বিশেষ সাক্ষাৎকার: মো. শহীদুল হক

বাংলাদেশকে নিজেদের প্রভাব বলয়ে চায় পশ্চিমারা

মো. শহীদুল হক সাবেক পররাষ্ট্রসচিব। এখন দিল্লি ইউনিভার্সিটির বঙ্গবন্ধু চেয়ার হিসেবে দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি বেসরকারি নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাউথ এশিয়ান ইনস্টিটিউট অব পলিসি অ্যান্ড গভর্ন্যান্সের ফেলো অধ্যাপক হিসেবে কাজ করছেন। সম্প্রতি তিনি দিল্লির জওহরলাল নেহরু ইউনিভার্সিটিতে (জেএনইউ) অতিথি অধ্যাপক হিসেবে যোগ দিয়েছেন। রোহিঙ্গা সংকট, ভূরাজনীতি ও সংযুক্তি—এ বিষয়গুলো নিয়ে দেশে-বিদেশে লেখালেখি এবং আলোচনার সঙ্গে তিনি যুক্ত আছেন। বাংলাদেশের গণতন্ত্র, নির্বাচন এসব বিষয়ে আন্তর্জাতিক আগ্রহ, ভূরাজনীতি নিয়ে তিনি প্রথম আলোর মুখোমুখি হয়েছেন।

সাক্ষাৎকার নিয়েছেন রাহীদ এজাজ

মো. শহীদুল হক
প্রশ্ন:

প্রথম আলো: বেশ কয়েক বছর ধরেই বাংলাদেশকে নিয়ে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে আগ্রহ বাড়ছে। এই আগ্রহ বাড়ার নেপথ্যে ভূরাজনীতি, অর্থনীতি নাকি অন্য কোনো কারণ আছে?

মো. শহীদুল হক: এ অঞ্চলকে ঘিরে ভূরাজনীতির যে গুরুত্ব, সেটা বেশ পুরোনো। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের মধ্য দিয়ে বঙ্গোপসাগরের ভূরাজনীতি পাল্টে গিয়েছিল। এ অঞ্চলে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রভাব বেড়ে গিয়েছিল। ধীরে ধীরে বৈশ্বিক পরিস্থিতির পরিবর্তন হলেও ভূরাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে বঙ্গোপসাগরের গুরুত্ব কখনোই কমেনি। হয়তো রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের গুরুত্ব সীমিত ছিল। এখন ভারত মহাসাগরীয় কৌশলের প্রেক্ষাপটে এবং বাংলাদেশের অবস্থানগত কারণে আমাদের নিয়ে মনোযোগ কয়েক গুণ বেড়ে গেছে। 

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: ভারত মহাসাগরীয় কৌশলের প্রেক্ষাপটে বলতে কি আপনি আইপিএসের (ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলের কৌশল) কথা বলছেন?

মো. শহীদুল হক: আমি আইপিএস এবং অঞ্চল ও পথের উদ্যোগের (বিআরআই) কথা বলছি। ভূরাজনীতির পাশাপাশি অর্থনৈতিক কারণেও বাংলাদেশের প্রতি বৈশ্বিক মনোযোগটা বেড়েছে। গত ৫০ বছরে বাংলাদেশ ভূরাজনৈতিক ক্ষেত্রে ধীরে ধীরে একটি পক্ষ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। যেটা ১৯৭১–এ বাংলাদেশে ছিল না। পাকিস্তান ওই সময় ভূরাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এ অঞ্চলে পাকিস্তানের গুরুত্ব কমার ফলে যে জায়গা তৈরি হয়েছে, তাতে ভারতের পর বাংলাদেশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। একই সঙ্গে বাংলাদেশ ভূ-অর্থনৈতিকভাবেও এগিয়েছে। বাংলাদেশের অনেক কৌশলগত অর্থনৈতিক সম্ভাবনাও রয়েছে। তৃতীয়ত, ছোট দেশ হলেও বঙ্গোপসাগরের মাথায় অবস্থান বাংলাদেশের। আপনি এ এলাকায় বাংলাদেশকে বিবেচনায় না নিয়ে কিছুই করতে পারবেন না। আর ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্রসীমা নির্ধারিত হওয়ায় বাংলাদেশের গুরুত্ব বেড়ে গেছে কয়েক গুণ। 

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: বাংলাদেশ ধীরে ধীরে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনকারী দেশ হয়ে উঠেছে। এ পরিস্থিতিতে বাংলাদেশকে নিয়ে একদিকে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্ব গণতন্ত্র এবং নির্বাচন নিয়ে তাদের প্রত্যাশার কথা জানাচ্ছে, অন্যদিকে রাশিয়া আর চীন পশ্চিমা প্রত্যাশার বিরোধিতা করে ইদানীং প্রকাশ্যে নিজেদের অবস্থান তুলে ধরছে। বড় শক্তিগুলোর এমন পাল্টাপাল্টি বাংলাদেশের জন্য ঝুঁকি বা চ্যালেঞ্জ কোনটা তৈরি করছে? 

মো. শহীদুল হক: আমি আসলে এটাকে ঝুঁকি হিসেবে দেখি না, দেখি সম্ভাবনা হিসেবে। একটা দেশ যতই উন্নতি করবে, গুরুত্বপূর্ণ হতে থাকবে, সে দেশের চ্যালেঞ্জও বাড়তে থাকবে। ওটাকে ঝুঁকি হিসেবে দেখলে ভুল হবে। এটাকে সুযোগ হিসেবে দেখে এগিয়ে যেতে হবে। ঝুঁকি তখনই হবে, যখন কোনো দেশ তার সম্ভাবনাকে বাস্তবায়ন করতে পারছে না। মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশ যখন বিশ্বের সাম্প্রতিক ক্ষমতার কাঠামোতে যতই ওপরের দিকে উঠতে থাকবে, তত তাকে ওই পর্যায়ে খেলার যোগ্যতা অর্জন করতে হবে। আর যদি খেলতে না পারে, তবে ঝুঁকি বাড়বে। যদি খেলতে পারে, তবে তা হবে সুযোগ। এখন এটা নির্ভর করবে বাংলাদেশ ভবিষ্যতে কীভাবে এমন পরিস্থিতিতে খেলবে বা কী পদক্ষেপ নেয়, তার ওপর। 

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: বাংলাদেশের নির্বাচন আর গণতন্ত্রের প্রশ্নে পশ্চিমাদের প্রত্যাশা নিয়ে রাশিয়া ও চীনের সমালোচনাকে কীভাবে বিশ্লেষণ করবেন? 

মো. শহীদুল হক: এটাকে সামগ্রিকভাবে ইতিবাচক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখাই বাঞ্ছনীয়। সবাই যে আগ্রহ দেখাবে, এটাই তো স্বাভাবিক। এখন আপনি যদি মনে করেন সবাই কেন আমাদের দিকে তাকাচ্ছে, তাহলে বুঝতে হবে আপনি বাস্তবতা থেকে অনেক দূরে বসে আছেন। এখন বাংলাদেশ নিয়ে যে আগ্রহ কিংবা কৌতূহল, আগামী ১০ থেকে ১৫ বছরে আরও বেড়ে যাবে। বাংলাদেশ নিশ্চয়ই একলা চলে এগিয়ে যেতে পারবে না। এখন প্রশ্ন উঠতে পারে, বাংলাদেশ কি পশ্চিমা মেরুকরণের পথ বেছে নেবে, না পূর্ব দিকে যাবে? নাকি বাংলাদেশ চীনের দিকে হেলে পড়বে?

এখানেই বাস্তবতার নিরিখে বাংলাদেশকে যাত্রাপথটা ঠিক করতে হবে। এত দিন পর্যন্ত আমরা মোটামুটিভাবে সবার সঙ্গেই ছিলাম। এটা সম্ভবও ছিল। অতীতে বাংলাদেশ তেমন অবস্থানে ছিল না বলে সবার সঙ্গে থাকতে পেরেছে। কিন্তু ধীরে ধীরে বাংলাদেশের অগ্রগতি এবং বৈশ্বিক রাজনৈতিক মেরুকরণে একটু ঝুঁকে পড়া বা হেলে পড়ার বিষয়টি সামনের দিনগুলোয় অবধারিত হয়ে উঠতে পারে। 

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: তার মানে কি আপনি প্রয়োজনের তাগিদে কোনো একটি পক্ষের দিকে ঝুঁকে পড়ার ইঙ্গিত করছেন? 

মো. শহীদুল হক: সামান্য ঝুঁকে পড়াটাও কিন্তু একটি দেশের পররাষ্ট্রনীতির অংশ। বাংলাদেশ কি ১৯৭২, ১৯৭৩ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের দিকে ঝুঁকে পড়েনি? সবার সঙ্গে বন্ধুত্বের কথা বললেও একটা দিকে তো বাংলাদেশ ঝুঁকে ছিল, যা ছিল তৎকালীন সোভিয়েত ব্লক। কাজেই সবার সঙ্গে সুসম্পর্ক রেখে এগিয়ে চলার যে মূলনীতি, সেটা শুধু আদর্শিক হলেই চলবে না। অবস্থানটা নিতে হবে বাস্তবতার নিরিখে এবং জাতীয় স্বার্থের বিবেচনায়। এখানেই আমাদের প্রজ্ঞার পরিচয় দিতে হবে। হুটহাট কোনো দিকে ঝুঁকে পড়লে এর পরিণতি কী হতে পারে, তা আমরা শ্রীলঙ্কার ক্ষেত্রে দেখেছি। কাজেই একটা পক্ষে আপনি ততটাই ঝুঁকবেন, যাতে করে আবার ফিরে এসে ভারসাম্য আনা যায়। তবে একাত্তরে গণতান্ত্রিক যে মূল্যবোধের জন্য বাংলাদেশ লড়াই করেছিল, সেটা শক্ত করে ধরে রাখতে হবে। তা না হলে পরিণতিটা হবে ছেঁড়া ঘুড়ির মতো। প্রশ্ন হলো, অর্থনৈতিক উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে যেসব মূল্যবোধের ভিত্তিতে স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে, সেগুলো যদি ঠিক না থাকে, তবে অর্থনৈতিক উন্নয়ন দীর্ঘস্থায়ী ও জনমুখী হবে না। মূল্যবোধের বিষয়গুলো ঠিক না থাকলে দিকহীন হয়ে পড়ার আশঙ্কা থেকে যাবে। 

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: গণতন্ত্র মূল্যবোধের কথা যখন বলছেন, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে মার্কিন ভিসা নীতিকে কীভাবে দেখেন? 

মো. শহীদুল হক: মার্কিন ভিসা নীতিকে আমাদের দেশের প্রেক্ষাপট থেকে দেখাটা ভুল হবে। ওই ভিসা নীতিকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেক্ষাপট থেকে দেখতে হবে। যুক্তরাষ্ট্র কিন্তু এবারই প্রথম কোনো দেশের বিরুদ্ধে ভিসা নীতি ঘোষণা করেছে, বিষয়টা কিন্তু এমন নয়। যুক্তরাষ্ট্র নিজেদের স্বার্থেই এ অবস্থান নিয়েছে। বিশেষ করে ডেমোক্র্যাটরা যখন ক্ষমতায় থাকে, তারা গণতন্ত্র ও সুশাসন নিশ্চিতের জন্য এ ধরনের পদক্ষেপ নিয়ে থাকে। এখন প্রশ্ন উঠতে পারে, যুক্তরাষ্ট্র যে উদ্দেশ্যে ওই ভিসা নীতি ঘোষণা করেছে, সেটা কি বাংলাদেশের মূল্যবোধের সঙ্গে সাংঘর্ষিক? তা তো নয়। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠার জন্যই তো একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল। তাই বিষয়টিকে আমাদের সেই দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা দরকার। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ সমুন্নত রাখার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের মিল রয়েছে।

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: যুক্তরাষ্ট্র ভিসা নীতির ঘোষণা করে বাংলাদেশকে কি চাপ দিয়ে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন করাতে চাইছে? 

মো. শহীদুল হক: যুক্তরাষ্ট্রের একটা ধারণা হয়েছে যে বাংলাদেশে গণতন্ত্র ঢিলেঢালা হয়ে গেছে। গণতন্ত্র সমুন্নত রাখার অঙ্গীকার থাকলেও তা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে প্রক্রিয়াগত বিষয়গুলো ক্রমাগত শিথিল হয়ে পড়ছে। তারা বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে জোরদার করতে আগ্রহী। বিশ্বজুড়ে গণতন্ত্রের প্রচারক হিসেবে দেশটি ভূমিকা রাখার অভিপ্রায় থেকেই বাংলাদেশে অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের ওপর জোর দিচ্ছে। 

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: আপনি বলছেন গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া জোরদারের বৈশ্বিক উদ্যোগের অংশ হিসেবে বাংলাদেশে অবাধ, সুষ্ঠু এবং শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের ওপর যুক্তরাষ্ট্র জোর দিচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের এমন তাগিদের সঙ্গে ভূরাজনীতির কি কোনো যোগসূত্র আছে?

মো. শহীদুল হক: অবশ্যই আছে। বৈশ্বিক সম্পর্কের কোনো কার্যক্রমই শেষ পর্যন্ত নিরপেক্ষ নয়। রাষ্ট্রের ভূরাজনৈতিক নীতি থাকবেই। এটাই স্বাভাবিক। প্রতিটি দেশের এ বিষয়ে শক্তিমত্তা কিংবা দুর্বলতা, দুটিই থাকতে পারে। ভূরাজনীতি একটি রাষ্ট্রের কৌশলেরই অংশ। 

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: ভূরাজনীতির কথা বললে আমাদের নিকট প্রতিবেশী ভারতের প্রসঙ্গ এসে যায়। আমাদের রাজনীতি ও নির্বাচনে ভারতের প্রভাবকে নিশ্চয় অস্বীকার করার সুযোগ নেই। 

মো. শহীদুল হক: অন্য দেশের মতো ভারতেরও ভূরাজনৈতিক লক্ষ্য রয়েছে। আর উদীয়মান শক্তি হিসেবে কিছু পদক্ষেপ আছে। প্রশ্ন হচ্ছে, এই পদক্ষেপগুলোকে আমরা কীভাবে দেখি। বাংলাদেশকে নিশ্চয় এখনো কেউ বলেনি চীনের সঙ্গে যেয়ো না। ফলে বাংলাদেশকে সময় ও পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে একধরনের ভারসাম্যমূলক অবস্থানে থেকে এগোতে হবে। বিশেষ কোনো একটি দিকে পুরোপুরি ঝুঁকে পড়ার সময় এখনো বাংলাদেশের জন্য আসেনি বলে আমি মনে করি। 

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রতি সমর্থন ছিল ভারতের। আগামী নির্বাচনেও কি তাদের সেই অবস্থান অটুট থাকবে?

মো. শহীদুল হক: আমার ধারণা, অবশ্যই তাদের আগের অবস্থান বজায় রয়েছে। নেপাল, শ্রীলঙ্কা, ভুটান, বাংলাদেশ যেখানেই হোক না কেন, পুরো দক্ষিণ এশিয়ায় স্থিতিশীলতা চায় ভারত। এটা নিয়ে বিতর্কের কোনো অবকাশ নেই। বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কটা বিশেষ এবং চিরন্তন। ভারত উদীয়মান শক্তি। সে জন্য বাংলাদেশের অনেক কিছু শুধু বঙ্গোপসাগর নয়, ভারতের সঙ্গে জড়িয়ে আছে। 

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: গত দুটি নির্বাচনে ভারতের সমর্থন ছিল আওয়ামী লীগের প্রতি, আমি সে বিষয়টা আপনাকে বলছিলাম। 

মো. শহীদুল হক: আমি আওয়ামী লীগের কথা বলছি না। যে দলকে ভারত সপক্ষের মনে করবে, তাদের প্রতি দিল্লির একটা বিশেষ অবস্থান থাকবে। সেটার বহিঃপ্রকাশ কীভাবে হবে, সেটা নির্ভর করবে পরিস্থিতির ওপর। বাংলাদেশে দীর্ঘস্থায়ী নানা বিবেচনায় ভারতের এবং বাংলাদেশের স্বার্থ জড়িত আছে। তার মানে হচ্ছে, বাংলাদেশ নিয়ে ভারতের আগ্রহ ও মনোযোগ অব্যাহত থাকবে। অন্যদিকে বঙ্গোপসাগরে উপস্থিতির পাশাপাশি মূল্যবোধ এবং জাতীয় স্বার্থের প্রেক্ষাপট থেকে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের অনেক সাযুজ্য রয়েছে। 

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের মূল্যবোধের মিলটা কোন দৃষ্টিকোণ থেকে বলছেন? 

মো. শহীদুল হক: তিনটি দেশই সংগ্রাম করে স্বাধীনতা অর্জন করেছে। তিনটি দেশের সংবিধানে মূল্যবোধের একটা মিল খুঁজে পাওয়া যায়। তিন দেশই গণতান্ত্রিক এবং অবাধ একটি সমাজ চায়। অবাধ গণমাধ্যম চায়। দর্শন এবং মূল্যবোধের একটা মিল এখানে দেখি। যেটা অন্য ব্লকে নেই। আবার আউটরিচের দিকে তাকিয়ে দেখলে কী পাই? আমাদের রপ্তানির বড় গন্তব্যটা যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলোয়। প্রযুক্তি কোথা থেকে আসে? বাংলাদেশ সমৃদ্ধির জন্য কোথায় যেতে আগ্রহী? সেটাও কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমেই। পশ্চিমের সঙ্গে আমাদের এই সম্পর্ক ও যোগাযোগের মাঝে ভারতের একটা যোগসূত্র আছে। ফলে তিন দেশের সম্পর্কের মৌলিক ভিত্তিটা জোরালো। সম্পর্কে ওঠানামা থাকতেই পারে। কিন্তু অন্য ব্লকের সঙ্গে সম্পর্কের ভিত্তি নিশ্চয়ই এই দুই দেশের মতো নয়। 

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: এমন কথাও রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে চালু আছে যে যুক্তরাষ্ট্র বেশি চাপ দিলে বাংলাদেশ ঝুঁকে পড়বে চীনের দিকে। ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের অংশীদারত্বের নিরিখে বিষয়টি সুখকর কি? 

মো. শহীদুল হক: পররাষ্ট্রনীতির বড় দিক হলো, সামগ্রিকভাবে পরিস্থিতিকে বিবেচনায় নিয়ে ভেবেচিন্তে সমন্বিতভাবে প্রতিক্রিয়া জানানো। যতই ঝড় আসুক, আপনি ধীরস্থির থাকবেন। বাক্যবাণ ব্যবহারের বিষয়ে সতর্ক থাকবেন। হুটহাট সম্পর্কের গতিপথ পরিবর্তন করবেন না। এ বিষয়গুলোতে সবাইকে সজাগ থাকতে হবে। বর্তমানে এ বিষয়গুলোতে বাংলাদেশে সমন্বয়ের অভাবটা চোখে পড়ছে। 

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: মার্কিন আন্ডার সেক্রেটারি উজরা জেয়া বাংলাদেশ সফরে এসে রাজনীতিতে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন। সে ক্ষেত্রে এই সফরকে কীভাবে মূল্যায়ন করবেন? 

মো. শহীদুল হক: যুক্তরাষ্ট্র গণতন্ত্র ও নির্বাচন নিয়ে তাদের প্রত্যাশার কথা বাংলাদেশকে সব সময় জানিয়ে গেছে। এটা তাদের কৌশলের অংশ। বাংলাদেশের কাছে প্রত্যাশাটা সরাসরি ঢাকায় এসে জানিয়ে গেছে। বাংলাদেশও নানা প্রতিশ্রুতি দিয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। এরপর তারা দেখবে তাদের প্রত্যাশা অনুযায়ী কী পদক্ষেপ বাংলাদেশ নিচ্ছে। এরপর প্রয়োজন মনে করলে আরও চেষ্টা করতে পারে। কারণ, রাজনীতির মতো কূটনীতিতেও শেষ বলে কিছু নেই।

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: ‘শেষ বলে কিছু নেই’ বিষয়টি কি স্পষ্ট করে বলবেন? 

মো. শহীদুল হক: যুক্তরাষ্ট্র বলছে তারা কী চায়, কী হলে ভালো হয় বলে তারা মনে করে। অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনে তারা জোর দিয়েছে। ‘শান্তিপূর্ণ’ বিশেষণটি আগে ঠিক এভাবে ছিল না। তার মানে শুধু বাংলাদেশ নয়, পুরো অঞ্চলের স্থিতিশীলতার ওপর তারা জোর দিচ্ছে।

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের নানা বক্তব্য এবং উদ্যোগে এমন কোনো আভাস আছে, যাতে মনে হতে পারে আগামী নির্বাচনের বিষয়গুলো সুরাহা তাদের কাছে চলে গেল? 

মো. শহীদুল হক: আন্তর্জাতিক রাজনীতি ও অর্থনীতি মিলিয়ে বাংলাদেশের যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে। এমন একটা পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ যাতে তাদের প্রভাবের মধ্যে থাকে, এ জন্যই পশ্চিমাদের এত উদ্যোগ। তারা চাইছে এবং সুযোগও দিচ্ছে বাংলাদেশ যাতে নিজেই সমস্যাগুলোর সুরাহা করে। তারা বন্ধুত্বের মাধ্যমে এ বিষয়গুলোয় আমাদের সহায়তা করতে আগ্রহী। তাই বলে নির্বাচনের বিষয়গুলো সুরাহা তাদের হাতে চলে গেছে, এমনটা ভাবার সুযোগ আছে বলে আমার মনে হয় না। 

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: আপনাকে ধন্যবাদ। 

মো. শহীদুল হক: আপনাকেও ধন্যবাদ।