সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির নির্বাচন

ভোটের ফল ধরে রাখাই বড় চ্যালেঞ্জ: রুহুল কুদ্দুস

সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সম্পাদক মো. রুহুল কুদ্দুস। জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ঐক্য প্যানেলের (নীল প্যানেল) মনোনীত প্রার্থী হিসেবে তিনি এবারও সম্পাদক পদে নির্বাচন করছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মনজুরুল ইসলাম

প্রশ্ন:

দেশের সর্বোচ্চ আদালতের আইনজীবীদের প্রতিনিধিত্বকারী সংগঠন সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির নির্বাচনে আপনি সম্পাদক হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। আপনার নির্বাচনী ইশতেহারের মূল বক্তব্য কী এবং নির্বাচিত হলে আপনি কী কী কাজ করতে চান?

রুহুল কুদ্দুস: সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি দেশের সর্বোচ্চ আদালতে প্র্যাকটিসরত আইনজীবীদের সংগঠন। এ সমিতির মূল উদ্দেশ্য হলো, আইনজীবীদের কল্যাণ করা। সম্পাদক নির্বাচিত হলে আমি দুটি বিষয়ে উন্নতি করতে চাই। যেহেতু আইনজীবী সমিতি একটি পেশাজীবী সংগঠন, প্রথমত তাঁদের পেশাগত উন্নতির ব্যবস্থা করব। এর আগে আমি যখন সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছি, তখন আইনজীবীদের জন্য নানা রকম ট্রেনিং, সেমিনারের ব্যবস্থা করেছিলাম। সুপ্রিম কোর্টের বিচারকেরা এসব অনুষ্ঠানে এসে আইনজীবীদের পরামর্শ দিয়েছেন। এর ফলে অনেক আইনজীবী পেশাগতভাবে সমৃদ্ধ হয়েছেন। এটা আবার শুরু করব।

দ্বিতীয়ত, বিচারাঙ্গনের দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে চাই। এর আগে দায়িত্ব পালনকালে আমি দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছিলাম। এর ফলে সুপ্রিম কোর্টের ফাইলিং ও এফিডেভিট সেকশনে দীর্ঘদিন পর্যন্ত অতিরিক্ত কোনো খরচ ছাড়াই একজন মানুষ এ কাজগুলো করতে পারতেন। কিন্তু এখন উপরি ছাড়া এ কাজগুলো হয় না। এর ফলে বিচারপ্রার্থীদের ভোগান্তি বাড়ছে। আমি নির্বাচিত হলে এটা বন্ধে ব্যবস্থা নেব।

এ ছাড়া সমিতির জন্য কিছু অবকাঠামোগত উন্নতি করতে চাই। এর আগের মেয়াদে আমি ‘ভবন টুয়েন্টি টুয়েন্টি’ নামে একটি ভবন নির্মাণের পরিকল্পনা করেছিলাম, কিন্তু তৎকালীন সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসনের বাধার কারণে সেটা মাঝপথে থেমে যায়। এরপর সম্পাদক নির্বাচিত হলেও আমাদের দায়িত্ব পালন করতে না দেওয়ায় সেই কাজ আর শেষ হয়নি। এবার সুযোগ পেলে সেই অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করব।

প্রশ্ন :

সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি একটি পেশাজীবী সংগঠন। কিন্তু সমিতির নির্বাচনে দলীয় রাজনীতির প্রভাব স্পষ্ট এবং এর ফলে আইনজীবীদের মধ্যে বিভক্তি তৈরি হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। এ বিষয়ে আপনার মতামত কী?

রুহুল কুদ্দুস: এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই, বাংলাদেশে সব ক্ষেত্রেই একটি রাজনৈতিক মতাদর্শগত বিভাজন রয়েছে। আইনজীবীরা সমাজের কোনো বিচ্ছিন্ন অংশ নন। তাই তাঁদের মধ্যেও এ বিভাজন সৃষ্টি হয়েছে। শুধু রাজনৈতিক মতপার্থক্যের কারণে যদি আইনজীবীদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে দলাদলি হয়, তাহলে এ ধরনের বিভাজন সংগঠনের ক্ষতির সৃষ্টি করে। আমি প্রত্যাশা করি, রাজনৈতিক মতাদর্শগত পার্থক্য থাকলেও আইনজীবীদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে আমাদের একটা ঐকমত্য থাকবে।

তবে এখন যে বিভাজন দেখা যাচ্ছে, সেটা কিন্তু অনেকটা নৈতিক বিভাজন। সারা দেশের মানুষ ভোট দিতে পারছেন না, তাঁদের ভোটের অধিকার নেই। আমরা মানুষের ভোটের অধিকার, মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই করছি। সর্বোচ্চ আদালতের একজন আইনজীবী হিসেবে দেশে গণতন্ত্র, মতপ্রকাশের স্বাধীনতাসহ মানুষের সিভিল-পলিটিক্যাল অধিকার থাকাটা অপরিহার্য বলে আমি মনে করি। কিন্তু যাঁরা আমাদের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ, তাঁরা এসবের কোনো কিছুতেই বিশ্বাস করেন না।

প্রশ্ন:

একটি বহুল প্রচলিত কথা আছে, বার (আইনজীবী সমিতি) ও বেঞ্চ (আদালত) একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ এবং স্বাধীন বার স্বাধীন বিচার বিভাগের জন্য অপরিহার্য। কিন্তু আমাদের আইনজীবীদের একটি বড় অংশ দলীয়ভাবে বিভক্ত। স্বাধীন বিচার বিভাগের জন্য তাঁদের এ ভূমিকাকে কীভাবে দেখেন?

রুহুল কুদ্দুস: বিচারপতি নিয়োগের কোনো নীতিমালা না থাকায় অন্য সবকিছুর চেয়ে এখন রাজনৈতিক বিবেচনা বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে। আমি মনে করি, একজন আইনজীবী কোনো দল সমর্থন করলেও নীতি, নৈতিকতা, মেধা, যোগ্যতার কারণে তিনি বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পেতেই পারেন। যখন তিনি একটি সাংবিধানিক দায়িত্ব পালনের জন্য শপথ গ্রহণ করবেন, তখন থেকে নিরপেক্ষতা বজায় রাখবেন। কিন্তু বিচারক নিয়োগে কোনো নীতিমালা বা মাপকাঠি না থাকায় এ রকম উপযুক্ত মানুষেরা বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পাচ্ছেন না।

প্রশ্ন:

গত বছর সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির নির্বাচনে সম্পাদক পদ নিয়ে বেশ জটিলতা তৈরি হয়েছিল। এটা নিয়ে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি–সমর্থক আইনজীবীদের মধ্যে দীর্ঘ সময় ধরে উত্তেজনা বিরাজ করেছে, অবাঞ্ছিত ঘোষণা, হাতাহাতি, মারামারি, এমনকি মামলা পর্যন্ত হয়েছে। দেশের সর্বোচ্চ আদালতের আইনজীবী সমিতির নির্বাচনকে কেন্দ্র করে কেন এমন অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটেছে?

রুহুল কুদ্দুস: সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির নির্বাচন হয় গঠনতন্ত্র অনুসারে। সেই গঠনতন্ত্র অনুসারে নির্বাচনের সময় সাত সদস্যের একটি নির্বাচন পরিচালনা উপকমিটি গঠন করা হয় এবং তারা প্রয়োজনীয়সংখ্যক সদস্য কোঅপ্ট করতে পারেন। সমিতির একজন জ্যেষ্ঠ সদস্যকে নির্বাচন পরিচালনা উপকমিটির আহ্বায়ক হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয়। যেহেতু আমরা দলীয়ভাবে বিভক্ত, তাই গত বছর দলনিরপেক্ষ ব্যক্তি এ ওয়াই মশিউজ্জামানকে এ দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল।

নির্বাচনে আমি সম্পাদক হিসেবে বিজয়ী হলেও ভোট পুনর্গণনার দাবি করে একটি অরাজক পরিবেশ তৈরি করা হয়েছিল। এ ওয়াই মশিউজ্জামানকে সারা রাত আটকে রাখা হয় এবং তাঁকে ভোটের ফলাফল ঘোষণা করতে দেওয়া হয়নি। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে তিনি পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। এ ঘটনার পর আওয়ামী লীগ–সমর্থিত আইনজীবীদের দিয়ে নিয়মবহির্ভূতভাবে নতুন নির্বাচন পরিচালনা কমিটি গঠন করা হয়। তারা নির্বাচনের ৪২ দিন পর পুলিশ ও বহিরাগতদের সঙ্গে নিয়ে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির তৃতীয় তলার একটি রুমের তালা ভেঙে সেখানে রাখা ব্যালট নিজেদের মতো করে গুনে সম্পাদক পদে আরেকজনকে বিজয়ী ঘোষণা করেন। এ ঘটনায় জাতীয়তাবাদী আইনজীবীসহ সাধারণ আইনজীবীরা ক্ষুব্ধ হন। তাঁরা নিয়মতান্ত্রিকভাবে আন্দোলন চালিয়ে যান। এ আন্দোলেন বাধা দিতে গিয়েই হামলা-মামলার ঘটনা ঘটেছে।

প্রশ্ন:

কয়েক দিন আগে ঢাকা আইনজীবী সমিতির নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। নির্বাচন পরিচালনায় অনিয়ম ও কারচুপির অভিযোগে বিএনপি–সমর্থিত নীল প্যানেল নির্বাচন বর্জন করেছে। সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির নির্বাচনে সে রকম কোনো আশঙ্কা আছে কী?

রুহুল কুদ্দুস: ঢাকা আইনজীবী সমিতির নির্বাচনে প্রধান নির্বাচন কমিশনার হিসেবে মহানগর দায়রা জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) আবদুল্লাহ আবুকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। তাঁকে দায়িত্ব দেওয়ার পরই সুষ্ঠু নির্বাচন হবে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। বিএনপি–সমর্থিত আইনজীবীরা আগেই বিষয়টি নিয়ে আপত্তি করেন এবং প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন। তাঁদের আশঙ্কা সত্যি প্রমাণ করে ভোট গ্রহণের প্রথম দিনই কারচুপি ও অনিয়ম হয়। এ রকম অবস্থায় সেই নির্বাচন বর্জন করা ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না।

সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির নির্বাচনেও একই রকম ঘটনা ঘটানোর চেষ্টা করা হয়েছিল। এখানেও একতরফাভাবে নির্বাচন পরিচালনা কমিটি ঘোষণা করা হয়েছিল। তবে আইনজীবীদের প্রতিবাদের মুখে তা বাতিল করা হয়। পরে ঐকমত্যের একটি ভিত্তিতে একটি নতুন উপকমিটি গঠন করা হয়েছে। গতবার নির্বাচনের ৪২ দিন পর আমাকে সম্পাদক পদে জোর করে হারিয়ে দেওয়া হয়েছিল। এরপরও আমরা এবার সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির নির্বাচন নিয়ে আশাবাদী এবং সর্বশক্তি দিয়ে শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে থাকব। আমাদের নির্বাচন বর্জন করার কোনো সুযোগ নেই।

প্রশ্ন:

বছরখানেকের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। এর আগে দেশের সর্বোচ্চ আদালতের আইনজীবীদের এ নির্বাচন কী কোনো বিশেষ তাৎপর্য বহন করে?

রুহুল কুদ্দুস: সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির এ নির্বাচন অবশ্যই তাৎপর্যপূর্ণ। দেশের যেসব জেলা আইনজীবী সমিতিতে নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে, সেখানে বিএনপি–সমর্থিত আইনজীবীরা জিতেছেন। দেশের সর্বোচ্চ আদালতের আইনজীবীদের নির্বাচনেও যদি বিএনপি–সমর্থিত প্রার্থীরা জেতেন, তাহলে সারা দেশে একটা বার্তা যাবে। তা ছাড়া দেশে ভোট নেই, গণতন্ত্র নেই, আইনের শাসন নেই। এ রকম অবস্থায় গণতন্ত্র, মানবাধিকার, আইনের শাসনের জন্য সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির ভূমিকা রাখার সুযোগ রয়েছে। এ কারণেই সরকারের সমর্থকেরা এ নির্বাচনকে প্রভাবিত করতে চান। অনেক আইনজীবী আমাকে বলেছেন, আমরা আপনাকে ভোট দেব। সেই ভোট ধরে রাখতে পারবেন তো? এই ভোটের ফল ধরে রাখাই আমাদের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।

প্রথম আলো: আপনাকে ধন্যবাদ।
রুহুল কুদ্দুস: আপনাকেও ধন্যবাদ।