ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মাধ্যমে শেখ হাসিনার সাড়ে পনেরো বছরের স্বৈরাচারী শাসনের অবসান ঘটল গত বছরের ৫ আগস্ট। এই সাড়ে ১৫ বছর সময়ে গুম, খুন, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডসহ মানবাধিকার লঙ্ঘনের অনেক ঘটনা ঘটেছে। মানবাধিকারের দৃষ্টিকোণ থেকে তাঁর (শেখ হাসিনা) এই শাসনামলকে কীভাবে মূল্যায়ণ করবেন?
সাঈদ আহমদ: মানবাধিকারের মাপকাঠিতে শেখ হাসিনার সাড়ে ১৫ বছরের শাসনামল অনেক দিক থেকেই ভয়ংকর ছিল। এ সময়ে মানবাধিকার লঙ্ঘনের কিছু নতুন নতুন উপাদান যুক্ত হয়েছে, যা আমরা আগে বাংলদেশে দেখিনি। হাসিনার শাসনামলের আগেও আমরা ক্রসফায়ার বা বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড দেখেছি। কিছু কিছু মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনার নজির হয়েতা আমরা সব আমলেই পাব। কিন্তু গত আমলে যেভাবে রাষ্ট্রের সব বাহিনী, আইন-কানুন, প্রশাসনিক-রাজনৈতিক ক্ষমতা—এ সবকিছুকে ব্যবহার করে একটি দমন-পীড়নমূলক ব্যবস্থা কায়েমের চেষ্টা করা হয়েছে, সেটা অন্য সময়ের চেয়ে অবশ্যই আলাদা।
ভিন্নমত দমনের ক্ষেত্রে বিগত আওয়ামী লীগ সরকার যে ন্যারেটিভ তৈরি করেছিল, তা হলো, ‘হয় তুমি আমার পক্ষে, না হয় আমার শত্রু’। এমনক সরকারের বিরোধিতাকে দেশের শত্রু বা রাষ্ট্রের শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করার প্রবণতা দেখা গিয়েছিল। ক্রসফায়ারের পাশাপাশি গুমের মতো ঘটনাগুলো ছিল খুবই ভীতিকর। সবশেষে, জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানের সময় যে নৃশংসতা চালানো হয়েছে—এটা মানবাধিকার লঙ্ঘনের একটা চরম উদাহরণ।
জুলাই-আগস্টে গণ-অভ্যুত্থানের সময় মানবাধিকার লঙ্ঘন ও সহিংসতা নিয়ে সম্প্রতি জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের দপ্তর একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। অপনি নিশ্চয়ই সেই প্রতিবেদনটি দেখেছেন। আন্দোলন দমনের চেষ্টায় যারা সেই সময় হত্যা, সন্ত্রাসের ঘটনা ঘটিয়েছে, তাদের বিচারের ক্ষেত্রে এ প্রতিবেদন কতটা ভূমিকা রাখতে পারবে বলে আপনি মনে করেন?
সাঈদ আহমদ: আমার মনে হয়, বিচারের ক্ষেত্রে এই প্রতিবেদন অনেকটাই সহায়ক হবে। বিচারপ্রক্রিয়া তো নির্ভর করে সাক্ষ্যপ্রমাণের ওপর। ৫ আগস্ট পর্যন্ত যারা ক্ষমতায় ছিল, তারাই প্রধানত সহিংসতার সঙ্গে যুক্ত ছিল। এর ফলে তাদের পক্ষ থেকে হয়তো তখন নথিপত্র, প্রমাণ মুছে ফেলার বা নষ্ট করার একটা চেষ্টাও করেছিল।
এ রকম প্রেক্ষাপটে জাতিসংঘের প্রতিবেদনটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, এটা দুনিয়ার বহুলস্বীকৃত সংস্থা। এই প্রতিবেদনে তারা মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিশেষ বিশেষ উপাদানের কথা বলেছে। এর মধ্যে গণহত্যা হতেও পারে, এমন উপাদানও রয়েছে—এ রকম ইঙ্গিতও তারা দিয়েছে। যে ট্রাইব্যুনালে এসব অপরাধের বিচার চলছে, এই প্রতিবেদন তাদের জন্য একটি পজিটিভ গাইডলাইন (ইতিবাচক নীতিমালা) হতে পারে। তবে এটুকুই যথেষ্ট নয়, আরও কমপ্লিমেন্টারি এভিডেন্স (প্রাসঙ্গিক সাক্ষ্যপ্রমাণ) দিয়ে তাদের অপরাধ প্রমাণ করতে হবে।
জাতিসংঘ প্রতিবেদনে নির্দিষ্টভাবে কিছু বিষয় তুলে ধরা হয়েছে। যেমন কোন বাহিনী জড়িত ছিল, তারা কী অস্ত্র ব্যবহার করেছে, কীভাবে তারা একটি নির্দিষ্ট গ্রুপকে টার্গেট করে সহিংসতা চালিয়েছে—এ বিষয়গুলো এসেছে। এ ছাড়া ‘স্টেট অ্যাক্টর’, অর্থাৎ সরকারি বাহিনীর পাশাপাশি ‘নন–স্টেট অ্যাক্টর’গুলো, যেমন ছাত্রলীগ, যুবলীগ বা আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠনগুলোর কথাও এসেছে। মানবাধিকার লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে আমরা সাধারণত ‘স্টেট অ্যাক্টর’গুলোকে জবাবদিহির মধ্যে আনতে পারি। কিন্তু ‘নন–স্টেট অ্যাক্টর’গুলো যদি সরকারি বাহিনীগুলোর সঙ্গে একত্রে সহিংসতা চালায়, তাহলে তাদেরও জবাবদিহির মধ্যে আনতে হবে। এ ক্ষেত্রেও জাতিসংঘের প্রতিবেদনটি কাজে লাগতে পারে।
জাতিসংঘের প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে, অন্তর্বর্তী সরকারের আমলেও মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটছে। গত ছয় মাসে যৌথ বাহিনীর হেফাজতে বেশ কিছু মৃত্যুর খবর সংবাদমাধ্যমে এসেছে। এসব ঘটনাকে কীভাবে দেখছেন?
সাঈদ আহমদ: একটা বিষয় বলা দরকার, জাতিসংঘ প্রতিবেদনের সময়সীমা কিন্তু ৫ আগস্ট নয়, ১৫ আগস্ট পর্যন্ত। এর ফলে ৫ আগস্টের পরেও ১৫ আগস্ট পর্যন্ত সংঘটিত ঘটনাগুলোর তথ্য-উপাত্ত এতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। ১৫ তারিখ পর্যন্ত মৃত মানুষের সংখ্যা ১ হাজার ৪০০-এর মতো হতে পারে বলে তারা প্রতিবেদনে বলেছে। তবে সরকারের পতন বা শেখ হাসিনার পালিয়ে যাওয়ার আগে এবং পরে কত মানুষ মারা গেছেন, সেই সংখ্যাটা ঠিক আলাদা করে বলা হয়নি।
অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে মানবাধিকার লঙ্ঘনের কিছু বিষয় জাতিসংঘের প্রতিবেদনে এসেছে। আমাদের দেশের মানবাধিকার সংগঠনগুলোও হেফাজতে মৃত্যুর কিছু পরিসংখ্যান প্রকাশ করেছে। একই সঙ্গে একটা বড় সংখ্যক মব লিঞ্চিংয়ের ঘটনা ঘটেছে—এগুলোও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড। অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাগুলো আসলেই দুঃখজনক। তবে সরকার নানা রকম ব্যাখ্যার দেওয়ার চেষ্টা করছে। যেমন পুলিশ ঠিকমতো কাজ করছে না, তাদের মনোবল এখনো ঠিক হয়নি ইত্যাদি।
যা–ই হোক, আমাদের আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে। দেখতে হবে, সরকার এ ঘটনাগুলোকে কতটা গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করে, তারা কোনো জবাবদিহির পদ্ধতি দাঁড় করাচ্ছে কি না। এসব কাজ যদি ঠিকমতো না হয়, যদি সব হত্যাকাণ্ডের যথাযথ বিচার না হয়, তাহলে সেটাই হবে বড় উদ্বেগের কারণ।
গত কয়েক মাসে সারা দেশে একধরনের মবের উৎপাত লক্ষ করা যাচ্ছে। মানবাধিকার ও আইনের শাসনের ক্ষেত্রে এ ঘটনাগুলোর প্রভাব কী?
সাঈদ আহমদ: মানবাধিকার এবং আইনের শাসনের জন্য এ ধরনের মব একটা বড় ঝুঁকি। ৫ আগস্ট বিগত স্বৈরাচারী সরকারের পতনের পর শুরুর দিকে যে ঘটনাগুলো ঘটেছে, সেগুলোকে আমরা মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে দেখতে পারি। কিন্তু ছয় মাস পর এসে যখন মব চলছে, তখন এ ঘটনাগুলোকে অন্যভাবে দেখার সুযোগ রয়েছে। সাম্প্রতিক কয়েকটি মবের ঘটনা আমরা যদি একটু ভালোভাবে বিশ্লেষণ করি, তাহলে দেখব, এগুলো ঠিক স্বতঃস্ফূর্ত নয়।
আমরা দেখেছি, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কারা ডাক দিচ্ছে, কীভাবে এগুলো সংগঠিত করা হচ্ছে। এ ঘটনাগুলোতে আমরা নির্দিষ্ট একটা-দুইটা বা কয়েকটা গ্রুপের ইনভলভমেন্ট দেখেছি। এ থেকে এগুলোকে ঠিক স্বতঃস্ফূর্ত জমায়েত মনে হয় না, বরং একটি উদ্দেশ্যমূলক কর্মকাণ্ড মনে হওয়াটাই স্বাভাবিক। এই গ্রুপগুলো মবকে একটা ‘মেথড’ বা পদ্ধতি হিসেবে ব্যবহার করছে।
দুঃখজনক হলো, কিছু ক্ষেত্রে সরকার এ মবগুলো দেখে না দেখার ভান করছে, আবার কোথাও দেখেও ব্যবস্থা নিচ্ছে না। মব নিয়ন্ত্রণ করতে না পারাটা এ সরকারের একটা ব্যর্থতা হিসেবে দেখা যায়; যদি এ রকম মব চলতে থাকে, তাহলে সেটা মানবাধিকার লঙ্ঘনের দিক থেকে একটা ভয়ংকর প্রবণতা তৈরি করবে।
আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে মানুষের মধ্যে উদ্বেগ রয়েছে। এ রকম অবস্থায় বিশেষ অভিযান ‘অপারেশন ডেভিল হান্ট’ শুরু হয়েছে। এর ফলাফল কী হতে পারে?
সাঈদ আহমদ: আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতির কথা বলে অপারেশন ডেভিল হান্ট পরিচালিত হচ্ছে। কিন্তু এ ধরনের অভিযান নিয়ে বহু দিক থেকেই প্রশ্ন তোলার সুযোগ রয়েছে। প্রথম হলো, এর নামকরণ। ‘ডেভিল’ মানে হলো ‘শয়তান’, আর ‘হান্ট’ হলো শিকার করা। এ ধরনের নাম ব্যবহার করে মানুষকে ‘ডিহিউম্যানাজাইড’ করা হয়। এটা মানবাধিকারের সঙ্গে কোনোভাবেই যায় না। একটা জিনিস খেয়াল করতে হবে, এই বিশেষ অভিযান শুরুর অল্প কয়েক দিনের মধ্যে ১০ হাজারের বেশি মানুষ গ্রেপ্তার হয়েছেন। অন্য সময় হলে আমরা হয়তো এ ঘটনাকে ‘গণগ্রেপ্তার’ বলতাম এবং এর প্রতিবাদ করতাম। এই বিশেষ অভিযানে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়গুলো মূল ধারার সংবাদমাধ্যমে আমরা এখনো খুব একটা পাচ্ছি না।
সরকারের পক্ষ থেকে এ অভিযানে গ্রেপ্তারের সংখ্যা জানানো হলেও, গ্রেপ্তারের পরে আসলে কী ঘটছে, আমরা তা জানি না। তাঁরা কি তাঁদের আইনি অধিকারগুলো পাচ্ছেন কি না—এটা জানা দরকার। অতীতে ‘অপারেশন ক্লিনহার্ট’-এর অভিজ্ঞতা আমাদের জন্য ভালো ছিল না। এ ধরনের বিশেষ অভিযানগুলো সব সময়ই মানবাধিকারের জন্য ঝুঁকি তৈরি করে।
জাতিসংঘের প্রতিবেদনে র্যাব বিলুপ্ত করার কথা বলা হয়েছে। মানবাধিকার সংগঠনগুলো এবং কোনো রাজনৈতিক দলও একই রকম দাবি করেছে। অন্যদিকে সরকার নাম ও পোশাক পরিবর্তনের কথা বলছে।
সাঈদ আহমদ: নাম বা পোশাক তো বহিরাবরণ, এগুলো পরবির্তন করে আসলে কাজের কাজ কিছুই হবে না। সমস্যা কিন্তু নাম বা পোশাকে নয়, সমস্যা হলো তারা যেভাবে কাজ করত, অর্থাৎ কাজের ধরন বা পদ্ধতি নিয়ে। র্যাবের কথা যদি বলি, তাহলে বলতে হবে, যে আইন ও ফ্রেমওয়ার্কে র্যাব চলছে, সেখানে তাদের কর্মকাণ্ডের জন্য একধরনের দায়মুক্তি পাওয়ার সুযোগ রয়েছে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ও দেশীয় মানবাধিকার সংস্থাগুলো, এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের দেওয়া নিষেধাজ্ঞায়ও র্যাবের বিরুদ্ধে কিছু সুনির্দিষ্ট অভিযোগ এসেছে। এর একটি হলো, র্যাবের মধ্যে একধরনের অতি সামরিকায়ন হয়েছে। তারা যে অস্ত্র ব্যবহার করে থাকে, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোর সাধারণত সে রকম অস্ত্র ব্যবহার করার কথা নয়। আরেকটি অভিযোগ হলো, র্যাব জবাবদিহির ঊর্ধ্বে চলে গিয়েছিল।
গুম–সংক্রান্ত কমিশন যে রিপোর্ট দিয়েছে, সেখানে কিন্তু অনেকগুলো ঘটনার সঙ্গে র্যাবের সম্পৃক্ততার কথা বলা হয়েছে। অন্যান্য বাহিনীর কথাও সেখানে এসেছে। লক্ষ করার মতো বিষয় হলো, এসব বাহিনীর কোনো সদস্য কোনো অপরাধ করলে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বলা হয়ে থাকে, এটা তাঁর ব্যক্তিগত দায়। কিন্তু বাহিনীর মধ্যে দায়মুক্তি ও জবাবদিহি না করার সংস্কৃতি চালু থাকলে, সেটা শুধু ব্যক্তির দায় হতে পারে না। এ রকম অবস্থায় শুধু নাম বা পোশাক পাল্টালে, সেটা শুধু ‘আইওয়াশ’–ই হবে, কাজের কাজ কিছু হবে না।
অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর সংখ্যালঘু এবং অন্যান্য জাতিসত্তা ইস্যু নিয়ে একধরনের উত্তেজনা তৈরি হয়েছিল। এ বিষয়গুলোকে কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন?
সাঈদ আহমদ: সংখ্যালঘু ও আদিবাসী ইস্যু দুটোকে আলাদাভাবে দেখতে হবে। সংখ্যালঘু, বিশেষভাবে আমরা যদি ধর্মীয় সংখ্যালঘু, আরও নির্দিষ্ট করে, যদি হিন্দু সম্প্রদায়ের কথা বলি, সেটা একটু জটিল ইস্যু। ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ বা তাঁদের স্থাপনার ওপর হামলার বেশ কিছু অভিযোগ আসতে শুরু করে। এটা অস্বীকার করার উপায় নেই, এ ঘটনাগুলোর একটা অংশ রাজনৈতিক। যদিও আমাদের দেশে অনেক দিন ধরে সত্যিকার অর্থে কোনো ভোট বা নির্বাচন হয়নি, তবু এমনটা মনে করা হয়, অন্য যেকোনো দলের চেয়ে আওয়ামী লীগের সঙ্গে হিন্দুধর্মাবলম্বী মানুষেরা বেশি সম্পৃক্ত। এর ফলে তাঁদের কেউ কেউ রাজনৈতিক কারণে আক্রান্ত হতে পারেন। এ ছাড়া অনেক দুষ্কৃতকারী বা সুযোগসন্ধানী সেই সময় পরিস্থিতির সুযোগ নিয়েছে। এর ফলে সাধারণ হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকদের আক্রান্ত হওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। এ রকম ঘটনা ৫ আগস্টের পরে যেমন ঘটেছে, তেমনি বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলেও হয়েছে। কিন্তু এবার বিষয়টা অনেক বেশি আলোচনায় এসেছে ভারতীয় মিডিয়ার অতিরঞ্জিত ও উদ্দেশ্যমূলক প্রচার-প্রপাগান্ডার কারণে। তারা এটাকে শুধু হিন্দু হওয়ার কারণে হামলার শিকার হয়েছেন, এমনটা দেখানোর চেষ্টা করছে। রাজনৈতিক, সাম্প্রদায়িক বা আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, যে কারণেই হোক না কেন, এগুলোকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই।
প্রতিটি ঘটনা যথাযথভাবে বিশ্লেষণ করা এবং সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন। তা না হলে এ রকম ঘটনা প্রতিরোধ করা যাবে না এবং সংখ্যালঘুদের ঝুঁকি কমবে না। আদিবাসী, বিশেষ করে পাহাড়ের আদিবাসীদের ইস্যুটা বেশ স্পর্শকাতর । ৫ আগস্টের পর আমরা সমতলের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষেরা যেভাবে একরকম মুক্তির স্বাদ পেয়েছি, পাহাড়ের মানুষেরা কি তেমনটা ফিল (অনুভব) করতে পেরেছেন? এর ফলে তাঁরা তাঁদের বঞ্চনার কথা তুলে ধরতে চেয়েছেন। কেউ কেউ আবার সেটা থামিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। এ ঘটনাগুলো অন্তর্ভুক্তিমূলক রাষ্ট্র ও সমাজ গড়ার ক্ষেত্রে অবশ্যই একটি বড় বাধা।
বেশ কয়েক বছর ধরেই বাংলাদেশে মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে বাধাগ্রস্ত করা হয়েছে। এখন পরিস্থিতির কতটা পরিবর্তন হয়েছে বলে মনে করেন?
সাঈদ আহমদ: মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে আমি শুধু আইনি কাঠামোর মধ্যে দেখি না, এটাকে একটা বড় চর্চার বিষয় হিসেবে দেখি। স্বৈরাচারী শাসনের কারণে আমরা দীর্ঘদিন এই চর্চা ঠিকমতো করতে পারিনি। বিগত আওয়ামী লীগ আমলে এটাকে নানাভাবে নিবৃত্ত করা হয়েছে। কখনো ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনের মতো আইনের মাধ্যমে, কখনো ট্যাগিংয়ের মাধ্যমে অথবা সেন্সরশিপ আরোপ বা সোশ্যাল মিডিয়া ব্লকিং করে এগুলো করা হয়েছে। মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে আগের চেয়ে কিছু উন্নতি অবশ্যই হয়েছে। এখন হয়তো মতপ্রকাশ বা লেখালেখির জন্য আইনি ঝামেলা কম হচ্ছে। কিন্তু মতপ্রকাশের জন্য আরও অনেক বাধা রয়ে গেছে।
ভিন্নমত বা সমালোচনা গ্রহণের সংস্কৃতি এখনো খুব দুর্বল। জনপ্রিয় বা পপুলিস্ট মতের বাইরে কোনো কিছু বলা বা লেখার সুযোগ কতটা তৈরি হয়েছে, সেটা নিয়ে অনেক প্রশ্ন রয়েছে। মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে আইনগত এবং রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক যত ধরনের বাধা আছে, সেটা দূর করার ক্ষেত্রে অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে খুব বেশি অগ্রগতি হয়েছে, সেটা বলা যাবে না। এই বিষয়ে তাদের আরও অনেক কিছু করার আছে বলে আমি মনে করি।
প্রায় ১৫ বছর আগে মানবাধিকার কমিশন গঠিত হলেও মানবাধিকার রক্ষায় বাস্তবে এর কোনো ভূমিকা নেই। এই কমিশনকে কীভাবে কার্যকরী করা যায়?
সাঈদ আহমদ: মানবাধিকার কমিশন নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারেরও একধরনের নিষ্ক্রিয়তা লক্ষ করা গেছে। আগের আমলে নিয়োগ পাওয়া কমিশনের সদস্যরা পদত্যাগ করলেও নতুন সদস্য নিয়োগ পাননি। এটা একটু হতাশাজনক।
২০০৯ সালের একটি আইন দিয়ে মানবাধিকার কমিশন গঠিত হয়েছিল। কিন্তু শুরু থেকেই এর কিছু ঘাটতি বা সীমাবদ্ধতা ছিল। বর্তমান সরকারের উপদেষ্টা পরিষদে বেশ কয়েকজন মানবাধিকারকর্মী রয়েছেন। বিভিন্ন সময় তাঁরা নিজেরাও এসব নিয়ে বিভিন্ন ফোরামে কথা বলেছেন। বর্তমান মানবাধিকার কমিশনের একটি বড় সীমাবদ্ধতা হলো, তাদের ম্যান্ডেট খুব সীমিত।
যেমন ধরেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যদি মানবাধিকার লঙ্ঘন করে, তাহলে কমিশনের সেটা নিয়ে তেমন কিছু করার নেই। কিন্তু বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা থেকে দেখা গেছে, মানবাধিকার লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভূমিকা বেশ বড়। রাষ্ট্রীয় বাহিনীগুলোর মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে মানবাধিকার কমিশন যদি কার্যকর ভূমিকা রাখতে না পারে, তাহলে সেই কমিশন নাগরিকের মানবাধিকার কতটা রক্ষা করতে পারবে, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।
মানবাধিকার কমিশনের সদস্য মনোনয়নপ্রক্রিয়া এবং বাজেট বরাদ্দ নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। সরকার সম্প্রতি এ ক্ষেত্রে কিছু পরিবর্তন এনেছে। কিন্তু এগুলো খুব কাজের কিছু হবে বলে মনে হয় না।
মানবাধিকার নিয়ে অনেক সময় পক্ষপাতমূলক অবস্থানের অভিযোগ ওঠে। রাজনীতির সঙ্গে মানবাধিকারের কি কোন সম্পর্ক আছে?
সাঈদ আহমদ: মানবাধিকারের সঙ্গে রাজনীতির মধ্যে একটা ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে। মানবাধিকার মানে মানুষের অধিকার, আবার রাজনীতিও মানুষের অধিকারের কথা বলে। এটা অনেকটা এমন, একই ফিল্ডে (বিষয়ে) দুটি ভিন্ন অ্যাপ্রোচ বা দৃষ্টিভঙ্গি। এতে মানবাধিকার ও রাজনীতির মধ্যে অনেক বিষয়ে ওভারল্যাপিং হয়, কখনো কখনো কনফিউশন (বিভ্রান্তি) তৈরি হয়। এই কনফিউশন থেকে দূরে থাকার উপায় হলো, বস্তুনিষ্ঠ থাকা। আমাদের এখানে অনেক মানবাধিকারকর্মী সেটা পারেননি বা পারছেন না। অনেক ক্ষেত্রেই তাঁরা তাঁদের রাজনৈতিক পক্ষপাত, ব্যক্তিগত সম্পর্ক কিংবা সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার কারণে নিরপেক্ষতা হারাচ্ছেন। একজন মানবাধিকারকর্মী হিসেবে আমি মনে করি, মানবাধিকার নিয়ে কোনো পক্ষপাত করা চলে না।
সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
সাঈদ আহমদ: আপনাকেও ধন্যবাদ।