী পাচ্ছি, সেটা খুব ভালোভাবে চিন্তা করতে হবে। আমাদের দেশীয় বিনিয়োগকারীরা খুব ভালোভাবে পোশাক পণ্য তৈরি করছেন, সেই একই পণ্য যদি বিদেশি বিনিয়োগকারীরা করেন, সেটা খুব একটা উৎসাহব্যঞ্জক নয়।
মনোযোগটা দিতে হবে সেখানেই, আমরা যেটা করতে পারছি না। আমাদের প্রধান একটা উন্নয়ন চ্যালেঞ্জ হলো, রপ্তানি বাড়ানো এবং রপ্তানিকে বহুমুখী করা। আমরা যদি মালয়েশিয়া, ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ডের দিকে তাকাই তাহলে দেখব যে বৈশ্বিক ভ্যালু চেইনের সঙ্গে তারা যুক্ত হয়ে রপ্তানি আয় অনেকটা বাড়িয়েছে। যেমন ল্যাপটপের কথা আমরা বলতে পারি। এর পার্টসগুলোর কয়েকটি করে মালয়েশিয়া, ভিয়েতনামসহ অন্যান্য দেশে তৈরি হয়। এরপর এক জায়গায় অ্যাসেম্বল হয়ে সেটা বাজারে আসে। আমাদের এ ধরনের ভ্যালু চেইনে ঢুকতে হবে। আমাদের ল্যাপটপ তৈরির পারদর্শিতা অর্জন করতে হবে না, কিন্তু আমরা ল্যাপটপের কিছু যন্ত্রাংশ তৈরির পারদর্শিতা অর্জন করতে পারি।
সে কারণে আমাদের সেসব বিনিয়োগকারী আনা দরকার, যাঁরা এ ধরনের যন্ত্রাংশ তৈরি করে সুনাম অর্জন করেছেন। এ পথেই আমরা বৈশ্বিক ভালু চেইনে যুক্ত হতে পারি। আমাদের এমন বিনিয়োগকারী খুঁজে আনতে হবে, যাঁদের একটা ব্র্যান্ড ভ্যালু আছে এবং যাঁদের কাছে উন্নত প্রযুক্তি আছে। মোদ্দা কথা, বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করার ক্ষেত্রে আমাদের স্ট্র্যাটেজিক ভিশন থাকতে হবে।
আপনাকে ধন্যবাদ।
সৈয়দ আখতার মাহমুদ: আপনাকেও ধন্যবাদ।