৫ আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার স্বৈরাচারী শাসনের পতনের পর ৯ মাসের বেশি সময় পেরিয়ে গেছে। গণ-অভ্যুত্থানের পর রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক রূপান্তর তথা সংস্কার ও নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের ক্ষেত্রে সাফল্য–ব্যর্থতাকে কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?
নূরুল কবীর: পাকিস্তানের পশ্চিমভিত্তিক অগণতান্ত্রিক শাসকশ্রেণির শাসন-নিপীড়ন থেকে মুক্তির লক্ষ্যে ১৯৭১ সালে সংঘটিত একটি জনযুদ্ধের ভেতর দিয়ে উত্থিত বাংলাদেশের ঐতিহাসিক অঙ্গীকার ছিল ‘সাম্য, সামাজিক ন্যায়পরতা ও নাগরিকদের মানবিক মর্যাদা’ প্রতিষ্ঠার জন্য একটি ‘গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র’ গড়ে তোলা। কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশের শাসকশ্রেণির বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সংগঠনের স্বৈরতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে, অর্ধশতাব্দীর বেশিকাল ধরে এখানে একটি যথার্থ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গড়ে তোলা সম্ভব হয়নি, বরং এ দেশের শাসকশ্রেণির বিভিন্ন সংগঠন আপন আপন সংকীর্ণ স্বার্থে এখানে একটি শোষণ-নিপীড়নমূলক স্বৈরতান্ত্রিক রাষ্ট্রের বিকাশ নিষ্পন্ন করেছে, গত বছরের জুলাই-আগস্ট আন্দোলনের সময় যার নৃশংস রূপ আমরা প্রত্যক্ষ করেছি।
ইতিপূর্বে বিভিন্ন ব্যক্তি ও রাজনৈতিক সংগঠন ‘বাংলাদেশ রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক রূপান্তর’ ও ‘নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের’ ঐতিহাসিক অপরিহার্যতা নিয়ে কথা বলেছে। তবে বিগত গণ-অভ্যুত্থানের ভেতর দিয়ে এই রাজনৈতিক প্রকল্প বাস্তবায়নের দাবি ও ন্যায্যতা বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করে। কিন্তু গণ-অভ্যুত্থানের পাটাতনের ওপর প্রতিষ্ঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রদর্শন সম্পর্কে অস্বচ্ছ ধারণা ও কোনো কোনো উপদেষ্টার প্রতিক্রিয়াশীল রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে ‘রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক রূপান্তর’ ও ‘নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত’ প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনা গত ৯ মাসে ক্রমেই হ্রাস পেয়ে চলেছে। এসব উপদেষ্টার সহযোগিতায় বরং কোনো কোনো প্রতিক্রিয়াশীল রাজনৈতিক শক্তির বিকাশের পথ প্রশস্ত হচ্ছে।
বিগত সরকারের আমলে মতপ্রকাশ বা গণমাধ্যমের স্বাধীনতা গুরুতরভাবে সংকুচিত ছিল। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর সেই পরিস্থিতির কতটা পরিবর্তন হয়েছে?
নূরুল কবীর: অন্তর্বর্তী সরকার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর গণমাধ্যমে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা আওয়ামী লীগের স্বৈরতান্ত্রিক জমানার তুলনায় সাধারণভাবে অবশ্যই সম্প্রসারিত হয়েছে। প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস তাঁর সরকারকে বরং সমালোচনা করার জন্য বারবার আহ্বান জানিয়েছেন। আমরা তাঁর সরকারের কার্যক্রম সম্পর্কে, এমনকি তাঁর নিজের বিভিন্ন পদক্ষেপ সম্পর্কেও আলোচনা-সমালোচনা অব্যাহত রেখেছি।
আমার জানামতে, পত্রিকার সম্পাদকদের এখন আর আওয়ামী জমানার মতো বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার পক্ষ থেকে সাংবাদিকতা সম্পর্কে নসিহতমূলক বার্তা গ্রহণ করতে হয় না। তবে সম্পাদক পরিষদের সহসভাপতি হিসেবে আমি জানি, সরকারের কোনো কোনো উপদেষ্টা ও গণ-অভ্যুত্থানের নেতৃত্বদানকারী কোনো কোনো নেতা ইতিমধ্যে সংবাদমাধ্যমের গণতান্ত্রিক স্বাধীনতার প্রতি খানিকটা বিতৃষ্ণ হয়ে উঠেছেন এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে তাঁরা অনাকাঙ্ক্ষিত বিরূপ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। এটা নিশ্চয় বিপজ্জনক লক্ষণ। এই লক্ষণের বিরুদ্ধে যৌক্তিকভাবে সংঘবদ্ধ প্রতিবাদ জ্ঞাপন করা প্রয়োজন।
এখানে বলা প্রয়োজন যে অন্তর্বর্তী সরকার কিছু লীগপন্থী সাংবাদিকের বিরুদ্ধে খুনের মামলা করেছে। এটা গ্রহণযোগ্য নয়। কোনো স্বৈরতান্ত্রিক সরকারকে বুদ্ধিবৃত্তিক সমর্থন জানানো একটি নৈতিকতাবিবর্জিত রাজনৈতিক অপরাধ, কিন্তু তা সাধারণভাবে কখনো একটি ‘ফৌজদারি অপরাধ’ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে না। সংশ্লিষ্ট সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে আর্থিক দুর্নীতিচর্চার মামলাও রুজু করা হয়েছে। যথাযথ অনুসন্ধানের ভিত্তিতে, স্বচ্ছ আইনি প্রক্রিয়ায় সেসব অভিযোগের বিচার হতেই পারে। কিন্তু ঢালাওভাবে খুনের মামলা দায়েরের ব্যাপারটি মোটেও গ্রহণযোগ্য নয়।
‘মব’ নামে পরিচিত ননস্টেট অ্যাক্টরগুলো নানাভাবে গণমাধ্যমের স্বাধীনতায় বাধা সৃষ্টি করছে, এমন অভিযোগ আছে। এ বিষয়কে কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন?
নূরুল কবীর: কোনো স্বৈরতান্ত্রিক সরকারের বিরুদ্ধে দীর্ঘকাল সংগ্রাম পরিচালনার প্রক্রিয়ায়, সংগ্রামীদের কারও কারও মননের ভেতর, তাঁদের অজান্তেই, কিছু কিছু স্বৈরতান্ত্রিক প্রবণতার অনুপ্রবেশ ঘটে। ফলে সংগ্রামের মুখে সেই স্বৈরতান্ত্রিক সরকারের পতনের পর বিজয়ী সংগ্রামীদের সেই সুপ্ত প্রবণতা নানা প্রতিক্রিয়ার আকারে সমাজে অভিব্যক্তি লাভ করে।
বিদ্যমান ক্ষেত্রে ‘রাষ্ট্রবহির্ভূত’ কিন্তু রাষ্ট্রের সঙ্গে জড়িত, এসব ননস্টেট ব্যক্তির কারও কারও ভেতর এই প্রবণতা লক্ষ করা যাচ্ছে, যা কখনো কখনো ‘মব অ্যাকশন’ হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছে। এ দেশের সমাজ ও রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক রূপান্তরের সংগ্রামকে এগিয়ে নিতে হলে এই প্রবণতার বিরুদ্ধে সচেতনভাবে সতর্কতার সঙ্গে ভাবাদর্শগত সংগ্রাম পরিচালনা করা প্রয়োজন হয়। আমাদেরও তা করতে হবে। তবে প্রতিবাদী তারুণ্যের কোনো ন্যায়সংগত প্রতিবাদকে আমরা যেন ‘মব জাস্টিস’ হিসেবে চিহ্নিত না করি।
অন্তর্বর্তী সরকার ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ আমলে পাস হওয়া একটি আইন ব্যবহার করে আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের এ সিদ্ধান্ত সম্পর্কে আপনার মতামত কী?
নূরুল কবীর: অন্তর্বর্তী সরকার ঠিক ‘আওয়ামী লীগ আমলে পাস হওয়া আইন ব্যবহার করে আওয়ামী লীগের কার্যক্রমকে নিষিদ্ধ ঘোষণা’ করেনি, সেই আইনের ভেতর নতুন বিধান সংযুক্ত করে সংগঠন হিসেবে লীগের অপরাধের বিচার ও বিচারপ্রক্রিয়া সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত তার রাজনৈতিক কার্যক্রম নিষিদ্ধ অর্থাৎ স্থগিত ঘোষণা করেছে। এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার আগে সরকার বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল, জামায়াতে ইসলামী ও এনসিপির অনুমোদন গ্রহণ করেছে।
যাহোক, আওয়ামী লীগ জনগণের ভোটাধিকার হরণ করে, প্রহসনমূলক নির্বাচনের মাধ্যমে, রাষ্ট্রের বলপ্রয়োগমূলক ক্ষমতার অপব্যবহার করে, রাষ্ট্রক্ষমতা কুক্ষিগত রেখে এ দেশে একটি লুটপাটতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছিল। আবার এই রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক অপরাধের বিরুদ্ধে সংগঠিত গণতান্ত্রিক সংগ্রামকে দমন করে ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য লীগ সরকার মাত্র তিন সপ্তাহে দেড় হাজার মানুষকে হত্যা করেছে এবং ২০ হাজার মানুষকে গুলি করে তাঁদের অনেককেই চিরতরে পঙ্গু করে দিয়েছে।
এমন একটি রাজনৈতিক দলের স্বৈরতান্ত্রিক নেতা-নেত্রীসহ খোদ সেই দলটিকেও ‘সংগঠন হিসেবে’ বিচারের আওতায় আনাকে আমি একটি ন্যায্য পদক্ষেপ হিসেবেই গণ্য করি। তা ছাড়া নতুন এই আইনি বিধানের অধীনে লীগের হত্যাযজ্ঞ বিচারের প্রক্রিয়া শুরু করার ফলে এ দেশে ১৯৭১ সালে পাকিস্তান সামরিক বাহিনী কর্তৃক পরিচালিত গণহত্যাযজ্ঞে জামায়াতে ইসলামীর সক্রিয় সমর্থনের জন্য সংগঠন হিসেবে জামায়াতের বিচারের আইনগত পথও প্রশস্ত হয়েছে। পৃথিবীর যেকোনো রাজনৈতিক দল বা সরকার কর্তৃক জনগণের বিরুদ্ধে পরিচালিত কোনো হত্যাযজ্ঞকে সমর্থন করা অন্যায়।
আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবিতে এনসিপিসহ কয়েকটি সংগঠনের উদ্যোগে যে সমাবেশ আহ্বান করা হয়েছিল, সেখান থেকে বিভিন্ন আপত্তিকর স্লোগান শোনা গেছে। জাতীয় সংগীত গাওয়ায়ও বাধা আসে। আওয়ামী লীগের বিরোধিতা করতে গিয়ে কোনো পক্ষ কি মুক্তিযুদ্ধেরও বিরোধিতা করছে?
নূরুল কবীর: হ্যাঁ, লীগকে নিষিদ্ধ করার দাবিতে এনসিপি আয়োজিত সমাবেশে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের ইতিহাসবিরোধী কয়েকটি স্লোগান উচ্চারিত হয়েছে। ফলে তা অবশ্যই ‘আপত্তিকর’। তবে আশার কথা হলো, একই সমাবেশ থেকে ওই সব ‘অনৈতিহাসিকতার’ দোষে দুষ্ট স্লোগানের বিরুদ্ধে যথার্থ প্রতিবাদও উত্থাপিত হয়েছে। সেখানে জাতীয় সংগীত গাওয়ায় বাধা দিলে, তারও যথাযথ প্রতিবাদ সংঘটিত হয়েছে।
কোনো রাষ্ট্রের ‘জাতীয় সংগীতের’ যাথার্থ নিয়ে বিতর্ক উঠতেই পারে, যথার্থ ইতিহাসের আলোকে, সততার সঙ্গে, নানা গঠনমূলক বিতর্কের মাধ্যমে তার নিষ্পত্তিও হতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশ রাষ্ট্রের উত্থানের জন্য এ দেশের মানুষকে যে রক্তাক্ত স্বাধীনতাযুদ্ধের ভেতর দিয়ে যেতে হয়েছে, সেই যুদ্ধের সময় যারা এ দেশের মানুষের স্বাধীনতা-প্রয়াসের বিরুদ্ধে সক্রিয় অবস্থান গ্রহণ করেছিল, তারা যখন ‘জাতীয় সংগীতের’ যাথার্থ নিয়ে প্রশ্ন তোলে, তখন তাকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত অসৎ রাজনৈতিক তৎপরতা হিসেবে ধরে নিতে হবে। গণতন্ত্রপরায়ণ দেশপ্রেমিক নাগরিকদের তরফে এসব অপতৎপরতাকে প্রশ্রয় দেওয়া উচিত নয়।
বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে আওয়ামী লীগ রাজনৈতিকভাবে নেতৃত্ব দিয়েছিল এ কথা যেমন সত্য, জামায়াতসহ দু-একটি অনুল্লেখযোগ্য সংগঠন ছাড়া অপরাপর সব রাজনৈতিক দল সেই যুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছিল, এ কথাও তেমন সত্য। ফলে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের ওপর লীগের একাধিপত্য প্রতিষ্ঠার অনুগামী অসত্য বয়ান গ্রহণযোগ্য নয়। এ অবস্থায় স্বাধীনতা-পরবর্তী লীগের নানা রাজনৈতিক অপকর্মের বিরোধিতা করার নামে, খোদ স্বাধীনতাযুদ্ধ কিংবা স্বাধীনতাযুদ্ধের গণচেতনার বিরোধিতাকে প্রশ্রয় দেওয়ারও সুযোগ নেই।
মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা কিংবা মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে ভুল বয়ান বা ন্যারেটিভ প্রচার করে কি বাংলাদেশে গঠনমূলক রাজনীতি করা সম্ভব?
নূরুল কবীর: প্রায় ৫৪ বছর আগে সংগঠিত বাংলাদেশের বিজয়ী স্বাধীনতাযুদ্ধকে এখন কে কীভাবে বিরোধিতা করবে? প্রশ্নটা হলো, সেই মহান জনযুদ্ধের ‘ভুল বয়ান’ প্রচার করে বাংলাদেশে গঠনমূলক রাজনীতি করা সম্ভব কি না? না, সম্ভব না। মুক্তিযুদ্ধের ‘দলীয়কৃত’, অর্থাৎ ভুল বয়ান প্রচার করে লীগ ও তার রাজনৈতিক দোসররাই যেখানে ‘গঠনমূলক রাজনীতি’ চর্চা করতে পারেনি, ‘মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের আর মুক্তিযুদ্ধবিরোধী’ শক্তি নামক স্লোগানের অধীনে দেশের গোটা জনসাধারণকে খাড়াখাড়িভাবে বিভক্ত করে হাজার হাজার মুক্তিযোদ্ধাকে ‘মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তি’ হিসেবে তকমা দিয়ে, দেশ গঠনে জনগণের সম্মিলিত শক্তিকে দ্বিখণ্ডিত করে, বাংলাদেশের সামষ্টিক আত্মশক্তি বিকাশের পথকে কণ্টকাকীর্ণ করেছে, সেখানে অন্যরা আবার আরেক ধরনের ‘ভুল বয়ান’ প্রচার করে কীভাবে গঠনমূলক রাজনীতি চর্চার পথ প্রশস্ত করবে? অসম্ভব।
বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধকে একটি ‘জনযুদ্ধ’ হিসেবে বিবেচনায় নিয়ে, সেই যুদ্ধে বিভিন্ন রাজনৈতিক ধারার অবদানকে স্বীকৃতি দিয়ে, বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের মৌল চেতনার সাম্য, সামাজিক ন্যায়পরায়ণতা ও নাগরিকের মানবিক মর্যাদার আলোকে রাষ্ট্র ও রাজনীতির গণতান্ত্রিক পুনর্গঠনের মাধ্যমেই কেবল এ দেশে ‘গঠনমূলক রাজনীতি’ চর্চা সম্ভব।
সম্প্রতি নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকায় বাংলাদেশে উগ্রপন্থার উত্থানের আশঙ্কা নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। আপনার মন্তব্য কী?
নূরুল কবীর: কোনো দেশের শাসকশ্রেণির বিভিন্ন দল ও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো যখন সমাজে দীর্ঘকাল ধরে অগণতান্ত্রিক, স্বৈরতন্ত্রী কিংবা কর্তৃত্ববাদী শোষণ-নিপীড়নমূলক রাজনৈতিক ব্যবস্থা জারি রাখে, তখন সে সমাজে প্রতিবাদী রাজনীতি হামেশাই ‘উগ্র রূপ’ ধারণ করে। কেননা, স্বৈরতান্ত্রিক কিংবা কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থা নিজেই অন্যান্য আরও নেতিবাচক নীতি-আদর্শের সঙ্গে উগ্রতার উপাদানে গঠিত। সাধারণভাবে বাংলাদেশে স্বৈরতান্ত্রিক শাসকশ্রেণি ও তার রাষ্ট্রের, বিশেষত দেড়-দশকব্যাপী লীগ সরকারের প্রবল উগ্রপন্থার বিরুদ্ধে বিরোধী শিবিরের রাজনীতির তুলনামূলকভাবে দুর্বল একাংশও ‘উগ্রতার’ দিকে ঝুঁকেছে।
বাংলাদেশ রাষ্ট্রের এবং এ দেশের মূলধারার রাজনীতি ও অর্থনীতির যথার্থ গণতান্ত্রিক রূপান্তরের ভেতর দিয়েই কেবল এখন পর্যন্ত দুর্বল ‘উগ্রপন্থী’ রাজনীতি বিকাশের পথরোধ করা যেতে পারে। নতুবা এখানে আরও বিভিন্ন ধরনের রাজনৈতিক উগ্রপন্থার বিকাশ ঘটতে থাকবে। এই প্রবণতা শেষ বিচারে দেশের জন্য মঙ্গলজনক হতে পারে না। ফলে গণতন্ত্রের তরফে, যেকোনো উগ্রবাদিতার বিরুদ্ধে রাজনৈতিক ও মতাদর্শিক সংগ্রাম পরিচালনা করা এখন একটি গুরুত্বপূর্ণ কর্তব্য হিসেবে সমাজে হাজির রয়েছে।
সংস্কারের পাশাপাশি নির্বাচন নিয়ে অনেক কথা হচ্ছে। সরকারের পক্ষ থেকে বারবার বলা হচ্ছে, আগামী ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। কিন্তু বেশির ভাগ রাজনৈতিক দল আশ্বস্ত হতে পারছে না। এই অবস্থার জন্য আপনি কাকে দায়ী করবেন?
নূরুল কবীর: রাষ্ট্র ও রাজনীতির গণতান্ত্রিক সংস্কার এবং জনপ্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্রের জন্য রাষ্ট্রের সব পরিসরে নির্বাচন কোনো পরস্পরবিরোধী প্রতিপাদ্য নয়। দুটিই দরকার। কিছু সংস্কার জাতীয় নির্বাচনের আগে, আর কিছু পরে কার্যকর হওয়াই বাঞ্ছনীয়। সংস্কারের নামে নির্বাচন প্রলম্বিত করা কিংবা নির্বাচনের নামে সংস্কারপ্রক্রিয়ায় বিঘ্ন তৈরি করা ঠিক হবে না। তবে হ্যাঁ, এ কথা ঠিক যে অন্তর্বর্তী সরকার আগামী ডিসেম্বর থেকে জুনে নির্বাচনের কথা বারবার বললেও, অনেক রাজনৈতিক দল আশ্বস্ত হতে পারছে না। তার কারণ হলো, ঠিক কবে, কোন মাসে, ‘নির্বাচনী তফসিল’ ঘোষিত হবে, সরকার তা-ও পরিষ্কার করে বলছে না।
সংশ্লিষ্ট সবাই জানেন, সরকারের ভেতরে ও বাইরে অনেকেই আছেন, যাঁরা নির্বাচন পিছিয়ে দিয়ে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে বেশ কয়েক বছর ক্ষমতায় রেখে, নিজেদের নানা ব্যক্তিগত ও দলগত সুবিধা আদায় করতে চান। এ অবস্থায় নির্বাচনী শিডিউলের সুনির্দিষ্ট সময়সীমা ঘোষিত না হওয়ার কারণে সরকারের রাজনৈতিক উদ্দেশ্যের ব্যাপারে রাজনৈতিক দলগুলোর ভেতর সন্দেহ সৃষ্টি হয়েছে। দেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও অর্থনীতির গতিশীলতা নিশ্চিত করার স্বার্থেই অনতিবিলম্বে এই সংশয় ও সন্দেহের নিরসন হওয়া প্রয়োজন। তা ছাড়া অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মনে রাখা প্রয়োজন, গণতান্ত্রিক নীতিমালা কোনো সরকারের জন্যই অনির্দিষ্ট মেয়াদে ক্ষমতায় থাকার ধারণা অনুমোদন করে না।
অন্তর্বর্তী সরকারের পারফরম্যান্স নিয়ে আপনার মতামত কী? সরকার নিরপেক্ষতা বজায় রাখতে পারছে না—বিএনপির পক্ষ থেকে একাধিকবার বলা হয়েছে। আপনি কীভাবে দেখছেন?
নূরুল কবীর: দু-একটা নির্দিষ্ট এলাকা বাদ দিলে, অন্তর্বর্তী সরকারের পারফরম্যান্স সন্তোষজনক নয়। দীর্ঘ ৯ মাসে রাষ্ট্রের কোনো গুরুত্বপূর্ণ পরিসরেই কোনো দৃশ্যমান ইতিবাচক পরিবর্তন নেই। সবকিছু পুরোনো পদ্ধতিতেই চলছে। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের শীর্ষ নেতৃত্বের প্রকাশ্য অনুমোদন সত্ত্বেও সেই দলের চাঁদাবাজ-দখলবাজ কর্মীদের গ্রেপ্তার করার সরকারি উদ্যোগ নেই। আর ‘নিরপেক্ষতা’ বলতে যদি আপনি ‘রাজনৈতিক দলনিরপেক্ষতা’ বুঝিয়ে থাকেন, সে ক্ষেত্রেও বিএনপির অভিযোগের খানিকটা ন্যায্যতা তো রয়েছে।
অন্তর্বর্তী সরকারে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের উদ্যোগে গঠিত নতুন রাজনৈতিক দল এনসিপির প্রত্যক্ষ প্রতিনিধিত্ব রয়েছে। ফলে রাষ্ট্রের নানা গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে তাঁরা সরকারের ওপর যতটা প্রভাব জারি রাখতে পারেন, অন্যদের সে সুযোগ নেই। এটা অদূর ভবিষ্যতে একধরনের নতুন সংকট তৈরি করতে পারে।
অতীতে অনেক জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে অন্তর্বর্তী সরকার রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করেছে। কিন্তু মিয়ানমারে মানবিক চ্যানেল ইস্যু কিংবা চট্টগ্রাম বন্দরের কনটেইনার টার্মিনাল পরিচালনার দায়িত্ব বিদেশি কোম্পানিকে দেওয়ার মতো বিষয়গুলো নিয়ে কোনো আলোচনা হয়নি। রাজনৈতিক দলগুলো এ নিয়ে আপত্তি তুলছে। বিষয়টাকে কীভাবে দেখছেন?
নূরুল কবীর: অন্তর্বর্তী সরকারের সব সময় মনে রাখা প্রয়োজন যে রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য তার যথাযথ ‘আইনগত বৈধতা’ নেই। লীগ সরকারের স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে পরিচালিত বিজয়ী গণতান্ত্রিক সংগ্রামের শিক্ষার্থী নেতৃত্বের প্রস্তাব, লীগবিরোধী সংগ্রামে অংশগ্রহণকারী বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সমর্থন ও সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় এই সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তাদের সবার সমর্থনই বিদ্যমান সরকারকে ‘রাজনৈতিক ন্যায্যতা’ জুগিয়েছে। ফলে রাষ্ট্রের তরফে কোনো বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থসংশ্লিষ্ট সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রাক্কালে, অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য এই শক্তিসমূহের প্রতিনিধিদের সঙ্গে যৌথ কিংবা আলাদাভাবে আলোচনা করা বাঞ্ছনীয়।
রাখাইন রাজ্যের জন্য ‘মানবিক চ্যানেল’ দেওয়া না–দেওয়া বা বন্দরের কনটেইনার টার্মিনাল পরিচালনার দায়িত্ব বিদেশি কোম্পানির কাছে হস্তান্তর করার মতো সিদ্ধান্তগুলো অত্যন্ত জাতীয় জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়, যা দেশের ওপর সুদূরপ্রসারী প্রভাব রাখতে বাধ্য। এসব বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের একা একা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা উচিত নয়। বাংলাদেশ যখন একটি ক্রান্তিকালের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হচ্ছে, তখন গণতন্ত্রপরায়ণ শক্তিসমূহের সম্মিলিত ভাবনার ওপর গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন।
আপনাকে ধন্যবাদ।
নূরুল কবীর: আপনাদেরও ধন্যবাদ।