সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি একটি পেশাজীবী সংগঠন। কিন্তু সমিতির নির্বাচনে দলীয় রাজনীতির প্রভাব স্পষ্ট এবং এর ফলে আইনজীবীদের মধ্যে বিভক্তি তৈরি হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। এ বিষয়ে আপনার মতামত কী?

আবদুন নূর: আইনজীবীদের মধ্যে যে বিভক্তি হয়েছে, সেটা হওয়া উচিত হয়নি। আমি আইনজীবী সমিতির সম্পাদক হিসেবে দলনিরপেক্ষভাবে কাজ করেছি। আমি সমিতির প্যাড ব্যবহার করে কখনো কোনো দলের পক্ষে বিবৃতি দিইনি। ব্যক্তি হিসেবে আমি দল করেছি, কিন্তু আইনজীবী সমিতির সম্পাদক হিসেবে কোনো দল করিনি। আইনজীবী সমিতি একটি দলনিরপেক্ষ প্রতিষ্ঠান, কিন্তু রাজনীতিমুক্ত প্রতিষ্ঠান নয়। এখানে রাজনীতি থাকবে, কিন্তু সেটা দলনিরপেক্ষ রাজনীতি। আমি সেভাবেই কাজ করেছি এবং ভবিষ্যতেও সেটা অক্ষুণ্ন থাকবে।

একটি বহুল প্রচলিত কথা আছে, বার (আইনজীবী সমিতি) ও বেঞ্চ (আদালত) একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ এবং স্বাধীন বার স্বাধীন বিচার বিভাগের জন্য অপরিহার্য। কিন্তু আইনজীবীদের একটি বড় অংশ দলীয়ভাবে বিভক্ত। এটা কি বিচার বিভাগের স্বাধীনতার জন্য নেতিবাচক ভূমিকা রাখছে না?  

আবদুন নূর: আইনজীবীদের মধ্যে দলীয় বিভক্তি আমাদের জন্য ক্ষতির কারণ হয়েছে। বার ও বেঞ্চ একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ কিংবা একই পাখির দুটি ডানা—এ কথাগুলো আমাদের জন্য প্রযোজ্য হয়নি। অনেক ক্ষেত্রেই আইনজীবীরা নিগৃহীত হয়েছেন। আমাদের দায়িত্ব হচ্ছে আদালতের অর্থাৎ বিচারপতি বা বিচারকদের সম্মান রক্ষা করা। একইভাবে তাঁদেরও দায়িত্ব আইনজীবীদের সম্মান রক্ষা করা। বিচারক বা আইনজীবীদের মধ্যে কেউ কারও চেয়ে ছোট বা বড় নয়। দুই পক্ষই যদি পরস্পরের প্রতি সম্মান দেখায়, তাহলে বার ও বেঞ্চের মধ্যে সম্পর্কের উন্নতি হবে।

গত বছর সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির নির্বাচনে সম্পাদক পদ নিয়ে বেশ জটিলতা তৈরি হয়েছিল। এটা নিয়ে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির সমর্থক আইনজীবীদের মধ্যে দীর্ঘ সময় ধরে উত্তেজনা বিরাজ করেছে, অবাঞ্ছিত ঘোষণা, হাতাহাতি, মারামারি, এমনকি মামলা পর্যন্ত হয়েছে। দেশের সর্বোচ্চ আদালতের আইনজীবী সমিতির নির্বাচনকে কেন্দ্র করে কেন এমন অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটেছে?

আবদুন নূর: আমাদের আইনজীবী সমিতির গঠনতন্ত্র অনুসারে নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রাথমিক দায়িত্ব হলো সম্পাদকের। সম্পাদক ভোটার তালিকা তৈরি করেন, তিনি নির্বাচনের শিডিউল ঘোষণা করেন, নির্বাচন পরিচালনার জন্য উপকমিটি গঠন করেন, তিনি ব্যালট পেপার ছাপান, ব্যালটে স্বাক্ষর করেন, নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণা করে তা সম্পাদকের কাছে উপস্থাপন করা হয়। তৎকালীন সম্পাদক ভোটার তালিকা করার সময় সেখানে ভুয়া ভোটারদের অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন। সেখান থেকেই জটিলতার শুরু। এরপর ভোট গণনার সময় কিছু অনিয়মের কারণে আমি পুনর্গণনার দাবি করি। কিন্তু নির্বাচন পরিচালনা উপকমিটির তৎকালীন আহ্বায়ক সেটা না করে পদত্যাগ করেন। এরপর ৪১ দিন পেরিয়ে গেলেও তৎকালীন সম্পাদক ভোট পুনর্গণনার কোনো ব্যবস্থা করেননি। এরপর নতুন উপকমিটি  গঠন করা হয় এবং ভোট পুনর্গণনা করলে আমি বিজয়ী হই। আর আইনজীবীদের হাতাহাতি-মারমারির বিষয়টি ছিল একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা, এটা নিয়মিত কোনো ঘটনা নয়। বাংলাদেশে যে রাজনীতি চলমান, তা আমাদের মধ্যে বিভাজন তৈরি করেছে এবং তার ফলশ্রুতিতে এ ধরনের ঘটনাগুলো ঘটেছে।

কয়েক দিন আগে ঢাকা আইনজীবী সমিতির নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। নির্বাচন পরিচালনায় অনিয়ম ও কারচুপির অভিযোগে বিএনপি সমর্থিত নীল প্যানেল সেই নির্বাচন বর্জন করেছে। সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির নির্বাচনে সে রকম কোনো আশঙ্কা আছে কি? নির্বাচনী পরিবেশ নিয়ে কিছু বলেন?

আবদুন নূর: আমরা নির্বাচনে প্রচার-প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছি। অন্যরাও সমানভাবে প্রচার-প্রচারণা চালাচ্ছেন। নির্বাচনী পরিবেশ অনেক ভালো। আমি একটা সুষ্ঠু, সুন্দর নির্বাচন করতে চাই। সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সম্পাদক হিসেবে আমি দৃঢ়তার সঙ্গে বলছি, এখানে নির্বাচন বর্জন করার পরিস্থিতি তৈরি হবে না। এরপরও কেউ যদি নির্বাচন বর্জন করে, তাহলে আমাদের কিছু করার নেই। নির্বাচন বর্জন করার রেওয়াজটা ভালো নয়।

বছরখানেকের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। এর আগে দেশের সর্বোচ্চ আদালতের আইনজীবীদের এই নির্বাচন কি কোনো বিশেষ তাৎপর্য বহন করে?

আবদুন নূর: আইনজীবী সমিতি একটি দলনিরপেক্ষ প্রতিষ্ঠান। জাতীয় রাজনীতিতে এর ভূমিকা সে রকমই হবে। আগামী জাতীয় নির্বাচন যেন সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য হয়, আইনজীবী সমিতি তাই চায়। অতীতে জাতীয় রাজনীতির ক্ষেত্রে আইনজীবী সমিতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। দেশে গণতন্ত্র ও মানবাধিকার রক্ষায় আমাদের সেই ভূমিকা অব্যাহত থাকবে।

প্রথম আলো: আপনাকে ধন্যবাদ।
আবদুন নূর: আপনাকেও ধন্যবাদ।