মোস্তফা কামালের সাক্ষাৎকার

মোখার সঙ্গে ’৯১-এর ঘূর্ণিঝড়ের অনেক মিল, দুশ্চিন্তার যথেষ্ট কারণ আছে

বাংলাদেশের দক্ষিণ উপকূলে এগিয়ে আসছে অতিপ্রবল ঘূর্ণিঝড় মোখা। এর পরিপ্রেক্ষিতে কক্সবাজারে ১০ নম্বর এবং চট্টগ্রাম ও পায়রা সমুদ্রবন্দরে ৮ নম্বর মহাবিপৎসংকেত দেওয়া হয়েছে। আন্তর্জাতিকভাবে এ ঘূর্ণিঝড়কে এ সময়ের সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ বলা হচ্ছে। ঘূর্ণিঝড় মোখার সর্বশেষ গতিবিধি, সম্ভাব্য আঘাত হানার সময় ও স্থান এবং ক্ষয়ক্ষতি এড়াতে প্রস্তুতির বিষয়ে কানাডার সাসকাচুয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ের আবহাওয়া ও জলবায়ুবিষয়ক পিএইচডি গবেষক মোস্তফা কামালের সঙ্গে কথা বলেছে প্রথম আলো। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন রাফসান গালিব

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: সম্ভাব্য ঘূর্ণিঝড় মোখার গতিপথ এখন কেমন?

মোস্তফা কামাল: ঘূর্ণিঝড় কেন্দ্রের পুরোটা কক্সবাজার জেলার ওপর দিয়ে অতিক্রম করার আশঙ্কা সবচেয়ে বেশি। আজ শনিবার বাংলাদেশ সময় বেলা তিনটার সময় ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের মডেল থেকে প্রাপ্ত পূর্বাভাস অনুসারে ঘূর্ণিঝড় মোখার স্থলভাগে আঘাতের প্রথম স্থান সেন্ট মার্টিন দ্বীপে। এরপরে কক্সবাজার জেলার উপকূলীয় সব উপজেলা। ঘূর্ণিঝড়টির স্থলভাগে আঘাতের সব সম্ভাব্য পথনির্দেশ করছে যেসব লাইন, তার প্রায় সব কটিই শেষ হয়েছে কক্সবাজার জেলার উপকূলীয় এলাকায়। মডেল অনুসারে, এ পথেই ঘূর্ণিঝড় মোখা স্থলভাগে আঘাতের আশঙ্কা ৯০ শতাংশের বেশি।

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: কখন এবং ঠিক কোন দিকে এটি উপকূলে আঘাত হানতে পারে?

মোস্তফা কামাল: ঘূর্ণিঝড় মোখার অগ্রবর্তী অংশ সেন্ট মার্টিন দ্বীপ অতিক্রম শুরু করার আশঙ্কা আজ শনিবার দিবাগত রাত তিনটার পর থেকে। ঘূর্ণিঝড়ের কেন্দ্র সেন্ট মার্টিন দ্বীপ ও কক্সবাজার জেলার ওপর দিয়ে অতিক্রম করার আশঙ্কা বেশি। ঘূর্ণিঝড়ের কেন্দ্র আগামীকাল রোববার সকাল ১০টার পর থেকে বিকেল ৫টার মধ্যে উপকূল অতিক্রম করার আশঙ্কা বেশি। ঘূর্ণিঝড়টির প্রভাব পুরোপুরি কেটে যেতে রোববার মধ্যরাত পর্যন্ত সময় লেগে যেতে পারে।

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: স্থলভাগে আঘাতের সময় বাতাসের গতিবেগ কেমন থাকতে পারে?

মোস্তফা কামাল: ঘূর্ণিঝড়টি সেন্ট মার্টিন দ্বীপে আঘাতের সময় বাতাসের সর্বোচ্চ গতিবেগ থাকতে পারে ঘণ্টায় ১৮০ থেকে ২১০ কিলোমিটার। কক্সবাজার জেলার ওপর দিয়ে অতিক্রম করার সময় বাতাসের সর্বোচ্চ গতিবেগ থাকতে পারে ঘণ্টায় ১৫০ থেকে ১৮০ কিলোমিটার। দক্ষিণ চট্টগ্রামের উপকূলে আঘাতের সময় বাতাসের সর্বোচ্চ গতিবেগ থাকতে পারে ঘণ্টায় ১৩০ থেকে ১৫০ কিলোমিটার।

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: এ ঘূর্ণিঝড়ের কারণে উপকূলীয় এলাকাগুলোতে কত ফুট উঁচু জলোচ্ছ্বাসে প্লাবিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে?

মোস্তফা কামাল: ঘূর্ণিঝড়টি দক্ষিণ-পশ্চিম দিক থেকে সেন্ট মার্টিন দ্বীপে আঘাতের আশঙ্কা নির্দেশ করছে বিশ্বের সব আবহাওয়া পূর্বাভাস মডেল। ঘূর্ণিঝড় মোখা যখন সেন্ট মার্টিন দ্বীপে আঘাত করবে (রোববার ভোর থেকে), তখন দ্বীপটি ১৫ থেকে ২০ ফুট উঁচু জলোচ্ছ্বাসে প্লাবিত হওয়ার প্রবল আশঙ্কা রয়েছে।

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: সেন্ট মার্টিন ছাড়া আরও কোন এলাকা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে? ক্ষতির ধরন কেমন হতে পারে?

মোস্তফা কামাল: সেন্ট মার্টিন দ্বীপ ছাড়াও কক্সবাজার জেলার কুতুবদিয়া, মহেশখালী দ্বীপসহ অন্য উপকূলীয় এলাকাগুলোতে ১০ থেকে ১৫ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাসের প্রবল আশঙ্কা দেখা যাচ্ছে। ভোলা, নোয়াখালী ও চট্টগ্রামের উপকূলীয় এলাকাগুলোতে ৮ থেকে ১২ ফুট, বরিশাল বিভাগের অন্য জেলাগুলোতে ৮ থেকে ১২ ফুট এবং খুলনা বিভাগের জেলাগুলোতে ৭ থেকে ১০ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাসে ব্যাপক এলাকা প্লাবিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। সেন্ট মার্টিন দ্বীপের বড় একটি অংশ সমুদ্রে বিলীন হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছি। সেন্ট মার্টিন দ্বীপের ভূকাঠামোর স্থায়ী ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা করছি।

সম্ভাব্য এ ঘূর্ণিঝড়ের কারণে চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার জেলায় ২৫০ থেকে ৪০০ মিলিমিটার, বরিশাল বিভাগ ও পার্বত্য চট্টগ্রামের জেলাগুলোর ওপর ২০০ থেকে ৩০০ মিলিমিটার বৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা করছি। এ অতিবৃষ্টির কারণে রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরগুলোসহ চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামের জেলাগুলোতে বন্যা, ভূমিধস ঘটতে পারে। যথাযথ প্রস্তুতি ও ব্যবস্থা না নিলে এতে প্রাণহানিও ঘটতে পারে।

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: সেন্ট মার্টিন থেকে ইতিমধ্যে লোকজন সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে। ঘূর্ণিঝড় মোকাবিলায় বাংলাদেশের প্রস্তুতি যথার্থ মনে করেন কি না?

মোস্তফা কামাল: আজ শনিবার সকাল পর্যন্ত সেন্ট মার্টিন দ্বীপে প্রায় আট হাজার মানুষ অবস্থান করছিল বলে নানা সূত্রে জানতে পেরেছি। সকাল পর্যন্ত সহস্রাধিক মানুষ উপকূলে অপেক্ষা করছিল দ্বীপ ছাড়ার জন্য উদ্ধারকারী জাহাজের অপেক্ষায়। তবে আজ সন্ধ্যার পর থেকে আর কোনো মানুষকে দ্বীপ থেকে সরিয়ে নেওয়া সম্ভব হবে না প্রতিকূল আবহাওয়ার জন্য। মডেল অনুসারে ঘূর্ণিঝড়টি যদি সেন্ট মার্টিনে আঘাত হানে, তাহলে দ্বীপের আটকে পড়া মানুষের প্রাণহানির আশঙ্কা রয়ে যাবে। এ আশঙ্কা এড়াতে কমপক্ষে দ্বিতল ভবন বা তার ওপরের স্থাপনায় আশ্রয় নিতে হবে বা সেই ব্যবস্থা করতে হবে।

সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ঘূর্ণিঝড় মোকাবিলায় অনেক প্রস্তুতি নিয়েছে ঠিকই, তবে আমি মনে করি, তা আরও আগে থেকে নেওয়ার দরকার ছিল। এপ্রিল মাসের ২৬ তারিখ থেকেই আবহাওয়া পূর্বাভাস মডেল নির্দেশ করছিল যে ঘূর্ণিঝড়ের কেন্দ্র সেন্ট মার্টিন দ্বীপের ওপর দিয়ে অতিক্রম করবে। লঘুচাপ সৃষ্টি হয়েছিল ৮ মে। অর্থাৎ লঘুচাপ সৃষ্টির পরে পাঁচ দিন অতিবাহিত হলেও সেন্ট মার্টিন দ্বীপ নিয়ে ভাবা হয়নি। সেখানকার সব মানুষকে সরানোর যাবতীয় প্রস্তুতি এবং সে অনুসারে প্রচারণা চালানো হয়নি। এমনকি দ্বীপের মানুষকে সরকারিভাবে সরিয়ে নেওয়া শুরু হয়েছে মাত্র শুক্রবার থেকে। এখানে কোথাও ঘাটতি আছে। সেন্ট মার্টিন থেকে সব মানুষ সরিয়ে ফেলার যথেষ্ট সময় ছিল, কিন্তু সেটিকে কাজে লাগানো হয়নি।

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: মোখার কারণে দেশের অন্যান্য অঞ্চলে কোনো প্রভাব দেখা যেতে পারে কি না?

মোস্তফা কামাল: মোখার কারণে বরিশাল ও খুলনা বিভাগের সব জেলার ওপর মাঝারি থেকে ভারী বৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। ঢাকা, সিলেট ও ময়মনসিংহ বিভাগের জেলাগুলোতে মাঝারি মানের এবং রাজশাহী ও রংপুর বিভাগের জেলাগুলোতে হালকা বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা রয়েছে।
খুলনা বিভাগের জেলাগুলোতে ১৫০ থেকে ২৫০ মিলিমিটার; ঢাকা ও সিলেট বিভাগের জেলাগুলোতে ১০০ থেকে ২০০ মিলিমিটার, রাজশাহী ও রংপুর বিভাগের জেলাগুলোতে ৫০ থেকে ১০০ মিলিমিটার এবং ময়মনসিংহ বিভাগের জেলাগুলোতে ১০০ থেকে ১৫০ মিলিমিটার বৃষ্টির হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: ঘূর্ণিঝড় ‘মোখা’ নিয়ে রেড অ্যালার্ট জারি করেছে দুর্যোগ সতর্কতাবিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা গ্লোবাল ডিজাস্টার অ্যালার্ট অ্যান্ড কো-অর্ডিনেশন সিস্টেম (জিডিএসিএস)। সংস্থাটি এ মুহূর্তে বিশ্বে চলমান দুর্যোগগুলোর মধ্যে ঘূর্ণিঝড় মোখাকে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে উল্লেখ করেছে। ঝুঁকির মাত্রাটা কেমন?

মোস্তফা কামাল: উচ্চ গতিবেগের বাতাস ও ব্যাপক উঁচু জলোচ্ছ্বাসের সৃষ্টির ক্ষমতাসম্পন্ন হওয়ার কারণে ঘূর্ণিঝড় মোখাকে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে উল্লেখ করা হচ্ছে। স্থলভাগে আঘাতের ছয় ঘণ্টার কম সময় আগে ঘূর্ণিঝড়টির সুপার সাইক্লোনে পরিণত হতে পারে। এ কারণে স্থলভাগে আঘাতের সময় ঘূর্ণিঝড়টি ঘণ্টায় ১৮০ থেকে ২০০ কিলোমিটার বেগে আঘাত করার আশঙ্কা রয়েছে। এতেই বোঝা যাচ্ছে, সেন্ট মার্টিন ও উপকূলের মানুষের ওপর ধাক্কাটা কেমন যাবে। সেন্ট মার্টিনে দ্বিতীয়তলার অধিক ভবন খুব বেশি নেই। সে ভবনগুলোতে সর্বোচ্চ তিন থেকে পাঁচ হাজার মানুষকে আশ্রয় দেওয়া সম্ভব হবে। ফলে বাকিদের জীবন ঝুঁকির মুখে থাকবে।

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: ইতিমধ্যে কক্সবাজার এলাকায় ১০ নম্বর বিপৎসংকেত ঘোষণা করা হয়েছে। ঘূর্ণিঝড় মোখা নিয়ে অনেকে ’৯১–এর ঘূর্ণিঝড়ের কথা মনে করছেন। সেই ঘূর্ণিঝড়ে বিপুল ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল। মোখা নিয়ে কি এমন ভয় আছে মনে করেন?

মোস্তফা কামাল: হ্যাঁ, যথেষ্ট কারণ রয়েছে ঘূর্ণিঝড় মোখা নিয়ে দুশ্চিন্তা করার। ঘূর্ণিঝড় মোখার উপকূলে আঘাতের সময় বাতাসের যে সম্ভাব্য গতিবেগের কথা আশঙ্কা করা হচ্ছে, তা ১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়টির গতিবেগের কাছাকাছি। আর একটি মিল হলো ১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়টি যে দিক থেকে অগ্রসর হয়ে ভোলা, নোয়াখালী, চট্টগ্রাম উপকূলে আঘাত করেছিল, প্রায় সেই একই দিক থেকে ঘূর্ণিঝড় মোখা বাংলাদেশের দিকে এগিয়ে আসছে। তা ছাড়া ঘূর্ণিঝড় মোখা শক্তিশালী হওয়ার জন্য অনেক বেশি সময় পেয়েছে ১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়টির তুলনায়। তবে গণযোগাযোগ, যোগাযোগব্যবস্থা ও নানা ব্যবস্থাপনা উন্নতির কারণে ঘূর্ণিঝড় মোখার কারণে ১৯৯১ সালের মতো ক্ষয়ক্ষতি ও প্রাণহানি হওয়ার আশঙ্কা কম।

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: বাংলাদেশের মানুষের জন্য আপনার পরামর্শ কী থাকবে?

মোস্তফা কামাল: দেশের মানুষের জন্য প্রথম পরামর্শ হলো ঘূর্ণিঝড় মোখা যে খুবই শক্তিশালী একটি ঝড় হিসেবে স্থলভাগে আঘাত করতে যাচ্ছে, এ পূর্বাভাসে বিশ্বাস স্থাপন করা। ঘূর্ণিঝড় মোকাবিলায় সরকারের জারি করার নির্দেশনাগুলো মনে চলা। সরকারের প্রতি পরামর্শ হলো বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের গাণিতিক পূর্বাভাস ব্যবস্থা যথেষ্ট সময় আগে দেশের বিভিন্ন মানুষের কাছে পৌঁছাতে হবে। বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়া পূর্বাভাস বিশ্লেষণ ও বিতরণ সক্ষমতার ব্যাপক উন্নতি করতে হবে।