বিশেষ সাক্ষাৎকার মো. হাদিউজ্জামান

আমাদের সড়কের অসুখটা রাজনৈতিক, টেকনিক্যাল নয়

অধ্যাপক মো. হাদিউজ্জামান যোগাযোগবিশেষজ্ঞ এবং বুয়েটের অ্যাকসিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক। সড়কে বিশৃঙ্খলা ও দুর্ঘটনা, মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা ভয়াবহ পর্যায়ে যাওয়ার কারণ, মেট্রোরেল চালুর পর ঢাকা শহরের গণপরিবহনব্যবস্থা ঢেলে সাজানোর সুযোগ—এসব বিষয়ে কথা বলেছেন প্রথম আলোর সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মনোজ দে

প্রথম আলো:

শুরুটা করি এবারের ঈদযাত্রা দিয়ে। ঈদের আগে ও পরে ১৫ দিনে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছেন ৩৬৭ জন। অবকাঠামো খাতে সবচেয়ে বেশি ব্যয়ের পরও কেন সড়কে এই মৃত্যুর মিছিল।

মো. হাদিউজ্জামান: আমাদের সড়ক অবকাঠামো ব্যাপক উন্নত হলেও সড়ক ব্যবস্থাপনা এখনো অনেক দুর্বল। ঈদের আগে ও পরে সেই বিশৃঙ্খলা আরও বেড়ে যায়। এখানে বেশ কিছু চাঁদাবাজির অভিযোগ পাওয়া যায়। বেশি ট্রিপ দেওয়ার জন্য পরিবহনের মালিক ও শ্রমিকদের মধ্যে একটা বেপরোয়া মনোভাব তৈরি হয়। তাঁদের মধ্যে একটা ধারণা আছে যে বেশি ট্রিপ মানেই বেশি আয়।

এই ধারণার কারণে আমাদের চালকদের বিশ্রামের ব্যাপারটা উপেক্ষা করা হয়। যাত্রীদের নিরাপত্তার বিষয়টা হালকাভাবে নেওয়া হয়। ভারী যানবাহন চলাচলের জন্য সড়কে যে লেন থাকার কথা, সেটা নেই। ফলে হালকা যানবাহনগুলো অনেক সময় বারবার ওভারটেক করার চেষ্টা করে। তখন দেখা যায় সড়কে সংঘর্ষ, রক্তক্ষরণ হয়।

ঈদের সময় ঢাকা ছাড়ার যাত্রীর সংখ্যা বহুগুণ বেড়ে যায়। তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে গণপরিবহনের জোগানটা নেই। ফলে আমাদের চাহিদা ও জোগানের মধ্যে একটা অসম প্রতিযোগিতা শুরু হয়। একে জিম্মি করে আমাদের কিছু অসাধু পরিবহন ব্যবসায়ী ভাড়া-নৈরাজ্য শুরু করে দেন। লক্কড়ঝক্কড় বাসগুলোকে সংস্কার ও রংচং করে মহাসড়কে দূরপাল্লার যাত্রায় নামিয়ে দেন। আনফিট গাড়িগুলো ঈদের সময় আরও বেশি বিশৃঙ্খলা তৈরি করে। দুর্ঘটনার ঝুঁকি আরও বাড়িয়ে দেয়। আনফিট গাড়ির চালক যাঁরা, তাঁরাও আনফিট। একজন চালক যদি দক্ষ, অভিজ্ঞ হন, তিনি কখনোই একটি আনফিট গাড়ি নিয়ে সড়কে নামবেন না। আর আনফিট গাড়ি ফিট যানবাহনগুলোকেও ঝুঁকিতে ফেলে দেয়।

ঈদের সময় আমাদের চালকের একটা ব্যাপক সংকট তৈরি হয়। লক্কড়ঝক্কড় বাসগুলোকে রংচং লাগিয়ে হয়তো রাতারাতি সড়কে নামিয়ে ফেলা যায়, কিন্তু এমন কোনো আলাদিনের চেরাগ আমাদের হাতে নেই, যে রাতারাতি দূরপাল্লার চালক বানিয়ে ফেলব। ফলে স্বল্প দূরত্বে যেসব চালক আছেন, বিশেষ করে নগর পরিবহন যাঁরা চালান, তাঁদের হাতেই দূরপাল্লার বাসের স্টিয়ারিং ধরিয়ে দেওয়া হচ্ছে।

এ ছাড়া আমরা মোটরসাইকেলকে মিনি গণপরিবহনে পরিণত করেছি। মোটরসাইকেলের চালকদের দূরপাল্লায় চালানোর মতো অভিক্ষতা, দক্ষতা ও শারীরিক ফিটনেস না থাকায় ঈদের সময় দুর্ঘটনা বাড়ছে। সড়ক আমরা আধুনিক করেছি ঠিকই, কিন্তু মোটরসাইকেলের উপযোগী অবকাঠামো কি না, সেটা একটা বিরাট প্রশ্ন। এ কারণে ঈদের সময় মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা বহুগুণ বেড়ে যাচ্ছে। ফলে সামগ্রিকভাবে ঈদের সময়ে দুর্ঘটনার পরিসংখ্যানে আমরা একটা বড় ঝাঁকুনি দেখছি।

প্রথম আলো:

সারা বছর দুর্ঘটনা ও হতাহতের চিত্র যে এর চেয়ে খুব একটা ভালো, তা বলার উপায় নেই। আমরা কি বলতে পারি না, সড়কে সারা বছর ধরেই হত্যাকাণ্ড চলছে?

মো. হাদিউজ্জামান: আমাদের যাঁরা নীতিনির্ধারক, তাঁদের মধ্যে একটা আত্মতৃপ্তি আছে যে আমরা তো সড়ক প্রশস্ত করে ফেলেছি, বহু এক্সপ্রেসওয়ে করেছি, নতুন নতুন সড়ক-মহাসড়ক-সেতু করে ফেলেছি।

কিন্তু সড়ককে নিরাপদ করার জন্য বিজ্ঞানসম্মত কাজগুলো করার কথা, সেখানে একটা জায়গাতেও কাজ হয়নি। পৃথিবীতে এমন কোনো দেশ কি আছে, যেখানে পাইকারিভাবে ফিটনেস সনদ দেওয়া হয়। বহু মালিক আছেন, যাঁরা ফিটনেস সনদ নেওয়ার প্রয়োজনীয়তা অনুভবই করেন না। কারণ তাঁরা জানেন যে সড়ক-মহাসড়কে বিভিন্নভাবে ম্যানেজ করে চলা যায়। তাঁদের সরকার বহুবার ছাড় দিয়েছে।

এমনকি ২০১০ সালে একবার ১০ বছর ধরে যেসব যানবাহন ফিটনেস সনদ নেয়নি, সেগুলোর নিবন্ধন বাতিল করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। সেখান থেকে সরকারকে পিছু হটতে হয়েছে। এরপর সরকার জরিমানা দিয়ে ও যথাযথ সরকারি ফি দিয়ে ফিটনেস সনদ নেওয়ার জন্য বলেছিল। সেখান থেকেও পিছু হটে বলা হলো, জরিমানা দেওয়ারও দরকার নেই, শুধু ফি দিয়ে ফিটনেস সনদ নিতে। এরপরও বিপুলসংখ্যক মালিক ফিটনেস সনদ নেওয়ার প্রয়োজন বোধ করেননি।

অভিজ্ঞতার সনদের ক্ষেত্রেও অনেকবার আপস করা হয়েছে। হালকা গাড়ির চালকদের মাঝারি গাড়ি চালানোর ক্ষেত্রে তিন বছরের অভিজ্ঞতা থাকার কথা বলা হয়েছিল। মাঝারি যানের চালকদের ভারী যানবাহন চালানোর ক্ষেত্রেও তিন বছরের অভিজ্ঞতা থাকার কথা। এ জায়গায় আপস করা হয়েছে। এক বছর অভিজ্ঞতা থাকলেই মাঝারি যানের চালকদের ভারী যানবাহন চালানোর সুযোগ দেওয়া হচ্ছে।

ভারী যানবাহনের লাইফটাইম (আয়ুষ্কাল) নির্ধারণের ক্ষেত্রেও সরকারকে পিছু হটতে হয়েছে। পৃথিবীর কোনো দেশ আছে, যেখানে বাস, ট্রাক এসব ভারী যানের অর্থনৈতিক লাইফটাইম নির্ধারণ করা হয়নি? সরকার ভারী যানের লাইফটাইম নির্ধারণ করল, কিন্তু তিন মাসের মধ্যেই প্রজ্ঞাপন স্থগিত করতে হলো।

আমাদের নীতিনির্ধারকদের বুঝতে হবে, তাঁরা কার সঙ্গে আপস করছেন। তাঁদের বুঝতে হবে, তাঁরা আসলে বিজ্ঞানের সঙ্গে আপস করছেন। বিজ্ঞানের সঙ্গে আপস করার মানেই হচ্ছে দুর্ঘটনার সঙ্গে আপস করা।

প্রথম আলো:

সড়ক পরিবহন আইনের ক্ষেত্রেও আমরা বড় আপস করতে দেখলাম।

মো. হাদিউজ্জামান: তিন দশক পর প্রথম একটি আইন তৈরি হচ্ছিল সড়কে শৃঙ্খলা ফেরানোর জন্য। কিন্তু দুঃখজনক সত্যি হলো, একটা গোষ্ঠীর চাপে পড়ে প্রয়োগের আগেই আইনটি খণ্ড-বিখণ্ড করে পোস্টমর্টেম করা হলো। এই আইনের বিভিন্ন ধারায় যে সংশোধনী আনা হয়েছে, সেটা অনেকটাই সমঝোতার দলিল হয়ে গেছে। একটা গোষ্ঠীকে শাস্তির হাত থেকে রেহাই দেওয়ার জন্য আইনটাকে সংকুচিত করা হয়েছে। যে আইনভিত্তিক পরিবহনব্যবস্থা গড়ে তোলার উদ্দেশ্য নিয়ে আইনটি করা হয়েছিল, সেটা শুরুতেই বড় ধরনের হোঁচট খেয়েছে।

বিভিন্ন গোষ্ঠীর চাপে পড়ে অথবা অনেক সময় সংকটের কথা বলে একটা আপসের সংস্কৃতি তৈরি হয়েছে। সড়ক অবকাঠামো চওড়া হচ্ছে, আধুনিক হচ্ছে, কিন্তু পাল্লা দিয়ে পরিবহন, চালক ও আইন যেমনটা স্মার্ট হওয়ার কথা, সেটা হয়নি।

প্রথম আলো:

তাহলে কি আমাদের নীতিনির্ধারকেরা অবকাঠামো উন্নয়নে যতটা আগ্রহী, ঠিক তার উল্টোটা সড়কে নিরাপত্তা নিশ্চিতের ক্ষেত্রে?

মো. হাদিউজ্জামান: আমাদের নীতিনির্ধারকেরা অবকাঠামোকে সব সময় সামনে আনছেন। অবকাঠামো খাতে সব সময় ব্যাপক বিনিয়োগ হয়। বিনিয়োগ যেখানে আছে, সেখানে আগ্রহটা অনেক বেশি। ফলে অবকাঠামো উন্নয়নের ক্ষেত্রে আমরা হুমড়ি খেয়ে পড়ছি। কিন্তু যানবাহন ব্যবস্থাপনা, সড়কে নৈরাজ্য ঠেকাতে যে ব্যবস্থাপনা দরকার, মানুষকে জিম্মিদশা থেকে বের করে আনার জন্য যেসব কাজ করার কথা, সেটা আসলে বিনিয়োগের বিষয় নয়। এটি আসলে দরদ দিয়ে কাজ করার বিষয়। যেখানে বিনিয়োগ নেই শুধু দরদ দরকার, সেখানে আমাদের নীতিনির্ধারকদের আগ্রহ নেই।

সড়ক, মহাসড়কে প্রতিদিনই নতুন নতুন যানবাহন নামছে, চালক নামছেন, পথচারী নামছেন। দরদ দিয়ে ২৪ ঘণ্টা, ৭ দিন, ৩৬৫ দিন সেখানে কাজ করতে হবে। আমি বলব, আমাদের নীতিনির্ধারকদের মধ্যে সেই দরদ কাজ করছে না। তাঁদের মধ্যে একটা ধারণা আছে যে সড়ক দুর্ঘটনা কমানো একটা স্বল্পকালীন প্রকল্প। কিন্তু একে স্বল্পকালীন প্রকল্প হিসেবে দেখার সুযোগ নেই।

অধ্যাপক মো. হাদিউজ্জামান
ছবি: সাজিদ হোসেন
প্রথম আলো:

সাম্প্রতিক বছরগুলোয় আমরা দেখছি, সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু হচ্ছে, তার প্রায় ৪০ শতাংশই মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় দেশগুলোতে জনসংখ্যার বিপরীতে আমাদের চেয়ে অনেক বেশি মোটরসাইকেল চলে। আমাদের এখানে কেন এত বেশি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা?

মো. হাদিউজ্জামান: গণপরিবহনের সংকটের অজুহাতে আমাদের নীতিনির্ধারকদের যাঁরা মোটরসাইকেলকে উৎসাহ দিচ্ছেন, তাঁরা আসলে মোটরসাইকেলকে বিক্ষিপ্তভাবে দেখেছেন। শুধু মোটরসাইকেল নয়, সব যানবাহনকে তাঁরা বিক্ষিপ্তভাবে দেখেন। কিন্তু আমাদের মোটরসাইকেল আমাদের সড়কের উপযোগী কি না, সড়কে আলাদা লেন আছে কি না, মোটরসাইকেল চালকদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার ব্যবস্থা আছে কি না, ড্রাইভিং লাইসেন্সের ব্যাপারটা কতটা বৈজ্ঞানিক ও আধুনিক করা গেছে—এভাবে সামষ্টিকভাবে তারা চিন্তা করেন না।

মোটরসাইকেলের মতো যান আমাদের সড়কের উচ্ছৃঙ্খল ও বিশৃঙ্খল পরিস্থিতিকে আরও নাজুক করেছে। ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া কিংবা চীনের ক্ষেত্রেও মোটরসাইকেলের মালিকানা অনেক বেশি। দেখা যায়, প্রতি ১ হাজার জনসংখ্যার বিপরীতে প্রায় ৫০০টি মোটরসাইকেল আছে। আমাদের এখানে ১ হাজার জনের বিপরীতে মালিকানা ৩০ জনের মতো। আমাদের মোটরসাইকেলের বাজার এখনো বিকাশমান। কিন্তু আমরা এখনই দেখছি, মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় আমরা এশিয়ায় শীর্ষে।

সহজলভ্য হওয়ায় মোটরসাইকেল এখন অনেকের জীবন ও জীবিকার জন্য বড় একটা মাধ্যম হয়ে গেছে। কিন্তু মোটরসাইকেলের জন্য সড়ক অবকাঠামো যেভাবে তৈরি করা দরকার ছিল, সেখানে কাজ করা হয়নি। মোটরসাইকেলকে আমরা যদি আমাদের পরিবহনব্যবস্থার অভিন্ন অংশ মনে করি, তাহলে সড়ক-মহাসড়কগুলো সেভাবে প্রস্তুত করতে হবে।

কিন্তু মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় যেভাবে নিহত হচ্ছে, স্থায়ীভাবে পঙ্গুত্ব বরণ করছে, সেই পরিসংখ্যান ভয়াবহ। আমরা একটি ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডের মধ্যে আছি—এটা বলে নীতিনির্ধারকেরা একটা আত্মতৃপ্তিতে ভুগতে পারেন। কিন্তু আমরা যারা গবেষণা করছি, তারা দেখছি যে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় সবচেয়ে বেশি নিহত হচ্ছেন কর্মক্ষম মানুষ। ফলে আমাদের জনমিতিক সুবিধা কিন্তু ড্রেন-আউট হয়ে যাচ্ছে। আমাদের যে পরিসংখ্যান (যদিও আমি মনে করি সেটা অপূর্ণাঙ্গ ও অবৈজ্ঞানিক) তা থেকে দেখছি, প্রতিবছর সড়ক দুর্ঘটনা ও হতাহতের কারণে যে ক্ষতি হচ্ছে, তার অর্থনৈতিক মূল্যে ৪০ হাজার কোটি টাকা। আমি মনে করি, একটা নীতি তৈরির আগে, সেই নীতির পেছনে যে গবেষণা থাকা দরকার, সেটা একেবারে অনুপস্থিত। মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা কমাতে গেলে নীতি সহায়তা লাগবে। সেটা পরিপক্ব ও বৈজ্ঞানিক হতে হবে।

প্রথম আলো:

মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় যাঁরা হতাহত হচ্ছেন, তাঁদের একটা বড় অংশ কিশোর বয়সী। ক্ষতিটা তো কোনো কিছু দিয়েই পূরণ হওয়ার নয়।

মো. হাদিউজ্জামান: সড়ক দুর্ঘটনায় যাঁরা হতাহত হচ্ছেন, তাঁদের বড় একটা অংশের বয়স ১৫ থেকে ১৮ বছরের মধ্যে। তাঁদের ড্রাইভিং সনদ থাকার প্রশ্নই আসে না। আমাদের উঠতি বয়সী কিশোর-তরুণেরা নজরদারির অভাবে ও অভিভাবকদের অসচেতনতার কারণে, মোটরসাইকেল নিয়ে সড়ক-মহাসড়ককে রেসিং ট্র্যাক বানিয়ে প্রতিযোগিতা করছেন। অকালে তাঁদের প্রাণ ঝরে যাচ্ছে।

এসব কিশোর-তরুণের পছন্দের শীর্ষে থাকছে স্পোর্টি ও উচ্চ গতির মোটরসাইকেল। অথচ আমাদের নীতিনির্ধারকেরা বলছেন, সিসির সঙ্গে গতির কোনো সম্পর্ক নেই। এটা অনেকটাই কল্পনাপ্রসূত কথাবার্তা। যেখানে পৃথিবীর উন্নত দেশগুলো, যাদের সড়কে ব্যাকরণ আছে, সড়কে লেনভিত্তিক গাড়ি পরিচালনা হয়, যাঁরা মোটরসাইকেল চালান সঠিকভাবে, তাঁরা ড্রাইভিং লাইসেন্স পান, সেসব দেশেই দেখা যাচ্ছে প্রতি ১০০ সিসি ইঞ্জিনের সক্ষমতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সড়কে হতাহতের সংখ্যা প্রায় আড়াই শতাংশ বেড়ে যায়।

অথচ আমাদের সড়কে যেখানে শৃঙ্খলার কোনো বালাই নেই, সেখানে বলা হচ্ছে, সিসির সঙ্গে গতির কোনো সম্পর্ক নেই। এ ধরনের হায়ার সিসি মোটরসাইকেলে যখন কিশোর-তরুণেরা বসবেন, সব সময় তাঁদের প্রলোভিত করবে উচ্চ গতিতে চালানোর। এ ধরনের মোটরসাইকেলের টর্ক, পাওয়ার ও গতি বাড়ানোর সক্ষমতা এতটাই মসৃণ যে ওঠামাত্রই দেখা যাবে গতি ১০০ কিলোমিটারে চলে গেছে। আমাদের নীতিনির্ধারকদের ভাবতে হবে উচ্চ গতির মোটরসাইকেল কোথায় চালানো হবে? আমাদের মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার ৬০ শতাংশ হয় মহাসড়কে।

প্রথম আলো:

নীতি প্রণয়নের ক্ষেত্রেও তো মন্ত্রণালয়গুলোর মধ্যে সমন্বয় নেই...

মো. হাদিউজ্জামান: নীতিগুলো নিচ্ছে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয়গুলোর মধ্যে সমন্বয়হীনতা এখানে বড় একটা বিষয়। এটা সত্যি যে এই সমন্বয়ের বিষয় জটিল ও চ্যালেঞ্জিং। আমাদের সড়ক-মহাসড়ক বিভাগ সড়ক তৈরি করছে যানবাহনের গতি বাড়ানোর জন্য। সেখানে ভারী যানবাহন চলবে। আবার শিল্প মন্ত্রণালয় মোটরসাইকেল দিয়ে শিল্প বিকাশের কথা বলছে। তাহলে দুর্ঘটনার দায় কে নেবে?

আমরা যদি সামষ্টিকভাবে চিন্তা করি, তাহলে কিন্তু মহাসড়কে উচ্চ গতির মোটরসাইকেল চালাতে আমরা প্রস্তুত নই। উচ্চ গতির মোটরসাইকেলগুলো কারা চালাবেন, কোথায় চলবে—এই নীতি ও পরিকল্পনায় যে দুর্বলতা, সেটাই আমাদের দুর্ঘটনার বর্তমান যে নাজুক পরিসংখ্যান, সামনে সেখানে আরও বড় ঝাঁকুনি দেবে। এই ঝাঁকুনি নেওয়ার সক্ষমতা আমাদের কতটুকু, সেটাই বড় প্রশ্ন। আমরা জাতিসংঘকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম, ২০২০ সালের মধ্যে আমরা সড়কে দুর্ঘটনা ৫০ শতাংশ কমিয়ে আনব। আমরা সেই প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে পারিনি। সময়টা আবার বাড়িয়ে ২০৩০ করেছি। কিন্তু আমরা দেখছি, প্রতিবছরই সড়ক দুর্ঘটনার রেখাচিত্র ঊর্ধ্বমুখী হচ্ছে।

প্রথম আলো:

সবাই বলছে ও সবাই জানে, ফিটনেসবিহীন যান, লাইসেন্সবিহীন চালক, ক্লান্তি নিয়ে গাড়ি চালানো, অবৈধ যান—এগুলোই সড়ক দুর্ঘটনার প্রধান কারণ। কিন্তু সমাধান কেন হয় না?

মো. হাদিউজ্জামান: জানা ও মানার বিষয়টা শুরু হতে হবে পরিবহনমালিকদের কাছ থেকে। কিন্তু সমস্যা হলো, আমাদের পরিবহনমালিকেরা পরিবহনের ব্যবসায়ী হয়ে গেছেন। ঝুঁকি উপলব্ধির বোধ তাঁদের খুবই দুর্বল। আনফিট গাড়ি, আনফিট চালক, অনিবন্ধিত চালক, অবৈধ যানবাহন যখন সড়কে চলছে, এটার যে প্রতিঘাত, সেটা তাঁরা মোটেই আমলে নেন না। দুর্ঘটনা ঘটলে মরবেন চালক, মরবেন যাত্রী, বাসমালিকদের তো কোনো সমস্যা নেই। মালিকদের মধ্যে একটা উদাসীনতা আছে।

পাশাপাশি মালিকদের মানানোর জন্য যে রাজনৈতিক সদিচ্ছার দরকার, সেখানে ঘাটতি আছে। কারণ, যাঁরা বাসমালিক, তাঁরাই সুবিধাভোগী, তাঁরাই সিদ্ধান্ত নেওয়ার সব কমিটিতে বসে আছেন, তাঁদের কেউ কেউ সরকারের মধ্যেও বসে আছেন। এটা একটা বিশাল সিন্ডিকেট, একটা আনহোলি নেক্সাস। এই সিন্ডিকেটের কাছে আমরা সবাই অসহায়। সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকলে এই সিন্ডিকেট ভাঙা যাবে না, সেটা আমি বিশ্বাস করি না। প্রশ্ন হলো, সরকার সেটা চাইছে কি না।

প্রথম আলো:

বাংলাদেশের মধ্যে সবচেয়ে সড়ক দুর্ঘটনাপ্রবণ এলাকা রাজধানী ঢাকা। সারা দেশে যত সড়ক দুর্ঘটনা সংঘটিত হয়, তার এক-চতুর্থাংশ হয় শহরাঞ্চলের সড়ক-মহাসড়কগুলোয়। আর শহরের সড়কে যত দুর্ঘটনা ঘটে, তার ৭৪ শতাংশই হয় রাজধানী ঢাকায়। একটা রাজধানী শহরের সড়ক কীভাবে এতটা দুর্ঘটনাপ্রবণ ও বিশৃঙ্খল হয়?

মো. হাদিউজ্জামান: বিশৃঙ্খলা শুরুই হয় রাজধানীতে পরিবহনগুলোর মধ্যে রেষারেষি, পাল্লাপাল্লি থেকে।

একে আমি ক্যানাবালিজম মনে করি। যাত্রী ধরতে গিয়ে কে কাকে খেয়ে ফেলবে, তারই অসম প্রতিযোগিতা। ঢাকার ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা খুবই দুর্বল। এখনো আমরা সেকেলে, অনেকটা হাতের ইশারায়, বাঁশি বাজিয়ে, হাতে লাঠি দিয়ে, চোখে লেজার লাইট মেরে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করছি।

মেট্রোরেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের মতো অত্যাধুনিক অবকাঠামো তৈরি হয়েছে, সেখানে ট্রাফিকব্যবস্থা সেকেলেই রয়ে গেছে। আমরা কেন একটা আধুনিক ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায় যেতে পারছি না, তার পেছনকার কারণটাও রাজনৈতিক। এই ঢাকা শহরের সড়কে এখনো প্রায় ১৮ সংস্করণের যানবাহন চলছে। রিকশা, ঠেলাগাড়ি, ঘোড়ার গাড়ি, ছোট, বড়, হালকা, ভারী, দ্রুতগতি—সব যান একসঙ্গে চলছে।

রাজনৈতিক বিবেচনায় নয়, বিজ্ঞান বিবেচনায় নিয়ে আমরা যদি সড়কে যানবাহনের সংস্করণ কমিয়ে আনতে পারি, তাহলে লেনভিত্তিক গাড়ি চালানো সম্ভব। সড়কে গতিসীমা নির্ধারণ করে, যেসব যানবাহন এই গতিসীমায় চালাতে সক্ষম, সেগুলো রেখে, ট্রাফিক সিগন্যালকে স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থাপনায় এনে, একটা চমৎকার ও আধুনিক সড়ক নেটওয়ার্ক আমরা তৈরি করতে পারি।

আলাদা লেন থাকলে, সময়সূচি ধরে ধরে গণপরিবহন চলার যে দর্শন, সেটা প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হতো।

বাসগুলোকে একটা কোম্পানি বা ছাতার নিচে এনে গণপরিবহনগুলোকে একটা চমৎকার শৃঙ্খলা ও লাভজনক করা যেত। দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে, ঢাকা শহরে যাঁরা সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান, তাঁদের ৬০ শতাংশ পথচারী। তাঁদের দুর্ঘটনার পেছনে ভারী যানবাহনের সম্পর্ক আছে। পুরো বিশ্বেই যখন গণপরিবহন যেখানে বাস রুট ফ্র্যাঞ্চাইজি—এই দর্শনে চলে, সেখানে উদ্যোগ নেওয়ার পরও আমরা সেটা বাস্তবায়ন করতে ব্যর্থ হয়েছি।

এর কারণ হচ্ছে, এর জন্য যে পূর্বপ্রস্তুতি থাকা দরকার ছিল, সেটা আমাদের নেই। সড়কে বিশৃঙ্খলার জন্য দায়ী আনফিট গাড়ি, অদক্ষ চালক রেখেই আমরা পরীক্ষামূলকভাবে বাস রুট ফ্র্যাঞ্চাইজি করেছি। ফলে হোঁচট খেয়েছি। পুরো বিশ্বের জন্য মডেল বাস রুট ফ্র্যাঞ্চাইজির, সেই ভালো মডেলটাও আমরা নষ্ট করেছি। আমাদের সড়কের অসুখটা রাজনৈতিক, এটা কোনো টেকনিক্যাল অসুখ নয়।

প্রথম আলো:

একদিকে মেট্রোরেল অন্যদিকে ঢাকার সড়কে লক্কড়ঝক্কড়, রংচটা ও ফিটনেসবিহীন বাস। বাসে বাসে রেষারেষি, সারা সড়কই স্টপেজ। মেট্রোরেল আসার পর একটি গতিশীল, সুশৃঙ্খল, আধুনিক গণপরিবহনব্যবস্থা কি গড়ে তোলার সময় হয়নি?

মো. হাদিউজ্জামান: পুরো ঢাকায় ৮০০-এর বেশি বাস স্টপেজ আছে। এর মানে ২০০-৩০০ মিটার পরপর বাস থামছে। আসলে ঢাকা শহরের পুরোটাই একটা বাস স্টপেজ। মেট্রোরেল চালু হওয়ার পর নিচের সড়কের একটা ব্যাপক উপযোগিতা তৈরি হয়েছে। কারণ, নিচের সড়কে যাঁরা গণপরিবহন ব্যবহার করতেন, তাঁদের একটা বড় অংশ মেট্রোরেলে চলে গেছে। পাশাপাশি যাঁরা ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহার করেন, তাঁদেরও একটা অংশ মেট্রোর যাত্রী। ফলে নিচের সড়কের ওপর চাপ অনেকটা কমেছে। সেটা প্রসারিতও হয়েছে। সেই সুযোগকে আমাদের বাসমালিকেরা নিতে পারতেন।

তাঁদের অভিযোগ হলো, দিনে যতগুলো ট্রিপ দেওয়ার কথা, তাঁরা সেটা পারেন না। সে কারণে তাঁরা লোকসানে থাকেন। এখন কিন্তু একটা সময়সূচিভিত্তিক গণপরিবহনব্যবস্থা চালু করার সুযোগ ছিল। বাসমালিকেরা যদি এখন ভালো মানের বাস ও যাত্রীচাহিদা অনুযায়ী বাস নামাতে পারেন, তাহলে মেট্রোর যে যাত্রী, তার বড় একটা অংশ তাঁদের বাসে চলে আসার কথা। কারণ, মেট্রোর ভাড়া বাসের ভাড়ার প্রায় দ্বিগুণ। আমি মনে করি, এত দিন বিকল্প না থাকায় আমরা বাসমালিকদের কাছে জিম্মি হয়ে ছিলাম। এখন বিকল্প মেট্রো এসেছে। ফলে বাসমালিকদের এখন ভাবতে হবে।

ঢাকার পরিবহনমালিক প্রায় তিন হাজার। যেকোনো একটা শহরে এতসংখ্যক মালিকের নজির নেই। এর মানে, আমরা রুট পারমিট দিয়েছি অবৈজ্ঞানিকভাবে। যাঁরা পরিবহন নেতা আছেন, তাঁদের কাছে রুট পারমিট পাওয়া মানে বিশাল ব্যবসা। একেবারে বিনিয়োগ ছাড়া মুনাফার সুযোগ। ঢাকা শহরে ৪০ থেকে ৪২টির বেশি রুট দরকার নেই। কোনো একটা রুটে দেখা যায় যে অনেকগুলো পরিবহন চলছে, আবার একই পরিবহনের মধ্যে অনেক মালিক আছেন। ঢাকার বাসে বাসে রেষারেষি কিন্তু এই কারণেই হয়।

সরকারের কাজ রুটগুলোকে বৈজ্ঞানিকভাবে তৈরি করে দেওয়া, অবকাঠামোগুলো তৈরি করে দেওয়া।

মেট্রোর মতো আধুনিক যান যেখানে এসেছে, আমি মনে করি, আমাদের সময় এসেছে, বাসমালিকদের দিকে শুধু না তাকিয়ে, প্রয়োজনবোধে আন্তর্জাতিক উন্মুক্ত দরপত্র আহ্বান করা। প্রয়োজনে বাইরের অপারেটরদের, যাদের বড় শহরে গণপরিবহন পরিচালনার অভিজ্ঞতা আছে, তাদের আসার সুযোগ করে দেওয়া। এখানে নীতি দরকার, রাজনৈতিক অঙ্গীকার দরকার, যারা অপারেটর আসবে, তাদের সমর্থন দেওয়া দরকার।

পৃথিবীর আর কোনো শহরে ঢাকার মতো গণপরিবহনের এত চাহিদা আছে কি না, আমার জানা নেই। লক্কড়ঝক্কড় বাসেই আমরা দেখছি, ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ যাত্রী ওঠেন। ভালো মানের ও সুশৃঙ্খল গণপরিবহন দেওয়া গেলে যাত্রীসংখ্যা ৬০ শতাংশে চলে যাবে। আমরা মেট্রোর পেছনে ২৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করছি। আমার ধারণা, আমরা ১ বিলিয়ন বিনিয়োগ করলে ঢাকার গণপরিবহনব্যবস্থা খোলনলচে পাল্টে দেওয়া সম্ভব।

প্রথম আলো:

দুর্ঘটনার জন্য কাউকে দায় নিতে, কিংবা জবাবদিহি করতে দেখি না। এই দায়হীনতার সংস্কৃতির নির্মম শিকার কি মানুষ হচ্ছে না?

মো. হাদিউজ্জামান: আমাদের অনেক নীতিনির্ধারকের ধারণা সড়ক চওড়া করলে দুর্ঘটনা এমনি এমনিই কমে যাবে। সড়কে সুশাসন, আইন প্রয়োগের জায়গাটা দরকার নেই। এই ধারণা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। সড়ক দুর্ঘটনা কোনো একক বিষয়ের কারণে হয় না। অনেকগুলো বিষয় এখানে কাজ করে। এসব বিষয় নিয়ন্ত্রণ করার জন্য অনেকগুলো প্রতিষ্ঠান আছে। কিন্তু আমাদের দায় না নেওয়ার যে সংস্কৃতি, সেটাও সড়ক দুর্ঘটনা না কমার পেছনে একটা বড় কারণ।

দুর্ঘটনা ঘটলে, সড়কে নকশাগত ত্রুটি আছে কি না, সেটা অনুসন্ধান করার প্রয়োজনীয়তা আমরা অনুভব করছি না। বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে কিংবা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে যানবাহনের ফিটনেস সনদ দেওয়া হচ্ছে কি না, কেন অনেক মালিক ফিটনেস সনদ নিতে অনুৎসাহিত হচ্ছেন, সেই দায় কিন্তু কেউ নিচ্ছে না। দক্ষ চালক তৈরির জন্য যেভাবে বৈজ্ঞানিকভাবে পরীক্ষা নেওয়ার কথা, সেটা যে হচ্ছে না, তার জবাবদিহিও কেউ করছে না। এমনকি মহাসড়কগুলোয় ধীর গতির যান চলার কথা নয়, কিন্তু ম্যানেজ করে সেগুলো চলছে। যাদের ম্যানেজ করে সেগুলো চলছে, তাদের আইনের আওতায় আনা হচ্ছে না, সেটার দায়ও কেউ নিচ্ছে না। আমাদের মধ্যে বদ্ধমূল ধারণা তৈরি হয়েছে, দায় নেওয়ার মানে হলো, পরাজিত হওয়া।