বিশেষ সাক্ষাৎকার: শ্রীনাথ রাঘবন

বাংলাদেশের জন্মও পাকিস্তানকে বদলাতে পারেনি

ভারতে অশোকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক শ্রীনাথ রাঘবন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের আন্তর্জাতিক প্রভাব ও প্রতিক্রিয়া নিয়ে তিনি লিখেছিলেন ১৯৭১: আ গ্লোবাল হিস্টরি অব দ্য ক্রিয়েশন অব বাংলাদেশ বইটি। লন্ডনপ্রবাসী সাংবাদিক কাজী জাওয়াদের অনুবাদে ১৯৭১: বাংলাদেশ সৃষ্টির বৈশ্বিক ইতিহাস বইটি সম্প্রতি প্রথমা প্রকাশন থেকে বেরিয়েছে। শ্রীনাথ রাঘবনের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন কাজী জাওয়াদ। আজ প্রকাশিত হলো দুই পর্বের সাক্ষাৎকারের শেষ পর্ব।

কাজী জাওয়াদ:

১৯৭১ সালে ভারতের যুদ্ধে জড়ানোর কারণ হিসেবে নিরাপত্তা বিষয়ে দেশটির উদ্বেগের যুক্তি তুলে ধরা হয়। কিন্তু পাকিস্তান ভেঙে গেলেও ভারতের নিরাপত্তা পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি। বরং তা বেড়ে গিয়ে দক্ষিণ এশিয়ায় পারমাণবিক অস্ত্র প্রতিযোগিতায় পর্যবসিত হয়েছে। এ অঞ্চলে চীনের ক্রমবর্ধমান উপস্থিতির পটভূমিতে দক্ষিণ এশিয়ার নিরাপত্তা পরিস্থিতিকে আপনি কীভাবে দেখেন?

শ্রীনাথ রাঘবন: ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে নিরাপত্তা সমস্যা ছিল ভূখণ্ডগত—এই দুই রাষ্ট্রের সৃষ্টির মুহূর্ত থেকে, জম্মু ও কাশ্মীর নিয়ে। জাতীয় পরিচিতি নিয়েও একধরনের প্রতিযোগিতা ছিল, যেখানে দক্ষিণ এশিয়ায় পাকিস্তানের সৃষ্টি হয়েছিল মুসলমানদের আবাস হিসেবে। ভারত খুব সচেতনভাবেই দেশটিকে হিন্দুভিত্তিক করতে চায়নি। অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক ব্যবস্থা ভারতে কেমন হবে, তা-ও সেই চেতনার ওপর নির্ভরশীল ছিল।

পাকিস্তানের সমস্যা ছিল একটি কেন্দ্রীভূত সংবিধান না থাকার। সংবিধান যখন তারা পেল, তত দিনে সামরিক শক্তি ক্ষমতা দখল করেছে, আর তার সব পরিণতিও সেই সঙ্গে চলে এসেছে। আসলে সমস্যাটা ছিল সামরিক বাহিনী জাতীয় ভূখণ্ডের দাবি করায়। তাতে আবার জাতীয় পরিচয় ও অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক ব্যবস্থার ভিন্নতাও যুক্ত ছিল। আমি মনে করি, একাত্তরে বাংলাদেশ সংকটের পরও পাকিস্তানের কোনো কিছুরই মৌলিক পরিবর্তন হয়নি। বাংলাদেশের জনগণের চাওয়া ছিল আত্মনিয়ন্ত্রণ করার অধিকার। তারা নিজেদের দেশ গড়তে চেয়েছিল। কিন্তু যেভাবে সেটা ঘটানো হয়েছে, তা ভারতকে পাকিস্তানের সঙ্গে আরেকটি সংঘাতে টেনে নিয়ে গেছে। এই সংঘাতের মূল কারণ ভারতের স্বার্থে ছিল না। ৬ বছর আগের, ১৯৬৫ সালের যুদ্ধের দিকে দেখুন। ভারত পূর্বাঞ্চলে কোনো আক্রমণ করেনি।

একাত্তরের যুদ্ধের পর ১৯৭২ সালে সিমলা চুক্তির সময়ে ভারত ও পাকিস্তান ঠিক করেছিল ওই সমস্যা শক্তি প্রয়োগ করে সমাধান করা হবে না। এখনো ভারতে অনেকে মনে করেন, ভারতের উচিত ছিল, তখনই সুবিধামতো এসবের সমাধান করে ফেলা। আমি মনে করি, ইন্দিরা গান্ধী তখন যা ভেবেছিলেন, তা সঠিক ছিল। যেমন ভূখণ্ড ও জনগণের একটি বিশাল অংশ হারানোর পর পাকিস্তানকে অপমান করে অমন সমাধান করলে, সেটি তাদের মধ্যে ক্ষত হয়ে থাকবে। তাতে ভবিষ্যতে আরও সংঘাতের বীজ বোনা হয়ে যাবে এবং সেই সমাধান টিকবে না।

আরেকটি বিষয় হলো, আমরা ভারতীয়রা পুরোপুরি ভুলে গেছি যে কাশ্মীর সমস্যা কাশ্মীরিদেরই। এটা পাকিস্তানিদেরও জিজ্ঞেস করুন। কারণ, আমি তাঁদের হয়ে কথা বলতে পারি না। কাশ্মীরিরাই ঠিক করবেন কে তাঁদের নেতা হবেন, সিদ্ধান্ত নেবেন, বিষয়গুলো কীভাবে ঘটবে, যেমন ভারত ও পাকিস্তানে ঘটে। আমি বলতে পারি না যে ভারত সরকার সমাধানের ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে। কাশ্মীরের জনগণ সরকারের সিদ্ধান্ত মেনে নিয়েছেন কি না, আমার কাছে তা পরিষ্কার নয়।

তাই আমি মনে করি, সিমলা চুক্তির সময় মিসেস গান্ধী পরিষ্কার বুঝিয়ে দিয়েছিলেন যে, তিনি পাকিস্তানে সামরিক শক্তির প্রত্যাবর্তন চান না। তিনি নিশ্চিত হয়েছিলেন যে ভারত যেন সংকটের ধকল কাটিয়ে ওঠার সময় পায় এবং অভ্যন্তরীণ ও অর্থনৈতিক বিষয়গুলোর দিকে নজর দিতে পারে। পারমাণবিক পরীক্ষা ও বিভিন্ন সংকটের কারণে ভারত-পাকিস্তান নিরাপত্তা সম্পর্কের উন্নতি হয়নি। পূর্বের অবস্থা বহাল রয়েছে। কাশ্মীরে বিদ্রোহের তীব্রতা হয়তো কিছু কমেছে। একই সঙ্গে সংবিধানের ৩৭০ ধারা উল্টে দিয়ে কাশ্মীরকে জোর করে ভারতের সঙ্গে যুক্ত করার চেষ্টা বিভিন্ন ধরনের রাজনৈতিক সমস্যা সৃষ্টি করবে। মোদ্দাকথা, এটা রাজনৈতিক সমস্যা। শুধু সাংবিধানিকভাবে, শুধু বল বা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা প্রয়োগ করে এর সমাধান হবে না।

কাশ্মীর ও ভারতের মধ্যে এত যে সংঘর্ষ হয়েছে, তারপরও কী জনগণ তাঁদের অধিকার স্থগিত করে রাখার বা ভারতের আনুগত্য চিরদিনের জন্য বা দীর্ঘ সময়ের জন্য মেনে নেবেন। আমার মনে হয়, তার জবাব হচ্ছে, না। আমার ধারণা, ভারত সরকারও তা জানে। এ জন্য তারা বলে যে এর রাষ্ট্রীয় মর্যাদা ফিরিয়ে দিতে চায়। কাশ্মীরের জনগণের স্বার্থ সার্বিকভাবে রক্ষা না করলে ভারত-পাকিস্তান সমস্যার কোনো সমাধান হবে না।

আমেরিকার খ্যাতনামা রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক স্টিভেন পি কোহেন তাঁর শেষ বই শুটিং ফর আ সেঞ্চুরি: দ্য ইন্ডিয়া-পাকিস্তান কনানড্রামে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, ২০৪৭ সালেও ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সম্পর্ক স্বাভাবিক হবে না। দুর্ভাগ্য, তাঁর ভবিষ্যদ্বাণী ক্রমেই অত্যন্ত সত্য বলে প্রমাণিত হচ্ছে। এর কারণ, আমরা আবার পথ হারিয়েছি। সেখানকার বিশাল জনগোষ্ঠীর আকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে হবে। ভারত বা পাকিস্তানে কেউ কাশ্মীরের স্বাধীনতার কথা বলে না বলে তা এড়িয়ে যাওয়া যাবে না।

বর্তমানে সেখানে ব্যাপক সামরিক উপস্থিতির জন্য উভয় প্রান্তে রাজনীতি ‘জমাট বরফ’ হয়ে গেছে। দুই পক্ষের মধ্যে কোনো আলোচনা না হলে ভবিষ্যতে খুব ভালো হবে না। এখন স্বল্প সময়ের জন্য যা শান্ত ও স্থিতিশীল বলে মনে হচ্ছে, তা বিস্ফোরক হয়ে উঠতে পারে। আমরা মিত্রদেশের অভ্যন্তরীণ সমস্যা ও বিদ্রোহের ক্ষেত্রে যাদের সাহায্য করেছি, তাদের চেয়ে ভারতের রাজ্যগুলো সেটা অনেক ভালো জানে। তাই আশা করি, আমরা অভিজ্ঞতা থেকে শিখব।

আরও পড়ুন
কাজী জাওয়াদ:

বহুবিধ ভাষা, ধর্ম, সংস্কৃতি, অর্থনীতি ও রাজনীতির কারণে ভারতের অখণ্ডতার ক্ষেত্রে কোনো ঝুঁকি আছে বলে মনে করেন কি?

শ্রীনাথ রাঘবন: আমি একজন তামিল। আমার জন্মেরও আগে তামিলনাড়ুতে স্বাধীনতার জন্য দ্রাবিড় আন্দোলন হয়েছিল। চীনের সঙ্গে যুদ্ধের কারণে ১৯৬০-এর দশকের গোড়ার দিকে তারা ভারত ইউনিয়নে থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। যদিও তাদের আকাঙ্ক্ষার শিকড় ছিল গভীরে প্রোথিত। কিন্তু তারা দেখেছে, বিচ্ছিন্নতার চেয়ে ভারতের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ থাকাই লাভজনক।

এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ। কারণ, রাজ্যটির অর্থনৈতিক অবস্থা অন্যান্য রাজ্যের চেয়ে ভালো ছিল না। এটি ছিল ভারতের স্বাধীনতার সময় সবচেয়ে দরিদ্র রাজ্যগুলোর একটি। কিন্তু এখন সেটি সমৃদ্ধ রাজ্যগুলোর একটি। শুধু অর্থসম্পদের মাপকাঠিতে নয়, শিক্ষার সুযোগের ক্ষেত্রেও। সমাজের যেকোনো পিছিয়ে পড়া অংশেরই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তির সুযোগ রয়েছে। শিল্পে নারী শ্রমিকের হারও এখানে বেশি। তামিলনাড়ুর মতো রাজ্য ভারতে থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে উপকৃত হয়েছে। যেসব রাজ্যে বিচ্ছিন্নতার প্রবণতা রয়েছে, তারা এমন দৃষ্টান্ত দেখে সিদ্ধান্ত নিতে পারে।

ভারত টিকবে কি না—এমন প্রশ্নের উত্তর হলো, আমি আশা করি টিকবে। তবে তা নির্ভর করে ভারত কী ধরনের প্রকল্প নেয়, তার ওপর। ১৯৪৭ সালে ভারত যে প্রকল্প নিয়েছিল, তাতে মেনে নেওয়া হয়েছিল যে ভারত বৈচিত্র্যপূর্ণ ও বহুমতাবলম্বী একটি দেশ। আমাদের বুঝতে হবে, ভারতের মতো বড় একটি দেশকে ‘চোঙার ছাঁচে’ ফেলা যায় না। ভারতীয় জাতীয়তাবাদের শক্তি উপনিবেশবিরোধী আন্দোলনের মাধ্যমে অর্জিত হয়েছিল। আমরা কি বর্তমানে তা স্বীকার করি? আমি বলব, ভারতের যেমন থাকা উচিত, এখনকার প্রধান রাজনৈতিক আদর্শ তার চেয়ে ভিন্ন।

কাজী জাওয়াদ:

বাংলাদেশ সৃষ্টির ইতিহাস লেখার ব্যাপারে ভারতের গবেষক-লেখকদের প্রবণতা হচ্ছে, বাংলাদেশে প্রকাশিত বাংলাদেশি লেখকদের লেখাকে গুরুত্ব না দেওয়া। আপনি কি সে ধারায় কোনো পরিবর্তন লক্ষ করেছেন?

শ্রীনাথ রাঘবন: যত দূর জানি, ভারতের নতুন প্রজন্মের গবেষকেরা ১৯৭১ সম্পর্কে বাংলাদেশে যেসব তথ্য, বইপত্র, মৌখিক ইতিহাস পাওয়া যায়, সেগুলো আরও বেশি ব্যবহার করছেন। তাঁদের সংখ্যা বাড়ছে। দিল্লিতে বসে থেকে লেখার পরিমাণ কমছে। সম্ভবত আমারটাই সে ধরনের শেষ বই। ভবিষ্যতে আমরা নতুন প্রজন্মের লেখা আরও দেখব। কারণ, তাদের ভাষার দক্ষতা বেশি হবে। তারা বাংলা বইপত্র পড়তে পারবে। আমার বিশ্বাস, আমাদের যদি ১০ বছর পরে আবার কথা হয়, তখন দেখব বাংলাদেশ ও তার জনগণ বিভিন্নভাবে বেশ কাছাকাছি চলে এসেছে।

কাজী জাওয়াদ:

একাত্তরের ঘটনাবলি আর কোন কোন বিষয়ে আরও বিস্তারিত গবেষণা করা যায়?

শ্রীনাথ রাঘবন: ১৯৭১ সালে যাঁরা দেশত্যাগ করে ভারতে এসে অনিশ্চিত জীবন কাটাতে বাধ্য হয়েছিলেন, দেশে ফিরে গিয়েছিলেন, আমি তাঁদের কাহিনি পড়তে চাই। মনে হয়, তেমন কোনো কাহিনি এখনো লেখা হয়নি। ভারতীয়রাও এমন কাহিনিতে জড়িত। কিন্তু আমরা ভারতীয়রা আবদ্ধ হয়ে আছি কতজন বাংলাদেশি রয়ে গেছেন, তাতে জনতাত্ত্বিক ভারসাম্য কীভাবে নষ্ট হয়েছে, সেসব নিয়ে।

আর একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে সমগ্র দক্ষিণ এশিয়ার বিষয়। এটা তখনকার যুবসমাজের জন্য। তাঁরা কেমন সংগ্রাম চেয়েছিলেন, রাজনৈতিক নেতৃত্ব তার কতটা জানতেন, এসব বিষয়। কারণ, একাত্তরের ঘটনাটি ছিল রাজনৈতিক সংগ্রামের চেয়ে বেশি সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগ্রাম। তখনকার দুই প্রজন্মের বোঝাপড়া সম্পর্কেও জানা দরকার, সেটা বাংলাদেশ ও পাকিস্তান উভয়ের দৃষ্টিকোণ থেকেই। আমি এখন যে কাজ করছি, তাতে বিষয়টা বারবার উঠে আসছে।

সব শেষে যে বিষয়টিতে আমার আগ্রহ তা হলো, এর আন্তর্জাতিক দৃষ্টিকোণ। আশা করি, শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ডের পূর্বাপর সম্পর্কে আরও গবেষণা হবে। ভারতীয় দলিলপত্রে আমি যা দেখি, তাতে জানতে পারি, মিসেস ইন্দিরা গান্ধী পরিষ্কার বুঝতে পেরেছিলেন, দক্ষিণ এশিয়াকে অস্থিতিশীল করার জন্য বেশ বড় রকমের আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র চলছিল। তিনি অনুভব করতে পেরেছিলেন, তিনি নিজে ও শেখ মুজিব লক্ষ্যবস্তু ছিলেন। ১৫ আগস্ট লালকেল্লায় যাওয়ার পথে মুজিব-হত্যার খবর পেয়ে তিনি নাকি মন্তব্য করেছিলেন, ‘জানতাম এমনটাই হবে।’

কাজী জাওয়াদ:

বইটি প্রকাশের ১০ বছর পর বাংলাদেশে এর বাংলা অনুবাদ প্রকাশিত হওয়ায় আপনার অনুভূতি কী?

শ্রীনাথ রাঘবন: আমি আপনার ও প্রকাশকের কাছে কৃতজ্ঞ। বইটির যে অনুবাদ হয়েছে, আমার কাছে তা বড় কথা নয়; বইটি যে বাংলাদেশে অনূদিত ও প্রকাশিত হয়েছে, এটাই অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এই বই লেখার সময় আমি চেয়েছি, ভারতের বাইরের পাঠকেরাও যেন এটা পড়তে পারেন। বইটির অনুবাদ, প্রকাশনা ও প্রচ্ছদের শিল্পকর্ম চমৎকার। আজ আমরা যেসব প্রশ্ন নিয়ে কথা বললাম, আশা করি বইটি পড়ে পাঠকেরা ঠিক সেই প্রশ্নগুলোই করতে থাকবেন।