বিশেষ সাক্ষাৎকার: হাসনাত কাইয়ূম

সংস্কার নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মতপার্থক্য বাড়ছে

রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক এবং গণতন্ত্র মঞ্চের অন্যতম নেতা হাসনাত কাইয়ূম। সুপ্রিম কোর্টের এই আইনজীবী বেশ কয়েক বছর ধরে রাষ্ট্র ও সংবিধান সংস্কার নিয়ে কথা বলার পাশাপাশি রাজনীতির মাঠেও সক্রিয়। এগুলো নিয়ে সম্প্রতি তিনি প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন।

সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মনজুরুল ইসলাম

প্রথম আলো:

রাষ্ট্র ও সংবিধানের নানা রকম সংস্কার নিয়ে আপনি দীর্ঘদিন ধরে কথা বলছেন। ৫ আগস্টের পর পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এসব বিষয়ে কতটুকু অগ্রগতি হয়েছে বলে আপনি মনে করেন?

হাসনাত কাইয়ূম: এ প্রশ্নটার উত্তর অনেক বিস্তৃত। এর মধ্যে রাষ্ট্র সংস্কারের পটভূমি এবং পরিণতি সবই অন্তর্ভুক্ত। আমরা ২০১৩ সালে বাহাত্তরের সংবিধানের একটি পর্যালোচনা প্রকাশ করি। সেখানে আমরা দেখতে পাই, যে আকাঙ্ক্ষা এবং অঙ্গীকার নিয়ে বাংলাদেশ নামে নতুন রাষ্ট্রটি যাত্রা শুরু করছিল, সংবিধানের রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি অংশে তার কিছু স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু ক্ষমতাকাঠামো অংশ ছিল তার বিপরীত।

আমরা তখন রাষ্ট্রকে মুক্তিযুদ্ধের আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নের উপযোগী করতে হলে এর ক্ষমতাকাঠামো অংশের যে ব্যাপক রদবদল করা প্রয়োজন, সেটা বুঝতে পারি। সে জন্য সংবিধান সংস্কারের প্রয়োজনীয়তার কথা তুলে ধরি। পরে ‘রাষ্ট্রচিন্তা’ ও ‘রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন’-এর মাধ্যমে বাংলাদেশের অপরাপর রাজনৈতিক ও সামাজিক শক্তির সহায়তায় সেই বক্তব্যকে আরও বিস্তৃত এবং পরিশীলিত আকারে জনগণের মধ্যে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করি।

৫ আগস্টের আগপর্যন্ত আমাদের এই বক্তব্য দাবি বা কর্মসূচি আকারে জনগণের সামনে হাজির ছিল। কিন্তু গণ-অভ্যুত্থানের পর এই দাবি আর শুধু দাবি আকারে থাকেনি। এটা বাস্তবায়নের পর্বে প্রবেশ করছে। বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে এটা এক বিরাট অগ্রগতি।

এখনকার প্রশ্ন হলো, এসব আকাঙ্ক্ষার কতটুকু বাস্তবায়ন করা হবে এবং কোন পদ্ধতিতে বাস্তবায়ন করলে সেসব পরিবর্তন টেকসই হবে। এ বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকার, আন্দোলনকারী শক্তি ও রাজনৈতিক দলগুলোই–বা কী ভাবছে। এগুলোর বিস্তৃত ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ প্রয়োজন। তবে সংক্ষেপে এটুকু বলা যায়, এবার গণ-অভ্যুত্থানের পর বাংলাদেশের পক্ষে যতটুকু অর্জন করা সম্ভব ছিল, পরিস্থিতি বলছে আমরা ততটুকু অর্জন করতে পারব না; সম্ভাবনা প্রতিনিয়ত কমছে।

প্রথম আলো:

সংবিধান সংস্কার কমিশনসহ সব কটি কমিশন সুপারিশসহ তাদের প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। কমিশনগুলোর এ প্রতিবেদন সম্পর্কে আপনার সার্বিক বক্তব্য কী?

হাসনাত কাইয়ূম: ছোট পরিসরে সার্বিক মতামত তুলে ধরা কঠিন। অবশ্যই কমিশনগুলো অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সামনে তুলে এনেছে। কিন্তু ওই প্রতিবেদনগুলো পড়লে যে কেউ বুঝবে যে এগুলো একধরনের একাডেমিক কাজ হয়েছে।

আমরা আমাদের রাষ্ট্রটিকে আপাতত কোন স্তরে উন্নীত করতে চাই এবং বাস্তবে সেখানে পৌঁছাতে হলে আমাদের বিদ্যমান আইনকানুন, রাজনীতির কোন বিষয়গুলোর কী রকম রূপান্তর ঘটাতে হবে, সে বিষয়ে সমন্বিত কোনো পরিকল্পনা কিংবা বোঝাপড়ার আওতায় কমিশনগুলো কাজ করেছে বলে প্রতিবেদনগুলো থেকে অন্তত সেটা মনে হয় না। একটি সামগ্রিক পরিকল্পনার অংশ হিসেবে প্রতিবেদনগুলোকে কাজে লাগানোর কোনো পরিকল্পনা দৃশ্যমান হয়নি। সে জন্য বাস্তবে সংস্কারের ক্ষেত্রে এগুলো খুব অল্পই কাজে আসবে।

আমরা তাদের খুন, গুম, লুটপাট, অর্থ পাচার, ক্ষমতার অপব্যবহারসহ যাবতীয় অপকর্মের বিচার চাই। সুষ্ঠুভাবে এসব বিচার করা গেলে দেশ থেকে শুধু আওয়ামী লীগই নিষিদ্ধ হবে না, রাজনৈতিক মাফিয়াতন্ত্রও নিষিদ্ধ হবে এবং দেশের মানুষ এদের হাত থেকে মুক্তি পাবে
প্রথম আলো:

জাতীয় ঐকমত্য কমিশন রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা শুরু করছে। আমরা যতটুকু জানতে পেরেছি, বেশ কিছু বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতপার্থক্য রয়েছে। এ ক্ষেত্রে আপনাদের অবস্থান কী?

হাসনাত কাইয়ূম: এ খবর সঠিক যে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতপার্থক্য দেখা দিয়েছে এবং সেই মতপার্থক্য দিন দিন কমার পরিবর্তে বিস্তৃত হচ্ছে। একটা বহুস্তরবিশিষ্ট সমাজে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মধ্যে কিছু প্রশ্নে মতপার্থক্য থাকাটাই স্বাভাবিক। আবার একইভাবে কিছু প্রশ্নে ঐকমত্য না থাকলে সেখানে সুস্থ রাজনৈতিক পরিবেশ রাখাটাই অসম্ভব।

আমাদের কিছু কিছু রাজনৈতিক সংগঠন এবং দলের মধ্যে এ বিষয়ে ন্যূনতম বোঝাপড়ার ঘাটতি আছে। এসব ঘাটতি দূর করে সবার মধ্যে আস্থা ফিরিয়ে আনার দায়িত্ব অন্তর্বর্তী সরকারের। কিন্তু সরকারের নিজের ঘাটতি পরিস্থিতিকে দিন দিন আরও বাড়িয়ে তুলছে। এটা হতাশাজনক।

আমরা আমাদের সর্বোচ্চ সামর্থ্য ও আন্তরিকতা দিয়ে তাত্ত্বিক এবং ব্যবহারিক ক্ষেত্রে এসব বিরোধ কমানোর জন্য চেষ্টা করে যাচ্ছি। আমরা প্রথম থেকেই এ বিষয়ে সবার মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা করেছি। আমরা সংবিধান সংস্কার পর্বের রাজনীতি এবং ক্ষমতা দখলের জন্য নির্বাচনের পর্বের রাজনীতির মধ্যে যে পার্থক্য রয়েছে, তা তুলে ধরার চেষ্টা করে যাচ্ছি।

আমরা ক্রমাগত বলে যাচ্ছি যে সংবিধান সংস্কারের জন্য লাগবে সর্বোচ্চ সমঝোতা আর নির্বাচনে বিজয় হওয়ার জন্য লাগবে প্রতিযোগিতা বা প্রতিদ্বন্দ্বিতা। আমরা বর্তমান পর্বকে সংবিধান সংস্কারের পর্ব হিসেবে চিহ্নিত করে সবার মধ্যে সমঝোতা গড়ে তোলার লক্ষ্যে রাজনৈতিক এবং সামাজিক পরিসরেও কাজ করে যাচ্ছি। কিন্তু বলতে দ্বিধা নেই যে আমরা এখন পর্যন্ত তেমন সফলতা পাইনি।

প্রথম আলো:

রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতপার্থক্য দূর করা সম্ভব না হলে সেটার সম্ভাব্য ফলাফল কী হতে পারে?

হাসনাত কাইয়ূম: রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সব বিষয়ে সবার সঙ্গে ঐকমত্য তৈরি হবে না। কিন্তু দলগুলোর মধ্যে অনেক প্রশ্নে সমঝোতা লাগবে। এমনকি ভিন্নমত করার বিষয়েও অনেক সময় একমত হতে হয়।

আমরা বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংস্কার নিয়ে অনেক দিন ধরে কথা বলে আসছিলাম। সে কারণে এখানকার রাজনৈতিক দলগুলোর এ–বিষয়ক চিন্তাভাবনার অনেকটাই আমাদের জানা ছিল। সে জন্য আমরা প্রথম থেকেই সতর্ক ছিলাম। রাষ্ট্রে নাগরিক অধিকার এবং মর্যাদার প্রশ্নে গুরুত্বপূর্ণ নয়, কিন্তু নানা কারণে এখানে বিতর্ক উসকে দেওয়ার কারণ হতে পারে—এ রকম বিষয়গুলোতে হাত না দেওয়ার জন্য আমরা সরকার এবং আন্দোলনকারী শক্তিগুলোর অনেককে নিরস্ত করতে চেষ্টা করেছি। কিন্তু তাতে সক্ষম হইনি।

এখানে অনেকে অভ্যুত্থান ও বিপ্লবকে গুলিয়ে ফেলেছেন। কেউ কেউ পুরো সংবিধান ছুড়ে ফেলার মতো ধৃষ্টতা দেখিয়েছেন। নিজেরা নানা রকম মব উসকে দেওয়ার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রকে পরোক্ষভাবে ব্যবহার করেছেন। এসব কাজ তাঁদের ভীতসন্ত্রস্ত করেছে, যাঁরা সমাজে অধিকতর শান্তি ও স্থিতিশীলতার প্রত্যাশায় পুরোনো রেজিমের পরিবর্তন চেয়েছিলেন।

এই ভীতিকে কাজে লাগিয়ে লাভবান হওয়ার চেষ্টায় আছে ‘ডিপস্টেট’সহ রাষ্ট্রের নানা প্রতিষ্ঠান ও সংস্থা। রাজনৈতিক দলগুলোর বিরোধের মধ্যে তারা স্বাভাবিকভাবেই ইন্ধন দিচ্ছে এবং ফায়দা নিচ্ছে। বিরোধাত্মক এ পরিস্থিতির সমাধান করতে হলে সমঝোতায় পৌঁছাতে হবে। এটা করতে না পারলে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ আরও দুর্যোগপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে।

প্রথম আলো:

সংস্কারের পাশাপাশি নির্বাচন নিয়ে অনেক কথা হচ্ছে। সরকারের পক্ষ থেকে বারবার বলা হচ্ছে, আগামী ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। সংস্কার শেষ করে এ সময়ের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে আপনি কতটা আশাবাদী?

হাসনাত কাইয়ূম: ব্যক্তিগতভাবে তো আমি খুবই আশাবাদী মানুষ। সরকার আন্তরিক হলে এ সময়ের মধ্যে অবশ্যই নির্বাচন সম্ভব। কিন্তু সরকার প্রায়ই তার ‘প্রায়োরিটি’ (অগ্রাধিকার) কিংবা ‘ফোকাস’ ঠিক রাখার ক্ষেত্রে দক্ষতার পরিচয় দিতে পারছে না। দেশের মানুষ সরকারকে সংস্কার, বিচার ও নির্বাচন প্রশ্নে যতটা ‘ফোকাসড’ দেখতে চায়, সেটার তীব্রতা যেন তারা বুঝতে পারে এবং এই চাওয়ার মর্যাদা যেন তারা রক্ষা করে।

প্রথম আলো:

বিএনপির পক্ষ থেকে একাধিকবার দ্রুত নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি করা হয়েছে। অন্যদিকে নবগঠিত জাতীয় নাগরিক পার্টিসহ (এনসিপি) কিছু দল সংস্কার ছাড়া নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে আপত্তি জানিয়েছে। এ ক্ষেত্রে আপনাদের অবস্থান কী?

হাসনাত কাইয়ূম: আমরা উভয় পক্ষের চাওয়াকেই যৌক্তিক মনে করি। বিএনপি একটি নির্বাচনমুখী দল এবং তাদের বিশ্বাস করার যথেষ্ট কারণ আছে যে নিরপেক্ষ নির্বাচন হলে তারাই নির্বাচিত হয়ে সরকার গঠন করবে। সে অনুযায়ী দলীয় স্বার্থ বিবেচনায় তারা যত আগে সম্ভব নির্বাচন চায়। সংবিধানের সংস্কারকে তারা বড়জোর সংবিধান সংশোধনের বিষয় মনে করে এবং তারা বিশ্বাস করে ক্ষমতায় গেলে তারা তাদের সুবিধামতো কিছু সংশোধনী করবে।

অন্যদিকে জুলাই অভ্যুত্থানে নেতৃত্বদানকারী ছাত্রসমাজের অংশ হিসেবে এনসিপি এবং আরও কিছু দল অতীত অভিজ্ঞতা থেকে মনে করে যে ক্ষমতায় যাওয়ার পরে কোনো দলই আন্দোলনের কিংবা নির্বাচনী অঙ্গীকার পূরণ করে না। এ ছাড়া কোনো কোনো দলের সংবিধান সংশোধনকে সংবিধান সংস্কার হিসেবে মানতে স্বাভাবিকভাবেই আপত্তি রয়েছে।

দুই–তৃতীয়াংশ সংসদ সদস্যের সম্মতিতে হওয়া সংবিধানের যেকোনো সংশোধনী উচ্চ আদালত কিংবা পরবর্তী যেকোনো সংসদ বাতিল করে দিতে পারে। ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা প্রবর্তন এবং উচ্চ আদালতের রায়ে তা অবৈধ ঘোষণা কিংবা পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তা বাতিল একটি বড় উদাহরণ।

এ ক্ষেত্রে আমরা উভয় পক্ষের দাবির যৌক্তিকতা বিবেচনা করে, উভয় পক্ষের ‘দুশ্চিন্তা’ দূর করার জন্য ১৯৭০ সালের নির্বাচনের মডেলে এই সংকটের সমাধান সম্ভব বলে মনে করি। ঐকমত্য কমিশনের মাধ্যমে রাজনৈতিক দলগুলো সংবিধানের যে যে সংস্কারের বিষয়ে একমত হতে পারবে, সে বিষয়ে একটি ‘ঐকমত্য চার্টার’ করে সেই ‘চার্টার’ অনুযায়ী সংবিধানের সংস্কার করে নিলে কোনো সমস্যা হবে না।

সংস্কারের জন্য যাতে নির্বাচন পিছিয়ে না যায় এবং নির্বাচিতরা সরকার গঠনের পর সংস্কার না–ও করতে পারে—এ রকম আশঙ্কাগুলো দূর করার জন্য ‘সংবিধান সংস্কার সংসদ’ এবং জাতীয় সংসদ নির্বাচন এক দিনেই করা যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে নির্বাচিতরা সংবিধান সংস্কার সংসদের সদস্য হিসেবে প্রথমেই ঐকমত্যের চার্টার অনুযায়ী সংবিধান সংস্কার করবেন। পরে সংস্কার করা সংবিধান অনুযায়ী সরকার গঠন করে রাষ্ট্র পরিচালনা করতে পারবেন।

আমরা বিভিন্ন পরিসরে আমাদের সমঝোতা প্রস্তাব তুলে ধরছি। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল এবং সামাজিক শক্তিগুলোর সঙ্গে কথা বলছি। আমরা আশা করছি, শেষ পর্যন্ত সমঝোতার এই ফর্মুলা কাজ করবে।  

প্রথম আলো:

সংস্কারগুলোর ক্ষেত্রে সংবিধান সংস্কার একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কেউ কেউ আবার বর্তমান সংবিধান বাতিল করার কথাও বলেছেন। সংবিধান নিয়ে কোন পথে যাওয়াটা আমাদের জন্য ইতিবাচক হবে?

হাসনাত কাইয়ূম: বাংলাদেশে কখনো বাহাত্তরের সংবিধান বাতিল করে নতুন সংবিধান গ্রহণের রাজনীতি তেমন করে কেউ গড়ে তোলেনি। দীর্ঘদিনের প্রচেষ্টায় আমরা সংবিধান সংস্কারের রাজনীতি কিছুটা গড়ে তুলেছিলাম। ৫ তারিখের পরপর সেই পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে কেউ কেউ সংস্কারের রাজনীতির চেয়ে ক্ষমতার রাজনীতিতে এগিয়ে থাকার খায়েশ থেকে অথবা অন্য কোনো দুরভিসন্ধি থেকে এসব আওয়াজ তুলে থাকতে পারে। সমাজ-রাষ্ট্রের যথাযথ বিশ্লেষণ করে কোনো দল বা গোষ্ঠী এমন রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে বলে তেমনটা আমি দেখিনি।

আমরা জানি, সংবিধান সংশোধন করতে হলে জাতীয় সংসদের দুই–তৃতীয়াংশ সদস্যের অনুমোদন লাগে। নতুন সংবিধান করতে হলে কনস্টিটিউয়েন্ট অ্যাসেম্বলি বা গণপরিষদ লাগে। একইভাবে সংবিধানের সংস্কার করতে হলে সংবিধান সংস্কার পরিষদ বা সংবিধান সংস্কার সংসদ নির্বাচন লাগবে। দেশের মানুষ যেহেতু এই সংবিধানের সংস্কারের বিষয়ে একমত, তাই আমরা মনে করি, সংবিধান সংস্কার পরিষদ নির্বাচনই হলো সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য পদ্ধতি।

আমরা মনে করি, শেষ পর্যন্ত সব ক্ষমতার মালিক জনগণ। তাই জনগণ যখন যাদের যে কাজ করার জন্য নির্বাচিত করবে, তারা কেবল সেই কাজই করতে পারে এবং সেটাই বৈধ হবে।

প্রথম আলো:

সংস্কারের ক্ষেত্রে প্রধানত কিছু সাংবিধানিক ও আইনি পরিবর্তনের কথা বলা হচ্ছ। কিন্তু আমাদের রাজনৈতিক দল ও রাজনৈতিক সংস্কৃতির ক্ষেত্রে কি সংস্কারের প্রয়োজন নেই? রাজনীতিতে সংস্কার ছাড়া অন্য সংস্কারগুলো কি টেকসই হবে?

হাসনাত কাইয়ূম: একদম টেকসই হবে না। রাজনৈতিক দল, রাজনৈতিক সংস্কৃতি তথা রাজনীতির সংস্কার ছাড়া শুধু আইনি এবং সাংবিধানিক সংস্কার পুরোপুরি ফল বয়ে আনবে না। আমরা মনে করি, সংস্কারের রাজনীতি ছাড়া এমনকি পূর্ণমাত্রায় সংস্কারই সম্ভব হবে না।

আমরা ‘রাষ্ট্রচিন্তা’ থেকে দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর গড়ে ওঠা এবং বিকাশের ইতিহাস পর্যালোচনা করে ‘বাংলাদেশপন্থী’ রাজনৈতিক দল গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তা এবং এ ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জের দিকগুলো সামনে আনার চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু আমাদের সামর্থ্য এবং অনুকূল পরিবেশের অভাবে সে আলাপটা তেমনভাবে সামনে আনতে পারিনি। কিন্তু বর্তমানে এ আলাপ অত্যন্ত জরুরি এবং এসব প্রশ্নের ফয়সালা না করে আমরা আর খুব একটা সামনে এগোতে পারব না।

প্রথম আলো:

জুলাই-আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানের সময় চালানো হত্যাকাণ্ডের বিচারের অগ্রগতি নিয়ে আপনার মত কী?

হাসনাত কাইয়ূম: বিচার যে গতিতে চলছে, তাতে আমরা ক্ষুব্ধ। বিদ্যমান অনেকগুলো সমস্যার মূল কারণ হলো বিচারের শ্লথগতি। আমরা প্রথম থেকেই এই হত্যাকাণ্ডের একটি সর্বজনগ্রাহ্য বিচারের দাবি করছিলাম। বিচারের মান নিয়ে যাতে ভবিষ্যতে কোনো প্রশ্ন তৈরি না হয়, সে জন্য মানবতাবিরোধী অপরাধগুলোর বিচার আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে (আইসিসি) পাঠানোর পক্ষে ছিলাম। কিন্তু সেটা হয়নি।

আমাদের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের (আইসিটি) গঠন, আন্তর্জাতিক পরিসরে আইনের গ্রহণযোগ্যতার অভাব, প্রকৃত অপরাধীদের দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার সুযোগ করে দেওয়া, প্রসিকিউশনের দুর্বলতা—সবকিছু মিলিয়ে একটি হতাশাজনক পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। জুলাই-আগস্টের শহীদদের প্রতি ‘বিশ্বাসঘাতকতা’ করা হচ্ছে, ইতিমধ্যে এ রকম অপরাধবোধ অনেকের মধ্যে কাজ করতে শুরু করেছে। বিচারের বিষয়ে দৃশ্যমান অগ্রগতি না থাকার কারণেই এমনটা হচ্ছে।

প্রথম আলো:

কোনো কোনো পক্ষ আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার দাবি করছে। আবার কেউ কেউ দল হিসেবে আওয়ামী লীগের বিচার করার কথা বলছেন। এসব দাবির যৌক্তিকতা নিয়ে আপনার বক্তব্য জানতে চাই।

হাসনাত কাইয়ূম: যথাযথভাবে বিচার না হওয়ার কারণেই নিষিদ্ধের দাবি উঠছে। আওয়ামী লীগ গত ১৫ বছরে যা করেছে, তাতে মনে হতে পারে, এটা শুধু একটি দল নয়; এটি ব্যক্তিগত মালিকানাধীন উত্তরাধিকারসূত্রে মালিকানা হস্তান্তরযোগ্য একটি মাফিয়া চক্র। এই মডেলে আওয়ামী লীগই একমাত্র দল নয়; ভিন্ন নামে ছোট–বড় আরও অনেক দল আছে। এরা রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে জনগণের সম্পদ, মর্যাদা, ভবিষ্যৎ নিজেদের জিম্মায় নেওয়ার প্রক্রিয়াকে রাজনীতি বলে চালায়। এদের কাছে দেশের মানুষ অসহায়, জিম্মি। আমরা এই চক্রের বিচার চাই। ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত বিচার চাই, দলের বিচার চাই।

তবে সরকারি বা নির্বাহী আদেশে নিষিদ্ধ করা দীর্ঘ মেয়াদে কোনো কাজে আসে না; বরং আইনের আশ্রয়লাভের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হওয়ার আহাজারি করার সুযোগ সৃষ্টি হয়। আমরা তাদের খুন, গুম, লুটপাট, অর্থ পাচার, ক্ষমতার অপব্যবহারসহ যাবতীয় অপকর্মের বিচার চাই। সুষ্ঠুভাবে এসব বিচার করা গেলে দেশ থেকে শুধু আওয়ামী লীগই নিষিদ্ধ হবে না, রাজনৈতিক মাফিয়াতন্ত্রও নিষিদ্ধ হবে এবং দেশের মানুষ এদের হাত থেকে মুক্তি পাবে। 

প্রথম আলো:

আপনাকে ধন্যবাদ।

হাসনাত কাইয়ূম: আপনাকেও ধন্যবাদ।