বিশেষ সাক্ষাৎকার : আসিফ মোহাম্মদ শাহান

পুরো প্রক্রিয়াটি এখন এলিট পরিচালিত সংস্কারপ্রচেষ্টা

আসিফ মোহাম্মদ শাহান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের অধ্যাপক। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্ক ও নাগরিক কোয়ালিশনের সদস্য। প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের এক বছরের অর্জন ও ব্যর্থতা, সংস্কারসহ রাজনৈতিক নানা প্রশ্ন নিয়ে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মনোজ দে

প্রথম আলো:

জুলাই অভ্যুত্থানের এক বছর পূর্ণ হলো। আমরা যদি এই ১২ মাসের দিকে ফিরে তাকাই, তাহলে এই অভ্যুত্থানের অর্জনগুলো কীভাবে চিহ্নিত করবেন? 

আসিফ মোহাম্মদ শাহান: অভ্যুত্থানের অর্জন কী, এই সংজ্ঞায়ন করাটা একটু জটিল। তার কারণ হলো জুলাইয়ের গণ–অভ্যুত্থানে যাঁরা অংশগ্রহণ করেছিলেন, তাঁরা সবাই একই প্রত্যাশা বা আশা নিয়ে অংশ নিয়েছিলেন, এ কথা বলা যাবে না। আমরা দেখছি অনেক রাজনৈতিক দল এখন জোরেশোরে দাবি করছে যে জুলাই গণ–অভ্যুত্থানের মূল লক্ষ্য ছিল শেখ হাসিনার পতন। তাদের বক্তব্য, সেই লক্ষ্য অর্জিত হওয়ায় তাদের কাজ শেষ। কিন্তু আমরা যদি পেছনে ফিরে দেখি, অভ্যুত্থানের শুরুটা হয়েছিল কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে। সেই আন্দোলন কিন্তু প্রথম দিকে রেজিম চেঞ্জ বা সরকার পতনের আন্দোলন ছিল না; বরং এটা ছিল একটি নির্দিষ্ট দাবির আন্দোলন। কিন্তু সরকার যখন অত্যন্ত কঠোরভাবে আন্দোলন দমন করতে শুরু করল এবং বিশেষ করে যখন মানুষ হত্যার মতো ঘটনার মধ্য দিয়ে সেই দমন যখন নৃশংসতায় পরিণত হলো, তখন আন্দোলনের চরিত্র ধীরে ধীরে বদলে গেল। সরকার পতনের এক দফা দাবি এল।

 এরপর আমরা যদি গত বছরের ২, ৩ বা ৪ আগস্টের আন্দোলন, বিশেষ করে ৩ আগস্ট শহীদ মিনারের জনসমাবেশের দিকে ফিরে তাকাই, তাহলে দেখব, আন্দোলনের লক্ষ্য শুধু শেখ হাসিনার পতনে সীমাবদ্ধ ছিল না; বরং আন্দোলনকারীরা বলেছিলেন, তাঁরা এমন একটি রাষ্ট্র চান, যেখানে যেন আর কোনো শেখ হাসিনা কিংবা তাঁর মতো কর্তৃত্ববাদী শাসক ফিরে আসতে না পারেন। অর্থাৎ এ পর্যায়ে আন্দোলনের আকাঙ্ক্ষাটা আরও বিস্তৃত হলো। এমন এক রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে তোলার আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত হলো, যেখানে রাষ্ট্র নাগরিকের সব অধিকার হরণ করবে না, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা দমন করবে না, মানুষের ইচ্ছা-আকাঙ্ক্ষাকে উপেক্ষা করবে না। 

শুরুর দিকে এটা ছাত্রদের আন্দোলন ছিল, পরে শিক্ষকেরা সেখানে যুক্ত হলেন। পরবর্তী সময়ে পোশাকশ্রমিক থেকে শুরু করে রিকশাচালক—সর্বস্তরের মানুষ যুক্ত হলেন। তাঁদের কেউই সরকারি চাকরিতে কোটার জন্য রাস্তায় নামেননি। তাঁদের একটা আকাঙ্ক্ষা নিশ্চয় ছিল—যেভাবে তাঁদের জীবনটা চলছে, সেখানে একটা পরিবর্তন আসবে। তাঁদের মতামত, অভিপ্রায়, ইচ্ছার প্রতিফলনে রাষ্ট্র গুরুত্ব দেবে।

সামগ্রিকভাবে চব্বিশের গণ–অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষাকে আমরা তিনটি দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে পাচ্ছি। প্রথমত, শেখ হাসিনার পতন। সেটা অর্জিত হয়েছে। দ্বিতীয়ত, রাষ্ট্রব্যবস্থার পরিবর্তন, মানে ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থায় আর না ফেরার আকাঙ্ক্ষা। এখানে আমরা কতটা সফল হয়েছি, সে প্রশ্ন থেকে যায়। কেননা, বিভিন্ন আলোচনায় আমরা দেখছি শক্তিশালী সরকার, দুর্বল সরকার, এ আলোচনাই হচ্ছে। কিন্তু মূল প্রশ্নটিই আমরা এড়িয়ে যাচ্ছি। রাষ্ট্রের কর্তৃত্ব কতখানি হবে, সে ব্যাপারে আমরা ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারিনি। এ ক্ষেত্রে অর্জনটা বলব মাঝামাঝি। তৃতীয়ত, জনগণের অংশগ্রহণ ও অংশীদারত্বের জায়গায় আমরা মোটেও কোনো পরিবর্তন আনতে পারিনি। 

প্রথম আলো:

তাহলে কি ব্যর্থতার পাল্লাটা একটু বেশি ভারী বলে মনে হচ্ছে? 

আসিফ মোহাম্মদ শাহান: আমি বলব না যে ব্যর্থতার পাল্লা অনেক বেশি ভারী। আমি বলব, যে আলাপ-আলোচনাগুলো শুরু হয়েছে, সেটা রাজনৈতিক পরিপক্বতার দিকে কিছুটা হলেও আমাদের এগিয়ে নেয়। কিন্তু ব্যর্থতার মূল জায়গাটাও চিহ্নিত করা প্রয়োজন। আমরা এই পরিবর্তনকে গণ–অভ্যুত্থান বলছি। এলিট যারা, অর্থাৎ পলিটিক্যাল, ইকোনমিক্যাল, সোশ্যাল ও পাওয়ার এলিটদের নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে অভ্যুত্থানটি হয়নি; বরং সর্বস্তরের জনগণের অংশগ্রহণকে আমরা যদি একটা প্রচণ্ড ঝড় বলি, তাহলে সেই ঝড়ের মধ্য দিয়ে এই অভ্যুত্থানে জনগণ এলিটদের ঐকমত্যটাকে ভেঙে দিয়ে, নতুন একটা রাষ্ট্রব্যবস্থা কায়েম করতে চেয়েছিল। কিন্তু অভ্যুত্থানের ফসল হিসেবে যে সরকার গঠিত হলো, তারা গণপরিসর বা জনগণের অংশগ্রহণের জায়গাগুলো তৈরি না করে আবারও নতুন ধরনের একটা এলিট ঐকমত্য তৈরি করল।

আমরা বলতে পারি, এলিটের চেহারা শুধু পরিবর্তন হয়েছে। একধরনের পলিটিক্যাল এলিটদের সরিয়ে আরেক ধরনের পলিটিক্যাল এলিট এসেছে। বিজনেস এলিট, আমলাতান্ত্রিক এলিট—এ জায়গায়গুলোয় কোনো পরিবর্তন হয়নি। সুতরাং আবারও এটি একটি এলিট পরিচালিত, এলিট নিয়ন্ত্রিত সরকার এসেছে। ফলে জনগণ এখানে নিজেদের অংশগ্রহণের রাস্তা খুঁজতে খুঁজতে একটা পর্যায়ে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। একটা অংশ পুরো প্রক্রিয়ার সম্পূর্ণ বাইরে চলে গেছে। আবার একটা অংশ, যাদের আমরা মব বলি, তারা সামনে চলে আসছে। এলিটরা আবার মবকে কিছু ক্ষেত্রে আশ্রয়-প্রশ্রয়ও দিচ্ছে। ফলে শেষ পর্যন্ত পুরো প্রক্রিয়া এখন এলিট পরিচালিত সংস্কারপ্রচেষ্টায় পরিণত হয়েছে।

 একটা বিষয় মনে রাখা দরকার যে চব্বিশের গণ–অভ্যুত্থান রাজনৈতিক দল দ্বারা নিয়ন্ত্রিত অভুত্থান নয়। এটাকে আমরা এক অর্থে সামাজিক শক্তি দ্বারা পরিচালিত অভ্যুত্থান বলতে পারি। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ছাত্রদের প্রতিনিধি, শিক্ষকদের মধ্যে যাঁরা এসেছেন তাঁরা শিক্ষকদের প্রতিনিধি, শ্রমিক কিংবা মফস্‌সলের যাঁরা এসেছেন, তাঁরাও বিভিন্ন সামাজিক শক্তির প্রতিনিধি। এই সামাজিক আন্দোলন যদি একটা বড় সামাজিক শক্তি হিসেবে গড়ে উঠতে পারত, তাহলে রাষ্ট্রের ক্ষমতাকাঠামোয় তাঁরা বড় ধরনের পরিবর্তন আনতে পারতেন। সামাজিক আন্দোলন গড়ে না ওঠা বা সামাজিক শক্তিগুলোর রাজনৈতিক অঙ্গনে জায়গা খুঁজে না পাওয়া, এই অভ্যুত্থানের আরেকটি বড় ব্যর্থতার জায়গা।

আসিফ মোহাম্মদ শাহান
প্রথম আলো:

সামাজিক শক্তিগুলো কেন তাদের জায়গাটা ধরে রাখতে ব্যর্থ হলো? আপনারা শিক্ষক নেটওয়ার্কের প্রতিনিধিরা তো দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করে আসছিলেন। এমন তো নয় আপনাদের অভিজ্ঞতাটা নতুন…

আসিফ মোহাম্মদ শাহান: এ প্রশ্নের উত্তর আমাদের দীর্ঘদিন ধরেই খুঁজতে হবে। উত্তরটা এককথায় খুব সোজাভাবে বলা কঠিন। প্রশ্নটি হচ্ছে রাষ্ট্র গঠনের এ প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন সামাজিক শক্তি যাঁরা অভ্যুত্থানে অংশ নিয়েছিলেন, তাঁরা জায়গা পেয়েছেন কি না। দ্বিতীয় প্রশ্নটি হলো সরকার কি তাঁদের একটা রাজনৈতিক পরিসর দিয়েছে? আমরা যদি অন্তর্বর্তী সরকারের কাজকর্ম দেখি, দুটি বিষয় দেখতে পাব। প্রথমত, এই সামাজিক শক্তিগুলোকে সরকার স্বীকৃতিই দিতে পারেনি। দ্বিতীয়ত, সামাজিক শক্তিগুলোকে বাছাই করার ক্ষেত্রে সরকারের একটা পিক অ্যান্ড চুজ নীতি ছিল। যখন বাংলা একাডেমির বইমেলায় কোনো ঘটনা ঘটছে কিংবা নারী বা ক্ষুদ্র জাতিসত্তার অধিবাসীদের দাবি নিয়ে কোনো বিক্ষোভ হচ্ছে, সরকার সেখানে খুব সহজেই একটা দমনমূলক ভূমিকায় চলে যাচ্ছে। আবার কেউ কেউ যখন এমন সব দাবি নিয়ে প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন যমুনায় যাচ্ছেন, যার অনেকগুলোই রাষ্ট্র যে নাগরিকের জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে, সেই মৌলিক প্রশ্নকেই লঙ্ঘন করে, অথচ সরকার তাঁদের স্বাগত জানাচ্ছে। সরকার এই পিক অ্যান্ড চুজ নীতি নিয়েছে, কারণ যে এলিট ঐকমত্যে সরকার গঠিত হয়েছে, এখানে তার স্বার্থ রয়েছে। এলিটরা তাদের স্বার্থ অনুযায়ী কাজ করবে। এলিটরা তাদের স্বার্থের জন্য পিক অ্যান্ড চুজ নীতিতে যাদের দরকার, তাদের জায়গা দিচ্ছে। আর তাদের যাদের দরকার নেই, তাদের জায়গা দিচ্ছে না বা যাদের দাবিয়ে রাখা দরকার, তাদের ওপর খড়্গহস্ত হচ্ছে। 

প্রথম আলো:

সংস্কারের প্রসঙ্গ এলে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ, আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব—এ শব্দগুলো ঘুরেফিরে আসছে। কিন্তু সাধারণ মানুষ তো তাদের প্রাত্যহিক জীবনে কী পরিবর্তন আসছে, সেটা দেখতে চান। এ পর্যায়ে এসে কি মনে হচ্ছে, সংস্কারপ্রক্রিয়া থেকে সাধারণ মানুষ অনেকটাই বাদ পড়ে গেছেন? 

আসিফ মোহাম্মদ শাহান: আমরা যদি সামাজিক আন্দোলন বা শক্তিগুলোকে সংগঠিত করতে পারতাম, তাহলে এখন যে সংস্কারগুলো নিয়ে আলাপ-আলোচনা করছি, তার ধরনটাই অন্য রকম হতে পারত। সাধারণ মানুষ যে ক্ষমতার ভারসাম্য বোঝেন না তা নয়। কিন্তু রাজনৈতিক শক্তিগুলো একবার সাধারণ মানুষকে বোঝানোর চেষ্টা করেনি দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ আসলে কেন দরকার। সাধারণ মানুষ বোঝেন যে সরকারের পরিবর্তন হওয়া দরকার। তাঁরা বোঝেন এক ব্যক্তি, এক দল দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকলে বড় ধরনের সমস্যা তৈরি করে। কিন্তু যখন কী প্রক্রিয়ায় এটা করতে হবে, সে প্রশ্ন তখন কিন্তু দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ বা আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব, এ বিষয়গুলো তারা বুঝতে পারে না। এখানে একটা বড় ধরনের ব্যর্থতা তৈরি হয়েছে, এই মেকানিজমগুলো সাধারণ মানুষকে বোঝানো হয়নি। একপর্যায়ে মানুষ যখন দেখছেন সংস্কার নিয়ে যে আলাপগুলো হচ্ছে, সেটা তাঁদের মাথার ওপর দিয়ে যাচ্ছে এবং যখন দেখছেন যে তাঁরা যখন জন্মসনদ নিতে ইউনিয়ন পরিষদে যাচ্ছেন, আইনি সহায়তা নিতে থানায় যাচ্ছেন, তখন আগের মতোই তাঁদের ঘুষ দিতে হচ্ছে, তখন পুরো রাজনৈতিক পরিসর থেকে নিজেদের সরিয়ে নিয়েছেন। এখন যদি সাধারণ মানুষের সঙ্গে কথা বলেন, তাহলে একটা প্যারাডক্স দেখতে পাবেন। নির্বাচন চান কি না, এ প্রশ্নের উত্তর তাঁরা দেবেন ‘হ্যাঁ’। আর নির্বাচনের মধ্য দিয়ে কোনো পরিবর্তন আসবে কি না, এ প্রশ্নের তাঁরা উত্তর দেবেন ‘না’। 

এই গণ–অভ্যুত্থান একটা বৈপ্লবিক রূপান্তরের বড় সুযোগ নিয়ে এসেছিল, সে সুযোগটা হারিয়ে গেছে। অন্তত মানুষের অংশগ্রহণকে যদি নিশ্চিত করা যেত, তাহলে একটি সম্ভাবনা তৈরি হতে পারত। আমরা যদি মানুষকে সংগঠিত করতে পারতাম, তাঁদের সম্পৃক্ত করতে পারতাম, তাহলে হয়তো এই বিপ্লব আজ থেকে ৫, ১০, ১৫ বা ২০ বছর পর বাস্তবে রূপ নিতে পারত। 

প্রথম আলো:

জনগণকে সম্পৃক্ত করার এই দায়িত্ব তো অনেক বেশি রাজনৈতিক দলগুলোর। এত বড় একটা গণ–অভ্যুত্থানের পরও কেন দলগুলো এখানে ব্যর্থ হলো? 

আসিফ মোহাম্মদ শাহান: কারণ, কেউই আসলে দীর্ঘ মেয়াদে ভাবেনি কীভাবে মানুষকে সম্পৃক্ত করা যায়, কীভাবে বোঝানো যায় যে পরিবর্তনগুলো তাঁদের
জীবনের জন্য অপরিহার্য। আমি বারবার বলি, প্রতিটি রাজনৈতিক দলই বাস্তববাদী। তারা সব সময় হিসাব করে কোন পদ্ধতিতে বা কোন প্রক্রিয়ায় গেলে সহজে ক্ষমতায় যাওয়া সম্ভব এবং কোন পথে গেলে ক্ষমতায় দীর্ঘস্থায়ী হওয়া যায়। 

এখানে দোষ-গুণ, ভালো-মন্দের বিষয় নয়। রাজনৈতিক দলগুলোর চিন্তার ধরনই এমন। রাজনৈতিক দলগুলোর সামনে এই যে জনসম্পৃক্ততার প্রশ্ন, জনগণের অংশগ্রহণের প্রশ্ন, এটা তাদের ক্ষমতায় যাওয়ার পর ক্ষমতাকে স্থায়ী করতে চায়, তার জন্য একটা বড় চ্যালেঞ্জ। যদি একজন সাধারণ নাগরিক তাঁর নির্বাচিত সংসদ সদস্য বা ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানকে নিয়মিত জবাবদিহির আওতায় রাখেন, তাহলে ওই রাজনৈতিক দল যে পেট্রন-ক্লায়েন্ট ব্যবস্থা তৈরি করবে বা রেন্টভিত্তিক অর্থনীতি গড়ে তুলবে, সেটা বড় ধরনের হুমকির মুখে পড়বে। ফলে ভবিষ্যতে তাদের ক্ষমতায় যাওয়ার পথও কঠিন হয়ে পড়বে। তাহলে এই কাঠামোকে বদলানোর কী স্বার্থ পড়েছে রাজনৈতিক দলের। এটা বিএনপির ক্ষেত্রে সত্যি, জামায়াতে ইসলামীর ক্ষেত্রে সত্যি। দুঃখজনক ব্যাপার হচ্ছে গণ–অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা এনসিপিও এলিট ঐকমত্যে ঢুকে পড়ছে।

 ফলে রাজনৈতিক দলগুলো কখনোই এমনি এমনি গণপরিসর তৈরি করবে না। দলগুলোর ওপর সেই চাপটা থাকতে হবে। অন্তর্বর্তী সরকার সেই চাপটা তৈরি করতে পারত।

আসিফ মোহাম্মদ শাহান
প্রথম আলো:

অভ্যুত্থানে নারীর অংশগ্রহণ ছিল অনন্য। কিন্তু আমরা প্রথম থেকেই অনলাইন ও অফলাইনে নারীদের, বিশেষ করে সামনের সারির মুখগুলোকে আক্রান্ত হতে দেখছি। সম্প্রতি ভোলা ও মুরাদনগরে ভয়াবহ দুটি যৌন সহিংসতার ঘটনা দেখলাম। নারীর সুরক্ষায় জোরালো কোনো পদক্ষেপ কেন দেখছি না? 

আসিফ মোহাম্মদ শাহান: নারীরা দুভাবে আক্রান্ত হচ্ছেন। একটি হচ্ছে অফলাইনে নির্যাতন, আরেকটি অনলাইনে সাইবার বুলিং। সমাজে যাঁরা তুলনামূলকভাবে সুরক্ষিত অবস্থানে আছেন, তাঁদের ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে অফলাইনে নির্যাতনের মাত্রা কম হলেও সাইবার বুলিং চালিয়ে তাঁদের কণ্ঠস্বর মুছে ফেলার চেষ্টা করা হচ্ছে। অর্থাৎ যাঁরা প্রতিবাদের ভাষা বজায় রাখতেন, তাঁদের মুখ বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে। 

এখন প্রশ্ন হলো, এগুলো কেন ঘটছে? এখানে দুটি বিষয় সামনে আসে—অন্তর্বর্তী সরকারের ভূমিকা কী, রাজনৈতিক দলগুলোর ভূমিকা কী।

যখন মুরাদনগর বা ভোলার মতো ঘটনা ঘটে, তখন আমরা প্রথমে রাজনৈতিক দলের দিকে আঙুল তুলি। অভিযুক্ত ব্যক্তি বিএনপি করে, না আগে আওয়ামী লীগ করত, পরে বিএনপি করে—এই বিতর্কের মধ্যে আমরা ঢুকে পড়ি। বিএনপির সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকলে ওই লোককে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়। এরপর গ্রেপ্তার করা হয়। আমার প্রশ্ন হচ্ছে, কেন আমরা শুধু রাজনৈতিক দলের দিকে আঙুল তুলছি, আঙুল তোলা উচিত তো অন্তর্বর্তী সরকারের দিকে। রাজনৈতিক দল কাউকে বহিষ্কার করছে, এটা তো কোনো শাস্তি হতে পারে না। এবং এই শাস্তি দেওয়ার দায়িত্বও রাজনৈতিক দলের নয়। রাজনৈতিক দল সর্বোচ্চ যেটা করতে পারে, সেটা হলো অভিযুক্তকে থানায় দিয়ে আসা। যদিও আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর যে চর্চা, সেখানে এটা অনেক বেশি আশা করা। সরকার বলছে ব্যবস্থা নিচ্ছে, কিন্তু ডিটারেন্স তৈরি করার ক্ষেত্রে যে পদক্ষেপটা নেওয়া দরকার, সেটা কি তারা নিচ্ছে? অনেক ক্ষেত্রেই আমরা দেখছি সরকার পিছিয়ে আসছে। সরকার একটা নারী কমিশন তৈরি করল। সেই কমিশন যখন তাদের প্রতিবেদনটা নিয়ে গেল, অসাধারণ কাজ হয়েছে বলে সেটা গ্রহণ করা হলো। নারী কমিশনের রিপোর্ট নিয়ে কারও দ্বিমত থাকতে পারে, কিন্তু সেই কমিশনে যাঁরা ছিলেন তাঁদের যখন অশ্রাব্য ভাষায় আক্রমণ করা হলো, তখন সরকার কি একবারও বলেছে, এটা আমাদের প্রতিবেদন। এখানে বিতর্ক, আলোচনা হতে পারে। কিন্তু এই প্রতিবেদন নিয়ে আক্রমণ কোনোভাবেই সমর্থন করব না। এই পরিষ্কার বার্তাটি সরকার দিতে ব্যর্থ হয়েছে।

প্রথম আলো:

শেখ হাসিনা সরকারের পতন হলেও বাংলাদেশের ফ্যাসিবাদী কাঠামো বিলীন হয়নি। এই বাস্তবতায় অনেকে আশঙ্কা করছেন, দেশে নতুন ধরনের ফ্যাসিবাদ—বিশেষ করে দক্ষিণপন্থী ফ্যাসিবাদের উত্থান হতে পারে। বাংলাদেশের সমাজবাস্তবতায় এর সম্ভাবনা কতটা আছে?

আসিফ মোহাম্মদ শাহান: দক্ষিণপন্থী ফ্যাসিবাদ উত্থানের সম্ভাবনাকে আমরা কেউই উড়িয়ে দিতে পারি না। আমরা যদি রাজনীতির যে লিবারেল সংস্করণ আছে, সেখান থেকে আমাদের রাজনৈতিক স্পেকট্রামের দিকে তাকাই, তাহলে বিএনপি নিজেদের সব সময় মধ্যপন্থী দল হিসেবে দাবি করে। বিএনপি লিবারেল ডেমোক্রেসিতে বিশ্বাসী, কিন্তু মানুষের অধিকারের প্রশ্নে বিএনপি যে খুব লিবারেল একটা অবস্থান নেয়, তা নয়। কারণ, এই দলের মধ্যে সব মতাদর্শের লোক আছে। এনসিপি শুরু থেকেই বলে আসছে যে তারা মধ্যপন্থার দিকে যাবে। এর মানে মধ্যপন্থায় আমরা একটা ক্রাউডেড স্পেস দেখতে পাচ্ছি। মধ্যপন্থা থেকে যত বেশি ডান দিকে যাওয়া যাবে, রাজনৈতিক পরিসরটা আরও ক্রাউডেড। কিন্তু আমরা যখন লিবারেল বা বামের জায়গাটি চিন্তা করছি, সেটা কিন্তু এখন পুরোপুরি শূন্য। অতীতে যারা এই রাজনীতি করতেন, তাঁরা সম্পূর্ণভাবে অগ্রহণযোগ্য। কমিউনিস্ট পার্টিগুলো কী যে বলার চেষ্টা করছে, সেটা অনেকের কাছেই পরিষ্কার নয়।

জাতি, ধর্ম, লিঙ্গ বা বর্ণ—একজন নাগরিকের পরিচয় যা–ই হোক না কেন, তার ন্যূনতম মৌলিক অধিকারটুকু রাষ্ট্রকে নিশ্চিত করতে হবে, এই প্রশ্নটির সহজ উত্তর মধ্য থেকে ডানে যত সরা যাচ্ছে, ততই ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে। কেউ কেউ বাইনারিতে যাব না, এমন কথা বলছেন; কেউ কেউ কিছুই বলছেন না; আর কেউ কেউ খুব স্পষ্ট করে বলছেন, এটা ৯০ শতাংশ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠের দেশ, এটাই মেনে নিতে হবে। রাষ্ট্রের সব নাগরিকের মৌলিক অধিকারগুলো পাওয়ার, কাজ করার, মতপ্রকাশ করার কিংবা বেঁচে থাকার অধিকার আছে। এই বক্তব্যটা কিন্তু কোথাও আসছে না। ফলে আমাদের পুরো রাজনৈতিক ডিসকোর্সটাই দক্ষিণপন্থা ঘিরে আবর্তিত হচ্ছে। এর সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে আমলাতন্ত্র, পুলিশ প্রশাসনসহ ফ্যাসিবাদী বিভিন্ন কাঠামো। আমাদের আমলাতন্ত্রের সত্যিকার অর্থে কোনো রাজনৈতিক আনুগত্য নেই।

প্রথম আলো:

আপনাকে ধন্যবাদ।

আসিফ মোহাম্মদ শাহান: আপনাকেও ধন্যবাদ।