অন্যায় সুবিধা ও সর্বব্যাপী দুর্নীতিই বড় সমস্যা

ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ। অর্থনীতিবিদ ও ১৯৯৬ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগ থেকে অধ্যাপক হিসেবে অবসর নেওয়ার পর বর্তমানে ঢাকার ইকোনমিক রিসার্চ গ্রুপের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করছেন তিনি। বাংলা ভাষায় তাঁর প্রথম বই উন্নয়নশীল দেশের গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র: একটি রূপরেখা। বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে বইটি লিখিত হলেও বাংলাদেশের আর্থসামাজিক অবস্থা কমবেশি বিধৃত হয়েছে। বইটির সূত্র ধরেই প্রথম আলো এই অর্থনীতিবিদের মুখোমুখি হয়।

সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সোহরাব হাসান শওকত হোসেন

ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ

প্রশ্ন :

প্রথমেই প্রশ্ন করতে চাই, আপনি বইয়ের শিরোনামকে অনুচিত সাহসী বলেছেন কেন? আমরা তো মনে করি, বইয়ে উচিত কথাই বলা হয়েছে।

ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ: কারণটা হলো, সমাজতন্ত্র নিয়ে কিছু বলতে গেলেই নানা বিভ্রান্তির সৃষ্টি হতে পারে। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন ও চীনের অর্থনৈতিক উদারীকরণের পর এখন সমাজতন্ত্রের কোনো নির্দিষ্ট বা আদর্শগত সংজ্ঞা দেওয়া কঠিন। অথচ দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশ ছাড়াও শ্রীলঙ্কা, ভারত ও নেপালের শাসনতন্ত্রে বিভিন্ন সময় সমাজতন্ত্র কথাটি যোগ করা হয়েছে। লাতিন আমেরিকা ও আফ্রিকার অনেক দেশে, যেখানে বহুদলীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা বিদ্যমান, সেসব দেশের রাষ্ট্রের মূলনীতিতে সমাজতন্ত্রের উল্লেখ আছে। প্রশ্ন হলো, গণতন্ত্র, বাজার অর্থনীতি ও সমাজতন্ত্রের ধারণার সমন্বয় কী করে করা যায়।

প্রশ্ন :

তাহলে কী ধরনের সমাজতন্ত্রের কথা আমরা বলছি?

ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ: ১৯৫০-এর দশকে ঔপনিবেশিক শাসনের অবসানের পর ভারতসহ কিছু উন্নয়নশীল দেশকে সমাজতান্ত্রিক নীতির দিকে ঝুঁকতে দেখা যায়। এসব দেশের গৃহীত উন্নয়নকৌশল ছিল তদানীন্তন সোভিয়েত ইউনিয়নের অনুকরণে কেন্দ্রীয়ভাবে পরিকল্পিত ও নিয়ন্ত্রিত শিল্পায়নের চেষ্টা। প্রবৃদ্ধি ও দারিদ্র্য নিরসন এ নীতির মূল লক্ষ্য হলেও পরবর্তী তিন থেকে চার দশকে এ লক্ষ্য অর্জনে অগ্রগতি হয়েছে খুব ধীরগতিতে। এরপর আশি ও নব্বইয়ের দশকে বাজারমুখী উদারীকরণ ও মুক্ত বাণিজ্যের উন্নয়নদর্শন এসে সবকিছু বদলে দেয়।

প্রশ্ন :

বাংলাদেশের ক্ষেত্রে কী হলো?

ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ: স্বাধীনতার পরপর আমরা সমাজতন্ত্রকে আদর্শগতভাবে বাহ্যত ভারতের চেয়েও শক্তভাবে গ্রহণ করেছিলাম, বিশেষত প্রস্তাবিত পরিকল্পিত উন্নয়ন ও শিল্পের সরকারি মালিকানার বিষয়ে। কিন্তু ১৯৭৫-এর সরকার পরিবর্তনের পর অর্থনৈতিক নীতির এ অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটে। এর পর থেকে অদ্যাবধি সংবিধানের অন্যতম মূলনীতি সমাজতন্ত্রের বিষয়ে আমরা বেশ চুপচাপ আছি।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: তাহলে এখন আবার সমাজতন্ত্রের প্রসঙ্গ সামনে এল কীভাবে?

ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ: বর্তমান বিশ্ব অর্থনৈতিক ব্যবস্থা নিয়ে বিশ্বব্যাপী ব্যাপক অসন্তোষ তৈরি হয়েছে। আর্থিক খাতের অস্থিতিশীলতা, প্রাচুর্যের পাশাপাশি চরম বৈষম্য ও বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর ক্রমবর্ধমান আধিপত্য এ ব্যবস্থাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। একে ক্ষোভ বা একধরনের অনিবার্যতার দৃষ্টিতে দেখা হচ্ছে। এ প্রেক্ষাপটেই উন্নয়নশীল বিশ্বের কোথাও কোথাও তথাকথিত ‘নব্য-উদারীকরণপরবর্তী সমাজতন্ত্র’ নিয়ে নতুন চিন্তাভাবনা শুরু হয়েছে। দক্ষিণ আমেরিকায় ইকুয়েডর, বলিভিয়া, ব্রাজিলে গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার নিয়েই নির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় এসেছে। এমনকি খোদ যুক্তরাষ্ট্রে সাম্প্রতিক এক সমীক্ষায় দেখা গেছে যে সে দেশের তরুণদের মধ্যে প্রায় অর্ধেকই পুঁজিবাদের বিপরীতে সমাজতন্ত্রের প্রতি ইতিবাচক ধারণা পোষণ করে।

প্রশ্ন :

আপনার বহুল আলোচিত মার্কেটস, মোরালস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট বইয়ে বর্তমান পুঁজিবাদী অর্থনীতির প্রতি বিশ্বব্যাপী ক্ষোভের কথা তুলে ধরেছেন, কিন্তু সমস্যার সমাধান তেমন বলেননি। এ বইয়ে সে বিষয়ে কী আলোকপাত করেছেন?

ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ: বইটিতে স্বল্প পরিসরে দেখানোর চেষ্টা করেছি, কেন বাজার অর্থনীতিকে সমাজতান্ত্রিক লক্ষ্য অর্জনের ব্যর্থতার অজুহাত হিসেবে দেখানো সংগত নয়। প্রয়োজন, বাজার অর্থনীতিকে জনকল্যাণমুখী করার উপযুক্ত নীতিমালা ও রাজনৈতিক সদিচ্ছা। লক্ষণীয় যে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর থেকে ১৯৭০-এর দশক পর্যন্ত পশ্চিমা বিশ্বে, বিশেষত যুক্তরাষ্ট্রে সম্পদ ও আয়ের বৈষম্য বাড়েনি, বরং কমেছিল। কমিউনিজমের বিপরীতে পাশ্চাত্যের শিল্পোন্নত দেশগুলোতে পুঁজিবাদকে যথাসম্ভব ‘মানবিক’ রূপে উপস্থাপনের একটা প্রতিদ্বন্দ্বিতা চলছিল। সামাজিক নিরাপত্তার নানা কর্মসূচি, আয় পুনর্বণ্টনকারী করব্যবস্থা, একচেটিয়া ব্যবসায় প্রতিরোধে অ্যান্টিট্রাস্ট আইন—এসব ছিল এ প্রচেষ্টার অংশ, কিন্তু ১৯৮০-এর দশক থেকে নব্য মুক্তবাজার দর্শনের উত্থান ও সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে ‘ঠান্ডা যুদ্ধ’-এর অবসানের পর ওই সব নীতি ধনিক শ্রেণি ও বৃহদাকার করপোরেট ব্যবসায়ের স্বার্থের অনুকূলে সম্পূর্ণ উল্টিয়ে ফেলা হয়। ফলে পুঁজিবাদ বিশ্বব্যাপী প্রকট আকারে আবির্ভূত হয়, যাকে কেউ কেউ ‘হাইপার ক্যাপিটালিজম’ আখ্যা দিয়েছেন।

প্রশ্ন :

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক বৈষম্যের পেছনে তাহলে কী কাজ করছে?

ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ: বর্তমান পুঁজিবাদী বিশ্ব অর্থনীতিতে আয় ও সম্পদের বৈষম্যের মূল কারণ নানা ধরনের ‘অনুপার্জিত’ আয়; বিশ্বায়নের যুগে আমরা সে ব্যবস্থারই গৌণ অংশীদারমাত্র। এ ধরনের আয়ের সঙ্গে প্রতিযোগিতামূলক বাজারের উদ্যোগ ও প্রণোদনার সম্পর্ক খুব ক্ষীণ। শিল্পোন্নত দেশে ‘অনুপার্জিত’ আয়ের উৎসের মধ্যে আছে বিশ্ব অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় বহুজাতিক কোম্পানিগুলোকে দেওয়া নানা সুবিধা, ‘মেধাস্বত্ব’-এর মাধ্যমে গবেষণালব্ধ উদ্ভাবনের বাণিজ্যিকীকরণ, নানা ব্র্যান্ডের পণ্যের একচেটিয়া বাজার, আর্থিক খাতের অত্যধিক বিস্তৃতি ও আধিপত্য, প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণের পরিবেশবিধ্বংসী বিনিয়োগ ইত্যাদি। আমাদের দেশে ‘অনুপার্জিত’ আয়ের উত্স হিসেবে যোগ হয়েছে স্বজনতোষী শিল্পায়ন, অন্যায় সুযোগ-সুবিধা বিতরণের রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও সর্বব্যাপী দুর্নীতি। এসব বাড়তি আয়ের উত্স বন্ধ করলে বাজার অর্থনীতির প্রতিযোগিতা ও প্রণোদনা বাড়বে বৈ কমবে না।

প্রশ্ন :

এ অবস্থায় গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের মূল লক্ষ্যগুলো কী হতে পারে?

ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ: লক্ষ্যগুলো সম্বন্ধে মোটামুটি কিছু ধারণা সাধারণভাবে প্রযোজ্য। যেমন সব নাগরিকের জন্য শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও বাসস্থানের মৌলিক চাহিদা পূরণ, সব কর্মক্ষম মানুষের কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তা এবং ন্যূনতম জীবনধারণের জন্য সর্বজনীন সামাজিক সুরক্ষা। এ ছাড়া মানবাধিকার, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ইত্যাদি গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ এমনিতেই একটা কল্যাণকর সমাজের কাম্য। এ ছাড়া গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের পক্ষে একটা বাড়তি যুক্তি হলো, একটি নিপীড়নমূলক কঠোর শাসনব্যবস্থার তুলনায় গণতান্ত্রিক উদার পরিবেশ ব্যক্তি-উদ্যোগের প্রণোদনা ও বিকাশের বেশি সহায়ক।

প্রশ্ন :

সামাজিক সাম্য ও ন্যায্যতার বিষয়টিও আপনি উল্লেখ করেছেন। এর ব্যাখ্যা কী?

ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ: বিষয়টি নিয়ে ন্যায়শাস্ত্রবিদদের মধ্যেও মতপার্থক্য আছে। তবে সমাজতন্ত্রের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ন্যায্যতার দুটি শর্ত দেওয়া যেতে পারে। প্রথমত, সব নাগরিকের সুযোগ সমান হতে হবে এবং দ্বিতীয়ত, সবচেয়ে সুবিধাবঞ্চিত ব্যক্তিদের জন্য বাড়তি সুবিধা দিতে হবে। দ্বিতীয় শর্তটি গুরুত্বপূর্ণ; যেমন ন্যূনতম জীবনধারণের সংগতি না থাকলে পরিবারের জন্য সন্তানদের শিক্ষার সুযোগ কাজে লাগানো কঠিন হয়। বামপন্থীরা যখন দারিদ্র্যকে শুধু বাজারব্যবস্থার ত্রুটি হিসেবে দেখে বা ডানপন্থীরা ব্যক্তির যোগ্যতা ও উদ্যোগের অভাবকে দায়ী করে, উভয় পক্ষই একটা বিষয় উপেক্ষা করে। আর্থিক ব্যর্থতা ও দারিদ্র্য শুধু ভাগ্যের দোষেও হতে পারে এবং সে ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের পক্ষে সামাজিক সুরক্ষা দেওয়ার নৈতিক দায়িত্ব আছে।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: আপনি পাশ্চাত্যের সোশ্যাল ডেমোক্রেসির ধারণা এবং তথাকথিত ‘স্ক্যান্ডিনেভিয়ান’ মডেলকে উন্নয়নশীল দেশের জন্য যথেষ্ট মনে করেননি। কারণ কী?

ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ: এটা সত্য, নরওয়ে, সুইডেন—এসব দেশে আয়ের বৈষম্য সবচেয়ে কম এবং নাগরিক সেবা প্রদানের ক্ষেত্রেও এ দেশগুলো সবচেয়ে এগিয়ে। তবে বাজারব্যবস্থায় সমাজতান্ত্রিক লক্ষ্য অর্জনের সবচেয়ে সীমাবদ্ধতা রাষ্ট্রের কর্তৃত্বে পর্যাপ্ত আয় ও সম্পদ। কারণ, যদিও অর্থনীতির বড় অংশই ব্যক্তি খাতে, সামাজিক কল্যাণে ব্যয় করার জন্য সরকারের হাতে যথেষ্ট রাজস্বের অর্থের প্রয়োজন। স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশগুলোতে রাজস্ব আয় জিডিপির অর্ধেকের বেশি। আর দক্ষিণ এশিয়ায় জিডিপির অনুপাতে রাজস্ব আয় শুধু ভারত আর নেপালে ২০ শতাংশের কাছাকাছি। শ্রীলঙ্কা ও বাংলাদেশে এ অনুপাত মাত্র ১০ শতাংশ বা তারও কম। এত কম রাজস্ব আয়ের অনুপাত দিয়ে শাসনতন্ত্রে ঘোষিত সমাজতন্ত্রের পথে বেশি দূর এগোনোর লক্ষ্যকে উচ্চাভিলাষীই বলতে হবে।

প্রশ্ন :

রাজস্ব আয় বাড়ানোর উপায় কী?

ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ: আমাদের ব্যাপক কর ফাঁকি বড় সমস্যা। তা ছাড়া অর্থনীতির একটা বড় অংশ অনানুষ্ঠানিক খাতে, করজালের বাইরে। চেষ্টা করলেও আমরা স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশগুলোর কাছাকাছিও রাজস্ব আয়ের হার বাড়াতে পারব না। তবে সুযোগগুলো কাজে লাগাতে হবে এবং নতুন চিন্তাভাবনাও করতে হবে। উন্নয়নশীল অনেক দেশের মতো আমাদের দেশে সম্পত্তির উত্তরাধিকারের ওপর কর নেই, সম্পদকর থাকলেও তার প্রয়োগ ত্রুটিপূর্ণ। এর ফলে বিশেষত অনৈতিকভাবে অর্জিত অর্থের ফলে যে বৈষম্য তৈরি হয়, তা বংশানুক্রমে চলতে থাকে।

প্রশ্ন :

আপনি বইয়ে লিখেছেন, বেসরকারি লাভজনক কোম্পানির শেয়ার কিনে সরকার শেয়ারের মুনাফা থেকে একটি ট্রাস্ট ফান্ড করতে পারে, যা থেকে সরকারের সামাজিক ব্যয়ের জন্য অর্থসংস্থান হতে পারে। বিষয়টি বুঝিয়ে বলবেন?

ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ: ধারণাটি সম্পূর্ণ নতুন নয়। উনিশ শ আশি ও নব্বইয়ের দশকে ব্রিটেনের লেবার পার্টির তরুণ প্রগতিশীল অংশ এ ধরনের একটি প্রস্তাব তাদের দলের নির্বাচনী ইশতেহারে অন্তর্ভুক্ত করার চেষ্টা করেছিল, একে তারা ‘সম্পদ-অংশীদারির গণতন্ত্র’ আখ্যা দিয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক কালের আর্থিক খাতের ধসের সময় ওবামা ও ট্রাম্পের প্রশাসন বড় বড় আর্থিক ও শিল্পপ্রতিষ্ঠানকে দেউলিয়া হওয়া থেকে রক্ষা করেছিল সরকারি অর্থে কোম্পানিগুলোর শেয়ার কিনে। অবশ্য পরে সরকারি শেয়ারগুলো ওই সব কোম্পানিকে কিনে নেওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়। এর পরিবর্তে সরকার চাইলে শেয়ারগুলো ধরে রেখে মুনাফা থেকে রাজস্ব আয় করতে পারত।

প্রশ্ন :

বাংলাদেশে এ সুযোগ কতখানি দেখেন?

ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ: আমাদের মতো দুর্বল ব্যাংকিং ব্যবস্থায় এ ধারণা বাস্তবায়নের সুযোগ বরং বেশি। দেখা যায়, কিছু বড় শিল্পগোষ্ঠীর মুনাফা অর্জনকারী ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ব্যাংকের ঋণ পরিশোধে খেলাপি হয়ে যায়। এর একটা কারণ অবৈধভাবে বিদেশে মুনাফা পাচার। এ ক্ষেত্রে শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোকে বাঁচিয়ে রাখতে বারবার ঋণ পুনঃ তফসিলীকরণ, সুদ মওকুফ ইত্যাদি সুবিধা দিতে হয়। কিন্তু এর পরিবর্তে সরকার আর্থিক সহায়তার শর্ত হিসেবে মুনাফা অর্জনকারী কোম্পানিগুলোর কিছু শেয়ার ‘সমমূল্যে’, অর্থাৎ শেয়ারপত্রে উল্লেখ করা দামে কিনে নিতে পারে। এ ছাড়া ভালো কোম্পানি বাজারে শেয়ার ছাড়লে সরকার আইন করে তার কিছু অংশ অগ্রাধিকার ভিত্তিতে উপযুক্ত দামে কিনে নিতে পারে। তবে শর্ত থাকবে যে কোম্পানির বোর্ডে সরকারের প্রতিনিধি থাকলেও তাদের ভোটাধিকার থাকবে না বা কোম্পানি পরিচালনায় হস্তক্ষেপ করতে পারবে না। কাজেই এখানে সরকারি মালিকানাধীন ব্যবসায়ের এর আগেকার তিক্ত অভিজ্ঞতায় ফিরে যাওয়ার আশঙ্কা নেই। তা ছাড়া মুনাফার অর্থ একটা স্বাধীন ট্রাস্ট গঠনের মাধ্যমে সামাজিক খাতে ব্যয় করতে হবে, যাতে অনভিপ্রেত রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ না থাকে।

প্রশ্ন :

কিন্তু আপনি বলেছেন জনকল্যাণের প্রয়োজনেই কিছু প্রতিষ্ঠানকে সরকারি মালিকানায় বাণিজ্যিকভাবে পরিচালিত করতে হবে। সেগুলোর দক্ষতা কীভাবে নিশ্চিত করা হবে?

ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ: বিশেষত জ্বালানি, পরিবহন, বিদ্যুৎ, প্রযুক্তি ইত্যাদি খাত অন্তত আংশিকভাবে সরকারি মালিকানায় রাখা প্রয়োজন। তা না হলে এসব খাতে ব্যক্তিমালিকানায় একচেটিয়া ব্যবসায়ের সুযোগ সৃষ্টি হবে অথবা প্রয়োজনীয় বেসরকারি বিনিয়োগ না-ও আসতে পারে। কিন্তু এসব রাষ্ট্রীয় বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান পরিচালনার দক্ষতা এবং কর্মকর্তাদের প্রণোদনা ও জবাবদিহি কী করে নিশ্চিত করা যাবে, সেটা নির্ধারণ করা সোজা নয়। বিভিন্ন দেশে খারাপ-ভালো দুই রকম অভিজ্ঞতাই আছে। মালয়েশিয়ার সম্পূর্ণ সরকারি মালিকানার তেল ও গ্যাস কোম্পানি পেট্রোনাস এ ধরনের একটি সফল উদাহরণ। ১৯৭৪ সালে প্রতিষ্ঠিত এই কোম্পানি থেকে সরকার এখন বছরে ১০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি মুনাফা পায়। দক্ষিণ কোরিয়ায় ১৯৭৩ সালে সরকার ‘পোসকো’ নামের যে লোহা ও স্টিল তৈরির কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করে, সেটি সে দেশের শিল্পায়নে বিরাট ভূমিকা রেখেছে এবং এই কোম্পানির বর্তমান ৭০ শতাংশ মালিকানা থেকে সরকারের বড় অঙ্কের আয় হয়। কিন্তু এর বিপরীত চিত্রও আছে। আফ্রিকার কিছু দেশে পাশ্চাত্যের বহুজাতিক কোম্পানিগুলো স্থানীয় প্রভাবশালী গোষ্ঠীর যোগসাজশে কীভাবে সম্পদ লুণ্ঠন করেছে এবং খনি অঞ্চলের পরিবেশ ও মানুষের জীবন-জীবিকার ওপর ধ্বংসাত্মক প্রভাব ফেলেছে, তার চিত্র ব্লাড ডায়মন্ড নামের বিখ্যাত চলচ্চিত্রে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।

প্রশ্ন :

শিক্ষার সুযোগ নিয়ে কী বলবেন?

ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ: সুযোগের সমতা তৈরির ক্ষেত্রে সর্বজনীন মানসম্মত মৌলিক শিক্ষা এবং মেধাভিত্তিক উচ্চশিক্ষার অধিকার একটি অপরিহার্য শর্ত। দক্ষিণ কোরিয়া যে আয়ের বৈষম্য না বাড়িয়েও দ্রুত প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে পেরেছিল, তার পেছনে উন্নত মানবসম্পদের বড় ভূমিকা ছিল। সব কর্মক্ষম নাগরিকের কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তা যে একটি সমাজতান্ত্রিক লক্ষ্য, তার সঙ্গে শিক্ষা পরিকল্পনার সরাসরি সম্পর্ক আছে। শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে এমন মানবসম্পদ তৈরি করা প্রয়োজন, যা অর্থনৈতিক উন্নয়নের চাহিদার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ। অন্যথায় শিক্ষিত বেকারের সমস্যা দেখা দেবে। ভারত বা বাংলাদেশে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির অংশ হিসেবে কায়িক শ্রমের ভিত্তিতে কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তার কিছু ব্যবস্থা আছে, কিন্তু শিক্ষিত বেকারের সমস্যা ভিন্ন বিষয়। আর শিক্ষায় সরকারি খাতের ব্যয় বরাদ্দের বিষয়টিও জরুরি। শিক্ষার অধিকার নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে বেসরকারি খাত সরকারি শিক্ষাব্যবস্থার পরিপূরক হতে পারে, কিন্তু বিকল্প হতে পারে না। উন্নত দেশে শিক্ষা খাতে সরকারি ব্যয় জিডিপির ৬ থেকে ৭ শতাংশ; ভারত, চীন ও ভিয়েতনামে ৪ শতাংশের কাছাকাছি, কিন্তু বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশে এ হার মাত্র ২।

প্রশ্ন :

আপনি বলেছেন, প্রতিযোগিতামূলক বাজারব্যবস্থাতেও বৈষম্য তৈরির একটা প্রবণতা থাকে। এর প্রতিকার কী?

ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ: সেটা ঠিক। যেমন স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশগুলোতেও যদি ধনীদের করপূর্ববর্তী আয় হিসাব করি এবং নিম্নবিত্তের সামাজিক সুরক্ষার সুবিধা বাদ দিয়ে আয়ের বৈষম্য মাপি, তা যুক্তরাষ্ট্রের সমান, এমনকি বেশিও হতে পারে। আমরা সাধ্যমতো রাজস্ব সংগ্রহ ও আয় পুনর্বণ্টনকারী করব্যবস্থা চালু করলেও স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশের মতো বৈষম্য কমাতে পারব না। এ জন্যই বাজারব্যবস্থাকে সমাজমুখী করার কথা ভাবতে হবে। মুহাম্মদ ইউনূস সামাজিক ব্যবসায়ের মডেল তৈরি করেছেন, যেখানে মুনাফা অর্জন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের মূল লক্ষ্য নয়। এ ছাড়া বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের নানা ধরনের সমাজমুখী মডেল আছে। যুগোস্লাভিয়ায় একসময়কার কারখানাভিত্তিক শ্রমিক সংগঠন দ্বারা পরিচালিত উৎপাদনের মডেল যথেষ্ট সফলতা অর্জন করেছিল। এসব বিষয় নিয়ে বইয়ে আলোচনা করেছি, অল্প কথায় বলা সম্ভব নয়।

প্রশ্ন :

আপনি বিভিন্ন দুর্বল গোষ্ঠীর সাংগঠনিক শক্তির ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন। বিষয়টা ব্যাখ্যা করবেন?

ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ: অর্থনৈতিক সাম্য ও ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো দুর্বল জনগোষ্ঠীকে সংগঠিত করা। এটা গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র প্রবর্তনের অত্যাবশ্যকীয় রাজনৈতিক প্রক্রিয়া, যা নিয়ে বইয়ে তেমন আলোচনা করিনি। এ বিষয়ে আজকাল ‘সংগঠনভিত্তিক গণতন্ত্র’ বা অ্যাসোসিয়েটিভ ডেমোক্রেসি নিয়ে আলোচনা হচ্ছে, যার বিষয়বস্তু হলো কী করে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার বিকেন্দ্রীকরণ করা যায় এবং তৃণমূল পর্যায়ে প্রতিনিধিত্বশীল সংগঠনের মাধ্যমে বিভিন্ন শ্রেণি ও গোষ্ঠীর ন্যায্য নাগরিক অধিকার নিশ্চিত করা যায়। যেমন জলাভূমি বা উন্মুক্ত জলাশয়ের মতো সাধারণ মানুষের ব্যবহার্য সম্পদকে মধ্যস্বত্বভোগীদের কবল থেকে রক্ষা করতে এসব সংগঠন ভূমিকা রাখতে পারে। উন্নয়নশীল দেশে গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের প্রতি অঙ্গীকারবদ্ধ কোনো রাজনৈতিক দল এ ধরনের সংগঠনের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়েই কেবল তাদের কর্মসূচির প্রতি জনসমর্থন তৈরি করতে পারে, শুধু তাত্ত্বিক আদর্শগত প্রচারণা দিয়ে খুব সুফল আশা করা যায় না।

প্রশ্ন :

আপনি কি গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র নিয়ে আশাবাদী?

ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ: এ বইয়ে যে গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের কথা বলা হয়েছে, তা কোনো নির্দিষ্ট আদর্শিক মতবাদের অংশ নয়; বরং এতে আলাদাভাবে বাস্তবায়নযোগ্য কিছু সমাজতান্ত্রিক উপাদানের কথা বলা হয়েছে, যেগুলো বিভিন্ন মাত্রায় কার্যকর করা সম্ভব। তবে কোন দেশে কখন এ সুযোগ আসবে, বলা কঠিন। এ ছাড়া কিছু ঝুঁকিও আছে। সমাজতান্ত্রিক অ্যাজেন্ডা নিয়ে নির্বাচিত হয়ে এসেছেন, যেমন বলিভিয়ার ইভো মোরালেস, তিনি অ্যাজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে গিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত স্বার্থগোষ্ঠীর বাধার মুখে ক্রমে কর্তৃত্ববাদী হয়ে উঠলেন এবং শেষ পর্যন্ত সম্প্রতি ক্ষমতাচ্যুত হলেন। এভাবে তো গণতান্ত্রিক চর্চা শক্তিশালী হয় না। ব্রাজিলের লুলা দা সিলভা কেন আবার নির্বাচিত হয়ে আসতে পারলেন? কর্মসংস্থান ও শিক্ষা-স্বাস্থ্যসুবিধা দিতে পারলে আবার ক্ষমতায় আসার সম্ভাবনা থাকে। জনকল্যাণমুখী নীতির ধারা বজায় রাখার জন্য ক্ষমতা যেভাবেই হোক ধরে রাখতে হবে, এমন মনোভাব বিপজ্জনক। গণতন্ত্রকে গণতন্ত্রের মতো চলতে দিলে, অন্যরা ক্ষমতায় এলেও গণমুখী কর্মসূচি একেবারে বাতিল করতে পারবে না।

আপনাকে ধন্যবাদ।

ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ: আপনাদেরও ধন্যবাদ।