সরকারের এক বছর হলো। আপনি তিনটি বড় মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে আছেন। এক বছরের অভিজ্ঞতা কী, কোন কোন বিষয়ে আপনি ভালো করলেন বলে মনে করেন?
মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান: অর্থপূর্ণ উন্নয়নের জন্য আসলে এক বছর যথেষ্ট নয়। সময় একটা বড় সীমাবদ্ধতা। যেমন রেলে ইঞ্জিন ও কোচের সংকট আছে। আজ ক্রয়াদেশ দিলে দুই থেকে আড়াই বছর লাগবে আসতে। গ্যাস খাতের সমস্যা হচ্ছে, স্থানীয় গ্যাসের উৎপাদন কমছে। উৎপাদন বাড়াতে এ বছরের মধ্যে ৫০টি কূপ ও আগামী বছর থেকে আরও ১০০টি কূপ খননের কাজ চলবে। এটা কয়েক বছর লাগবে। নতুন গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কৃত হলে প্রক্রিয়াকরণ প্ল্যান্ট ও পাইপলাইন করে গ্যাস উৎপাদন করতে সময় লাগে। এগুলো সবই সময়সাপেক্ষ; অন্তত তিন বছর লাগে, যা হাতে নেই। তাই আমরা চেয়েছি এমন একটা জায়গা তৈরি করতে, যাতে পরের সরকার এগুলো করতে পারে। যে সংকটের মধ্যে এ সরকার কাজ শুরু করেছে, সেটির মধ্যে যেন আগামী সরকারকে পড়তে না হয়।
তবু স্বল্প সময়ে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির বিপুল বকেয়া বিল পরিশোধ করা হয়েছে। প্রতিযোগিতামূলক দরপত্রের ব্যবস্থা করে অর্থ সাশ্রয়ের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এতে খরচ কমে আসছে। চলতি অর্থবছরে ৩৭ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি বরাদ্দ রাখা হয়েছে। এটি আগের তুলনায় অনেক কম। গত সরকার আইন ও নীতিমালা করে দুর্নীতি করেছে। আমরা এসে বিতর্কিত আইন ও কিছু নীতিমালা বাতিল করেছি। বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম নির্ধারণের ক্ষমতা বিইআরসির হাতে ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে। উল্লেখযোগ্য উন্নয়ন করতে চার থেকে পাঁচ বছর সময় লাগে।
একজন শিক্ষক হিসেবে সব মিলিয়ে আপনার নিজের কাজ এবং সরকারকে কত নম্বর দেবেন?
ফাওজুল কবির খান: এটা আসলে আমার করা ঠিক হবে না। এটা জনগণ, যাঁরা সেবাগ্রহীতা, তাঁরা ভালো বলতে পারবেন। তবে সময় একটা বড় সীমাবদ্ধতা। বড় ধরনের দৃশ্যমান পরিবর্তনের জন্য সময়টা যথেষ্ট নয়। অনিয়ম ঠিক করতেই বেশির ভাগ সময় চলে গেছে। আরেকটি বড় সীমাবদ্ধতা হলো, সরকারের কোনো চিয়ারলিডার নেই। যারা রাস্তায় থেকে সরকারের কাজকে সমর্থন দেবে। নীরব জনসমর্থন আছে; কিন্তু গোষ্ঠীগত সমর্থন নেই। ছাত্ররা শুরুতে সমর্থন জুগিয়েছে, পরে তারা নিজেদের রাজনৈতিক দল করেছে। সরকারকে দুই শতাধিক আন্দোলন মোকাবিলা করতে হয়েছে।
তবে এর মাঝেও বেশ কিছু কাজ করে যাচ্ছি আমরা। এ দায়িত্বে থেকে আগে লোকজন কী করছে আর আমরা কী করতে পারলাম; ব্যক্তিগত জায়গা থেকে দৃষ্টান্ত তৈরি করার চেষ্টা করছি। দেখানো হয়েছে, বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার কীভাবে স্থিতিশীল করতে হয়। মূল্যস্ফীতি কীভাবে কমিয়ে আনা যায়। বাজারব্যবস্থা ব্যবহার করে অর্থনীতি পরিচালনা করা। আগে লোডশেডিং হতো, এবারের গ্রীষ্মে হয়নি। বিদ্যুতের দাম একবারও বাড়ানো হয়নি। কেনাকাটায় খরচ কমানোর উপায় দেখিয়ে দেওয়া হয়েছে।
সৌদি আরবে গিয়ে ক্রাউন প্রিন্সের সঙ্গে বৈঠক হয়েছে। তাঁরা শুরুতেই জানতে চেয়েছেন, সরকারের মেয়াদ কত দিন। তখন মেয়াদ বাকি ছিল এক বছরের মতো। তাঁরা বলেন, একটি বিনিয়োগ প্রস্তাব চূড়ান্ত করতেই তো এক বছর লাগে। এ কারণেই আমরা চাইছি দ্রুত নির্বাচন হয়ে যাক। একটি দীর্ঘমেয়াদি সরকার আসুক, বিনিয়োগ হোক। এখন আমরা যদি সমুদ্রে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের দরপত্র আহ্বান করি, তাহলে বিনিয়োগকারীরা অংশ নেবেন না। এ জন্য দরপত্রের জন্য প্রয়োজনীয় সব নথি তৈরি করে রাখা হচ্ছে, যাতে নতুন সরকার এসেই দরপত্র আহ্বান করতে পারে।
গত বছরের ৮ আগস্ট প্রকাশিত লেখায় আপনি সবার জন্য সমান সুযোগ তৈরির কথা বলেছিলেন। শপথ গ্রহণের সাত দিনের মধ্যেই নিজের ও পরিবারের সম্পদ বিবরণী ও কর দেওয়ার নথি সরকারের কাছে দাখিল করে জবাবদিহির সূত্রপাত করবেন বলে আশা প্রকাশ করেছিলেন। এরপর আপনি নিজেও সরকারে যোগ দিয়েছেন। এটা কতটুকু হলো?
ফাওজুল কবির খান: কাজে যোগদানের ১৫ দিনের মধ্যে আমি সম্পদের হিসাব বিবরণী মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে জমা দিয়েছি। অন্য সব উপদেষ্টাও জমা দিয়েছেন। এটি প্রকাশ করা তো অন্য একটি বিষয়। এখন প্রকাশ করলে অযথা বিতর্ক তৈরি হতে পারে। দায়িত্ব হস্তান্তরের সময় আবার সম্পদের হিসাব জমা দিয়ে যাব। এরপর সাংবাদিকেরা মিলিয়ে দেখতে পারেন। দেড় বছরে সম্পদ কতটা বাড়ল বা কমল, এটি একটি চমকপ্রদ কাজ হতে পারে সাংবাদিকদের জন্য।
গণ-অভ্যুত্থানের পর অন্তর্ভুক্তিমূলক শব্দটা বেশ আলোচনায় আসে। আপনি আরও চার বছর আগেই দেশে বিদ্যমান বিভেদ দূর করতে অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ তৈরিকে সমাধান হিসেবে দেখতেন। গত এক বছরে অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ তৈরি কি এগিয়েছে, নাকি বিভেদ আরও বেড়েছে?
ফাওজুল কবির খান: অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজের একটি হলো সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীকে অন্তর্ভুক্ত করা। কিছুদিন আগে মন্দিরের জন্য রেলের জমি দেওয়া হয়েছে, এমন নজির অতীতে নেই। সীতাকুণ্ডের পাহাড়ে চন্দ্রনাথ মন্দিরের কাছে একটি গোষ্ঠী মসজিদ বানাতে চেয়েছে। এটা তো উদ্দেশ্যমূলক; এমন কখনো হয়নি আগে। তাই পরিষ্কার বলে দেওয়া হয়েছে, এসব করা যাবে না; বরং উল্টোটা করা হবে।
চন্দ্রনাথ মন্দিরে যেতে সিঁড়িগুলো ভেঙে গেছে, তাই এগুলো মেরামত করতে স্থানীয় প্রশাসনকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এটা ধর্মীয় দিক থেকে অন্তর্ভুক্তি। আরেকটি হলো, অনগ্রসর জনগোষ্ঠীকে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করা। যেমন একজন রিকশাচালকের আয়ের ওপর অন্তত চারজনের পরিবার নির্ভর করে। তাই হুট করে রিকশা বন্ধ করে দিলেই হবে না। আগে তাঁদের বিকল্প আয়ের ব্যবস্থা করতে হবে। রিকশা না তোলার এটিও একটি কারণ।
দরিদ্র লোক সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হন মূল্যস্ফীতির কারণে, বাজারে দাম বাড়লে তাঁদের ওপর চাপ পড়ে। তাই মূল্যস্ফীতি কমানোর দিকে জোর দেওয়া হয়েছে, এটি এখনো নিম্নমুখী আছে। আসলে কেক যদি আকারে ছোট হয়, কাটার পর কেউ কম বা বেশি পেতে পারে। তাই কেকটা বড় করার চেষ্টা করছি আমরা। যদিও আমরা নতুন করে তেমন কর্মসংস্থান তৈরি করতে পারিনি। কর্মসংস্থান হয় বিনিয়োগ থেকে। স্বল্পমেয়াদি সরকারের সময় বিনিয়োগ আকৃষ্ট করা কঠিন।
দেশে এখন প্রধান আলোচনা নির্বাচন ফেব্রুয়ারিতে হবে তো? আর নির্বাচন হলে আওয়ামী লীগের জায়গা থাকবে কি না? আমরা বলতে চাইছি মূল আওয়ামী লীগ বা পরিশুদ্ধ আওয়ামী লীগের একটি আলোচনা চলছে। নির্বাচন নিয়ে আপনার মতামত কী?
ফাওজুল কবির খান: ঘোষিত সময়ে নির্বাচন হবে বলেই সরকার মনে করে। কেননা, বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান বাড়াতে হলে দীর্ঘমেয়াদি সরকার দরকার। আমরা আগামী সরকারের জন্য ক্ষেত্র তৈরি করে যাচ্ছি। অর্থনীতি লাইনচ্যুত হয়ে গিয়েছিল, আমরা আবার এটিকে লাইনে তুলে দিয়েছি। এখন চাইলে এটিকে ভালোভাবে পরিচালনা করা সম্ভব।
আওয়ামী লীগের কী হবে তা আওয়ামী লীগ বলতে পারবে। আওয়ামী লীগের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নির্বাচন কমিশন নেবে। আওয়ামী লীগের ভোটারদের তো কেউ খারিজ করে দেয়নি। তাদের তো বলা হয়নি তোমরা আওয়ামী লীগ সমর্থন করো ভোট দিতে পারবে না। আওয়ামী লীগের যাঁরা নির্যাতনের সঙ্গে, লুটপাটের সঙ্গে জড়িত নয়; তাঁরা তো প্রার্থী হতে পারেন। তাঁরা স্বতন্ত্র প্রার্থী হতে পারেন বা অন্য দল থেকে প্রার্থী হতে পারেন। তাঁদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করার সুযোগ তো বাতিল করা হয়নি। দল হিসেবে দলীয় প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করতে পারবে কি না; সেটি নির্বাচন কমিশনের বিষয়, সরকারের বিষয় নয়।
প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস একাধিকবার বলেছেন যে ইতিহাসের সেরা নির্বাচন হবে। নির্বাচন কমিশনাররা বলেছেন, এবারের নির্বাচন সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ। আপনি কি মনে করেন যে সামনের নির্বাচনটা ইতিহাসের সেরা নির্বাচন হওয়ার মতো বাস্তব পরিস্থিতি আছে?
ফাওজুল কবির খান: আসলেই এবারের নির্বাচনটা চ্যালেঞ্জিং। আমরা চেষ্টা করছি অবাধ, নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের ক্ষেত্র প্রস্তুত করার। ২০১৮ সালে যাঁরা নির্বাচনের অনিয়মের সঙ্গে জড়িত ছিলেন, তাঁদের সবাইকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। এটা করা হয়েছে এ কারণে যে এখন যাঁরা দায়িত্ব পালন করবেন; তাঁরাও জেনে গেলেন ভবিষ্যতে জবাবদিহি করতে হতে পারে। সাবেক দুই প্রধান নির্বাচন কমিশনার এখন কারাগারে। পরিণতিটা সবার সামনে আছে, এটা দেখে সতর্ক হতে পারেন। ভোটে বাধা দেওয়া, পোলিং এজেন্ট সরিয়ে দেওয়ার ঘটনা এবার ঘটবে না। সাংবাদিকেরাও মুক্তভাবে দায়িত্ব পালন করবেন।
এবার আপনার মন্ত্রণালয়কেন্দ্রিক কয়েকটি প্রশ্ন করি। গত সরকারের করা দায়মুক্তি আইন হিসেবে পরিচিত দ্রুত বিদ্যুৎ ও জ্বালানির সরবরাহ বৃদ্ধি বিশেষ বিধান আইন রহিত করা হয়েছে; কিন্তু ওই আইনে করা চুক্তি নিয়ে নানা বিতর্ক আছে। সেসব চুক্তি বহাল রাখা নিয়ে কী বলবেন?
ফাওজুল কবির খান: চুক্তিগুলো বহাল রাখার সবচেয়ে বড় কারণ হলো এগুলো আন্তর্জাতিক চুক্তি। ঋণ নিয়ে এসব প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছে। এডিবি, বিশ্বব্যাংক ছাড়াও বড় বড় বাণিজ্যিক ব্যাংকের অর্থায়ন আছে। তাই বাতিল না করে ট্যারিফ পর্যালোচনার জন্য একটি কমিটি কাজ করছে। এটি নিয়েই ইতিমধ্যে আপত্তি জানিয়েছে এডিবি। এ ছাড়া চাইলেই তো চুক্তি বাতিল করা যায় না, আইনি ব্যাপার আছে। চুক্তির শর্ত ভঙ্গ করলে বা আদালতে প্রমাণযোগ্য দুর্নীতির প্রমাণ পেলে বাতিল করা যায়। বিদ্যুৎ খাত নিয়ে গঠিত জাতীয় কমিটি এগুলো নিয়ে কাজ করছে। তারা ধীরে এগোচ্ছে। তবে তারা দুর্নীতি, বিশেষ করে টাকা লেনদেনের তথ্য–প্রমাণ সংগ্রহ করছে। আবার এক হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্রের চুক্তি বাতিল করলে তার তো বিকল্প সংস্থান করতে হবে। না হলে তো বিদ্যুৎ–ঘাটতি তৈরি হবে, লোডশেডিং বেড়ে যাবে।
অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর আদানি, রামপালসহ বিতর্কিত বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের চুক্তি বাতিল করার চাপ আছে। যার কোনোটি এখনো বাতিল বা সংশোধন করা হয়নি। চুক্তি বাতিলের কি আদৌ সুযোগ আছে?
ফাওজুল কবির খান: বাড়তি খরচ নিয়ে আদানির সঙ্গে আলোচনা চলছে। আদানি এটিকে আরবিট্রেশনের (সালিসি) দিকে নিয়ে যাচ্ছে। এর প্রথম ধাপ হচ্ছে, প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা পর্যায়ের বৈঠক; যা হয়ে গেছে। দ্বিতীয় ধাপ হচ্ছে মেডিয়েটর (মধ্যস্থতাকারী) নিয়োগ করা, যা এখনো হয়নি। আদানি যদি সালিসির দিকে যায়, তা মোকাবিলায় প্রস্তুত থাকতে হবে। সালিসির জন্য অভিজ্ঞ ও আন্তর্জাতিক আইনজীবী নিয়োগের প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। চুক্তি বাতিলে আইনি ব্যত্যয় হলে বড় ধরনের ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।
গত সরকারের সময় দরপত্র ছাড়া, আলোচনার মাধ্যমে খরচ ধরে বিদ্যুৎকেন্দ্রের চুক্তি করা হয়েছে। রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রে বাড়তি খরচ করা হচ্ছে। বিদেশি বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানে দেশি ও বিদেশি কর্মী নিয়োগের আনুপাতিক হার বেঁধে দেওয়া আছে।
যদিও গত সরকারের সময় বিদ্যুৎ খাতে বিনিয়োগ বোর্ডের কোনো বিধিনিষেধ কাজ করেনি। রামপাল বেশিসংখ্যক বিদেশিদের নিয়োগ করেছে। স্থানীয় লোকজনের চেয়ে তাঁদের বেতন পাঁচ গুণ বেশি। ফলে ব্যয় বেড়ে গেছে। বিনিয়োগ বোর্ডকে এটি দেখতে বলা হয়েছে। কয়লা কেনায় বাড়তি খরচ করা হচ্ছে। এগুলো ঠিক করার চেষ্টা চলছে। মাতারবাড়ী কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রে প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদনের খরচ ৮ টাকা ৪৫ পয়সা। বাকিদের তো ১২-১৪ টাকা হতে পারে না। মাতারবাড়ীর খরচ ধরে সব কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন খরচ পর্যালোচনা করা হচ্ছে।
ক্যাপাসিটি চার্জ নিয়ে অনেক সমালোচনা ছিল গত সরকারের বিরুদ্ধে। আপনিও সমালোচনা করেছেন। সেই ক্যাপাসিটি পেমেন্ট তো কমেনি। সরকারের গঠিত কমিটি চুক্তি পর্যালোচনা করে উৎপাদন ব্যয় কমানোর কথা, তাতেও দৃশ্যমান অগ্রগতি নেই। কেন এত দেরি হচ্ছে?
ফাওজুল কবির খান: ক্যাপাসিটি চার্জ নিয়ে একটি ভুল ধারণা আছে। এটি মূলত বিদ্যুৎকেন্দ্রের মূলধন খরচ। ঋণ নিয়ে বিদ্যুৎকেন্দ্র বানানো হয়। তাই ক্যাপাসিটি চার্জ না থাকলে কেউ বিনিয়োগ করবে না। বিদ্যুৎকেন্দ্রের চুক্তিতে দুটি খরচ ধরা আছে, একটি মূলধন খরচ ও অন্যটি পরিচালন খরচ। তাই বিদ্যুৎ উৎপাদন করুক আর না করুক, ক্যাপাসিটি চার্জ দিতেই হবে। না হলে ঋণ শোধ করতে পারবে না। তবে এখন এটি পর্যালোচনা করা হচ্ছে। যে বিদ্যুৎকেন্দ্রের ঋণ শোধ হয়ে গেছে, তাদের ক্যাপাসিটি চার্জ বাদ দিতে হবে। মূল সমস্যা ছিল প্রতিযোগিতা ছাড়া চুক্তি করা। এতে খরচ বাড়তি দেখিয়ে ক্যাপাসিটি চার্জ বেশি নেওয়ার সুযোগ তৈরি করে দেওয়া হয়েছে। আদানি, পায়রা, রামপাল—সবাই খরচ বাড়িয়ে চুক্তিতে ট্যারিফ নির্ধারণ করে নিয়েছে। এগুলো এখন যাচাই করে দেখা হচ্ছে। আরেকটি বড় সমস্যা হচ্ছে চাহিদার চেয়ে বেশি হারে বিদ্যুৎকেন্দ্র বানানো হয়েছে। জ্বালানি নিশ্চিত না করেই এগুলো করা হয়েছে। ব্যবসায়িক সুবিধা দিতে ও নিজেরা লাভবান হতে এসব বিদ্যুৎকেন্দ্র করা হয়েছে।
আপনার মতে, বৃহৎ ভৌত–অবকাঠামো, বিশেষত যোগাযোগ অবকাঠামো প্রকল্প রাজনীতিবিদদের অতি প্রিয়। এসব প্রকল্প নিয়ে আপনার সমালোচনা ছিল। দায়িত্ব নেওয়ার পর এমন কোনো প্রকল্প কি বাদ দিয়েছেন?
ফাওজুল কবির খান: মেগা প্রকল্পে প্রতিযোগিতা কম হয়, দুর্নীতি হয়। তারপর আবার শর্তের বেড়াজাল থাকে। এরপর এটি বাস্তবায়নে বাড়তি সময় নিয়ে খরচ বাড়ানো হয়। তাই মেগা প্রকল্পে অত আগ্রহ দেখানো হচ্ছে না। তবে জরুরি প্রকল্প যেমন জ্বালানি তেল পরিশোধনের সক্ষমতা বাড়ানোর প্রকল্পটি নেওয়া হয়েছে।
অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প বা কোনো প্রকল্পের অপ্রয়োজনীয় খরচের অংশ বাতিল করা হচ্ছে। পদ্মা সেতুর দুই প্রান্তে রেললাইন নির্মাণ প্রকল্পে ফরিদপুরের ভাঙ্গায় খোলা মাঠে শীতাতপনিয়ন্ত্রিত রেলস্টেশন করা হচ্ছিল। অথচ আশপাশে লোকালয় নেই। কমলাপুরেও এমন ব্যবস্থা নেই। তাই শীতাতপনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা বাদ দেওয়া হয়েছে। বিভিন্ন প্রকল্পে রেস্টহাউস, ডরমিটরি কেটে দেওয়া হচ্ছে। রেলে সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের নামে কোটি কোটি টাকা খরচ করে। সম্ভাব্যতা যাচাই আসলে নিজেরাই করে; কিন্তু ঠিকাদারের সঙ্গে যোগসাজশ করে টাকা নিয়ে যায়।
এখন থেকে এটি নিজেদের করতে বলা হয়েছে। আগে আন্তর্জাতিক এজেন্সি নিরপেক্ষভাবে কাজ করত, এখন তারাও দুর্নীতির অংশ হয়ে যাচ্ছে। এমনভাবে শর্ত ঠিক করে দেয়, নির্দিষ্ট কয়েকজন ছাড়া দরপত্রে কেউ অংশ নিতে পারে না। এগুলো এখন দেখা হচ্ছে। কিশোরগঞ্জের মিঠামইনে গত সরকারের সময় করা সড়কটি নানা সমস্যা তৈরি করেছে। তাই উপযোগিতা যাচাই করে সেখানে উড়ালসড়ক নির্মাণ প্রকল্প বাদ দেওয়া হয়েছে।
ঢাকায় দুই লাখ কোটি টাকা ব্যয়ে সরকার কি মেট্রোরেলের দুটি লাইন নির্মাণ করবে? প্রতি কিলোমিটারে তিন হাজার কোটি টাকার বেশি খরচ হবে। এত ব্যয় করার পর মানুষ চড়া ভাড়ার মুখে পড়বেন কি?
ফাওজুল কবির খান: জাপান বড় ও গুরুত্বপূর্ণ দাতা। তবে এ খরচ সহনীয় নয়। তাই বিশ্বব্যাংক, এডিবি ও অন্যান্য দাতাগোষ্ঠীর সঙ্গে আলোচনা করা হচ্ছে। এমনভাবে শর্ত তৈরি করা হবে, যাতে মেট্রোরেল নির্মাণে জাপান ও অন্য দেশ মিলে অনেক বেশি কোম্পানি প্রতিযোগিতা করতে পারে। জাপানের প্রযুক্তি ভালো; কিন্তু খরচ তো সহনীয় হতে হবে। পাশের দেশ ভারত বা থাইল্যান্ডে কত খরচ হচ্ছে তা দেখা হচ্ছে।
সড়কে পুরোনো যানবাহন, ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার দাপট—এসব ক্ষেত্রে কি নৈরাজ্য চলতেই থাকবে? দুর্ঘটনায় প্রাণহানি বছরে ৪০ শতাংশ বাড়ছে। কীভাবে দেখেন?
ফাওজুল কবির খান: সড়ক দুর্ঘটনা বাড়ছে। এর কয়েকটি কারণ আছে। পরিবহন খাতেও একটি মাফিয়া চক্র কাজ করে। সব বাস আনা হয় একটি দেশ থেকে। এসব বাস উচ্চমানের নয়। এগুলো ৫ থেকে ১০ বছর চলার উপযোগী। বিদেশে একটি বাস ২০ থেকে ৩০ বছর চলে। মেয়াদোত্তীর্ণ, নিম্নমানের এসব যানবাহন দুর্ঘটনা ঘটায়, এগুলো সরাতে হবে। তাই আগে গুণগত মানের বাস আনার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। বাণিজ্য উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠক করা হবে আমদানি সহজ করতে। আর অর্থায়নে সুদের হার কমাতে বাংলাদেশ ব্যাংক ও অন্যান্য ব্যাংকের সঙ্গে বৈঠক করব। বাস ডাম্পিংয়ের জায়গারও ব্যবস্থা করা হয়েছে। এখন হঠাৎ ১০ হাজার বা ২০ হাজার গাড়ি সড়ক থেকে তুলে নিলে যাতায়াতে সংকট তৈরি হতে পারে। আবার পরিবহন খাতে ধর্মঘটের হুমকি আছে। তাই আগে নতুন যানবাহন রাস্তায় নামানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। এ ছাড়া বিশ্বব্যাংকের প্রকল্পের আওতায় রাস্তায় সংকেতব্যবস্থা আধুনিকায়ন করা হচ্ছে। অ্যাম্বুলেন্স কেনা হচ্ছে, যাতে দুর্ঘটনায় আহত মানুষদের দ্রুত হাসপাতালে নেওয়া যায়।
সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
ফাওজুল কবির খান: আপনাদেরও ধন্যবাদ।