বিশেষ সাক্ষাৎকার: সায়েরা বানু

আমাদের যক্ষ্মা গবেষণা অন্য দেশে ছড়িয়ে দেওয়ার সময় এসেছে

ড. সায়েরা বানু আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণাকেন্দ্র, বাংলাদেশের (আইসিডিডিআরবি) ইনফেকশাস ডিজিজেস ডিভিশনের ইমার্জিং ইনফেকশন্স কর্মসূচির প্রধান। আড়াই দশক ধরে তিনি যক্ষ্মা নিয়ে গবেষণা করছেন। বিশ্ব যক্ষ্মা দিবস উপলক্ষে প্রথম আলোর সঙ্গে তিনি আইসিডিডিআরবির যক্ষ্মাবিষয়ক কাজ, জাতীয় যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির বর্তমান পরিস্থিতিসহ নানা বিষয়ে কথা বলেছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন শিশির মোড়ল

প্রথম আলো:

জগতে গবেষণা করার কত বিষয় আছে, কত রোগ আছে, আপনি যক্ষ্মা নিয়ে গবেষণা করলেন কেন?

সায়েরা বানু: গবেষণার প্রতি আগ্রহ থাকার কারণে এমবিবিএস পাস করার কিছু পরে ১৯৯১ সালে আমি আইসিডিডিআরবিতে যোগ দিই। পরবর্তী সময় জাপানে যাই। সেখানে অন্যান্য সংক্রামক রোগের পাশাপাশি যক্ষ্মা বিষয়ে কাজ করি। আমি মেডিকেল সায়েন্স বিষয়ে জাপানে মাস্টার ডিগ্রি নিয়েছিলাম। জাপান থেকে দেশে ফেরার পর প্যারিসের লুই পাস্তুর ইনস্টিটিউটে যক্ষ্মা নিয়ে পোস্টগ্র্যাজুয়েট ট্রেনিং নেওয়ার সুযোগ আসে। সারা দুনিয়ায় সাড়াজাগানো যক্ষ্মার জিনোম সিকোয়েন্স করা বিজ্ঞানী স্টুয়ার্ট কোলের তত্ত্বাবধানে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করি। সেই সময় আইসিডিডিআরবিতে যক্ষ্মার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে কোনো কাজ ছিল না।

সংক্ষেপে বলা যায় তিনটি কারণে যক্ষ্মার প্রতি আগ্রহ হয়: যক্ষ্মার সমস্যাটি বড়; আইসিডিডিআরবিতে যক্ষ্মা নিয়ে কোনো কাজ তখন ছিল না; এবং গবেষণার অনেক সুযোগ ছিল। প্যারিস থেকে ফিরে আমি ছোট আকারে টিবি ল্যাব তৈরি করে যক্ষ্মার কাজ শুরু করি।

প্রথম আলো:

বাংলাদেশে যক্ষ্মা এখন কত বড় সমস্যা? কেন যক্ষ্মাকে এখনো গুরুত্ব দিতে হবে?

সায়েরা বানু: বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার রিপোর্ট অনুযায়ী, দেশে ২০২২ সালে আনুমানিক ৩ লাখ ৭৯ হাজার মানুষ যক্ষ্মায় আক্রান্ত হয় এবং ৪২ হাজার মানুষ যক্ষ্মায় মারা যায়। এ ছাড়া ৪ হাজার ৯০০ মানুষ ওষুধ প্রতিরোধী যক্ষ্মায় (এমডিআর) আক্রান্ত হয়। ২০২২ সালে ২ লাখ ৬২ হাজার ৭৩১ যক্ষ্মা রোগী শনাক্ত হয়, যা আক্রান্ত ব্যক্তিদের ৬৯ শতাংশ। অর্থাৎ ৩১ শতাংশ ব্যক্তি রোগ শনাক্তের বাইরে রয়ে যায় এবং এমডিআর টিবি আক্রান্ত ব্যক্তিদের মধ্যে প্রায় ৩ হাজার ৫০০ জন শনাক্ত হচ্ছে না। এসব মানুষ সাধারণ যক্ষ্মা বা ওষুধ প্রতিরোধী যক্ষ্মা ছড়াচ্ছে।

আমরা দেখেছি, মানুষ সহজে যক্ষ্মা পরীক্ষা করায় না। পরিস্থিতি অনেক খারাপ হওয়ার পর পরীক্ষা করাতে বা চিকিৎসকের কাছে আসে। দেশে রোগী শনাক্তের কাজে ৫০ শতাংশ ক্ষেত্রে জিন-এক্সপার্ট যন্ত্র ব্যবহার করা হয়। বাকি ৫০ শতাংশ ক্ষেত্রে সনাতন অণুবীক্ষণযন্ত্র ব্যবহৃত হয়। দরকার সব ক্ষেত্রে জিন-এক্সপার্ট যন্ত্র ব্যবহার করা। আমাদের দেশে শিশুদের যক্ষ্মা ঠিকমতো শনাক্ত হচ্ছে না। মোট যক্ষ্মা শনাক্তের ৮ থেকে ১২ শতাংশ শিশু হওয়ার কথা, কিন্তু শনাক্ত হচ্ছে ৪ শতাংশ। অর্থাৎ অনেক শিশুর যক্ষ্মা থাকলেও তারা শনাক্ত হচ্ছে না, চিকিৎসার আওতায় আসছে না।

এসব পরিসংখ্যান থেকে বোঝা যায়, সমস্যাটি অনেক বড়। যক্ষ্মার বিষয়ে আমাদের আরও মনোযোগী হওয়া কেন দরকার।

প্রথম আলো:

সমস্যা যদি এত বড় থেকেই থাকে, তাহলে এতকাল সরকার ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো কী করল?

সায়েরা বানু: আমাদের দেশে সম্পদের স্বল্পতা আছে। এ দেশে যক্ষ্মা নির্ণয়, চিকিৎসা সবকিছু সব মানুষকে বিনা মূল্যে দেওয়া হয়। এখনো অনেক মানুষ জানে না যে সরকার যক্ষ্মার চিকিৎসা বিনা মূল্যে দিচ্ছে। আমি মনে করি, সরকারের সেবা বিষয়ে মানুষের ধারণা কম। এ ক্ষেত্রে সচেতনতার ঘাটতি আছে বলে আমি মনে করি। যক্ষ্মার মতো রোগের বিরুদ্ধে যুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন দরকার। সেই সামাজিক আন্দোলন আমাদের নেই।

প্রথম আলো:

দেশে যক্ষ্মা নিয়ে সরকার ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো কে কী করছে? আইসিডিডিআরবি কী করছে?

সায়েরা বানু: জাতীয় কর্মসূচি বাস্তবায়ন করে সরকার। এতে সহযোগিতা করে ব্র্যাক, ডেমিয়েন ফাউন্ডেশনসহ অনেকগুলো এনজিও। আইসিডিডিআরবিও সরকারকে সহায়তা করে। আইসিডিডিআরবি যক্ষ্মা-সংশ্লিষ্ট অনেক গুরুত্বপূর্ণ গবেষণার কাজ করেছে। এই যেমন ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে যক্ষ্মার প্রকোপ ২০ গুণ বেশি। আইসিডিডিআরবি সেখানে ২০০৫ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত কাজ করে। প্রতিদিন দুজন কর্মী সেখানে যেতেন। তাঁরা ‘আমদানিতে’ স্ক্রিনিং করতেন। রোগী শনাক্ত হলে তাঁদের আলাদা করা হতো। একপর্যায়ে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার হাসপাতালের যক্ষ্মার ওয়ার্ড সম্প্রসারণ করা হয়। কারাগারের ‘রাইটারদের’ সম্পৃক্ত করে একটি মডেল তৈরি করা হয়। এরপর একই মডেল চট্টগ্রাম, সিলেট ও কাশিমপুর কারাগারে বাস্তবায়ন করা হয়। এখন সারা দেশের কেন্দ্রীয় কারাগারগুলোতে যক্ষ্মা কর্মসূচি আছে।

এ ছাড়া শিশুরা সহজে কফ দিতে পারে না। তাই শিশুদের যক্ষ্মা শনাক্ত করা কঠিন। কফ শিশুরা খেয়ে ফেলে। আমরা মল পরীক্ষা করে শিশুর যক্ষ্মা শনাক্ত করার উপায় বের করেছি। এটা আমাদের গবেষণার ফল। আমাদের গবেষণার পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা শিশুদের যক্ষ্মা শনাক্তকরণ পদ্ধতিতে পরিবর্তন আনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যা বিশ্বের অন্যান্য দেশেও প্রয়োগ করা হচ্ছে। এসবের পাশাপাশি আইসিডিডিআরবি ঢাকা শহরের সাতটি কেন্দ্র এবং ঢাকার বাইরে সিলেট, রাজশাহী ও চট্টগ্রামে একটি করে মোট ১০টি রোগনির্ণয় কেন্দ্র (টিবিএসটিসি) চালু করেছে। নির্ভরযোগ্য পরীক্ষার জন্য এসব কেন্দ্রে মানুষের ভিড় বাড়ছে। গবেষণা ছাড়াও এসব কাজ আমরা করছি।

প্রথম আলো:

বর্তমানে যক্ষ্মার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে প্রধান চ্যালেঞ্জগুলো কী?

সায়েরা বানু: একটি কথা মনে রাখতে হবে, নখ ও চুল ছাড়া শরীরের যেকোনো অঙ্গে বা অংশে যক্ষ্মা হতে পারে। কিন্তু কিছু মানুষের এখনো এই ধারণা আছে যে যক্ষ্মা শুধু ফুসফুসের রোগ। ২৫ শতাংশ যক্ষ্মা ফুসফুসবহির্ভূত। রোগনির্ণয়ে মানুষকে সর্বতোভাবে উদ্বুদ্ধ করা যাচ্ছে না। অন্যদিকে শিশুদের অধিক সংখ্যায় রোগনির্ণয় করা যাচ্ছে না। রোগনির্ণয় করার জন্য আমাদের আরও বেশিসংখ্যক জিন-এক্সপার্ট যন্ত্র দরকার। বেসরকারি খাতে, অর্থাৎ প্রাইভেট হাসপাতাল-ক্লিনিক ও চিকিৎসকদের ব্যক্তিগত চেম্বারে শনাক্ত হওয়া রোগীরা জাতীয় কর্মসূচির মধ্যে যথাযথভাবে অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে না। বস্তিবাসী ও ডায়াবেটিক রোগীদের ঝুঁকি বেশি। কিন্তু বস্তিবাসী ও ডায়াবেটিক রোগীদের সঠিকভাবে রোগনির্ণয়ে কিছু কমতি আছে।

প্রথম আলো:

স্পিলওভার, অর্থাৎ গরু থেকে মানুষে যক্ষ্মা ছড়াচ্ছে—কথা কি ঠিক? একটু ব্যাখ্যা করবেন?

সায়েরা বানু: জীবজন্তুর জীবাণু যদি মানুষে আসে, তা হলে তাকে ‘স্পিলওভার’ বলা হয়। এই জীবজন্তু থেকে জীবাণু চলে আসার ঘটনা যক্ষ্মার ক্ষেত্রেও ঘটে। মানুষ যে জীবাণু দ্বারা আক্রান্ত হয়, তাকে বলে মাইকোব্যাকটেরিয়াম টিউবারকিউলোসিস। মানুষের এই যক্ষ্মায় বা জীবাণুতে গরু-ছাগলও আক্রান্ত হতে পারে। গরু বা ছাগলের যক্ষ্মার জীবাণুকে বলে মাইকোব্যাকটেরিয়াম বোভাইন। মাইকোব্যাকটেরিয়াম বোভাইন গরু-ছাগল থেকে মানুষে আসতে পারে। আমরা এটা গবেষণায় পেয়েছি। তবে এ কথাও সত্য যে এটি বাংলাদেশের জন্য বড় কোনো সমস্যা নয়।

প্রথম আলো:

এমডিআর টিবির সমস্যা কত বড়? কী করা উচিত? সরকার কী করছে?

সায়েরা বানু: দুই কারণে ওষুধপ্রতিরোধী যক্ষ্মায় মানুষ আক্রান্ত হয়। প্রথমত, যক্ষ্মায় আক্রান্ত ব্যক্তি যদি নিয়মিত সঠিক মাত্রায় পূর্ণ মেয়াদে ওষুধ সেবন না করে, ব্যক্তির শরীরে থাকা জীবাণু ওষুধ প্রতিরোধী হয়ে ওঠে। দ্বিতীয়ত, ওষুধ প্রতিরোধী জীবাণু সরাসরি অন্য ব্যক্তির শরীরে যেতে পারে। প্রতিবছর ৪ হাজার ৯০০ মানুষ নতুন করে ওষুধ প্রতিরোধী যক্ষ্মায় আক্রান্ত হয়। এদের দুই-তৃতীয়াংশ শনাক্ত হয় না। এখন দেশে প্রায় ১ হাজার ৮০০-এর বেশি ওষুধ প্রতিরোধী যক্ষ্মারোগী সরকারি কর্মসূচির আওতায় চিকিৎসা নিচ্ছে। তাদের মধ্যে কেউ ঠিকমতো চিকিৎসা না নিলে এক্স-ডিআর যক্ষ্মার ঝুঁকি থাকে। তাদের জীবন বাঁচানো কঠিন। আমাদের মধ্যে কত মানুষ এমডিআর যক্ষ্মা নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে, তার সঠিক তথ্য আমাদের নেই। দিন দিন এই ঝুঁকি বাড়ছে।

প্রথম আলো:

আপনাকে জাতীয় যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির প্রধান বা যক্ষ্মা বিষয়ে সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী করা হলে আপনার কাজের অগ্রাধিকার কী হতো বা আপনি কী কী কাজ করতেন?

সায়েরা বানু: বহু বছর ধরে জাতীয় কর্মসূচির বাস্তবায়ন চলছে। এখন সার্বিক একটি মূল্যায়ন হওয়া দরকার। যে কাজ বা গবেষণায় সাফল্য আছে, তা আরও ব্যাপক আকারে বাস্তবায়ন করা যেতে পারে। সে কাজ করার জন্য আরও বিনিয়োগ করা দরকার। আমি নেতৃত্বে থাকলে যক্ষ্মার জন্য আরও অর্থ বরাদ্দের সুযোগ খুঁজতাম। দ্বিতীয়ত, আমাদের সেবার মান উন্নত করা দরকার। তৃতীয়ত, সাধারণ মানুষের সচেতনতা বৃদ্ধিতে জোর কর্মসূচি হাতে নিতে হবে, যেন মানুষ যক্ষ্মা পরীক্ষা করাতে উদ্বুদ্ধ হয়।

এ ছাড়া বাংলাদেশের সায়মা ওয়াজেদ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়া অঞ্চলের পরিচালক। তাই আমাদের দেশের যক্ষ্মার গবেষণা ও ব্যবস্থাপনা-সংক্রান্ত অভিজ্ঞতা এশিয়ার অন্য দেশেও বাস্তবায়নের সুযোগ আছে। আমি সে জন্যও কাজ করতাম।

প্রথম আলো:

কখনো কী এমন কিছু চোখে পড়েনি, যা শোধরানো গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয়েছে?

সায়েরা বানু: আমাদের দেশে সেফেইড জিন-এক্সপার্ট যন্ত্র ব্যবহার করা হয়। এই যন্ত্রের একটি দুর্বলতা আছে। শরীরে যক্ষ্মার জীবাণুর পরিমাণ কম থাকলে অনেক সময় ফলাফলে ভুলে ওষুধ প্রতিরোধী যক্ষ্মায় আক্রান্ত হয় বলে জানায়। আমাদের গবেষণায় এই ত্রুটি আমরা ধরতে পারি। এটা ছিল বড় ধরনের ব্যত্যয়। বলা যায়, এটা ছিল কোম্পানির পক্ষে করা বড় ভুল। একই ধরনের গবেষণা ভারত, চীন, দক্ষিণ আফ্রিকা, হাইতিতেও হয়েছে। এ বিষয়ে আমি সেফেইড কোম্পানির সঙ্গে যোগাযোগ করি। কোম্পানি নতুন যন্ত্র জিন-এক্সপার্ট আলট্রা হিসেবে আপডেট করেছে। এখন ওষুধ প্রতিরোধী যক্ষ্মার রোগী শনাক্তকরণ আরও সঠিক হবে বলে আশা করা যায়।

প্রথম আলো:

আপনাকে ধন্যবাদ।

সায়েরা বানু: আপনাকেও ধন্যবাদ।