আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের বিশেষ সাক্ষাৎকার

মানবাধিকার ও মতপ্রকাশের ধারণা স্থিতিশীল কিছু নয়

আওয়ামী লীগের নতুন সরকারে আবারও আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পেয়েছেন আনিসুল হক। টানা তৃতীয় দফায় তিনি এই দায়িত্ব পেলেন। মানবাধিকার, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে মামলাসহ আইনগত বিভিন্ন বিষয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন কাদির কল্লোলআনোয়ার হোসেন

প্রথম আলো:

আওয়ামী লীগের গত ১৫ বছরের শাসনে মানবাধিকার নিয়ে দেশে–বিদেশে নানা সমালোচনা ও প্রশ্ন রয়েছে। নতুন সরকারের সামনেও মানবাধিকারের বিষয়টি বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখেন কি?

আনিসুল হক: সেভাবে যদি আপনারা দেখেন, তাহলে আমি প্রশ্ন করব যে ২০০২ সালে (বিএনপি সরকারের সময়) যখন অপারেশন ক্লিন হার্ট নামে অভিযান হলো, তখন তো মানবাধিকারের ব্যাপারে কেউ কোনো প্রশ্ন করেনি। বরং যদি সেই সময়ের সঙ্গে ২০০৯ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত (আওয়ামী লীগ সরকারের ১৫ বছর) সময়ের তুলনা করা হয়, তাহলে দেখা যাবে, তখন যে রকম বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড হতো, যে রকম গুমের সংস্কৃতি ছিল এবং মানুষের মনে যে আতঙ্ক ছিল, সেটা কিন্তু ১৫ বছরে ছিল না। ২০০৯ সালে যখন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকার গঠন করলেন, তখন আমাদের সামনে অনেক চ্যালেঞ্জ ছিল।

এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা এবং আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করার জন্য আইনের প্রয়োগ কঠিন করার বাস্তব প্রয়োজন ছিল। এখন আইন প্রয়োগ সঠিকভাবে করা হলে সেখানে যদি কাউকে অপরাধী হিসেবে আইনের মুখোমুখি হতে হয়, তাহলে তো বলা যায় না যে আমরা মানবাধিকার লঙ্ঘন করেছি। এ ছাড়া আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মধ্যে ২০০২ সালের সংস্কৃতির কিছু কিছু ঢুকে গিয়েছিল, তারা ভেবেছিল যে অতিরঞ্জিত করলেও তাদের আইনের আওতায় আনা হবে না এবং কিছু কিছু অতিরঞ্জিত তারা করেছিল। সেটাকে কিন্তু সরকারের সঙ্গে সম্পৃক্ত করলে সঠিক হবে না। যেমন নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের ঘটনা। এটা যখন তারা করেছিল, তখন কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে সরকারের কর্তব্য হিসেবে তাদের আইনের আওতায় এনে কারাগারে পাঠানো হয়েছিল এবং বিচারের মুখোমুখি করা হয়েছিল।

প্রথম আলো:

এখানেই প্রশ্ন রয়েছে যে নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের ঘটনার মতো যেগুলো আলোচনায় এসেছে, তখন হয়তো সরকার তাতে ব্যবস্থা নিয়েছে। কিন্তু যে ঘটনাগুলো আলোচিত হয় না, সেগুলোর ব্যাপারে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয় না।

আনিসুল হক: আলোচনায় আসার মতো ঘটনা খুব একটা ঘটেনি বলেই সেগুলো আলোচনায় আসেনি। আর আমরা যখন খুব গুরুত্ব দিয়ে বিষয়গুলো দেখা শুরু করলাম, আমাদেরকে ৭৬ জন নিখোঁজের একটি তালিকা দেওয়া হলো জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের দপ্তর থেকে। আমরা তা তদন্ত করলাম। কিন্তু তদন্তের প্রক্রিয়ায় আমরা বলেছিলাম, অভিযোগকারী পরিবারগুলোর কাছে পুলিশ গিয়ে তাদের অভিযোগ শুনবে।

এ কথা বলার পর প্রথম আলো, ডেইলি স্টারসহ কিছু খবরের কাগজে খবর প্রকাশ হওয়া শুরু হলো যে পরিবারগুলোকে হুমকি দেওয়া হচ্ছে। সেটাও আমরা ধর্তব্যের মধ্যে নিলাম। তখন আমরা ঠিক করলাম যে থানা থেকে একটা চিঠি দেওয়া হবে এবং তাতে বলা হবে যে আপনারা তথ্য–প্রমাণ দেন আমরা খুঁজব। এখনো সেই প্রক্রিয়া কিন্তু চলছে। এ ছাড়া আমরা ভিন্নভাবেও তদন্ত করলাম। তাতে দেখা গেল, এর মধ্যে অনেকেই ফিরে এসেছেন। আবার অনেকেই আছেন মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি, তাঁরা তো ভেগে গেছেন। ফলে তদন্তে দেখা যায়, তাদের দেওয়া তথ্য ও ফ্যাক্টসের মধ্যে অনেক তারতম্য রয়েছে।

প্রথম আলো:

গুমের বিষয়ে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো এবং এমনকি জাতিসংঘ ও যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে বিভিন্ন সময় বক্তব্য দেওয়া হয়েছে। জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের দপ্তরসহ আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আপনাকে জবাবও দিতে হয়েছে। আপনারা তদন্তের কথা বলছেন। কিন্তু তদন্তে কী পাওয়া যাচ্ছে, তা আপনারা কখনো প্রকাশ করেননি।

আনিসুল হক: তদন্ত শেষ না হলে আমরা তা কেন প্রকাশ করব। এখনো অনেক পরিবার আছে, যারা তথ্যগুলো সঠিকভাবে দেয়নি। ৭৬ জনের নিখোঁজের তালিকার ব্যাপারে আমরা তদন্তে এ পর্যন্ত যা পেয়েছি, তা কিন্তু জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের কাছে পৌঁছে দিয়েছি। এরপর তারা ২১ জনের আরেকটি তালিকা দিয়েছে। আমরা প্রতিটি অভিযোগ তদন্ত করে তাদের পাঠাচ্ছি। কারণ, বিচারবহির্ভূত কোনো হত্যাকাণ্ডে এই সরকারের কোনো সম্পৃক্ততা নেই।

প্রথম আলো:

অভিযোগ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিরুদ্ধে। বিশেষ বাহিনী র‍্যাবের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞাও দিয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর অভিযোগ, বিরোধী দলের রাজনীতি করে বলেই তাদের স্বজনদের উঠিয়ে নিয়ে গুম করা হয়।

আনিসুল হক: দেখেন, ২০১৪ সালের নির্বাচনের পর আমি প্রথম যখন আইনমন্ত্রী হই, তখন আমাকে ২৪১ জনের একটি তালিকা দেওয়া হয়েছিল। সেই তালিকা নিয়ে আমরা দেখলাম, সেগুলো সঠিক নয়। দু–তিনটি ছাড়া ওই তালিকার প্রতিটির ব্যাপারে আমরা তখন জবাব দিয়েছি। এরপর এল ৭৬টি। সেটাও আমরা জবাব দিয়েছি। এখন এল ২১ জনের তালিকা। আমরা প্রতিটি তদন্ত করে সত্য তথ্য তাদের পাঠাচ্ছি। আর র‍্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞার কথা বলছেন। তারা নিষেধাজ্ঞা দিতে পারে। কিন্তু আমাদের মনে হয়, এটা জুডিশাস হয়নি। সে জন্য উই আর কন্টেস্টিং ইট (আমরা এর প্রতিবাদ করছি)।

প্রথম আলো:

আপনি কি মনে করেন, আপনারা যে যুক্তি বা তথ্য তুলে ধরছেন, জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক মহলে তা গ্রহণযোগ্য হচ্ছে?

আনিসুল হক: গ্রহণযোগ্যতার মাপকাঠি কী। গ্রহণযোগ্যতার মাপকাঠি হচ্ছে কমিটি অব নেশসনসে যাঁরা আছেন, তাঁরা আমার যুক্তি বা জবাবদিহি গ্রহণ করছেন কি না। গত বছরের নভেম্বরে ১১১টি দেশ মানবাধিকার বিষয়ে আলোচনায় অংশ নিয়েছিল। আমি তাতে ছিলাম। প্রতিটি দেশের প্রতিনিধি কথা বলেছেন। ১০০টি দেশ আমাদের মানবাধিকার বিষয়ে প্রশংসা করেছে। তারা খুবই নমনীয়ভাবে বলেছে, আমরা এটা মানি যে মানবাধিকার নিশ্চিত করতে ভালো কাজ হচ্ছে। তবুও তারা কিছু সুপারিশ করেছে। আর ৯টি দেশ আমাদের প্রশংসা করেও কিছু সাজেশন দিয়েছে। যেমন ধরেন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য বলেছে, তারা একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন চায়। এসব রাজনৈতিক কথাও তারা বলেছে।

প্রথম আলো:

কিন্তু যে দেশগুলোর মানবাধিকার পরিস্থিতি ভালো, সেই দেশগুলো তো সমর্থন করছে না। এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো রয়েছে।

আনিসুল হক: ধরেন, জর্জ ফ্লয়েড নামের এক ব্যক্তি ‘আই কান্ট ব্রিদ’ (আমি শ্বাস নিতে পারছি না) বলার পরও তাঁকে মেরে ফেলেছে। এমন সব ঘটনা দেখেও যদি আপনি বলেন যে তারা মানবাধিকার বিষয়ে আমাদের অনেক ওপরে আছে, তাহলে আমার মনে হয় মানবাধিকারের সংজ্ঞা আবার নতুন করে দিতে হবে। কিন্তু আমাদের এখানে যাদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, তাদের কিছু কর্মকর্তা অতিরিক্ত করে ফেলেছে। তবে অতিরিক্ত কিছু করার সঙ্গে সঙ্গে তাদের ব্যাপারে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। আমরা যদি ব্যবস্থা না নিতাম, তাহলে আপনারা বলতে পারতেন যে রাষ্ট্র এটাকে স্পনসর (সমর্থন) করছে। আমরা তা করছি না।

প্রথম আলো:

এখন আসি ৭ জানুয়ারির নির্বাচনের ব্যাপারে। নির্বাচনের আগে গত বছরের ২৮ অক্টোবর ঢাকায় বিএনপির সমাবেশ পণ্ড হওয়ার পর থেকে শুরু হয় দলটির নেতা–কর্মীদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তার অভিযান। বিএনপি বলছে, তাদের দলের মহাসচিব থেকে শুরু করে দলের ২৩ হাজারের বেশি নেতা–কর্মী এখনো কারাগারে রয়েছেন।

আনিসুল হক: এই সংখ্যাটা সঠিক নয়। আরেকটা বিষয় এখানে বলা দরকার, তা হচ্ছে, একমাত্র আওয়ামী লীগই ২০০১ সালে কোনো গন্ডগোল ছাড়াই ক্ষমতা হস্তান্তর করেছিল। কিন্তু  ২০০১ সালে ‘বিতর্কিত’ নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় এসে বিএনপি সারা দেশে আওয়ামী লীগ নেতা–কর্মী এবং সংখ্যালঘুদের ওপর তাণ্ডব চালিয়েছিল। তখন অত্যাচারের ঘটনাগুলোর মামলার তদন্ত করা হয়নি। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর সেই মামলাগুলোর তদন্ত করা হয়েছে। এরপর ২০১৩ ও ২০১৪ সালে বাসের মধ্যে মানুষ পুড়িয়ে মেরে অগ্নিসন্ত্রাস করা হয়েছে। সেসব মামলার বিচারের প্রক্রিয়া এখন শেষ হয়ে এসেছে। যখন এগুলোর তদন্ত চলছিল, তখন তো অভিযুক্ত কাউকে গ্রেপ্তার করা হয়নি।

প্রথম আলো:

কিন্তু নির্বাচনের আগে মামলাগুলোর গতি বাড়িয়ে দেওয়া হয়। পুলিশই বাদী এবং পুলিশই সাক্ষ্য দিয়েছে। এই অভিযোগও এসেছে।

আনিসুল হক: পুলিশের সাক্ষীর ওপর সব সাজা হয়নি। কথা হচ্ছে, পুলিশ অভিযোগপত্র দিয়ে মামলা আদালতে আনতে যে সময়টা পার হয়েছে, এর সঙ্গে কাকতালীয়ভাবে মিলে গেছে নির্বাচনের সময়।

প্রথম আলো:

এখানেই প্রশ্ন উঠেছে, ৭ জানুয়ারির নির্বাচন ঘিরে বিএনপির নেতাদের গ্রেপ্তার করে পুরোনো মামলায় বিচার দ্রুত শেষ করা হয়। আবার নতুন মামলা দেওয়া হয়।

আনিসুল হক: আমি আপনাকে বলছি, ২৮ অক্টোবর সমাবেশ করতে তাদের অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। এর আগে ২০২২ সালের ১০ ডিসেম্বর তাদের সমাবেশ করতে অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু ২৮ অক্টোবর এসে তারা সমাবেশ থেকে সহিংসতা করেছে, তারা সন্ত্রাস করেছে। আরেকটা বিষয় হচ্ছে, প্রধান বিচারপতির বাসভবনে আক্রমণ কেন করা হলো? এটার মানে হচ্ছে, বিএনপি–জামায়াত আইনের শাসনে বিশ্বাস করে না। আর পুরোনো মামলার বিচার আগে শেষ হলে বলা হতো, আন্দোলন দমনের জন্য এটা করা হচ্ছে। মামলা আইন অনুযায়ী এগিয়েছে এবং আইনের জন্যই বিচার হয়েছে। এর মধ্যে অন্যায় হলো কোথায়?

প্রথম আলো:

কিন্তু বিএনপি নেতাদের মামলার বিচার কার্যক্রম এতটাই দ্রুত করা হয়েছে যে ঢাকায় রাতেও আদালতের কার্যক্রম চলেছে।

আনিসুল হক: এসব অভিযোগ বা খবর আসলে ভুল। ধরেন একজন সাক্ষী সাক্ষ্য দিচ্ছে, তখন ছয়টা বেজে গেছে, কিন্তু ওই সাক্ষীর সাক্ষ্য শেষ করতে আরও পাঁচ মিনিট সময় প্রয়োজন। তখন দুই পক্ষের আইনজীবীর সঙ্গে কথা বলে আদালত হয়তো সময় দিয়ে সাক্ষীর সাক্ষ্য নেওয়া শেষ করতে আধা ঘণ্টা বা এক ঘণ্টা বেশি চালিয়েছে। কিন্তু কথা হচ্ছে যে সুবিধার কারণে আদালত ১৫ মিনিট বা এক ঘণ্টা বেশি চললে আইন ভঙ্গ হয় না। অতীতে বহু আদালত রাতে চলেছে।  জিয়াউর রহমানের সামরিক শাসনের সময় রাত ১২টা পর্যন্ত মার্শাল ল কোর্টে বিচার চলত, আর রাত একটায় ফাঁসি হতো।

প্রথম আলো:

বিএনপি বলছে, তাদের ২৩ হাজারের বেশি নেতা–কর্মী এখনো কারাগারে।

আনিসুল হক: এর আগেও একদিন আপনি এই প্রশ্ন করেছিলেন। সেদিন আপনি ২০ হাজারের কথা বলেছিলেন। কিন্তু আমি খোঁজ নিয়ে বলেছিলাম, সংখ্যাটা ১০ হাজারের মতো হবে। এখনো বলছি, সংখ্যাটা ২৩ হাজারের কাছাকাছিও নয়। অনেক অনেক নিচে।

প্রথম আলো:

আপনি বলছেন, আইন তার নিজের গতিতে চলছে। কিন্তু বিএনপি বলছে, তাদের নেতা–কর্মীদের মামলায় ৯০ শতাংশেরই সাজা হয়েছে। তাঁদের প্রত্যেকের বিরুদ্ধে অনেক মামলা। শীর্ষ পর্যায়ের নেতারাও জামিন পাচ্ছেন না। এমন অভিযোগ তাঁদের আইনজীবীরা করছেন।

আনিসুল হক: আদালত সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে কাজ করেন। আমাদের করণীয় কিছু নেই। আমার কথা হচ্ছে, প্রধান বিচারপতির বাসভবনের গেটে লাথি মারার অভিযোগের একটা মামলায় হাইকোর্টে একজন বিএনপি নেতা জামিন পাননি। কিন্তু একটা জিনিস তো সত্য, প্রধান বিচারপতির বাসভবনে হামলা করে বিচারপতিদের যদি আপনি অপমান করেন বা তাঁদের সংঘাতে টেনে আনেন, তাঁরাও তো মানুষ। ফলে তাঁরা যদি কোনো স্ট্যান্ড নেন, সেখানে তো আমাদের কিছু করার নেই।

প্রথম আলো:

নিউমার্কেট থানার একটি মামলায় বিএনপির নেতা হিসেবে আসামি করা হয় শাজাহান ওমরকে। কিন্তু তিনি নির্বাচনে অংশ নেবেন বলে তাৎক্ষণিক জামিন পেলেন। এরপর রাতে মুক্তি পেয়ে পরদিন আওয়ামী লীগে যোগ দিয়ে নৌকা প্রতীকে নির্বাচন করলেন। তিনি বিশেষ সুবিধা পেলেন কি না?

আনিসুল হক: জামিনের ব্যাপারে তাঁকে কোনো প্রিভিলেজ (বিশেষ সুবিধা) দেওয়া হয়নি। জেল থেকে বেরিয়ে তিনি একজন স্বাধীন মানুষ হিসেবে কী সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, সেটা তাঁর বিষয়। তিনি তাঁর সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তাঁকে মনোনয়ন দিয়েছেন এবং তিনি জয়লাভ করেছেন। এর সঙ্গে অন্য কোনো বিষয় মেলানো ঠিক হবে না।

প্রথম আলো:

নাশকতার অভিযোগে একই মামলায় আসামি বিএনপির অন্য নেতারা তো জেলে রয়ে গেছেন।

আনিসুল হক: একেকজনের ব্যাপারে অভিযোগ তো একেক রকম। কেউ হুকুমের আসামি, কেউ মাঠে থেকে ঘটনা ঘটিয়েছেন। এর ওপর নির্ভর করে মামলার মেরিট বা গুরুত্ব।

প্রথম আলো:

মতপ্রকাশের স্বাধীনতা একটা বড় ইস্যু। ভিন্নমত প্রকাশ করলেই তাঁর ওপর সরকারের খড়্গহস্ত নেমে আসে। মানে দেশে মতপ্রকাশের ক্ষেত্রে একটা ভয়ের সংস্কৃতি চলছে। আমরা সাংবাদিকেরাও অনেক বিষয় খবর প্রকাশে ভয় পাই। একধরনের সেলফ সেন্সরশিপ কাজ করে।

আনিসুল হক: আপনারা সাংবাদিকেরা বললেন যে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন থাকলে সাংবাদিকদের একটা মনস্তাত্ত্বিক ভয় তৈরি হয়েছে। যদিও সরকার ওই আইনে খুব একটা মামলা করেনি, ব্যক্তি মামলা করেছে। এরপরও মনস্তাত্ত্বিক ভয়ের কথা যখন বলা হয়েছে, আমরা কিন্তু আলোচনা করে ভীতির জায়গাগুলো পরিবর্তন করেছি। যেমন জামিনযোগ্য করে দিয়েছি। মানহানির অভিযোগের ক্ষেত্রেও শিথিল করেছি। কিন্তু এটাও মানতে হবে, সামাজিক মাধ্যমকে অপব্যবহার করা হয়। এর থেকে সবারই প্রটেকশন (সুরক্ষা) দরকার।

প্রথম আলো:

আপনারা নিজেরা কি উপলব্ধি করেন যে মানুষের মধ্যে একটা ভয় কাজ করে, তারা কথা বলতে ভয় পায়। কখনো কি মনে হয়?

আনিসুল হক: আমার মনে হয়, কিছু কিছু পত্রিকা, কিছু মানুষ এই ভীতিটা ছড়ানোর চেষ্টা করে। কিন্তু আপনি যদি গ্রামগঞ্জে যান, তাহলে দেখবেন, সেখানে রাজনৈতিক ভীতি নেই, মানে আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে কিছু বলা যাবে না—এ রকম কোনো ভীতি নেই।

প্রথম আলো:

মানবাধিকার ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার বিষয়ে সমালোচনা থেকে বেরিয়ে আসার ব্যাপারে এখন আপনাদের পরিকল্পনা কী হবে?

আনিসুল হক: মানবাধিকার ও মতপ্রকাশের কনসেপ্ট (ধারণা) কিন্তু স্থিতিশীল কিছু নয়। এগুলো সব সময় পরিবর্তন হচ্ছে। এই পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে যেখানেই আরও উন্নত বা ভালো করা প্রয়োজন, সেটা আমরা করব।

প্রথম আলো:

টানা তৃতীয় দফায় আইনমন্ত্রী হিসেবে এবার আপনার অগ্রাধিকারে কী থাকবে?

আনিসুল হক: প্রথম অগ্রাধিকার হবে মামলার জট কমানো। মামলার দীর্ঘসূত্রতার কারণে কিন্তু মানুষ দুর্ভোগ পোহাচ্ছে। এই দুর্ভোগ বন্ধ করার দায়িত্ব আমার। আমি আইনমন্ত্রী হিসেবে আগের দুই মেয়াদে একধরনের অবকাঠামো তৈরি করেছি, যাতে মামলার জট কমিয়ে মানুষকে ত্বরিত ন্যায়বিচার দেওয়া যায়। এর মধ্যে ই–জুডিশিয়ারি প্রকল্পটা বাস্তবায়িত হবে। এর সঙ্গে বিজ্ঞ বিচারকের আসন বাড়বে। এ ছাড়া বিচারের আগে তদন্তসহ অন্য প্রক্রিয়াগুলোও দ্রুত করার পরিকল্পনা করা হচ্ছে। এখন ৩৮ লাখের মতো মামলা বিচারের অপেক্ষায় রয়েছে। আশা করি, এই জট কমে আসবে।

প্রথম আলো:

ধন্যবাদ আপনাকে সময় দেওয়ার জন্য।

আনিসুল হক: আপনাকেও ধন্যবাদ।