ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় আদালতে অচলাবস্থার মূল কারণ দুর্নীতি

জেড আই (জহিরুল ইসলাম) খান পান্না। সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের সাবেক সভাপতি ও ব্লাস্টের ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য। ব্রাহ্মণবাড়িয়া আদালতের অচলাবস্থা, বিচারাঙ্গনের দুর্নীতি ও দেশের সামগ্রিক বিচারব্যবস্থা নিয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেন এই আইনজীবী। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মনোজ দে।

জেড আই খান পান্না
প্রশ্ন:

প্রথম আলো: বিচারক ও আইনজীবী দ্বন্দ্বে ব্রাহ্মণবাড়িয়া আদালতে অচলাবস্থা এক মাসের বেশি সময় পেরিয়ে গেছে। প্রথমে দুই আদালত, এখন সব কটি আদালত বর্জন করছেন আইনজীবীরা। এই অচলাবস্থা ও দ্বন্দ্বে ভোগান্তিতে পড়ছেন বিচারপ্রার্থীরা। বিষয়টিকে কীভাবে দেখছেন?

জেড আই খান পান্না: আপাতভাবে মনে হবে ভোগান্তিতে পড়ছেন বিচারপ্রার্থীরা, কিন্তু আইনজীবীরা যদি তাঁদের পেশাগত কাজ করতে না পারেন, তাহলে তাঁরাও কিন্তু ভোগান্তিতে পড়ছেন। অচলাবস্থার মূল কারণ হলো দুর্নীতি। বিচারাঙ্গন যদি দুর্নীতিমুক্ত না করা যায়, তাহলে বিচারপ্রার্থীও কোনো দিন ন্যায়বিচার পাবেন না।

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি তানভীর ভূঞা বলেছেন, আইনমন্ত্রী আনিসুল হক দুই বিচারককে বদলির আশ্বাস দিয়েছিলেন। আইনমন্ত্রীর দেওয়া আশ্বাস পূরণ না হওয়ায় তাঁরা এখন সর্বাত্মক কর্মবিরতি পালন করছেন। এভাবে আলটিমেটাম দিয়ে বিচারকদের বদলির দাবি করা কতটা যৌক্তিক?

জেড আই খান পান্না: একটা বিষয় হলো, বিচারক যদি দুর্নীতিপরায়ণ হন, তাহলে বদলি কোনো শাস্তি নয়। আমরা সাধারণভাবে দেখি, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে এ ধরনের অভিযোগ উঠলে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় বদলি করে। এটা তো শাস্তি নয়। কেউ যদি অপরাধ করে, তাহলে বদলি নয়, তার কৃতকর্মের জন্য শাস্তি দেওয়া হোক। কিছুদিন আগে আদালতে দুর্নীতির বিরুদ্ধে মানিকগঞ্জে মানববন্ধন হয়ে গেছে। রাজবাড়ী, নীলফামারী, খুলনা, পিরোজপুর আদালতেও একই ধরনের ঘটনা ঘটেছে। এর কারণটা কী? কয়েক দিন আগে একটি বেসরকারি টেলিভিশনের প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ঢাকার বিভিন্ন আদালতে জিআরও ও পেশকার কীভাবে বকশিশ বা ঘুষ নিচ্ছেন। নিম্ন আদালতে  ঘুষ না দিয়ে কেউ যদি বলে—আমি বিচার পাই, তাহলে আমি বলব, এটা একটা ভাঁওতাবাজি। সবাই যে দুর্নীতিপরায়ণ, সেটা আমি বলব না, কিন্তু অধিকাংশ মানুষ দুর্নীতির শিকার। বিষয় হলো, আমি যদি বিচারক হয়ে আমার অফিসের দুর্নীতি দূর করতে না পারি, তাহলে বলতে হবে, দুর্নীতির লালন–পালন কর্তা আমি। একজন আইনজীবী যদি দুর্নীতিপরায়ণ হন, তিনি ঘুষ দিয়ে কিন্তু জাজমেন্ট আনতে পারবেন না, ঘুষ দিয়ে জামিনও আনতে পারবেন না। তাহলে এই দুর্নীতির জন্য প্রকৃতপক্ষে কে দায়ী?

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: ব্রাহ্মণবাড়িয়া ছাড়াও গত কয়েক মাসে দেশের বেশ কিছু নিম্ন আদালতে বিচারকদের সঙ্গে আইনজীবীদের অসদাচরণের ঘটনা ঘটেছে। এ ধরনের বেশির ভাগ ঘটনায় ক্ষমতাসীন দলের সমর্থক আইনজীবীরা যুক্ত ছিলেন। তাঁদের এই অসদাচরণের সঙ্গে কি রাজনৈতিক ক্ষমতা প্রদর্শনের কোনো সম্পর্ক আছে?

জেড আই খান পান্না: আইনজীবীদের এ ধরনের অসদাচরণ কিছুতেই আমরা প্রশ্রয় দিতে পারি না।  ব্রাহ্মণবাড়িয়া আদালতে আইনজীবীরা যে ভাষায় কথা বলেছেন, তা অত্যন্ত লজ্জাজনক ভাষা। এ ঘটনায় আইনজীবী হিসেবে আমি দুঃখিত, লজ্জিত। কিন্তু আমার একটা প্রশ্ন আছে, এ ঘটনায় ভিডিওটা করল কে? আদালতের ভেতরে এ ভিডিওটা নিশ্চয়ই কোনো আইনজীবী করেননি। যিনি এই ভিডিও করেছেন, তিনি অন্যায় করেছেন।  জজ সাহেবদেরও বোঝা উচিত, দুই হাত চেয়ারের ওপরে বসিয়েছেন বলে যেকোনো মানুষকে যেকোনো ভাষায় কথা বলতে পারেন না। তাঁদেরও সংযত ভাষায় কথা বলা উচিত, ধৈর্যশীল হওয়া উচিত।

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: আইনজীবীরা কখনো কখনো বিচারকসহ আদালতের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বিরুদ্ধে নানা রকম দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগ তুলেছেন। এই অভিযোগগুলোর সুরাহা না হলে আদালতের ওপর বিচারপ্রার্থী ও সাধারণ মানুষের আস্থা কি থাকবে? এ ক্ষেত্রে কী ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে?

জেড আই খান পান্না: বিন্দুমাত্র আস্থা থাকবে না। কেউ কি বলতে পারবেন তিনি আদালতে গিয়ে ন্যায়বিচার পাচ্ছেন? আমি বারবার বলি, আমাদের যে আইন, সেটা মাকড়সার জালের মতো। এখানে ছোটখাটো পোকামাকড় ধরা পড়বে, কিন্তু যদি সেটা বড় হয়, তাহলে মাকসার জালই থাকবে না। তাঁদের জন্য আইনকানুন নয়। যাঁরা ব্যাংক ডাকাতি করেছেন, তাঁদের জন্য কি কোনো আইনকানুন আছে দেশে? এমনকি যাঁরা বড় বড় ঋণখেলাপি, তাঁদের নাম খেলাপিদের তালিকাতেই আসে না। আরেকটি ভয়াবহ বিষয় হচ্ছে, আইন পাস করার পরই সরাসরি বিচারক নিয়োগ হচ্ছে। তাঁদের কোনো ফাইলিং এক্সপেরিয়েন্স নেই। দুনিয়ার কোথাও এটা নেই। সরাসরি বিচারক নিয়োগ না করে আইনজীবীদের ভেতর থেকে পরীক্ষামূলকভাবে নিয়োগ দেওয়া দরকার। প্রয়োজনে বয়স বাড়িয়ে নিয়োগ দেওয়া হোক। আমার মনে হয়, বিচারক নিয়োগে সংস্কার প্রয়োজন। ভারতের ক্ষেত্রে ন্যূনতম ৩-৫ বছরের অভিজ্ঞতা না থাকলে জুডিশিয়াল সার্ভিসে কেউ অ্যাপিয়ার করতে পারেন না। আমরাও এখানে শুরু করেছিলাম, কিন্তু তাতে কেউ আগ্রহী হননি। সৎ, নির্ভীক, নির্লোভ ও আইন বিষয়ে জ্ঞান না থাকলে কারও বিচারক হওয়া উচিত নয়।

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: বদলি, পদোন্নতিসহ নিম্ন আদালতের বিচারকদের নিয়ন্ত্রণ এককভাবে সুপ্রিম কোর্টের হাতে নেই। আইন মন্ত্রণালয় বা সরকারের সেখানে বড় ভূমিকা থাকে। এটা কি বিচার বিভাগের ওপর নির্বাহী বিভাগের কর্তৃত্ব আরোপের একটি সুযোগ নয়?

জেড আই খান পান্না: বিষয়টা যদি আমরা বলি, তাহলে সুপ্রিম কোর্ট বলবেন— না, এটা আমাদের হাতে রয়েছে। কিন্তু প্রকৃত চিত্র ভিন্ন। এখানে আরেকটি বিষয় উল্লেখ করা দরকার। প্রশাসনিক রুলস অনুযায়ী, জেলা প্রশাসক, জেলা জজ ও কর্মচারী-কর্মকর্তাদের সপরিবার থাকার জন্য আবাসনের ব্যবস্থা আছে। কিন্তু এখন অধিকাংশ সরকারি কর্মকর্তারা সপরিবার এলাকায় থাকেন না। ফলে তাঁদের অনেকের বিরুদ্ধে নারীঘটিত কেলেঙ্কারি শোনা যাচ্ছে, পারিবারিক অশান্তি সৃষ্টি হচ্ছে। অনেকে ঢাকায় অ্যাপার্টমেন্ট কিনে থাকেন। অনুমতি ছাড়া বৃহস্পতিবার তাঁরা ঢাকায় চলে আসেন। রোববার আবার কর্মক্ষেত্রে যান। এটা কীভাবে সম্ভব?

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: আদালতকে, বিশেষ করে নিম্ন আদালতকে রাজনৈতিক বা দলীয় উদ্দেশ্য পূরণে ব্যবহারের অভিযোগ উঠছে। এ রকম অবস্থায় বিচার বিভাগের স্বাধীনতার বিষয়টি নিম্ন আদালতের ক্ষেত্রে সত্যি কতটা কার্যকর বলে মনে হয়?

জেড আই খান পান্না: একটা ঘটনার কথা বলি। সরকারি দলের না হলে তিনি যে প্রতিবাদ করবেন, সে উপায় এখন নেই। সাতক্ষীরা বারের কয়েকবারের সভাপতি শাহ আলমকে ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনে জেলে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। সরকারি দল না করায় তাঁর পক্ষে আইনজীবীরও দাঁড়াতে চাইছিলেন না। তাঁকে জেল থেকে বের করার জন্য আমাকে যেতে হয়েছে। অনলাইনে প্রতিবাদ করায়, পোস্ট দেওয়ায় অনেককে জেলে যেতে হচ্ছে। কিন্তু রাজনীতিবিদেরা এখন যেভাবে প্রকাশ্যে একে-অন্যের বিরুদ্ধে যে ভাষায় কথাবার্তা বলছেন, তাতে আমার লজ্জা হয় যে আমি একসময় রাজনীতি করতাম।

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: দুর্নীতিকে বাংলাদেশের মূল সমস্যা বলে মনে করছেন। দুর্নীতি তো এখন সর্বব্যাপী। বিচারাঙ্গনে দুর্নীতি কি আলাদাভাবে বন্ধ করা যাবে?

জেড আই খান পান্না: বাংলাদেশে সব ধরনের দুর্নীতি বন্ধ করতে হবে। সবখানেই ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন। এর কোনো বিকল্প ও শর্টকাট পথ নেই। নগরে যদি আগুন লাগে, সেটা কিন্তু দেবালয় দেখে না। কিন্তু আগুন নেভানো শুরু করার জন্য তো একটা জায়গা লাগে। এর জন্য সর্বোত্তম জায়গা হলো বিচারাঙ্গন। বিচারাঙ্গন দুর্নীতিমুক্ত না করা গেলে সারা দেশ থেকে কোনো দিনই দুর্নীতি দূর করা যাবে না। দেশের বিভিন্ন আদালতে যে ঘটনাগুলো ঘটছে, সেগুলো একেকটা স্ফুলিঙ্গ, যেকোনো সময় বিস্ফোরণ ঘটতে পারে।

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: এ থেকে উত্তরণে করণীয় কী বলে মনে করছেন?

জেড আই খান পান্না: বিচারাঙ্গন থেকে দুর্নীতি হটানোর একটা পদক্ষেপ উচ্চ আদালত থেকে নেওয়া উচিত। যেকোনো পরিস্থিতিতে দুর্নীতিপরায়ণ কোনো কর্মকর্তা ও কর্মচারীকে যদি পাওয়া যায়, তাঁর বিরুদ্ধে কঠোর থেকে কঠোরতম ব্যবস্থা নিতে হবে। একজন সরকারি চাকরিজীবী দুর্নীতি করলে যে অপরাধ, একজন বিচারক করলে পরে তার থেকে শত গুণ বেশি অপরাধ। বিষয়টি এখন গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে।

১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীন হলো। ১৯৭২ সালে আমরা চমৎকার একটা সংবিধান পেলাম। কিন্তু আইন তো চলছে সেই কলোনিয়াল আইনে। সেগুলো পুরোপুরি নিপীড়নমূলক আইন। এভাবে একটা স্বাধীন দেশ চলতে পারে না। সব আইনের বড় আইন হলো সংবিধান। সংবিধানেই আছে, কেউ কাউকে ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত করতে পারবেন না। মানুষের মৌলিক অধিকার খর্ব করতে পারবেন না। আমি আপনাদের মাধ্যমে বিচারকদের বলতে চাই, যাঁরা আসামিদের থানাহাজতে রিমান্ডে পাঠান, তাঁরা যেন প্রতিটি থানাহাজতে গিয়ে সাত দিন করে থেকে আসেন। বাস্তব অভিজ্ঞতা নিয়ে দেখে আসুক, সেখানে কোনো মানুষ থাকতে পারে কি না।

কলোনিয়াল ধারণা থেকেই ফাঁসির আসামিকে কনডেমড সেলে রাখা হয়। আধুনিক ধারণা হলো সংশোধন। সভ্য দুনিয়ায় ফাঁসি নেই। কিন্তু আমরা ফাঁসি দিচ্ছি। জেলখানা শাস্তির জায়গা নয়, সেটি সংশোধনাগার। এই চিন্তাভাবনা যদি বিচারকদের মাথায় না থাকে, সংসদ সদস্যদের মাথায় না থাকে, তাহলে তো আর কিছু হবে না।