বিশেষ সাক্ষাৎকার: রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর

আমাদের নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তে যেতে হবে

রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান। গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘উন্নয়ন অন্বেষণ’-এর প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারপারসন। বাংলাদেশের অর্থনীতি ও রাজনীতির সংকট, অর্থনৈতিক মডেলের সীমাবদ্ধতা, ভূরাজনীতির সঙ্গে অর্থনীতির চ্যালেঞ্জ, নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের সম্ভাবনা—এসব বিষয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন।

সাক্ষাৎকার নিয়েছেন এ কে এম জাকারিয়া মনোজ দে

রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর
প্রশ্ন:

প্রথম আলো: বাংলাদেশ নিয়ে অনেক সম্ভাবনার কথা আমরা শুনেছি। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে অনেক ক্ষেত্রেই গোষ্ঠীস্বার্থের কাছে সর্বজনীন স্বার্থ হারিয়ে যাচ্ছে। এই পরিস্থিতি কেন সৃষ্টি হলো?

রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর: বাংলাদেশ একধরনের অগ্রগতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল। বাংলাদেশ নিয়ে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন কথা শোনা গেছে। মুক্তিযুদ্ধের পরপর শোনা গেল বাংলাদেশ একটা তলাবিহীন ঝুড়ি। এখন অনেকে বলছেন, বাংলাদেশ প্যারাডক্সের কথা। বলা হচ্ছে বাংলাদেশ উন্নয়নের বিস্ময়। কিন্তু অর্থনীতি ও রাজনীতির নির্দেশকগুলো বিবেচনা না করেই এসব মন্তব্য করা হয়েছে। অর্থনীতির বিভিন্ন নির্দেশক, যেমন শ্রম, পুঁজি গঠন, প্রযুক্তি, ভূমিব্যবস্থাপনা অথবা রাজনৈতিক নির্দেশক যেমন প্রতিষ্ঠান, প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জনগণের সম্পর্ক, রাষ্ট্রের সঙ্গে জনগণের সম্পর্ক—এসব বিষয়ে যথেষ্ট চিন্তাভাবনা না থাকার কারণেই আজ এই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। আসলে আমাদের উন্নয়নের মডেলের যে গল্পটা বলা হয়েছে, তার মৌলিক বিষয়ে সব সময় ঘাটতি ছিল।

যেমন বিনিয়োগ যদি অর্থনীতির সংযোজন বা মোট দেশজ উৎপাদনের মূল হাতিয়ার না হয়, তাহলে সেই অর্থনীতি টেকসই হতে পারে না। আবার প্রতিষ্ঠান যদি ঠিকমতো কাজ না করে, তাহলেও অর্থনীতি টেকসই হতে পারে না। এরই প্রতিফলন আজকে আমরা দেখছি।

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: আমরা অনেক সময় রাজনীতি থেকে অর্থনীতিকে আলাদা করে দেখতে চাই। বাংলাদেশের মতো বিকাশমান অর্থনীতির দেশে রাজনীতি থেকে অর্থনীতিকে আলাদা করে দেখার সুযোগ আছে কি?

রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর: রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক নির্দেশকগুলোর মধ্যে যদি সমন্বয় না ঘটে, তাহলে সামনের দিকে এগোনো যাবে না। এটা শুধু বাংলাদেশের নয়, সব উন্নয়নশীল দেশগুলোর একটা সাধারণ সমস্যা। দেখার বিষয় হচ্ছে, রাষ্ট্র যেসব নীতি নিচ্ছে, সেগুলো গ্রহণের ক্ষেত্রে জনগণের অংশগ্রহণ কী বা কতটা এবং রাষ্ট্রের সঙ্গে জনগণের চুক্তির সম্পর্ক কী।

এসব বিবেচনায় নিলে দেখা যায়, রাজনৈতিক বন্দোবস্তের ঘাটতির কারণে অনেক দেশের অগ্রগতি থমকে গেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যেসব অর্থনীতি উন্নতি করেছে, তারা কোনো না কোনোভাবে একধরনের রাজনৈতিক বন্দোবস্ত তৈরি করেছে। তারা প্রতিষ্ঠানগুলোকে কার্যকর করে গড়ে তুলতে পেরেছে। যেসব দেশে প্রতিষ্ঠানের কার্যকারিতা থাকেনি, সেসব দেশে সমস্যা হয়েছে। সেটা আর্জেন্টিনার ক্ষেত্রে যেমন সত্যি, নাইজেরিয়ার ক্ষেত্রে তেমন সত্যি, সবচেয়ে বড় সত্যি শ্রীলঙ্কার ক্ষেত্রে। সবাই বলতেন শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সামাজিক নিরাপত্তার অগ্রগতিতে দক্ষিণ এশিয়ার রোলমডেল শ্রীলঙ্কা। কিন্তু রাজনৈতিক বন্দোবস্তের ঘাটতির কারণে আজ শ্রীলঙ্কা খাদের কিনারায় এসে দাঁড়িয়েছে।

রাজনৈতিক বন্দোবস্তের ক্ষেত্রে অধিকাংশ মানুষের অংশগ্রহণ না থাকলে অর্থনীতিতে একচেটিয়াবাদ তৈরি হয়, রাজনীতিতেও গোষ্ঠীতন্ত্র তৈরি হয়। অর্থনৈতিক উন্নয়ন সেখানেই টেকসই হবে, যেখানে জবাবদিহি নিশ্চিত করা হয় এবং জনগণের অংশগ্রহণ যেখানে থাকে। অন্যদিকে গোষ্ঠীতন্ত্র যখন সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করে, তখন অর্থনৈতিক উন্নয়নের সব কটি নির্দেশকই বিপরীতমুখী হবে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে সেটাই ঘটেছে। এখানে দারিদ্র্য কমার গতি কমেছে, কর্মসংস্থানহীন জনগোষ্ঠীর সংখ্যা বেড়েছে, প্রবৃদ্ধি বিনিয়োগকেন্দ্রিক হয়নি, পরিবেশের ক্ষেত্রে দখল-দূষণের মাত্রা ব্যাপকভাবে বেড়েছে। আনুষ্ঠানিক হোক অথবা অনানুষ্ঠানিক হোক—প্রতিষ্ঠান যদি কাজ না করে, তাহলে উল্টো ফলটাই আসবে।

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ক্ষেত্রের চ্যালেঞ্জগুলো কী বলে মনে করেন?

রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর: আমরা সাম্প্রতিককালে চার ধরনের বড় চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। প্রথমত, জ্বালানি নিরাপত্তা। মালয়েশিয়া ও দক্ষিণ কোরিয়ার ক্ষেত্রে দেখা গেছে, জ্বালানি খাতে রাষ্ট্র যাদের পৃষ্ঠপোষকতা করেছে, তারা শুধু জ্বালানি খাতেই কাজ করেনি, নতুন নতুন সংযোজন করেছে। আমাদের এখানে যাদের পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়া হয়েছে, তাদের দরকার ছিল নিজেদের সক্ষমতা বাড়ানোর পাশাপাশি জ্বালানি অনুসন্ধানের মতো কাজ করার সামর্থ্য অর্জন করা। কিন্তু সেটা হয়নি; বরং উল্টো পুঁজির পাচার হয়েছে।

দ্বিতীয় চ্যালেঞ্জটি হচ্ছে, এখানে বিভিন্ন খাতে আমাদের দেশে যে প্রণোদনা দেওয়া হয়েছে, সেটা উল্টো ঋণ সংস্কৃতির বিকাশ ঘটিয়েছে। এর কারণ হলো, সহায়তাটা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে পারফরম্যান্সের ওপর ভিত্তি করে দেওয়া হয়নি। একমাত্র তৈরি পোশাক খাতে কাজ করার পর সহায়তা দেওয়া হয়েছে, সে কারণে এ খাতে ঋণ খেলাপির পরিমাণ কম। অন্য খাতে কিন্তু ঋণ খেলাপির মাত্রা বেশি। এ থেকে একটা বিষয় প্রমাণিত হয়, আমাদের দেশেও যথাযথ নীতি এবং প্রতিষ্ঠান যেখানে কাজ করেছে, সেখানে বিকাশ ঘটেছে।

তৃতীয় চ্যালেঞ্জটা হচ্ছে অর্থনীতির বহুমুখীকরণ না হওয়ায় রপ্তানি বাড়েনি। অন্যদিকে আমদানির নামে পুঁজির পাচার হয়েছে। এ কারণেই এখন আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এত দ্রুত কমে গেছে।

চতুর্থ চ্যালেঞ্জ হলো দেশি-বিদেশি ঋণের পরিমাণ অনেক বেড়ে গেছে। স্বাধীনতার পর থেকে ২০১৬-১৭ অর্থবছর পর্যন্ত যে পরিমাণ ঋণ নেওয়া হয়েছিল, তার দ্বিগুণ পরিমাণ ঋণ গত কয়েক বছরে নেওয়া হয়েছে। প্রতিষ্ঠান কাজ না করায় বাংলাদেশ ব্যাংক একধরনের হিসাব দিচ্ছে আর রাজস্ব বোর্ড আরেক ধরনের হিসাব দিচ্ছে। প্রতিটি ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে উন্নয়নের যে গল্পটা বলা হয়েছিল, তা মৌল ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে ছিল না; বরং মৌল ভিত্তিটা উল্টো দিন দিন ক্ষয় হয়েছে।

এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় গোষ্ঠীতন্ত্র বাংলাদেশে দুটি জিনিস করতে দিচ্ছে না। সমস্যা সমাধানে সৃজনশীল হতে দিচ্ছে না, আর ফরেনসিক কায়দায় খুঁটিনাটি ও প্রাত্যহিক বিষয় বিবেচনায় নিয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের পথ তৈরি করছে না।

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: তা হলে আপনি যে চ্যালেঞ্জগুলোর কথা বললেন, তা থেকে বের হওয়ার কি পথ নেই?

রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর: বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বর্তমান যে চ্যালেঞ্জগুলো আছে, তা থেকে বেরিয়ে আসার পথ আছে। এখানে হতাশার জায়গা নেই। কিন্তু আমাদের যে রাজনৈতিক পরিস্থিতি, তা সমাধানের ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। রাজনৈতিক পরিবেশের পরিবর্তন ছাড়া এই চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করা সম্ভব নয়। বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠানগুলো একটা স্ট্যাটাস ক্যু বা স্থিতাবস্থার মধ্যে পড়ে গেছে। সৃজনশীল উপায়ে সামনের দিকে যেতে পারছে না। এই সমস্যাটা তৈরি হয়েছে গোষ্ঠীতন্ত্রের কারণে।

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: চুইয়ে পড়া উন্নয়ন নীতির কথা আমরা শুনেছি, কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এর সুফল শেষ পর্যন্ত ক্ষমতাকেন্দ্রের সঙ্গে যুক্তরাই পাচ্ছে। জিডিপি, মাথাপিছু আয়—এসব বাড়ার কথা শোনা গেলেও আয়বৈষম্য বেড়ে আমরা চরম বৈষম্যমূলক সমাজে পরিণত হয়েছি। এই পরিস্থিতিকে কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন।

রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর: কোভিড মহামারি কতকগুলো বিষয় আমাদের সামনে নিয়ে এসেছে। আমরা টের পেলাম আমাদের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি আসলে খণ্ডবিখণ্ড। এই কর্মসূচিতে যাঁর অন্তর্ভুক্ত থাকার কথা তিনি অন্তর্ভুক্ত নেই, আবার যাঁর অন্তর্ভুক্ত থাকার কথা নয়, তিনি সেখানে আছেন। এই কর্মসূচিটা আবার পূর্ণ জীবনচক্রভিত্তিক না। শিশুকাল থেকে বৃদ্ধকাল পর্যন্ত কারও প্রয়োজনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয় এ কর্মসূচি। কোভিড মহামারি থেকে আমরা শিক্ষা গ্রহণ করতে পারিনি। আমাদের উচিত ছিল, সর্বজনীন শিক্ষা, সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবাভিত্তিক সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির দিকে যাওয়া।

শ্রমের প্রাপ্তি ও পুঁজির প্রাপ্তির মধ্যে বিশাল একটা ফারাক আমরা দেখছি। বাংলাদেশ ভয়ংকর বৈষম্যের দেশে পরিণত হয়েছে। সাধারণ মানুষকে কেন্দ্র করে অর্থনীতির যে আবর্তন হওয়া দরকার, সেটা হচ্ছে না। প্রকৃত মজুরি অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বাড়েনি। এরপর মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হয়ে এসে পড়েছে মূল্যস্ফীতি।

এখানে বৈষম্যটা নীতিকেন্দ্রিক বৈষম্য। বাইরের বাজারে পণ্যের দাম বাড়ার কারণে আমাদের এখানেও দাম বেড়েছিল। কিন্তু বাইরের বাজারে পণ্যের দাম কমার পরও আমাদের এখানে কমে না। এ নিয়ে নিজস্ব কায়দায় চিন্তা করা প্রয়োজন। জিডিপির অনুপাতে সরকারের রাজস্ব আয় বাড়েনি। রাজস্ব না আসায় টাকার ঘাটতি দেখা যাচ্ছে। ফলে সরকারকে ঋণ নিতে হচ্ছে। আমাদের ব্যাংক খাত এর মধ্যেই ন্যুব্জ, সে কারণে ঋণ দেওয়ার ক্ষমতা কমে গেছে। ফলে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে টাকা ছাপতে হচ্ছে। গভর্নরের হিসাব অনুযায়ী, কেন্দ্রীয় ব্যাংক যদি ৭০ হাজার কোটি টাকা ছাপে, তা হলে টাকার হাতবদল হওয়ার প্রক্রিয়ায় তা ৫ গুণ হয়ে প্রায় ৩ লাখ ৫০ হাজার কোটি টাকা হওয়ার কথা। ফলে নীতির কারণেই এখানে একটা মূল্যস্ফীতি ঘটছে।

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: আপনি বললেন আমাদের দেশে যে বৈষম্য তা নীতিকেন্দ্রিক। মানে আমরা যে নীতিতে চলছি, সেটাই বৈষম্য তৈরির জন্য দায়ী। বিষয়টি একটু ব্যাখ্যা করবেন কি?

রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর: বাংলাদেশে স্বাধীনতার পরের বাজেটের সঙ্গে এখনকার বাজেটের তুলনা করলে বিষয়টি পরিষ্কার হবে। এ ক্ষেত্রে দেখবেন মৌলিক পার্থক্য ঘটে গেছে। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের মৌলিক ভিত্তি হলো সাম্য, সামাজিক ন্যায়বিচার ও মানবিক মর্যাদা। এর ওপর ভিত্তি করেই প্রথম বাজেটে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে বরাদ্দ ছিল ৫০০ কোটি টাকা, আর রাজস্ব ব্যয় বা পরিচালন ব্যয়ে বরাদ্দ ছিল ১৮৬ কোটি টাকা। এখন দেখা যায়, পুরোটাই উল্টো হয়ে গেছে। বাজেটে ঋণবাবদ ও বেতনবাবদ খরচ বেশি।

এখানে মূল বিষয়টা হলো, বিনিয়োগে স্থবিরতা তৈরি হচ্ছে, কর্মসংস্থানে প্রবৃদ্ধি হচ্ছে না, দারিদ্র্য বিমোচনের গতি কমে যাচ্ছে ও বৈষম্য বাড়ছে। এ সবকিছুই ঘটছে নীতির কারণে। কেননা নীতিটা কেন্দ্রীভূত হচ্ছে ক্ষমতার মাধ্যমে, ক্ষমতাটা আসছে রাজনৈতিক বন্দোবস্তের একচেটিয়াতন্ত্রের কারণে। ফলে অমিত সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশের যে অগ্রগতি হয়েছিল, সেটা বিপরীতমুখী হয়েছে।

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: রাজনৈতিক বন্দোবস্তের একচেটিয়াতন্ত্রের কারণে যদি এই পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়ে থাকে, তবে এ থেকে উত্তরণের পথ কী? রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী ও আমলাতন্ত্রের সমন্বয়ে দেশে ক্ষমতার যে ত্রিভুজ তৈরি হয়েছে, সেখান থেকে বের হয়ে নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত তৈরি কি আদৌ সম্ভব?

রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর: বাংলাদেশের রাজনীতি ও অর্থনীতিতে স্বজনতোষী পৃষ্ঠপোষকতার একটি পরিস্থিতি ও সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। রাজনীতিবিদ, নির্বাহী বিভাগ, বিচার বিভাগ, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী—সবাই লেনদেনের সংস্কৃতির মধ্য দিয়ে একটা অনর্জিত আয়ভিত্তিক সমাজ গড়ে তুলেছে। একইভাবে তারা আবার নিজেদের মধ্যে সীমাটাও ভাগ করে নিয়েছে। তারা নিজেদের স্বার্থেই স্থিতাবস্থা বজায় রাখতে চায়। তারা নিজেরা কোনো পরিবর্তন করতে নয়, উল্টো পরিবর্তনের ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

কিন্তু সম্ভাবনার জায়গা হলো, বাংলাদেশের ইতিহাস কতগুলো নীতি নির্দেশ করে। ব্রিটিশ আমলে পূর্ববঙ্গের মানুষেরা কৃষক-প্রজা পার্টিকে সমর্থন দিয়েছিল। অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় এখানে কৃষকেরা বেশি ঋণগ্রস্ত ছিল। দলটি বলেছিল, আমরা ক্ষমতায় গেলে ঋণ সালিসি বোর্ড করব। মুক্তিযুদ্ধের ক্ষেত্রেও বয়ানটা পরিষ্কার, সোনার বাংলা শ্মশান কেন? নব্বইয়ের বয়ানটাও পরিষ্কার, স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের অবসান। কোনো স্থিতাবস্থাই শেষ কথা নয়। ইতিহাসের অভিজ্ঞতায় দেখা যায়, বাধা অতিক্রমের নতুন সৃজনশীল কায়দা যুগে যুগে বের হয়েছে। এখন এর সঙ্গে আবার একটি ভূরাজনৈতিক বাধ্যবাধকতাও তৈরি হচ্ছে। ভেতরের চাপ ও বাইরের চাপ তৈরি হওয়ার বিজ্ঞানই বলছে একধরনের নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের মধ্যে না গেলে বর্তমান চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করা দুরূহ হবে।

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: ভূরাজনীতিতে বাংলাদেশের গুরুত্ব বাড়ছে এবং সে কারণে নানা ধরনের চাপও তৈরি হচ্ছে। চাপ সামাল দিয়ে অর্থনীতির সুযোগটা গ্রহণ করা কতটা সম্ভব?

রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর: এখানে চারটি বিষয় রয়েছে। প্রথমটা হচ্ছে, যেকোনো প্রতিবেশীর সঙ্গে সহযোগিতা বাড়ানো। প্রশ্ন হলো, আমাদের যে আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য এবং পুঁজির চাহিদা, তা ক প্রতিবেশীরা আমাদের দিতে পারবে? তারা যদি দিতে পারে, সেটাই হবে সবচেয়ে ভালো পথ। দ্বিতীয় বিষয় হলো, পরাশক্তির দ্বন্দ্বে আমরা কোনো একদিকে ঝুঁকে পড়ব কিনা। এটা সম্ভব নয়। কারণ, আমদানি-রপ্তানি, শ্রমবাজার—এসবের বিবেচনা বাংলাদেশের কোনো এক দিকে হেলে পড়ার বিষয়টিকে সমর্থন করে না। তৃতীয় প্রশ্নটি হলো, বাংলাদেশ সব শক্তির মধ্যে ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা করে চলবে কি না। ভারসাম্য বজায় রেখে চলার মূল মুশকিল হলো, যেকোনো সময় পরিস্থিতি উল্টো দিকে ঘুরে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। চতুর্থ বিষয় হলো, অন্তর্ভুক্তিমূলক অবস্থান নেওয়া। এর মানে হলো বাইরের শক্তির সব অংশকে তাদের ভূমিকা পালন করতে দেওয়া। এর মূল বিষয় হচ্ছে, কোনো একটি শক্তি যে নীতি নিয়ে চলছে, তার সেই মূল স্বার্থের সঙ্গে আমাদের সংযোগ গড়ে তোলা বা সেটা মেটানো।

এ ক্ষেত্রে মূল বিবেচনার বিষয় হচ্ছে, আমরা নিজ থেকে উদ্যোগী হয়ে নাকি চাপে পড়ে সিদ্ধান্ত নিচ্ছি। যদি চাপে পড়ে সিদ্ধান্ত নিই, তাহলে পিছলে পড়ার বা খারাপ পরিস্থিতির মধ্যে পড়ার ঝুঁকি তৈরি হয়। এ ক্ষেত্রে দুটি শর্ত অনুসরণ করার মাধ্যমে বিরুদ্ধ পরিস্থিতি মোকাবিলা করা সম্ভব। প্রথমত, দেশে যতগুলো রাজনৈতিক দল আছে, তাদের মধ্যে আমাদের জাতীয় নিরাপত্তা ও জাতীয় স্বার্থে নেওয়া পররাষ্ট্রনীতির প্রশ্নে ঐকমত্য থাকতে হবে। দ্বিতীয়ত, যে সরকার ক্ষমতায় থাকবে, তার যেন একটা আদর্শ স্থাপনকারী বৈধতা থাকে। সাধারণ মানুষ যেন মনে করেন, সরকারের ক্ষমতায় বৈধতা আছে এবং বিদেশিদের সঙ্গে তারা যে দর-কষাকষি করছে, সেটা জনস্বার্থেই হচ্ছে।

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: বাংলাদেশ সম্প্রতি ব্রিকসে যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এটা কি অর্থনৈতিক সম্ভাবনা তৈরি করতে পারে? নাকি এর পেছনে সরকারের রাজনৈতিক বিবেচনাই এখানে কাজ করছে?

রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর: আঞ্চলিক সমিতি বা শিবিরে যাওয়ার আমাদের একটা ইতিহাস আছে। সেই ইতিহাস আমাদের তিনটা শিক্ষা দেয়। প্রথমটা হলো, কোথায় গেলে আমাদের প্রয়োজন এবং তাদের প্রয়োজন মিটবে। যেমন সার্ক আঞ্চলিকভাবে খুবই প্রয়োজনীয়, কিন্তু এটা আমাদের বড় কিছু দিতে পারেনি। রাজনৈতিক প্রশ্নগুলোর আলোচনা করার সুযোগ না থাকায় সেটা কার্যকর থাকেনি। দ্বিতীয় বিষয়টা হলো, কোন শর্তে আমরা সেখানে যাচ্ছি। ইন্দো–প্যাসিফিক হোক আর ব্রিকস হোক—আমাদের দেখতে হবে সেখানে গেলে আমাদের উৎপাদনের বহুমুখীকরণ হবে কি না।

সহযোগিতা ঋণভিত্তিক হবে, না পুঁজি বিনিয়োগভিত্তিক হবে—সেটাও বড় বিবেচ্য বিষয়। ঋণ হিসেবে পুঁজি আসলে আমাদের জন্য ঝুঁকি বেশি। কিন্তু যৌথ বিনিয়োগ হলে সবার জন্যই ঝুঁকি সমান। তৃতীয় বিষয়টি হচ্ছে, আমি অনেকবার বলেছি, ২০৩৫-৩৬ সালে আমাদের অর্থনীতি এক ট্রিলিয়ন ডলার হওয়া সম্ভব। কিন্তু এই উল্লম্ফন করতে গেলে আমাদের উৎপাদন বহুমুখীকরণের সঙ্গে প্রযুক্তিগত সক্ষমতা লাগবে। কোনো জোটে যুক্ত হয়ে আমরা সর্বোচ্চ সুবিধাটা পাব, সেই হিসাব-নিকাশের জন্য আমাদের যথেষ্ট হোমওয়ার্ক করে এগোতে হবে। চাপে পড়ে নীতিগত অবস্থান নিলে আমরা গ্রহীতা দেশ হিসেবেই থেকে যাব। নিজেদের স্বার্থ নিশ্চিত করতে পারব না।

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: নির্বাচন সামনে রেখা বাংলাদেশে বর্তমানে এক অনিশ্চিত পরিস্থিতি বিরাজ করছে। অর্থনীতিতেও সংকট বিরাজ করছে। এই সংকটের প্রধান উদ্বেগের দিকগুলো কী কী? উত্তরণের জন্য কোনো পরামর্শ আছে কি?

রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর: আমাদের রাজনীতির দীর্ঘস্থায়ী উদ্বেগ হচ্ছে, কোনো রাজনৈতিক দল আরেক রাজনৈতিক দলের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে পারেনি। আরেকটি বড় উদ্বেগ হলো, যে রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় থাকে, তারা তাদের অর্থনৈতিক নীতির জন্য জনগণের কাছে কখনো জবাবদিহি নিশ্চিত করেনি।

বাংলাদেশের বিনির্মাণের মূল শর্ত হচ্ছে রাজনৈতিক বন্দোবস্তে অধিকাংশের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা। বর্তমান রাজনৈতিক পরিবেশ স্বাধীনতাযুদ্ধের মৌল মন্ত্রগুলো ধারণ করতে পারছে না। জনগণ যাতে তার প্রতিনিধি নির্বাচন করতে পারে এবং রাজনৈতিক দলগুলো যাতে অন্য রাজনৈতিক দলের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে পারে—সেই নিশ্চয়তা দরকার। রাজনীতি ও অর্থনীতির ক্ষেত্রে আমরা যে চ্যালেঞ্জগুলোর মধ্যে পড়েছি, সে কারণেই আমাদের ভূরাজনৈতিক ছায়াযুদ্ধে পড়তে হচ্ছে।

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: আপনাকে ধন্যবাদ।

রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর: আপনাদেরও ধন্যবাদ।