আপনি তো এর আগেও বাংলাদেশে এসেছেন। এবার কত দিন পর এলেন?
সুগত বসু: এবার ছয় বছর পর দুই দিনের জন্য এসেছি। ২০১২ সালে আমার বাবা প্রয়াত চিকিৎসক শিশিরকুমার বসুকে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ‘মুক্তিযুদ্ধ মৈত্রী সম্মাননা’ দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সম্মাননা গ্রহণ করতে আমার মা কৃষ্ণা বসু আর আমি এসেছিলাম। ২০১০ সালে নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসুর জীবনী প্রকাশ উপলক্ষে বক্তৃতা দিতে এসেছিলাম । অনেকবারই আসা হয়েছে বাংলাদেশে। তবে আশির দশকের শুরুতে যখন কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি করছি, তখন বাংলাদেশের মহাফেজখানাগুলোতে ঘুরে ঘুরে বেশ কিছু গবেষণার কাজ করেছি।
সেগুলো কোন ধরনের গবেষণা?
সুগত বসু: আমার প্রথম বই অ্যাগরেরিয়ান বেঙ্গল: ইকোনমি, সোশ্যাল স্ট্রাকচার, অ্যান্ড পলিটিকস। এ বইয়ের অনেকটা কাজ বাংলাদেশে করা। এটা মুক্তিযুদ্ধের পর ১৯৭৯-৮০ সালের দিকের ঘটনা। তখন আমি কৃষি অর্থনীতি, কৃষিসমাজ, কৃষকের রাজনীতি নিয়ে কাজ করছিলাম। তখন বাংলাদেশের মহাফেজখানাগুলোতে থাকা অনেক তথ্যের দরকার হয়েছে। পরে আবার ভারত মহাসাগর পাড়ের বিভিন্ন দেশের মধ্যকার অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সংস্কৃতিগত সম্পর্ক নিয়ে গবেষণার কাজ শুরু করি।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে আপনার পরিবারের ঐতিহাসিক ভূমিকা রয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাসপোর্ট ছাড়াই বাবার সঙ্গে যশোর রোড দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছিলেন, সেই ঘটনাটা জানতে চাই?
সুগত বসু: যত দূর মনে পড়ে, ১৯৭১ সালের নভেম্বর মাসের শেষ রোববার ছিল সেটা। আমার স্কুলের ছুটি ছিল। বাবার সঙ্গে গিয়েছিলাম নেতাজি ফিল্ড হাসপাতালে। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে মে মাসে বনগাঁ সীমান্তের কাছে বকচরা গ্রামে আহত মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্রোপচার ও শুশ্রূষা দিতে এ হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। আমি বাবার সঙ্গে যেতাম। সেদিন বাবা বললেন, সীমান্তের অবস্থাটা একটু দেখে আসি। আমরা জিপে করে বনগাঁ বর্ডারের দিকে যাচ্ছিলাম। কিন্তু কেউ আমাদের গাড়ি থামাল না।
যশোর রোড ধরে জিপ চলে এল বাংলাদেশের ভেতরে। তখন সেখানে উপস্থিত বন্ধুভাবাপন্ন সেনারা বললেন, ‘আপনারা বেশি দূরে চলে এসেছেন, ফিরে যান।’ আমরাও বুঝলাম, সামনে বিপদ হতে পারে তখন ফিরে গেলাম। তবে বুঝতে পারলাম পাসপোর্ট, ভিসা ছাড়াই প্রথমবারের মতো বাংলাদেশে প্রবেশ করেছি। কিশোর বয়সের সেই স্মৃতিটা এখনো মনে আছে।
মুক্তিযুদ্ধের সময় আপনার বাবা শিশিরকুমার বসুর অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে বাংলাদেশে আসা এবং আপনার কিশোর চোখে দেখা শরণার্থীশিবির নিয়ে কিছু বলুন।
সুগত বসু: যুদ্ধ চলাকালে শিশির কুমার বসু ও তাঁর সহকর্মীরা যশোর ও খুলনা হাসপাতাল পর্যন্ত গিয়েছিলেন। সেখান থেকে আহত ব্যক্তিদের অ্যাম্বুলেন্সে করে নেতাজি ফিল্ড হাসপাতালে আনা হতো। মুক্তিযুদ্ধের সময় নেতাজি ফিল্ড হাসপাতালে বাবা ও বাবার প্রাক্তন ছাত্র উমা শংকর সরকার উদ্বাস্তু শিশুদের চিকিৎসা করতে প্রাণপণ চেষ্টা করতেন। এ সময় স্যালাইনের অভাবে কচি ডাবের জল দিয়ে কাজ চালাতে দেখেছি। কলকাতায় বড় হওয়ায় আমি দারিদ্র্য দেখেছি। তবে শরণার্থীশিবিরগুলোতে যে দুর্দশা দেখেছিলাম, তা ছিল ভয়াবহ।
মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকে বর্তমান বাংলাদেশ, আপনার মূল্যায়ন জানতে চাই।
সুগত বসু: হেনরি কিসিঞ্জার বলেছিলেন, স্বাধীন বাংলাদেশ হবে ‘বাস্কেট কেস’। কিন্তু সেই ভবিষ্যদ্বাণী যে একেবারে ভুল, সেটা বাংলাদেশ প্রমাণ করে দিয়েছে। আশির দশকের শুরুতে যখন এখানে আসি, তখন বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে অনেক দারিদ্র্য দেখেছি। ঢাকায়ও গাড়ি খুব কম ছিল। যে কটা গাড়ি দেখতাম তার প্রতিটির নাম্বার প্লেটের শুরুতে সা. স লেখা ছিল। অর্থাৎ সেগুলো ছিল সাহায্য সংস্থার গাড়ি।
একুশ শতকে যখন আসছি, এখন দেখছি উত্তর থেকে দক্ষিণ, গাড়ির জন্যই চলা যায় না। গাড়ি যে উন্নতির একমাত্র নমুনা, তা নয়। এবার এসে দেখলাম এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে। তবে এগুলো তো চোখের দেখা। বাংলাদেশের যেটা সত্যিকারভাবে অর্জন বলে আমার মনে হয়, তা নারীর ক্ষমতায়ন। ভারতবর্ষের তুলনায়ও এখানে বাংলাদেশ বেশি অর্জন করেছে বলে মনে হয়েছে। অন্যান্য ক্ষেত্রেও বাংলাদেশ অনেক এগিয়েছে।
উন্নয়নের কথা বলতে হলে তো এখন জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবিলা, শিক্ষা খাত, দুর্নীতি—এমন অনেক প্রসঙ্গ আসবে। এসব বিবেচনায় বাংলাদেশকে কেমন দেখছেন?
সুগত বসু: সব সময়ই মনে রাখা উচিত যে আরও অনেক উন্নতির প্রয়োজন রয়েছে। যে অর্জনগুলোর কথা বললাম, এগুলো তুলনামূলক দৃষ্টিতে দেখা। তবে অবশ্যই নীতির প্রশ্ন আছে। সেখানে সব দেশেরই কিছু ঘাটতি রয়েছে। বাংলাদেশেরও সেসব দিকে আরও মনোযোগ দেওয়া উচিত। কারণ, বাংলাদেশ যখন দরিদ্র ছিল, তখন কিছু আদর্শ বাস্তবায়নের কথা বলেছে। সেই আদর্শের কথা মনে রাখা উচিত।
এ দেশ ১৫ বছর সামরিক শাসনের অধীনে ছিল। সে সময়টা দেখেছি। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তখন কথাবার্তা কম হতো। কিন্তু মানুষের মধ্যে জানার আগ্রহ ছিল। বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরা এখন হার্ভার্ডে পড়তে যাচ্ছে। আমার নিজেরও কয়েকজন বাংলাদেশি ছাত্র আছেন। কিছু কিছু জায়গায় সবারই সেবা ও ত্যাগের আদর্শগুলোর দিকে ফিরে দেখা উচিত।
আমি মনে করি, জাতীয়তাবাদে একটা মুক্তির দিকও যেমন আছে, বিপরীতে সংকীর্ণতার দিকও থাকতে পারে। তাই এমন একটা দেশপ্রেম প্রয়োজন, যাতে মানুষের মধ্যে সেবার আদর্শের জন্ম নেয়, ত্যাগ স্বীকার করার ইচ্ছা হয়। সেগুলো হয়তো আমরা আজকের দিনে কম দেখছি।
মুক্তিযুদ্ধের পর বাংলাদেশ ৫০ বছর অতিক্রম করেছে। সার্বিকভাবে যদি দেখি, যথেষ্ট অগ্রগতি করেছে বাংলাদেশ।
আপনি ভারত মহাসাগর নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে গবেষণা করছেন। এই গবেষণার উল্লেখযোগ্য দিক কোনগুলো?
সুগত বসু: অনেক ইতিহাসবিদ ভারত মহাসাগরের কথা লিখেছেন। তাঁদের একটা ধারণা ছিল, এখানে ইউরোপীয় সাম্রাজ্য কায়েম হওয়ার পর ভারত মহাসাগরের যে পুরোনো যোগাযোগ ছিল, সবই ভেঙে গিয়েছিল। আমি দেখালাম সম্পর্কগুলো ভেঙে যায়নি। সেগুলোর একটু অদল-বদল হয়েছিল। ইউরোপীয়রাই সেই বদলটা করেছিল।
বঙ্গোপসাগরের অর্থনীতি, সংস্কৃতির বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে আপনার কাছে জানতে চাই।
সুগত বসু: আমি সমগ্র ভারত মহাসাগর নিয়ে লিখেছিলাম। কিন্তু এর মধ্যে বঙ্গোপসাগরও একটা গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল। অর্থনীতির সম্পর্কের কথা যদি ভাবি তাহলে দেখব, যাঁরা বিনিয়োগকারী ছিলেন, তাঁদের অধিকাংশ ছিলেন তামিল চেট্টিয়ার। তাঁরা পুরো বঙ্গোপসাগরে ছড়িয়ে ছিলেন। তাঁরা গিয়েছিলেন বার্মা ও মালয়াতে। তাঁরাই ছিলেন সেসব জায়গার মহাজন। শুধু পুঁজিপতিরা গিয়েছিলেন তা নয়, ইংরেজরা আমাদের দেশ থেকে অনেক শ্রমিকদের নিয়েছিলেন। তামিলনাড়ু থেকে শ্রীলঙ্কার চা-বাগানে, মালয়ার রবারবাগানে কাজ করতে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল শ্রমিকদের। সে সময়ের পুঁজিপতি এবং শ্রমিকেরা সবাই এই বঙ্গোপসাগরে ঘুরছিলেন।
১৯৩০-এর দশকে মন্দা হলো। তখন এই তামিল চেট্টিয়ার যাঁরা পুঁজিপতি ছিলেন, তাঁরা বার্মার চাষিদের জমি কিনে নিচ্ছিলেন। এতে একটা বিপজ্জনক রাজনৈতিক পরিস্থিতি দেখা দেয়। কৃষকদের অভ্যুত্থান হয়।
সাংস্কৃতিক দিকের কথা যদি বলি, তাহলে আমার হান্ড্রেড হরাইজন বই থেকে বলি। এ বইতে আমি লিখেছিলাম, ১৯২৭ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বেরিয়ে পড়লেন। বঙ্গোপসাগর অতিক্রম করে তিনি গেলেন সিঙ্গাপুর, মালয়াতে। এরপর বালি, জাভা, শ্যামদেশ—এসব জায়গা ঘুরেছিলেন।
রবীন্দ্রনাথ মনে করেছিলেন, হাজার বছরের একটা পুরোনো সম্পর্ক তিনি আবার আবিষ্কার করছেন। আমরা যদি রবীন্দ্রনাথের জাভাযাত্রীর পত্র পড়ি তাহলে বুঝতে পারব, এই বঙ্গোপসাগরে প্রাক্-আধুনিক যুগে এবং আধুনিক যুগেও কী ধরনের সাংস্কৃতিক সম্পর্ক ছিল।
রবীন্দ্রনাথ ১৯২৭ সাল সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন সুরেন করকে। তিনি অনেকগুলো ছবি এঁকেছিলেন। আরও ছিলেন সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়কে। তিনি লিখেছিলেন দ্বীপময় ভারত ও শ্যাম দেশ। জাভাযাত্রীর পত্র এবং দ্বীপময় ভারত ও শ্যাম দেশ পাশাপাশি রেখে পড়লে সাংস্কৃতিক সম্পর্কটি বোঝা যায়। রবীন্দ্রনাথ এই সমুদ্রপথে বসে চিঠি লিখেছেন। তাতে তিনি বলেছেন, রামায়ণ-মহাভারতের কাহিনি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া নিজেদের মতো করে নিয়েছে। তাই এসব সম্পর্কগুলো বজায় ছিল।
রাজনীতির দিক থেকে দেখতে গেলে, গান্ধীজির প্রথম আন্দোলন হয়েছিল ভারত মহাসাগরের অন্য প্রান্তে দক্ষিণ আফ্রিকায়। আমাদের উপমহাদেশে স্বাধীনতাসংগ্রামের শেষ পর্যায়ে নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াতে আজাদ হিন্দ ফৌজ গঠন করলেন। তিনি হিন্দু, মুসলমান, শিখ, খ্রিষ্টানকে ঐক্যবদ্ধ করলেন। পাঠান, তামিল, বাঙালির মধ্যে ঐক্য সাধন করলেন।
ভারতীয় উপমহাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের দিকে তাকালে দেখতে পাই, শেষ পর্যায়ে বঙ্গোপসাগর ভিত্তি করে রাজনৈতিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল । নেতাজি ১৯৪৩ সালে পতাকা উত্তোলন করলেন আন্দামান দ্বীপে। তাই অর্থনীতি, সংস্কৃতি, রাজনীতি—সব দিক থেকেই বঙ্গোপসাগরের মধ্যে যোগাযোগ আধুনিক যুগেও বজায় ছিল।
মিয়ানমার এবং ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সমুদ্রসীমা নির্ধারিত হয়েছে। বাংলাদেশ তাঁর সমুদ্রকে সঠিকভাবে ব্যবহার করতে পারছে বলে মনে হয়?
সুগত বসু: এখানে আমি বৃহত্তর পরিপ্রেক্ষিতের কথা বলব। অনেক সময় আমরা যখন এশিয়ার উত্থানের কথা ভাবি, তখন চিন্তা করি যেসব বড় বড় দেশ আছে, তাদের মধ্যে সম্পর্ক কী রকম হবে। যেমন ভারত-চীন অথবা চীন-জাপানের মধ্যে সম্পর্ক। তবে আমি যখন এশিয়ার উত্থানের কথা ভাবি তখন মনে হয়, দুটি দেশের এখানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। একটি বাংলাদেশ, অন্যটি মিয়ানমার।
সাগরের দিক দিয়ে তো একটা যোগাযোগ হতেই পারে। কিন্তু ভূমিতে কয়েকটি আঞ্চলিক সংযোগের দিকে (ওভারল্যান্ড ও কয়েকটি ইন্টার রিজিওনাল কানেকটিভিটি) এগোনো উচিত। এভাবে যখন আমরা চিন্তা করি, তখন বালাদেশের ব্যাপারে আমাদের অনেক আশাবাদী হওয়ার কারণ আছে। কিন্তু মিয়ানমারে এখন যে অবস্থা, তাতে এই সংযোগ (ওভারল্যান্ড কানেকটিভিটি) কতটা কার্যকর হবে, তা এই মুহূর্তে বলা যাচ্ছে না। তাই এশিয়ার উত্থানের কথা ভাবতে গেলে শুধু বড় দেশগুলো কী করবে, সেটার দিকে মনোযোগ না দিয়ে বাংলাদেশের মতো দেশগুলো আরও কী কী করতে পারে, সেদিকে মন দিতে হবে। বাংলাদেশেরও এখানে ভূমিকা রাখার ব্যাপার আছে।
বর্তমান বঙ্গোপসাগরে ‘সুনীল অর্থনীতির’ (ব্লু ইকোনমি) কোন কোন ধরনের সম্ভাবনা ও প্রতিবন্ধকতা দেখছেন?
সুগত বসু: বাংলাদেশের ব্লু ইকোনমি নিয়ে কিছু অগ্রগতি অবশ্যই হয়েছে। তবে আরও যেখানে অনেক কিছু করার আছে, সেটা জলবায়ু বিপর্যয় মোকাবিলার সঙ্গে সম্পর্কিত বিষয়গুলো। বৈশ্বিক উষ্ণায়ন যে পর্যায়ে পৌঁছাচ্ছে, সেখানে বাংলাদেশকেও অনেক বড় চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হবে। এদিকে বাংলাদেশেকে আরও মনোযোগ দিতে হবে।
অর্থনীতির দিক থেকে এমন কতগুলো জিনিস বাংলাদেশ করেছে, যা হয়তো ভারতবর্ষও করেনি। বিশ শতকের শেষে, একুশ শতকের শুরুতে চীন খুব এগিয়ে গিয়েছিল। তাদের বলা হতো ‘ম্যানুফ্যাকচারিং হাব অব দ্য ওয়ার্ল্ড’। কারণ, তাদের লেবার কস্ট (শ্রমিকের মজুরি) খুব কম। তারাই সবকিছু রপ্তানি করছিল।
একুশ শতকে ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশ কিন্তু সেই জায়গাটা খানিকটা নিতে পেরেছে। পোশাক রপ্তানি খাত এগুলোর একটি। কিন্তু চ্যালেঞ্জের বিষয়ে বাংলাদেশের আরও সঠিক পদক্ষেপ নেওয়ার সুযোগ আছে। আর একটি ব্যাপার, সব সময় সরকারের দিকে তাকিয়ে থাকলে হয় না। নতুন প্রজন্ম, সুশীল সমাজ তাদেরও ভূমিকা আছে। সচেতনতা বৃদ্ধি কতটা হচ্ছে, সেসব দেখার ব্যাপার রয়েছে।
এর আগে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত নির্ধারণ নিয়ে আপনার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। তৃণমূল কংগ্রেস থেকে নির্বাচিত হয়ে আপনি ছিটমহল নিয়ে পদক্ষেপ নিয়েছেন। কিন্তু এখনকার সময়ের সমস্যা তিস্তা। এ নিয়ে কোনো পদক্ষেপ নিয়েছেন?
সুগত বসু: আমি ২০১৪ সালে ভারতবর্ষের পার্লামেন্টে যাদবপুর লোকসভা কেন্দ্র থেকে নির্বাচিত হলাম। যে কেন্দ্র থেকে আমার মা কৃষ্ণা বসু আরও তিনবার লোকসভার সদস্যা নির্বাচিত হয়েছিলেন। তিনি পাঁচ বছর ছিলেন আমাদের পার্লামেন্টারি স্ট্যান্ডিং কমিটির পররাষ্ট্রনীতির চেয়ারপারসন। আমিও সে কমিটির সদস্য হয়েছিলাম। প্রথমেই যেটা আমাদের কাছে এল, ‘ল্যান্ড বাউন্ডারি অ্যাগ্রিমেন্ট’ বিষয়ে আমাদের সংবিধান সংশোধনীর বিলের খসড়া। আমরা যদিও বিরোধী পক্ষে ছিলাম, কিন্তু অন্যান্য বিষয়ে নরেন্দ্র মোদি সরকারের সঙ্গে বিরোধিতা থাকলেও এ বিষয়ে আমরা একমত হয়েছিলাম।
এর আগে ৪০ বছর ধরে ভারতের পার্লামেন্ট এটা অনুমোদন (র্যাটিফাই) দেয়নি। তখন আমি জোর দিয়ে নিজের দলের নেত্রীর সঙ্গে কথা বললাম। দেখলাম এটি করতে হলে সংবিধান সংশোধনের বিল পাস হতে হবে। যার জন্য দরকার দুই-তৃতীয়াংশ ভোট। আমরা সেটা করতে পারলাম। আমি তখন বলেছিলাম, আমাদের জাতীয় স্বার্থেই প্রয়োজন বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক ভালো করা। বিশেষ করে এই ছিটমহলে থাকা হতদরিদ্র মানুষ, যারা শিক্ষার সুযোগ পায় না, স্বাস্থ্যসেবার ব্যবস্থা নেই, তাদের জন্য এটি কার্যকর হওয়া প্রয়োজন।
এই রিপোর্ট আমরা কমিটিতে গ্রহণ করলাম। তখন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ এবং বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সব সময় যোগাযোগ রেখে চলেছি। ভারতবর্ষের পার্লামেন্টে এই একটি বিল সর্বসম্মতিক্রমে
পাস হয়।
তখন তিস্তা নিয়েও কথা হয়েছে। আমার মনে হয়, তিস্তা নিয়ে আলাপ অনেক এগিয়েছে। পার্লামেন্টে থাকতেই আমার ইচ্ছা ছিল, তিস্তার বিষয়ে দুই দেশের মধ্যে সমাধান হোক। সেটা তখন করতে পারিনি। আমি সব সময়ই কীভাবে ভারত-বাংলাদেশ এবং দুই বাংলার মধ্যে সম্পর্ক ভালো করা যায়, তা নিয়ে সচেষ্ট হয়েছি।
আমাদের একটু অন্যভাবে চিন্তা করতে হবে। পশ্চিম বাংলা হোক বা বাংলাদেশ, আমরা যদি এশিয়া বিশেষ করে দক্ষিণ-পূর্ব এবং পূর্ব এশিয়ায় এই বঙ্গোপসাগর দিয়ে আরও নিবিড় যোগাযোগ স্থাপন করতে পারি, তাহলে দুদিকেরই অর্থনৈতিক উন্নতি আরও প্রশস্ত হবে।
আপনি একসময় বাংলাদেশের মহাফেজখানাগুলো ঘুরে দেখেছেন। পশ্চিমবঙ্গে নেতাজি রিসার্চ ব্যুরো পরিচালনা করছেন। বাংলাদেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য সংরক্ষণ নিয়ে কোনো পরামর্শ দেবেন?
সুগত বসু: আশির দশকে যখন এসেছিলাম, তখন জাতীয় মহাফেজখানা ছিল না। তবে বাংলাদেশ স্বাধীনতার সময় যেসব রেকর্ড পেয়েছিল, সেসব রক্ষিত হয়েছিল। তখন সচিবালয়ে যেসব কাগজপত্র দেখেছিলাম, সেসব এখন জাতীয় মহাফেজখানায় গিয়েছে। ডিস্ট্রিক্ট রেকর্ড রুমের কাগজপত্র আনা হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর বেশ কিছু কাগজপত্র উদ্ধার করে প্রকাশিত হয়েছে। যেমন অসমাপ্ত আত্মজীবনী, কারাগারের রোজনামচা। এসব সংরক্ষণের গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।
যাঁরা ইতিহাস সংরক্ষণের জন্য কাজ করেন, তাঁদের দুটি বিষয় খেয়াল রাখা প্রয়োজন। বর্তমানে কোনো ঐতিহাসিক ঘটনা ঘটছে কি না? তা রেকর্ড হচ্ছে কি না? এগুলো এমনভাবে সংরক্ষণ করতে হবে, যেন ভবিষ্যৎ প্রজন্ম তা ৪০ বা ৫০ বছর পরও খুঁজে পায়। একই সঙ্গে তাদের প্রযুক্তিগত জ্ঞান থাকতে হবে। কীভাবে পুরোনো প্রযুক্তি থেকে নতুন প্রযুক্তিতে নিতে হয়, সেটা জানতে হবে।
সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
সুগত বসু: আপনাকেও ধন্যবাদ।