বিশেষ সাক্ষাৎকার মো. শহীদুল হক

বাংলাদেশের ট্রেন ভবিষ্যতে ভারত হয়ে ভুটান ও নেপালে যাবে

তিন সপ্তাহের কম ব্যবধানে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারত ও চীন সফর করেন। এ সফরে বাংলাদেশের প্রত্যাশা কতটা পূরণ হলো, তিস্তা প্রকল্পের ভবিষ্যৎ ও আঞ্চলিক ভূরাজনৈতিক টানাপোড়েনে বাংলাদেশের অবস্থান—এসব বিষয়ে কথা বলেছেন সাবেক পররাষ্ট্রসচিব ও নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক মো. শহীদুল হক। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন রাহীদ এজাজ

প্রথম আলো:

প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফর কেমন হলো? বাংলাদেশের প্রত্যাশার কতটা পূরণ হলো?

মো. শহীদুল হক: প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফর খুব সময়োপযোগী ও ফলপ্রসূ হয়েছে। এ সফরে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি স্পষ্ট করে বলেছেন, তাঁদের দেশের সব নীতির নিরিখে বাংলাদেশকে বিবেচনায় নেওয়া হয়। এ সফরে একটি ভিশন স্টেটমেন্ট সই হয়েছে।

প্রথম আলো:

ভবিষ্যৎ-মুখী সম্পর্কের পটভূমি থেকে সফরটা ভালো হয়েছে বলতে চাইছেন?

শহীদুল হক: এ সফরের মধ্য দিয়ে দুই দেশের নেতারা সহযোগিতার পথনকশা তৈরির নির্দেশনা দিয়েছেন।

প্রথম আলো:

সম্পর্কে যেমন ভবিষ্যৎ থাকে, এতে অতীত আর বর্তমানও থাকে। তিস্তা চুক্তি ঝুলে আছে দীর্ঘদিন ধরে। সম্প্রতি ভারত তিস্তার যৌথ পানি ব্যবস্থাপনায় আগ্রহ দেখিয়ে কারিগরি দল পাঠানোর প্রস্তাব দিয়েছে। এ ধরনের প্রকল্পে যৌথ কারিগরি দল যুক্ত হলে সমস্যার সমাধান দীর্ঘমেয়াদি হয়ে থাকে। এমন এক পরিপ্রেক্ষিতে প্রস্তাবিত তিস্তা বৃহদায়তন প্রকল্পের ভবিষ্যৎকে কীভাবে দেখেন?

শহীদুল হক: তিস্তার পানিবণ্টন যে গুরুত্বপূর্ণ ও জটিল, এটা বোধ হয় বাংলাদেশ ও ভারত দুই পক্ষই জানে। ভারত এটা জানে যে তিস্তার পানিবণ্টনের ক্ষেত্রে তারা কিছু করতে পারছে না আর বাংলাদেশ অন্য দেশের সঙ্গে তিস্তা প্রকল্প (ভাটিতে পানি সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনা) নিয়ে আগ্রহ দেখিয়েছে। সে কারণে তিস্তা চুক্তি নিয়ে বসে না থেকে ভারত তিস্তা প্রকল্পে বাংলাদেশকে সহায়তার চেষ্টা করছে। এ উপলব্ধি ভারতের হয়েছে যে তিস্তা দুই দেশের সম্পর্কে ক্ষতের সৃষ্টি করেছে এবং সে ক্ষত বড় হচ্ছে।

প্রথম আলো:

আপনি বলতে চাইছেন, তিস্তা চুক্তি না হওয়াটা সম্পর্কে ক্ষত তৈরি করেছে, ভারত সরকারের এই উপলব্ধি হয়েছে?

শহীদুল হক: আমি লক্ষ করেছি, শুধু ভারত সরকার নয়; দেশটির নানা পর্যায়ে এমন উপলব্ধি হয়েছে। সেখানকার লোকজনের সঙ্গে কথা বলে মনে হয়েছে, আলোচনা করে চূড়ান্ত হওয়ার পর তিস্তা চুক্তি সই হওয়া উচিত ছিল। তাই যে ক্ষতিটা হয়েছে, সেটা কীভাবে পুষিয়ে দেওয়া যায়, সেটি এখন বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে।

প্রথম আলো:

এ সফরে দুই দেশের মধ্যে পণ্যবাহী ট্রেন চলাচলে একটি সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে। বাংলাদেশের ভূখণ্ড ব্যবহার করে ভারতের ট্রেন দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে যাবে। রাজনৈতিক অঙ্গনে এ নিয়ে প্রচুর বিতর্ক তৈরি হয়েছে। শেষ পর্যন্ত রেলের সমঝোতা স্বাক্ষরের ফলে কী হবে? এতে কোন দেশ বেশি লাভবান হবে?

শহীদুল হক: বাংলাদেশ কী ধরনের সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করেছে, সেটা পরিষ্কার হওয়া জরুরি। ভবিষ্যতে বাংলাদেশের ট্রেন ভারত হয়ে ভুটান ও নেপালে যাবে। আবার ভারতের পাশাপাশি ভুটান ও নেপালের ট্রেনও বাংলাদেশে আসা-যাওয়া করতে পারবে। ভারতের সঙ্গে নেপাল ও ভুটানের রেল যোগাযোগ আছে। আমাদের সঙ্গে নেই। এখন ভারতের সঙ্গে আমাদের সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হওয়ায় রেলপথে নেপাল ও ভুটানে যাওয়ার পথ সুগম হলো।

প্রথম আলো:

ভারতের পাশাপাশি নেপাল ও ভুটানে রেলপথে পণ্য ও লোকজন যাওয়ার পথ সুগম হওয়ায় বাংলাদেশ এর সুফল পাবে বলছেন। কিন্তু ভারত হয়ে নেপাল ও ভুটানে চলাচলের ক্ষেত্রে কিছুটা ঘাটতির কথা শোনা যায়?

শহীদুল হক: এটা ঠিক যে নেপাল ও ভুটানের রেল নেটওয়ার্ক এখনো অতটা তৈরি হয়নি। তবে চার দেশের মধ্যে পুরোদমে রেল যোগাযোগ শুরু হওয়ার আগে তা তৈরি হয়ে যাবে। সামগ্রিকভাবে এই সমঝোতা স্মারক সইয়ের ফলে তা বাস্তবায়নের জন্য মাশুল, নিরাপত্তাসহ প্রয়োজনীয় নানা দিক ঠিক করা হবে। কাজেই রেল যোগাযোগ সব পক্ষের জন্য সমান সুযোগ তৈরি করবে।

প্রথম আলো:

বাংলাদেশের ভূখণ্ড হয়ে আসাম থেকে বিহারে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হবে। এ জন্য সঞ্চালন লাইন তৈরি হবে। এ সঞ্চালন লাইন হওয়ার ফলে বাংলাদেশ কতটা সুফল পাবে?

শহীদুল হক: আমার জানামতে, কখনো প্রয়োজন হলে এই সঞ্চালন থেকে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ পেতে পারে।

প্রথম আলো:

বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্কের মাত্রা ঐতিহ্য, ইতিহাস, মিত্রতা নানা কারণে অন্য কোনো দেশের সঙ্গে তুলনীয় নয়। এরপরও ইদানীং দুই দেশের সম্পর্কের মাঝখানে চলে আসছে চীন। চীনকে নিয়ে ভারতের এমন সংবেদনশীলতার নেপথ্যে কী কাজ করছে?

শহীদুল হক: পৃথিবী এখন এমন একটা অবস্থায় আছে যে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে আর দুই দেশের সম্পর্কের পরিসরে সীমিত রাখা যায় না। বিচ্ছিন্নভাবে দুই দেশের নিরিখে সম্পর্কের মূল্যায়ন করে আজকের দিনে অংশীদারত্ব এগিয়ে নেওয়া সম্ভব নয়। সে জন্যই বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ভারতে কিংবা চীনে গেলে বৈশ্বিক বিষয়গুলো আলোচনায় আসে। আগেও এ প্রসঙ্গ আলোচনায় ছিল। তবে এখনকার মতো তা এত ব্যাপক ছিল না।

প্রথম আলো:

তার মানে দুই দেশের আলোচনায় তৃতীয় পক্ষের প্রসঙ্গ আগেও ছিল, এখন তার মাত্রা বেড়েছে?

শহীদুল হক: এখানে আরেকটি কারণকে বিবেচনায় নিতে হবে। ভারতের সঙ্গে চীনের বৈরিতা এখন আর গোপন নয়। তাই এটা আরও বেশি গুরুত্বের সঙ্গে আসছে। কাজেই এটা গোপন করার কিছু নেই।

প্রথম আলো:

তার মানে বিষয়টি কি এমন, জুনে প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরের সময় চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের বিষয়টি আলোচনায় এসেছিল?

শহীদুল হক: মতবিনিময় হয়তো হয়েছে। আমরা ব্রাসেলস বা অন্য কোনো দেশের রাজধানীতে আনুষ্ঠানিক সফরে গেলে অন্য দেশ ও অঞ্চলের সম্পর্ক নিয়ে মতবিনিময় হয়ে থাকে। মতবিনিময়টা অতীতের চেয়ে এখন বেশি হচ্ছে। মনে রাখতে হবে, ভারতের সঙ্গে আলোচনার সময় আমাদের কথাবার্তা শুধু চীন প্রসঙ্গে সীমিত থাকে না। বাংলাদেশ যেহেতু ভারত মহাসাগরের কেন্দ্রে। এখানে যুক্তরাষ্ট্র, চীন, জাপান, রাশিয়া ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন সবার সঙ্গে সম্পর্কের মাত্রা আলোচনায় আসে।

প্রথম আলো:

আপনি বলছেন, এক দেশের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এখন অন্য দেশের সম্পর্কের মাত্রা নিয়ে মতবিনিময় হয়। এ পরিস্থিতিকে বিবেচনায় নিলে কোনো দেশের সঙ্গে বড় কোনো প্রকল্পে যুক্ত হওয়ার আগে সামগ্রিকভাবে নানা দিক বিবেচনায় নেওয়া কতটা জরুরি?

শহীদুল হক: রেল বা পানির কোনো প্রকল্প শুধুই ব্যবসার বিষয় নয়। এ বিষয়গুলো বাংলাদেশের কৌশলগত সম্পদ। এটা আমাদের বিবেচনায় নিতে হবে। কাজেই কৌশলগত সম্পদ নিয়ে দর-কষাকষির সময় শুধু প্রকল্পের নিরিখে দেখার সুযোগ নেই। সংযুক্তি, পানি এ বিষয়গুলোর সঙ্গে ভূরাজনীতি যুক্ত। প্রয়োজনে কখনো অর্থনৈতিক ইস্যু প্রাধান্য পায়, আবার কখনো প্রাধান্য থাকে রাজনীতি। রাজনৈতিক বোঝাপড়া ঠিক না হলে রাজনৈতিক ভারসাম্য যথাযথভাবে করা না গেলে অর্থনীতির ক্ষেত্রে বড় কিছু করাটা কঠিন হয়ে পড়ে।

প্রথম আলো:

 আপনাকে ধন্যবাদ।

শহীদুল হক: আপনাদেরকেও ধন্যবাদ।