বিশেষ সাক্ষাৎকার : মোহাম্মদ তানজীমউদ্দিন খান

পশ্চিমাদের ভণ্ডামোর কারণেই ফিলিস্তিনে এই পরিস্থিতি

ড. মোহাম্মদ তানজীমউদ্দিন খান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক। নতুন করে ফিলিস্তিন ও ইসরায়েলের সংঘাতে জড়ানো, গাজায় মানবিক সংকট তৈরি হওয়া এবং মধ্যপ্রাচ্যে তৈরি হওয়া নতুন পরিস্থিতি নিয়ে তিনি প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন রাফসান গালিব

মোহাম্মদ তানজীমউদ্দিন খান
ছবি: প্রথম আলো
প্রশ্ন:

প্রথম আলো: সিরিয়া-ইয়েমেন যুদ্ধ, এমনকি লিবিয়ার গৃহযুদ্ধ নিয়ে মধ্যপ্রাচ্য পরিস্থিতি অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে উঠছিল। এমন মুহূর্তে হামাসের এ হামলা কেন?

তানজীমউদ্দিন খান: এর আসলে অনেকগুলো কারণ আছে। ২০০৭ সালের পর থেকে গাজা একধরনের অবরুদ্ধ অবস্থায় আছে। শুধু একটাই করিডর তারা ব্যবহার করতে পারে, যেটি মিসরের সঙ্গে, তা–ও খুব সীমিতভাবে। ছিটমহলে পরিণতে হয়ে গাজা হয়ে উঠেছে পৃথিবীর সবচেয়ে জনবহুল, সমস্যাসংকুল ও অমানবিকভাবে বসবাসের একটি অঞ্চল।

ইসরায়েলে বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর ক্ষমতাসীন হওয়া, তাঁর মন্ত্রিসভায় যখন চরম ডানপন্থী নেতৃত্ব থাকে, বিশেষ করে প্রতিরক্ষামন্ত্রী, অর্থমন্ত্রীর মতো গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোয় অথবা অবৈধ সেটেলার রাজনৈতিক ব্যক্তিরা থাকেন, তখন ফিলিস্তিনিদের প্রতি তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গি কেমন হবে, তা বোঝাই যায়। এখন তো সেটি আরও স্পষ্ট, ফিলিস্তিনিদের তাঁরা চিহ্নিত করেছেন ‘হিউম্যান অ্যানিমেল’ হিসেবে।

আবার মধ্যপ্রাচ্যে কয়েক বছর আগে থেকে ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিককরণের একটি প্রচেষ্টা শুরু হয় যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায়। আব্রাহাম অ্যাকর্ডসের মাধ্যমে ইসরায়েলের সঙ্গে আরব আমিরাত, বাহরাইনের সম্পর্ক স্বাভাবিককরণের চুক্তি হয়। এরই ধারাবাহিকতায় সৌদি আরবেরও সেখানে যুক্ত হওয়ার একটি প্রচেষ্টা দেখা যাচ্ছিল। আবার ২০১৭ সালে জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের স্বীকৃতি দেওয়ার বিষয়টিও ফিলিস্তিনিদের আরও স্পর্শকাতর করে তোলে।

 গত সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘের সাধারণ সভায় নেতানিয়াহু মধ্যপ্রাচ্যের একটি নতুন মানচিত্র দেখান। সেই মানচিত্রে গাজা ও পশ্চিম তীরের কোনো অস্তিত্বই নেই। এর মধ্য দিয়ে পুরো ফিলিস্তিনের অস্তিত্বকেই অস্বীকার করা হয়। সেখানে তাঁর বক্তব্যের মধ্য দিয়ে প্রকাশ পায়, সৌদির সঙ্গে তাদের সম্পর্ক স্বাভাবিককরণের মধ্য দিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের নতুন একটি মানচিত্র তৈরি হচ্ছে।

একই সঙ্গে এ বছরের পরিসংখ্যান যদি আমরা দেখি, প্রায় প্রতিদিনই ফিলিস্তিনিরা হত্যার শিকার হচ্ছে। হামাসের হামলার আগপর্যন্ত সেটি ছিল প্রায় আড়াই শ। প্রতিবছরই এমন চিত্র আমরা দেখতে পাই। এই সবকিছু মিলিয়ে ফিলিস্তিনিদের মধ্যে একটি মনস্তাত্ত্বিক ক্ষোভ তৈরি হয়। তাদের কাছে মনে হচ্ছিল, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে তারা পরিত্যক্ত। সবকিছু মিলিয়ে পিএলওর চেয়ে বেশি জনপ্রিয় হয়ে ওঠায় হামাসের ওপর অভ্যন্তরীণ একটি চাপ তৈরি হয় ইসরায়েলের এই ধারাবাহিক অন্যায়ের বিরুদ্ধে তাদের অবস্থানটা স্পষ্ট করার। যার ফলে হামলাটা আমরা দেখতে পেলাম।

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: ইসরায়েলের প্রতিক্রিয়া কতটা বিধ্বংসী হয়ে উঠতে পারে, তা যে কারও বোঝার কথা। এরপরও হামাস এমন হামলা করতে গেল কেন?

তানজীমউদ্দিন খান: মনস্তাত্ত্বিক ক্ষোভের কথা তো আগেই বলেছি। একদিকে অবরুদ্ধ পরিস্থিতিতে অমানবিক জীবনযাপন, অন্যদিকে ধারাবাহিকভাবে ইসরায়েলি আগ্রাসন ও হত্যাকাণ্ড। তাদের মতো পরিস্থিতিতে না পড়লে আসলে বিষয়টি বোঝা সম্ভব নয়। এমন পরিস্থিতিতে একধরনের হতাশা ও ক্ষোভ দুই-ই তৈরি হয়, তখন হামলার পর পরবর্তী সময়ে কী হবে, সেই বিবেচনাবোধ কাজ না–ও করতে পারে। আর পিএলওর চরম দুর্নীতি, নতজানু নীতি, ইসরায়েলের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে না পারার কারণেও হামাসের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পেয়েছে। সেই জনপ্রিয়তা ও ফিলিস্তিনিদের চাপ তাদের এমন একটি আত্মঘাতী পদক্ষেপ নিতে হয়তো প্ররোচিত করেছে। আর ইসরায়েলের নাগরিককে জিম্মি করে আগেও তারা সফল হয়েছে, সেই দিকটাও হয়তো বিবেচনায় ছিল তাদের।

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: হামাসের এই হামলা ইসরায়েল কেন টের পেল না? মিসর ও জর্ডানের গোয়েন্দা সতর্কবার্তার পরও সেটি কীভাবে সম্ভব হলো?

তানজীমউদ্দিন খান: ইসরায়েলে নেতানিয়াহুর বিরোধীদের জোটের একটি শক্তিশালী আন্দোলন তৈরি হয়েছে। সেখানে তার ওপরে বিচারব্যবস্থার সংস্কারের চাপও তৈরি হয়েছে। ফলে নেতানিয়াহুর রাজনৈতিক অবস্থান দুর্বল হয়ে পড়েছিল এবং কয়েক বছর ধরে অভ্যন্তরীণ টানাপোড়েনের কারণে ইসরায়েলের জাতীয় সংহতি আগের মতো কাজ করছিল না বলেও অনেকের মত। আবার বিভিন্ন কারণে ২০০৫ সালের পর থেকে গাজা থেকে পশ্চিম তীরের দিকে বসতি স্থাপনে ইসরায়েল বেশি মনোযোগী হয়ে ওঠে। ফলে হামাস সেখানে সুযোগ নিয়েছে।

এখন আমরা দেখতে পাচ্ছি, নেতানিয়াহুর অধীনে একটি যুদ্ধকালীন জাতীয় সরকার গঠিত হয়েছে, যেখানে বিরোধীরাও আছে। এমনটাও ভাবা যায়, নেতানিয়াহু সরকার এ হামলা সম্পর্কে আগে থেকে জেনে থাকলেও সেটিকে প্রতিরোধ করার চেয়ে বরং ঘটনা ঘটতে দিয়ে নেতানিয়াহু নিজের রাজনৈতিক অবস্থানকে নতুন করে শক্তিশালী করার সুযোগ হিসেবে কাজে লাগিয়ে থাকতে পারেন।

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: বলা হচ্ছে, এ হামলার মধ্য দিয়ে ইসরায়েলকে আরও সুযোগ করে দিয়েছে হামাস। এর মধ্য দিয়ে হামাস গঠনে ইসরায়েলের পৃষ্ঠপোষকতা ছিল, এমন একটি পুরোনো আলোচনা আবারও সামনে এসেছে।

তানজীমউদ্দিন খান: হামাসের গঠনের পেছনে ইসরায়েলের পৃষ্ঠপোষকতার বিষয়টি পশ্চিমা সংবাদমাধ্যম বলে থাকে। আমার কাছে এগুলো একধরনের ষড়যন্ত্রতত্ত্বই মনে হয়। কারণ, হামাস গঠনের পেছনে একটি আদর্শিক বিষয় আছে। তারা মিসরের মুসলিম ব্রাদারহুডের আদর্শে বা অনুসরণে গঠিত হয়েছে, আবার নানাভাবে সহায়তা পায় ইরান থেকে। তবে ইসরায়েল যে নতুন মানচিত্র সামনে এনেছে, সেটি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে হামাসের এ হামলা তাদের বড় সুযোগ করে দিতে পারে। গাজায় স্থল অভিযান চালানোর জন্য লাখ লাখ গাজাবাসীকে যেভাবে সরে যেতে বলা হয়েছে, এর মধ্য দিয়ে গাজা খালি করে সেখানে তাদের দখলদারত্ব পুরোপুরি নিশ্চিত করতে চাইছে হয়তো।

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: ইউক্রেনে রাশিয়া হামলা চালিয়ে পানি ও বিদ্যুৎ সব বন্ধ করে দেয়। তখন পশ্চিমারা এটিকে বলেছিল যুদ্ধাপরাধ। গাজায় ঠিক একই ধরনের পদক্ষেপে ইসরায়েলের পক্ষ নিল তারা, এমনকি একই ধরনের ভুক্তভোগী ইউক্রেনও। বিষয়টাকে কীভাবে দেখছেন?

তানজীমউদ্দিন খান: ফিলিস্তিন প্রশ্নে তো এটি খুবই স্বাভাবিক। কারণ, ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাই তো হয়েছে পশ্চিমা শাসকদের হিপোক্রেসি বা ভণ্ডামোর মধ্য দিয়ে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে ও পরের ইতিহাস থেকে সেটি আমরা সবাই জানি। পশ্চিমা শাসকদের এই হিপোক্রেসির ধারাবাহিকতা ফিলিস্তিনিদের ক্ষেত্রে আমরা সব সময় দেখি। অন্য জায়গায় তারা ঠিকই মানবাধিকারের কথা বলে আর ফিলিস্তিন ইস্যুতে ইসরায়েলকে ঘিরে সামরিক কৌশলগত স্বার্থ রক্ষা এবং মধ্যপ্রাচ্যে তাদের প্রভাববলয় টিকিয়ে রাখার জন্য ইসরায়েলকে সমর্থন দেওয়া ও সমর্থন পাওয়া গুরুত্বপূর্ণ। ফিলিস্তিনের মানবিক ইস্যু তখন তাদের বিবেচনায় আসে না। একই কারণে ইসরায়েলের প্রতি ইউক্রেনের সমর্থন আমরা দেখতে পাচ্ছি, রাশিয়া দ্বারা একইভাবে তারাও ভুক্তভোগী হওয়ার পরেও। এখানে দ্বিপক্ষীয় ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক তো অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ, যেখানে মানবিকতার ইস্যু অনেক সময় গৌণ হয়ে যায়।

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: কিন্তু হামাসের হামলায় অনেক ইসরায়েলি বেসামরিক লোক, বিশেষ করে নারী-শিশু ও বিদেশি নাগরিক নিহত হয়েছে। অনেককে জিম্মি করেছে। সে বিষয়টাও তো আছে।

তানজীমউদ্দিন খান: হত্যা তো হত্যাই, সেটি ইসরায়েলি বা ফিলিস্তিনি বা যেকোনো দেশের মানুষই হোক। মানুষ হত্যা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। কিন্তু এখানে এক পক্ষের অপরাধকে পেছনে ঠেলে দিয়ে আরেকজনের একই ধরনের অপরাধকে বেশি করে সামনে আনলে তো পক্ষপাতিত্বটা স্পষ্ট হয়ে যায়। ২০০৭ সালে হামাস নির্বাচনে জয়ী হয়ে গাজার শাসনভার নেওয়ার পর থেকে ২০০৮, ২০১২, ২০১৪, ২০২১ সালে একই ধরনের নৃশংস আক্রমণ ইসরায়েল সেনাবাহিনী ধারাবাহিকভাবে করে এসেছে। সেখানে দেশটির অস্ত্রধারী সেটেলার মানুষের যুক্ততাও আমরা দেখে থাকি। কিন্তু এবার যেভাবে পশ্চিমাদের মনোযোগ আমরা দেখতে পাচ্ছি, সেসব নৃশংসতার ক্ষেত্রে তেমনটি দেখা গিয়েছিল কি? তবে পশ্চিমা রাষ্ট্র ও গণমাধ্যমের বাইরে গিয়ে বৈশ্বিক একটি সিভিল সোসাইটি তৈরি হয়েছে, যারা সব সময় গাজায় অমানবিক পরিস্থিতি ও ইসরায়েলের অন্যায় আচরণ নিয়ে কথা বলেছে। সেখানে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো আছে, এমনকি ইসরায়েলি মানবাধিকার সংগঠন ও ইউরোপের ইহুদি সংগঠনও। এদের অনেকেই ২০০৮ সাল থেকে ইসরায়েলের গাজা অবরুদ্ধ করে রাখাকে বর্ণবাদ ও যুদ্ধাপরাধের সঙ্গে তুলনা করে। এখন এ ধারাটা আরও জনপ্রিয় হয়ে উঠলে বা রাষ্ট্র ও সংবাদমাধ্যমের মূলধারার মতো গুরুত্ব পেতে থাকলে, হামাসের হামলায় হত্যাকাণ্ডের বিষয়টি যেভাবে সামনে আনছে, তার বিপরীত চিত্রটাও আমাদের সামনে আসবে।

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: অসলো শান্তিচুক্তি সফল না হওয়ার মূল কারণটি কী?

তানজীমউদ্দিন খান: অসলো চুক্তির গোটা প্রক্রিয়াটিই হয়েছে আসলে অত্যন্ত গোপনে। সেখানে ফিলিস্তিনের নেতৃত্বে পিএলও থাকলেও, এটি আসলে স্পষ্ট ছিল না অসলো চুক্তির প্রতি সাধারণ ফিলিস্তিনিদের পূর্ণাঙ্গ সমর্থন ছিল কি না। সেটি ছিল না বলেই হামাস এত জনপ্রিয় হলো। এ ধরনের চুক্তির জন্য নিজস্ব জনগোষ্ঠীর মধ্যে যে আস্থা তৈরির দরকার ছিল, সেই আস্থার মধ্যে সংকট ছিল। এ চুক্তির মাধ্যমে ইসরায়েলকে ফিলিস্তিনের স্বীকৃতি দেওয়ার পর যে নতুন বাস্তবতা তৈরি হয়েছে, সেখানে তো শান্তির পরিবর্তে আরও বেশি অশান্তি তৈরি হয়েছে। চুক্তি অনুসারে গাজা ও পশ্চিম তীর থেকে ইসরায়েল সরে আসার কথা থাকলেও সেটি ঘটেনি। চুক্তির সময় সেখানে এক লাখ ইসরায়েলির বসবাস থাকলেও এখন হয়েছে কয়েক গুণ। এরপর পূর্ব জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। সবকিছু মিলিয়ে আসলে পরিস্থিতি এমন পরিবর্তন হয়েছে, তাতে বলাই যায় যে অসলো শান্তিচুক্তি একধরনের ব্যর্থই হয়েছে। যার কারণে সেই চুক্তির গ্রহণযোগ্যতা ফিলিস্তিনিদের কাছে আরও কমেছে এবং হামাসের মতো সংগঠন শক্তিশালী হয়েছে। তারা ১৯৬৭ সালের যুদ্ধের আগে ফিলিস্তিনের মানচিত্রটা যেমন ছিল, সেই মানচিত্র তারা ফেরত চায়। সেখানে অন্তত তাদের মধ্যে একটি পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। কিন্তু ফিলিস্তিন একটি স্বাধীন রাষ্ট্র বা জাতি হিসেবে দাঁড়াতে পারে, এমন কোনো প্রক্রিয়া তো আমরা দেখলাম না। দেখলাম ইসরায়েলের আরও বেশি আগ্রাসী মনোভাব। সেখানে আসলে এমন পরিস্থিতি অবশ্যম্ভাবী।

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: এখন মধ্যপ্রাচ্যে কেমন পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে বলে মনে করেন?

তানজীমউদ্দিন খান: মধ্যপ্রাচ্যের নেতৃত্বের প্রতিযোগিতা মূলত সৌদি আরব ও ইরানের মধ্যে। ইরানের মধ্যে সব সময় এই দুশ্চিন্তা থাকেই সৌদি আরব শক্তিশালী হয়ে উঠলে তার প্রভাব কমে যাবে। সে ক্ষেত্রে হামাসের এ হামলার কারণে ইরানকে আবারও সবাই বিবেচনা করছে। অনেকে বলছে, এ ঘটনার মধ্য দিয়ে ইরানকে এখন আরও বেশি গুরুত্বের সঙ্গে নিতে হবে। তাহলে ইরানও আরও বেশি সক্রিয় হতে পারবে মধ্যপ্রাচ্যের ভাগ্য নির্ধারণে।

এখন হামাসের এ হামলার কারণে সৌদি-ইসরায়েলের সম্পর্ক স্বাভাবিককরণ প্রক্রিয়া ব্যাহত তো হবেই, জটিল পরিস্থিতিও তৈরি হয়েছে। সৌদির পক্ষে এখন ইসরায়েলকে সমর্থন দেওয়াটা কঠিন হয়ে গেছে। মধ্যপ্রাচ্যে রাশিয়া ও চীনের অবস্থান পশ্চিমাদের একেবারে বিপরীতে। এখন এ অঞ্চলে নতুন করে সংঘাত ছড়িয়ে পড়লে চীন ও রাশিয়ার প্রভাব বিস্তারের নতুন সুযোগ তৈরি হবে। এখন যুক্তরাষ্ট্র সেখানে রণতরি পাঠিয়েছে। সেটি অবস্থান করবে মূলত লেবাননের কাছে, সেটির একটি বড় কারণ হচ্ছে হিজবুল্লাহকে ঠেকানো। যাতে এ সংঘাতকে কেন্দ্র করে আঞ্চলিক পর্যায়ে যুদ্ধ ছড়িয়ে না পড়ে।

এখানে ইসরায়েল-ফিলিস্তিনের তিনটি প্রতিবেশী রাষ্ট্র মিসর, জর্ডান, লেবাননের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি গুরুত্বপূর্ণ। মিসর ও জর্ডানের নাগরিকদের মধ্যে বিপুলসংখ্যক ফিলিস্তিনি আছে। লেবাননে আছে হিজবুল্লাহ। এসব দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যেও ফিলিস্তিনি ইস্যুটা যথেষ্ট কার্যকর। এখন ইসরায়েল গাজায় যে স্থল অভিযান চালানো শুরু করেছে, তাতে বড় ধরনের মানবিক বিপর্যয় তৈরি হলে সংঘাতের চরিত্র পাল্টে যেতে পারে। হামাসের সঙ্গে ফিলিস্তিনের অন্যান্য সশস্ত্র সংগঠন, হিজবুল্লাহসহ আঞ্চলিক ইসলামি গোষ্ঠীগুলো এখানে এক জায়গায় চলে আসতে পারে। তবে পুরো বিষয়টা নির্ভর করছে আবার যুক্তরাষ্ট্রের ওপর। পশ্চিমা রাষ্ট্রের জন্য একটি বিষয় হচ্ছে, এখানে মানবিক বিপর্যয় নেমে এলে আবারও শরণার্থী সংকট তৈরি হবে। সেটি পশ্চিমাদের অর্থনীতির ওপর চাপ তৈরি করবে। ইসরায়েলের প্রতিক্রিয়ার মধ্যে এই প্রবণতা দেখা যাচ্ছে, তাদের স্থল অভিযান গণহত্যামূলক একটি যুদ্ধের দিকে চলে যেতে পারে। এ রকম পরিস্থিতে সেখানে যে মানবিক আবেদন জোরালো হয়ে উঠলে তখন সবার জড়িয়ে না পড়ে উপায় থাকবে না। কারণ, প্রতিবেশী দেশগুলোর ওপর তাদের গণমানুষের চাপ তৈরি হবে।

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: ফিলিস্তিনের পাশে আরব দেশ বা মুসলিম দেশগুলোর শক্ত অবস্থান দেখা যাচ্ছে না। এমনটা কেন?

তানজীমউদ্দিন খান: কাতারকে আমরা সব সময় ফিলিস্তিন ইস্যুতে জোরালো ভূমিকা রাখতে দেখি। এবারও তারা মধ্যস্থতা তৈরির চেষ্টা করছে। সৌদি আরবের কথা তো আগেই বললাম। তবে এখানে ব্যতিক্রম আরব আমিরাত ও বাহরাইন। তারা আব্রাহাম অ্যাকর্ডসের কারণে ইসরায়েলের সমালোচনায় যাচ্ছে না। সবার কাছে আসলে জাতীয় স্বার্থ অথবা ক্ষমতাসীনদের স্বার্থটাই প্রধান হয়ে উঠেছে। যেহেতু মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর শাসন গণতান্ত্রিক নয়, তাদের কর্তৃত্ববাদ টিকিয়ে রাখার জন্য কখনো কখনো ইসরায়েল বা যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন প্রয়োজন হয়। ফলে ফিলিস্তিনকে একেবারে দ্বিধাহীনভাবে সমর্থন দেওয়াটা তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। আবার এখন আন্তর্জাতিকভাবে আদর্শিক রাজনীতির গুরুত্বও কমে গেছে। অনেক দেশে, এমনকি মুসলিম দেশগুলোয়ও কর্তৃত্ববাদী শাসন গড়ে উঠেছে। তার প্রতিফলনই আমরা আসলে দেখছি ফিলিস্তিনের প্রতি সমর্থনের ব্যাপারে। এখানে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানের কথা অনেকে বলছেন। ইউক্রেন–রাশিয়া যুদ্ধের কারণে তুরস্কসহ অনেক দেশের জন্য নতুন বাস্তবতা তৈরি হয়েছে। তুরস্ক ন্যাটোর সদস্য, ইউরোপীয় ইউনিয়নেও ঢোকার চেষ্টা করে যাচ্ছে। ফলে তুরস্ক এবার খুবই সতর্কভাবে তাদের বিবৃতিগুলো দিচ্ছে।

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: একটা সময় ফিলিস্তিন ইস্যুতে বাংলাদেশেও জোরালো প্রতিবাদ দেখা যেত। ইসলামপন্থী ও বামপন্থী উভয় দিক থেকেই। কয়েক বছর ধরে সেটি আগের মতো দেখা যাচ্ছে না। ফিলিস্তিন ইস্যুতে আমাদের জনপরিসরে চিন্তার পরিবর্তন ঘটেছে কি?

তানজীমউদ্দিন খান: বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ১৫ বছর ধরে নতুন একটা বাস্তবতা দেখা যাচ্ছে। এখানেও একটি কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থা তৈরি হয়েছে। বর্তমান বাংলাদেশে নির্বাচনকে ঘিরে আন্তর্জাতিক রাজনীতির একটি মেরুকরণ তৈরি হয়েছে। সেই মেরুকরণে যুক্তরাষ্ট্রের বিপরীতে আছে চীন ও রাশিয়া। আঞ্চলিক রাজনীতির ক্ষেত্রে ভারতের অবস্থানও এখানে গুরুত্বপূর্ণ। এখন নির্বাচনকে কেন্দ্র করে পশ্চিমাদের সঙ্গে বাংলাদেশের একটা টানাপোড়েন তৈরি হয়েছে। এখন যারা কর্তৃত্ববাদী ব্যবস্থার বিপক্ষে আছে, তারা তো একধরনের পরিবর্তন চায়। তাদের আকাঙ্ক্ষার বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের চলমান কূটনৈতিক তৎপরতা হয়তোবা কিছুটা প্রভাব তৈরি করছে। তার মানে মার্কিন স্বার্থ আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে এখন বাংলাদেশে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। যার ফলে ইসলামপন্থী, প্রগতিশীল বা মধ্যপন্থী দলগুলো যে–ই হোক, সবাই এখন আন্তর্জাতিক ইস্যুতে অবস্থান নিতে বেশ হিসাব–নিকাশ করবে।

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: আপনাকে ধন্যবাদ।

তানজীমউদ্দিন খান: আপনাকেও ধন্যবাদ।