বিশেষ সাক্ষাৎকার : সানজিদা ইসলাম

আমরা এখনো গুমের ট্রমা থেকে বের হতে পারিনি

সানজিদা ইসলাম মায়ের ডাকের সংগঠক। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে গুমের শিকার ব্যক্তিদের পরিবারগুলোকে নিয়ে তিনি এ সংগঠন গড়ে তুলতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন। সংগঠনটি কীভাবে তৈরি হয়েছিল, তাঁরা কী ধরনের প্রতিকূল পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছিলেন, গুমের ঘটনার তদন্ত ও বিচার ইত্যাদি বিষয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মনজুরুল ইসলাম

প্রথম আলো:

‘মায়ের ডাক’ সংগঠনটির যাত্রা শুরু হলো কীভাবে?

সানজিদা ইসলাম: আমার ভাই সাজেদুল ইসলাম সুমন বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তিনি ২৫ নম্বর ওয়ার্ড (ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন) বিএনপির সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির একতরফা নির্বাচনের আগে তখন সারা দেশে বিএনপিসহ বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। এ কারণে আমার ভাই বাড়িতে থাকতেন না। তিনি বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় আমাদের এক আত্মীয়ের বাসায় থাকতেন।

২০১৩ সালের ৪ ডিসেম্বর র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র‌্যাব) একটি দল রাত সাড়ে আটটার দিকে বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা থেকে সুমনসহ ছয়জনকে তুলে নিয়ে যায়। যাঁরা তুলে নেন, তাঁরা সশস্ত্র ছিলেন এবং তাঁরা র‌্যাবের পোশাক পরা ছিলেন। তিনটি ডাবল কেবিন ভ্যান আর একটি সাদা মাইক্রোবাস ছিল। এসব গাড়িতে ‘র‌্যাব-১’ লেখা ছিল। ওই দিনই রাতেই শাহীনবাগ এলাকা থেকে আরও দুই বিএনপি নেতাকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। তখন রাস্তায় গাড়িতে সুমনসহ ওই ছয়জন ছিলেন। এটা সেখানে উপস্থিত সবাই দেখেছিলেন। 

 ঘটনার পরপরই আমার মা, বোন, ভাই প্রথমে ভাটারা থানায় যান। কিন্তু র‌্যাব তাঁদের তুলে নিয়ে গেছে শুনে পুলিশ কোনো মামলা বা জিডি নেয়নি। এরপর র‌্যাব-১ অফিসে যাই। কিন্তু তারা তুলে নেওয়ার বিষয়টি স্বীকার করেনি। আমরা ভেবেছিলাম, যেহেতু রাষ্ট্রীয় বাহিনী তুলে নিয়ে গেছে, জিজ্ঞাসাবাদের পর আমার ভাইকে ছেড়ে দেবে। দুই-তিন দিন পেরিয়ে যাওয়ার পরও তাঁদের ছাড়া হয়নি কিংবা কোনো আদালতেও নেওয়া হয়নি। তখন আমরা বিষয়টি নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়ি।

 আমার ভাইকে যখন তুলে নিয়ে যাওয়া হয়, তখনো আমরা গুম ব্যাপারটা সম্পর্কে জানতাম না। তখন পর্যন্ত এ রকম ঘটনা আমরা খুব বেশি দেখিনি। বিরোধী দলের রাজনীতি করার কারণে এ রকম যে ঘটতে পারে, আমাদের মতো সাধারণ পরিবারের তা জানা ছিল না। 

৫ জানুয়ারির একতরফা নির্বাচনের পরও যখন আমার ভাইয়ের কোনো খোঁজ পাওয়া যাচ্ছিল না, তখন আমরা র‌্যাব, ডিজিএফআই, পুলিশ, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আবেদন করি। কিন্তু সেসব আবেদনের কোনো উত্তর পাওয়া যাচ্ছিল না। আমরা অনেকবার মামলা করার চেষ্টা করি। কিন্তু সেটাও সম্ভব হয়নি। এরপর ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে আমার মা গুম হওয়া ওই আটটি পরিবার নিয়ে একটি সংবাদ সম্মেলন করেন। এটাকেই ‘মায়ের ডাক’ সংগঠনটি তৈরির প্রথম পদক্ষেপ বলা যেতে পারে।  

 গুম হওয়া আটজনের পরিবার জনসমক্ষে কথা বলার পর বোঝা গেল গুমের শিকার হয়েছেন আরও অনেকে। সে বছর ৩১ আগস্ট আন্তর্জাতিক গুম দিবসে মায়ের ডাকের ব্যানারে গুমের শিকার ব্যক্তিদের ১০০ পরিবার নিয়ে একটি সংবাদ সম্মেলন করা হয়। এরপর গুম হওয়া ব্যক্তিদের পরিবারের সদস্যরা আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে থাকলেন। তখন আমরা বুঝলাম, সারা দেশে সংখ্যাটা আরও অনেক বেশি। এরপর শেখ হাসিনার পুরো শাসনামলে, বিশেষ করে নির্বাচনগুলোর আগে সারা দেশে আরও বহু গুমের ঘটনা ঘটেছে। বিগত সরকারের আমলে নানা প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যেও গুমের শিকার এই পরিবারগুলোকে একত্র করার কাজ করেছে মায়ের ডাক।

প্রথম আলো:

আপনি প্রতিকূল পরিস্থিতির কথা বললেন। সেগুলো কেমন ছিল, একটু বলবেন?  

সানজিদা ইসলাম: বিগত সরকারের সময় আমরা যখনই কোথাও কোনো অনুষ্ঠান করার চেষ্টা করেছি, সেটা মানববন্ধন কিংবা সভা-সমাবেশ, যেটাই হোক, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আমাদের নানাভাবে বাধা দিয়েছে। আমরা যখন সাংবাদিক বা মানবাধিকারকর্মীদের সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছি, তখন তারা বাধা দিয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সব সময়ই আমাদের নজরদারির মধ্যে রেখেছিল। এমনকি সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস যখন আমাদের কার্যালয়ে এসেছিলেন, আওয়ামী লীগের লোকজন তাতেও বাধা সৃষ্টি করেছিল। আমরা যাতে কথা বলতে না পারি, গুমের ঘটনাগুলো নিয়ে জনমত তৈরি করতে না পারি, বিগত সরকারের পক্ষ থেকে সে রকম চেষ্টা করা হয়েছিল।

প্রথম আলো:

বিগত সরকারের আমলে ‘ক্রসফায়ার’-এর নামে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। আবার গুমের ঘটনাও ঘটেছে। গুমের কি কোনো আলাদা তাৎপর্য আছে?

সানজিদা ইসলাম: গুমের ঘটনার একটা বড় তাৎপর্য হলো অনিশ্চয়তা। সার্বক্ষণিক একটা অনিশ্চয়তা থাকে যে গুমের শিকার ব্যক্তি বেঁচে আছেন, নাকি তাঁকে মেরে ফেলা হয়েছে। বেঁচে থাকলে কোথায় আছেন, কীভাবে আছেন, তাঁকে নির্যাতন করা হচ্ছে কি না, তিনি আদৌ ছাড়া পাবেন কি না—এ প্রশ্নগুলো সব ভুক্তভোগী পরিবারগুলোকে অনিশ্চয়তার মধ্যে ফেলে রাখে। এই যেমন আমার ভাইকে প্রায় ১২ বছর আগে গুম করা হয়েছে, কিন্তু আমরা এখনো তাঁর সম্পর্কে কিছু জানি না। সরকার বা কোনো বাহিনীর পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে কিছুই জানানো হয়নি। এ রকম অনিশ্চয়তা গুমের শিকার পরিবারগুলোকে ট্রমাগ্রস্ত করে রাখে। আমরা এখনো সেই ট্রমা থেকে বের হতে পারিনি।

প্রথম আলো:

গুমের ঘটনাগুলোর সঙ্গে রাজনীতির কি কোনো সম্পর্ক আছে?

সানজিদা ইসলাম: বিগত সরকারের আমলে যাঁরা গুমের শিকার হয়েছেন, তাঁদের প্রায় সবাই বিরোধী দল ও মতের মানুষ ছিলেন। এর মধ্যে অন্য পেশার লোক থাকলেও রাজনীতিসংশ্লিষ্ট মানুষের সংখ্যা ৮০ শতাংশের ওপরে। আরেকটি বিষয় লক্ষ করা গেছে, নির্বাচনের আগে গুমের ঘটনাগুলো বেশি ঘটেছে। এ বিষয়গুলো থেকে বোঝা যায়, জনগণের ম্যান্ডেট ছাড়া বিনা ভোটে ক্ষমতায় থাকতেই এই গুম-খুনের ঘটনাগুলো ঘটেছে।

প্রথম আলো:

আপনাদের হিসাবে বিগত সরকারের আমলে কত মানুষকে গুম করা হয়েছিল? এর মধ্যে কত মানুষ ফিরে এসেছেন আর কতজন এখনো গুম রয়েছেন? 

সানজিদা ইসলাম: গত সরকারের আমলে প্রায় ৭০০ মানুষকে গুম করা হয়েছিল বলে আমরা হিসাব করেছিলাম। কিন্তু গুম কমিশন গঠন করার পর প্রায় ১ হাজার ৭০০ আবেদন জমা পড়েছে। এ থেকে মনে হয়, গুম হওয়া মানুষের সংখ্যা আরও বেশি। 

গত সরকারের আমলে প্রতিকূল পরিস্থিতির কারণে বহু গুমের ঘটনা সামনে আসেনি। এর ফলে এগুলো নথিভুক্ত হয়নি। ৫ আগস্ট স্বৈরাচার হাসিনার পতন ও পলায়নের পর অল্প কয়েকজনকে ছেড়ে দেওয়া হয়। আমাদের হিসাবে ডকুমেন্টেড প্রায় সাড়ে তিন শ মানুষ এখনো গুম রয়েছেন।

প্রথম আলো:

অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে গুমবিরোধী আন্তর্জাতিক সনদে স্বাক্ষর করেছে বাংলাদেশ। এ ছাড়া গুমসংক্রান্ত তদন্ত কমিশনও গঠন করা হয়েছে। এগুলোকে কীভাবে দেখছেন?  

সানজিদা ইসলাম: এ দুটি বিষয়কে আমি ইতিবাচক হিসেবেই দেখছি। কিন্তু গুমের ঘটনার তদন্তে এখনো আশানুরূপ অগ্রগতি লক্ষ করা যাচ্ছে না। শুধু গুমের অভিযোগে এখন পর্যন্ত কাউকে গ্রেপ্তার করা হয়নি। এ ছাড়া ‘আয়নাঘর’ নামে ডিটেনশন সেন্টারগুলো সংস্কার করে সেখানে আলামত নষ্ট করা হয়েছে। ৫ আগস্টের পরও এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে। এর ফলে গুমের ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত নিয়ে পুরোপুরি আশঙ্কামুক্ত হতে পারছি না।

প্রথম আলো:

গুমের ঘটনার বিচারের বিষয়ে আপনার বক্তব্য কী?

সানজিদা ইসলাম: আমাদের প্রথম থেকে চাওয়া হলো গুম হওয়া ব্যক্তিদের সন্ধান। গুমের শিকার ব্যক্তিরা কি আদৌ বেঁচে আছেন, নাকি তাঁদের মেরে ফেলা হয়েছে, আমরা তা জানতে চাই। গুমের শিকার পরিবারগুলো আর কত অপেক্ষায় থাকবে?

আমাদের আরেকটি চাওয়া হলো গুমের ঘটনাগুলোর ন্যায়বিচার করতে হবে। এ ক্ষেত্রে কাউকে ছাড় দেওয়া যাবে না। প্রতিটি ঘটনার তদন্ত করে বিচার করতে হবে। গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে স্বৈরাচারী সরকারের পতনের পর আমরা আশা করেছিলাম সবকিছু নতুনভাবে শুরু হবে, আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো নিজেদের অতীতের অপকর্মগুলো প্রকাশ করবে; গুমের ঘটনাগুলোর সঙ্গে কারা কারা জড়িত ছিল, সেটা নিয়ে তদন্ত করা হবে। 

কিন্তু এসব ক্ষেত্রে তেমন কোনো উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না; যাঁরা গুমের সঙ্গে জড়িত ছিলেন, তাঁরা কেউ অবসরে গেছেন, কেউ নিজের বাহিনীতে বহাল তবিয়তে আছেন, কারও কারও পদোন্নতিও হয়েছে। তাঁদের চিহ্নিত করে বিচারের মুখোমুখি করতে হবে। গুমের ঘটনাগুলোর সঙ্গে বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের অনেকে জড়িত ছিলেন। যাঁরা জড়িত ছিলেন, বাংলাদেশে তাঁদের আর রাজনীতি করতে দেওয়া উচিত নয়। বাংলাদেশে আর যেন কখনো কেউ গুম না হন, সেটি নিশ্চিত করতে হলে ন্যায়বিচারের কোনো বিকল্প নেই।

প্রথম আলো:

আপনাকে ধন্যবাদ।

সানজিদা ইসলাম: আপনাকেও ধন্যবাদ।