বিশেষ সাক্ষাৎকার ড. মো. শফিকুল ইসলাম

রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের নিরাপত্তাঝুঁকি দিন দিন বাড়ছে

ড. মো. শফিকুল ইসলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিউক্লিয়ার ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের জ্যেষ্ঠ অধ্যাপক। যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির নিউক্লিয়ার সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি বিভাগে ভিজিটিং অধ্যাপক হিসেবে কাজ করেছেন। পারমাণবিক প্রযুক্তির ওপর শিক্ষা ও গবেষণায় নিয়োজিত রয়েছেন প্রায় ৩০ বছর ধরে। যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, অস্ট্রিয়া, ইতালি, রাশিয়া ও চীনে পরমাণু প্রযুক্তির নিরাপত্তার বিষয়ে উচ্চতর প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তাঝুঁকি, ভূরাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ, প্রকল্পের দুর্বলতা, ঘাটতিসহ নানা দিক নিয়ে তিনি কথা বলেছেন প্রথম আলোর সঙ্গে। 

সাক্ষাৎকার নিয়েছেন কাজী আলিম-উজ-জামান মনোজ দে

প্রথম আলো:

বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে ব্যয়বহুল প্রকল্প রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র। ২০২২ সালের ডিসেম্বরে উৎপাদনে আসার কথা থাকলেও কয়েক দফা পিছিয়ে গেছে। এবার ডিসেম্বরে প্রথম ইউনিট থেকে পরীক্ষামূলক বিদ্যুৎ উৎপাদনের আশা করা হচ্ছে। সম্প্রতি বিমানবন্দরে কার্গো ভিলেজে আগুনে রূপপুরের জন্য আনা কিছু সরঞ্জাম পুড়েছে। সব মিলিয়ে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প ডিসেম্বরে চালুর ব্যাপারে আশাবাদী হওয়া যাচ্ছে কি? 

মো. শফিকুল ইসলাম: সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে ডিসেম্বরে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রথম ইউনিট থেকে পরীক্ষামূলকভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু হবে। কিন্তু বাস্তবে এটি বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু নয়, চুল্লিতে জ্বালানি স্থাপনের প্রক্রিয়া মাত্র। বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষেত্রে এটি কেবল গুরুত্বপূর্ণ একটি ধাপ। এরপর শুরু হবে দীর্ঘমেয়াদি পরীক্ষা-নিরীক্ষা। যেমন পারমাণবিক চুল্লির ক্রিটিক্যালিটি (ঝুঁকির মাত্রা) পরীক্ষা, বিভিন্ন ব্যবস্থার সমন্বয় ও নিরাপত্তা যাচাই। এসব পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষ না হলে চুল্লি থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা যায় না। সাধারণত  জ্বালানি স্থাপনের পর অন্তত এক বছর সময় লাগে স্থিতিশীলভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু করতে। বর্তমান অবস্থা ও প্রস্তুতির পর্যায় দেখে বলা যায়, সব স্থাপন, পরীক্ষা ও কমিশনিং সম্পন্ন করে রূপপুরের প্রথম ইউনিট থেকে জাতীয় গ্রিডে পুরো সক্ষমতায় বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে আরও এক বছরের বেশি সময় লেগে যেতে পারে। 

সম্প্রতি শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজে আগুনে রূপপুরের জন্য আনা কিছু সরঞ্জাম ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, যার ফলে রাশিয়ান ঠিকাদার ফোর্স ম্যাজুর (আকস্মিক দুর্বিপাক) ঘোষণা করেছে। এ ঘোষণা স্পষ্ট ইঙ্গিত দেয় যে যদি দ্রুত বিকল্প সরবরাহ নিশ্চিত করা না যায়, তবে প্রকল্পের অগ্রগতিতে প্রভাব পড়বে। সব দিক বিবেচনায় রূপপুর বিদ্যুৎকেন্দ্র ‘ডিসেম্বরে চালু’—এই কথাকে রাজনৈতিক বা প্রচারণামূলক প্রতিশ্রুতি হিসেবে নয়; বরং প্রকল্পের বর্তমান প্রযুক্তিগত অগ্রগতির বাস্তবতা হিসেবে দেখা উচিত। 

প্রথম আলো:

২০১৩ সালে প্রকল্পটি যখন নেওয়া হয়েছিল, তখনকার ভূরাজনৈতিক বাস্তবতা আর এখনকার বাস্তবতায় বিস্তর ব্যবধান। যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, চীন ও ভারতের মতো পরাশক্তি ও আঞ্চলিক শক্তিগুলোর মধ্যে প্রতিযোগিতা ও বিরোধ যেকোনো সময়ের চেয়েই এখন তীব্র। এ বাস্তবতায় পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের মতো কৌশলগত একটি স্থাপনা নিয়ে বাংলাদেশের সামনে কতটা নিরাপত্তাঝুঁকি আছে বলে মনে করছেন? 

মো. শফিকুল ইসলাম: যদি প্রকল্পটি আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা নির্দেশিকা মেনে পরিচালিত হয় এবং সব নিরাপত্তা প্রটোকল কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করা হয়, তাহলে ভূরাজনৈতিক উত্তেজনা থাকলেও সরাসরি নিরাপত্তাঝুঁকি তেমনভাবে বেড়েছে বলা যায় না। তবে নিরাপত্তা বিষয়ে সতর্ক থাকা প্রয়োজন। বিশেষ করে আঞ্চলিক অস্থিরতা, তৃতীয় পক্ষের হুমকি, অভ‍্যন্তরীণ ও সাইবার হামলা—এ সব নিরাপত্তাঝুঁকিকে বিবেচনায় রাখতে হবে। রাশিয়ার ওপর পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার কারণে জটিল ও পরীক্ষিত কিছু যন্ত্রপাতি সরাসরি পাওয়া যাচ্ছে না। বিকল্পভাবে যন্ত্রপাতি সংগ্রহের প্রক্রিয়া চলছে বলে জেনেছি। এসব যন্ত্রপাতির কার্যকারিতা ও নির্ভরযোগ্যতা যদি যথাযথ না হয়, সে ক্ষেত্রেও নিরাপত্তাঝুঁকি তৈরি হতে পারে। 

প্রথম আলো:

ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে রাশিয়ার ওপর পশ্চিমারা নানা ধরনের নিষেধাজ্ঞা দিয়ে যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রে ডোনাল্ড ট্রাম্প দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসার পর রাশিয়ার ওপর নতুন নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন। সব মিলিয়ে রাশিয়ার সঙ্গে লেনদেন এবং যন্ত্রাংশ, সরঞ্জাম আনাটাও তো আমাদের জন্য বেশ চ্যালেঞ্জিং হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ বাস্তবতায় দ্বিতীয় ইউনিটের ভবিষ্যৎ কী? 

মো. শফিকুল ইসলাম : চ্যালেঞ্জটা শুধু দ্বিতীয় ইউনিটের জন্য নয়, প্রথম ইউনিটের ক্ষেত্রেও সমানভাবে প্রযোজ্য। ২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি যেদিন রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হলো, সেদিন থেকেই এর প্রভাব রূপপুর প্রকল্পের ওপর পড়তে শুরু করেছে। প্রকল্পের নিরাপত্তাব্যবস্থার কিছু পরীক্ষিত ও গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্রাংশ, যেমন পাম্প ও মোটর সরাসরি ইউক্রেনে তৈরি হতো। যুদ্ধ শুরু হওয়ায় সেগুলো আর পাওয়া সম্ভব হয়নি। এ ছাড়া প্রকল্পের কিছু উপকরণ ইউরোপের বিভিন্ন দেশ, বিশেষ করে জার্মানিতে উৎপাদিত হচ্ছিল। সরবরাহের প্রস্তুতি শেষ পর্যায়ে থাকলেও যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের নিষেধাজ্ঞার কারণে শেষ মুহূর্তে এই যন্ত্রাংশগুলো রূপপুরে পাঠানো সম্ভব হয়নি। ফলে প্রকল্পের জন্য গুরুত্বপূর্ণ সরঞ্জাম সরবরাহে বাধা সৃষ্টি হচ্ছে ও বিকল্প উৎস খুঁজে পেতে উল্লেখযোগ্য সময় লাগছে। 

আরও একটি বাস্তবতা এখানে আছে। প্রথম ইউনিটের কাজ সম্পন্ন করতে গিয়ে অনেক যন্ত্রাংশ নষ্ট হয়েছে। সেই শূন্যস্থান পূরণ করতে গিয়ে দ্বিতীয় ইউনিট থেকে অনেক যন্ত্রাংশ খুলে আনা হয়েছে। প্রকল্প ব্যবস্থাপনার দিক থেকে এই চর্চা একেবারেই অনুচিত। এটি দ্বিতীয় ইউনিটের অগ্রগতিতে বিলম্ব সৃষ্টি করছে।

 সর্বোপরি, ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর থেকে রাশিয়ার ওপর পশ্চিমাদের নিষেধাজ্ঞা থাকায় প্রযুক্তি, ব্যাংকিং ও আন্তর্জাতিক অর্থপ্রবাহের জায়গাগুলো কঠোরভাবে প্রভাবিত হচ্ছে। এর ফলে রূপপুর প্রকল্পের জন্য যন্ত্রাংশ ও টেকনিক্যাল সার্ভিস আগের তুলনায় অনেক বেশি জটিল হয়ে পড়েছে। সব মিলিয়ে দ্বিতীয় ইউনিটের জন্য এখনই কার্যকর সরবরাহব্যবস্থা ঠিক না করতে পারলে সেটি চালুর ব্যাপারে আমাদের দীর্ঘদিন অপেক্ষা করতে হতে পারে। 

প্রথম আলো:

প্রকল্পের মেয়াদ বৃদ্ধি মানেই ব্যয় বৃদ্ধি। সময়মতো উৎপাদনে না যাওয়ার কারণে বড় একটি আর্থিক ক্ষতিও হচ্ছে। সে ক্ষেত্রে সস্তায় বিদ্যুৎ উৎপাদনের গল্পটাও তো ম্লান হয়ে যায়…! 

মো. শফিকুল ইসলাম : বিষয়টি আংশিক সত্য। প্রকল্পের চুক্তি অনুযায়ী রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের নির্মাণ খরচ ১২ দশমিক ৬৫ বিলিয়ন ডলার; কিন্তু ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন এবং অন্যান্য বাস্তবতার কারণে সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের তুলনায় রূপপুরের ইউনিটপ্রতি বিদ‍্যুৎ উৎপাদনের খরচ প্রায় ৫০ শতাংশ বেড়েছে। প্রকল্পটি ইতিমধ্যে প্রায় তিন বছর পিছিয়ে গেছে। এই বিলম্বের কারণে বাড়তি ঋণের কিস্তি শোধ করতে হচ্ছে, স্থাপিত যন্ত্রপাতির আয়ুষ্কাল কমে যাচ্ছে এবং জনবলের জন্য অতিরিক্ত বেতন-ভাতা দিতে হচ্ছে। প্রকল্পটি সময়মতো চালু হলে জীবাশ্ম জ্বালানি আমদানির ওপরও আমাদের চাপ কমত। সব দিক থেকেই রূপপুর প্রকল্পের অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তাঝুঁকি দিন দিন বাড়ছে। তবে এখনো সুযোগ আছে। সঠিক ও সুস্থ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে প্রকল্পটিকে দীর্ঘ মেয়াদে লাভজনক করা সম্ভব। 

প্রথম আলো:

এত বড় একটি কৌশলগত প্রকল্প, অথচ তার প্রায় পুরোটাই নির্ভর করতে হচ্ছে রাশিয়া থেকে আসা যন্ত্রাংশ ও প্রযুক্তির ওপরে। বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু হয়ে যাওয়ার পর জরুরি ভিত্তিতে যদি কোনো যন্ত্রাংশ ও প্রযুক্তিগত সহায়তার প্রয়োজন হয়, সময়মতো সেটি পাওয়া যাবে কি না, তা নিয়েও তো বড় একটা শঙ্কা আছে? এ ক্ষেত্রে করণীয় কী? 

মো. শফিকুল ইসলাম : অবশ্যই এটি একটি বাস্তব চ্যালেঞ্জ। রূপপুর প্রকল্পের অনেক গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্রাংশ এবং প্রযুক্তিগত সহায়তা রাশিয়া থেকে আসছে। প্রকল্প চালু হওয়ার পর জরুরি ভিত্তিতে যদি কোনো যন্ত্রাংশ বা প্রযুক্তিগত সহায়তার প্রয়োজন হয়, তা সময়মতো পাওয়া নিয়ে শঙ্কা রয়েছে। বিশেষ করে ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতার কারণে যেসব যন্ত্রপাতি বিকল্প পথে সহজে পাওয়া যাবে না। এর জন্য আমাদের বিশেষ পরিকল্পনা নেওয়া দরকার। যেমন বিকল্প উৎস নিশ্চিত করা, পর্যাপ্ত মজুত রাখা, স্থানীয় সক্ষমতা বাড়ানো ও সাপ্লাই চেইনে ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা। ডিজাইনার প্রতিষ্ঠান ও উৎপাদকদের সঙ্গে সরাসরি চুক্তি করাও একটি বড় বিকল্প। এ ছাড়া দেশে একটি প্রযুক্তিগত সহায়তা সংস্থা তৈরি করা প্রয়োজন। এই সংস্থা পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট রাশিয়ান ফেডারেশন এবং আন্তর্জাতিক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নিয়মনীতি, বিধিবিধান ও মানদণ্ডের সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করবে। 

প্রথম আলো:

জাপানের ফুকুশিমা বিপর্যয়ের পর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের নিরাপত্তা নিয়ে জনমনে ব্যাপক শঙ্কা আছে। অনেকের মনে এই ধারণা আছে যে জাপানের মতো দেশে যেখানে পারমাণবিক বিপর্যয় ঘটেছে, বাংলাদেশ সেখানে কতটা নিরাপদ? আপনি যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, চীন ও জাপানে পরমাণু প্রযুক্তির নিরাপত্তা নিয়ে কাজ নিয়েছেন। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের নিরাপত্তাঝুঁকি কতটা? বড় মাত্রার ভূমিকম্প হলে কী হবে? 

মো. শফিকুল ইসলাম :বাংলাদেশের পরিস্থিতি জাপানের সঙ্গে তুলনীয় নয়। রূপপুর পারমাণবিক চুল্লি হচ্ছে তৃতীয় প্রজন্মের প্লাস–থ্রি প্রযুক্তির আর ফুকুশিমা পারমাণবিক চুল্লি ছিল দ্বিতীয় প্রজন্মের। রূপপুর পারমাণবিক চুল্লি বহু স্তরের আধুনিক নিরাপত্তাবলয়ে নির্মিত। প্রকল্পটির এমনভাবে নকশা করা হয়েছে, যা ভূমিকম্প, বন্যাসহ অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগ কিংবা সন্ত্রাসী হামলা মোকাবিলা করতে যথেষ্ট শক্তিশালী। বড় মাত্রার ভূমিকম্প হলে চুল্লিটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে বন্ধ হয়ে যাবে, রেডিয়েশন নির্গমন প্রতিরোধ করবে এবং জরুরি প্রতিকারব্যবস্থা কার্যকর হবে। সুতরাং প্রযুক্তিগত ও ব্যবস্থার দিক থেকে রূপপুর বিদ্যুৎকেন্দ্র অত্যন্ত নিরাপদ। তবে নিরাপত্তা নিয়ে জনমনে যে শঙ্কা আছে, সেটি নিরসন করার জন্য শিখনমূলক প্রচার, স্বচ্ছ তথ্য সরবরাহ এবং নিয়মিত নিরাপত্তা পর্যালোচনা অপরিহার্য। সঠিক ব্যবস্থাপনা, নির্মাণ ও পরীক্ষা কার্যক্রম, প্রশিক্ষণ ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার মাধ্যমে ঝুঁকি প্রায় শূন্যের কাছাকাছি রাখা সম্ভব। 

প্রথম আলো:

প্রযুক্তি না হয় অত্যাধুনিক হলো; কিন্তু এই প্রযুক্তি যাঁরা পরিচালনার দায়িত্বে থাকবেন, এ রকম একটি অতিসংবেদনশীল স্থাপনা পরিচালনায় তাঁরা কতটা দক্ষ, যোগ্য ও নির্ভরশীল? অদক্ষতা তো অনেক ক্ষেত্রে বড় নিরাপত্তাঝুঁকি তৈরি করে। আপনি কী বলবেন? 

মো. শফিকুল ইসলাম : পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের নিরাপত্তা নির্ভর করে চালনা ও রক্ষণাবেক্ষণকারীদের দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার ওপর। রূপপুরে চালনা ও রক্ষণাবেক্ষণকারীদের জন্য দীর্ঘমেয়াদি প্রশিক্ষণ এবং আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী দক্ষতা যাচাই নিশ্চিত করা উচিত। অদক্ষ চালনা ও রক্ষণাবেক্ষণ নিরাপত্তার জন্য বড় ঝুঁকি তৈরি করতে পারে, তাই প্রযুক্তি ও প্রশিক্ষণ একসঙ্গে থাকা অপরিহার্য। সবাইকে নিরাপত্তাসংস্কৃতি মেনে চলতে হবে। 

প্রথম আলো:

রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে নিয়োগকে কেন্দ্র করে অসন্তোষ আছে। সেখানে আন্দোলনও হতে দেখেছি। এমন অভিযোগ আছে যে বিগত সরকারের আমলে নিয়োগের ক্ষেত্রে দক্ষতা ও যোগ্যতার চেয়ে রাজনৈতিক নিয়োগকেই প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। এ বিষয়গুলো রূপপুর প্রকল্পের জন্য কী ধরনের চ্যালেঞ্জ ও ঝুঁকি তৈরি করছে? 

মো. শফিকুল ইসলাম : ব‍্যবস্থাপনায় ও নিয়োগে ত্রুটি থাকলে অসন্তোষ তো থাকবেই। দক্ষতা ও মেধার বাইরে কর্মী নিয়োগে রাজনীতি, স্বজনপ্রীতি, দুর্নীতি বা ‘জি হুজুর’, ‘হ‍্যাঁ হুজুর’ সংস্কৃতি থাকলে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র সুষ্ঠুভাবে চালনা করা কোনোভাবেই সম্ভব হবে না। এ ক্ষেত্রে এখনই সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে যথাযথ ব‍্যবস্থা না নিলে আমাদের পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র সম্ভাবনার পরিবর্তে অনেক বড় ঝুঁকি তৈরি করবে। 

প্রথম আলো:

পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনায় যদি এ ধরনের সমস্যা থেকে যায়, তাহলে কী ধরনের ঝুঁকি তৈরি হতে পারে? 

মো. শফিকুল ইসলাম : বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি নিয়ন্ত্রণ সংস্থায় যদি অভ্যন্তরীণ দুর্বলতা থাকে, তা প্রকল্পের জন্য গুরুতর নিরাপত্তাঝুঁকি তৈরি করতে পারে। রাশিয়ান ঠিকাদার এই সুযোগ নিয়ে প্রযুক্তি–সংক্রান্ত চুক্তি ও মানদণ্ডে আপস করতে পারেন। এর ফলে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র চালনায় নিরাপত্তা, রেডিয়েশন নিয়ন্ত্রণ এবং জরুরি প্রতিকারব্যবস্থা প্রভাবিত হতে পারে। আমরা দেখছি, পরিচালনা পর্ষদ এখনো পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রটি পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় নিয়মকানুন, বিধিবিধান ও মানদণ্ড তৈরি করতে পারেনি। তাদের নিজেদের অভিজ্ঞ ও দক্ষ কারিগরি দল নেই।

সব নিরীক্ষা–সংক্রান্ত কার্যক্রমের জন্য তারা রাশিয়ার নিয়ন্ত্রক সংস্থার ওপর নির্ভরশীল। আমাদের বুঝতে হবে, একটি দেশের পুরো পারমাণবিক নিরাপত্তাসংস্কৃতি গড়ে ওঠে পরিচালনা পর্ষদের নিয়মকানুন ও বিধিবিধান থেকেই। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে সেটি অনুপস্থিত বলে মনে হচ্ছে। আর সরকারের উচিত প্রতিষ্ঠানটিকে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ে না রেখে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অধীন ন‍্যস্ত করা। এতে স্বার্থের দ্বন্দ্বের প্রভাব থেকে বের হয়ে প্রতিষ্ঠানটি স্বাধীনভাবে কাজ করতে সক্ষমতা অর্জন করবে। 

প্রথম আলো:

রূপপুর প্রকল্পের যে দুর্বলতা ও ঘাটতি রয়েছে, তা থেকে উত্তরণে করণীয় কী বলে মনে করেন? 

মো. শফিকুল ইসলাম: যেকোনো সমস্যা সমাধানের প্রথম ধাপ হলো ‘সমস্যা আছে’ এটি স্বীকার করা। প্রথমত, ‘স্পর্শকাতর’ দোহাই থেকে বেরিয়ে এসে একটি স্বাধীন বিশেষজ্ঞ কারিগরি প্যানেল গঠন করে প্রকল্পের অগ্রগতি ও দুর্বলতা পর্যালোচনা করে জরুরি ভিত্তিতে সুপারিশ প্রণয়ন এবং তার ভিত্তিতে একটি বাস্তবসম্মত কর্মপরিকল্পনা তৈরি করা প্রয়োজন। দ্বিতীয়ত, একটি গ্রহণযোগ্য, অভিজ্ঞ ও কার্যকর প্রকল্প ব‍্যবস্থাপনা টিম গঠন করা দরকার। তৃতীয়ত, রাশিয়ার সঙ্গে বোঝাপড়া করে এখনো যেসব সংবেদনশীল যন্ত্রাংশ বানানো অসম্পূর্ণ আছে, সেগুলো দ্রুত তৈরি করে সরবরাহব্যবস্থা স্থিতিশীল করা প্রয়োজন। চতুর্থত, পরিচালনা পর্ষদের সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে হবে। পাশাপাশি স্বচ্ছ নিয়োগনীতি, নিয়মিত অডিট, সুষ্ঠু ব‍্যবস্থাপনা, কর্মীদের নিয়মিত প্রশিক্ষণ ও দক্ষতা যাচাই এবং নিরাপত্তাসংস্কৃতি মানা—এই দিকগুলোর দিকে বিশেষ নজর দিতে হবে।

প্রথম আলো:

আপনাকে ধন্যবাদ। 

মো. শফিকুল ইসলাম: আপনাদেরও ধন্যবাদ।